বৃষ্টি তোমাকে দিলাম❤️পর্ব-2

0
2699

বৃষ্টি তোমাকে দিলাম❤️পর্ব-2
ফাবিহা নওশীন

অহনা ইশারাকে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে এসে ওকে মেঝেতে নির্লিপ্তভাবে বসে থাকতে দেখে ওর কাছে আসে। ওর মুখোমুখি বসলে ইশারা চোখ তুলে ওর দিকে তাকায়। ওর চোখ দেখে অহনা বুঝতে পারল ও কেঁদেছে।

“কি হয়েছে ইশু? কেঁদেছিস কেন? মন খারাপ? মন খারাপই বা কেন হবে? আমিও না কি বলছি। বল তো কি হয়েছে?”

ইশারা মোবাইলটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিল। অহনা পিক আর মেসেজ দেখে গালি দিল।
“ওই কুকুরের বাচ্চা আবার অন্য আইডি দিয়ে তোকে বিরক্ত করছে। আইডি ডিএক্টিভ করে দে।”

“আইডি ডিলিট করে দেব। আমি নতুন করে বাঁচার সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাই সব কিছুই নতুন করে শুরু করব৷ এই আইডি ডিলিট করে দেব।”

“ভালো সিদ্ধান্ত। আর চিন্তা করিস না ও এখানে আসতে পারবে না। তোর খোঁজ কখনো পাবে না।”

ইশারা জোরে শ্বাস নিয়ে বলল,
“আমার সামনে যদি কখনো আসে আর আমার লাইফে যদি ইন্টারফেয়ার করার চেষ্টা করে তাহলে এইবার আমি ওকে খুন করে ফেলল। অনেক হয়েছে আর পারছি না।”

অহনা ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
“ইশু শান্ত হ। এসব মাথা থেকে জাস্ট বের করে ফেল। আগামীকাল তোর জয়েনিং। সব প্রস্তুতি নিয়ে নে। তারপর রিলেক্স মুডে একটা ঘুম দে। সকালে উঠে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।”

“ঠিক হতেই হবে। আগামীকাল লাইফের নতুন একটা অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছি। কোনো ভুল করব না সব ঠিকঠাক হবে ইনশাআল্লাহ।”

অহনা মন খারাপ করে বলল,
“হুম। আমাদের আলাদা ডিপার্টমেন্টে কেন জব হলো? এক অফিস হলে কত মজা হতো। এক সাথে কাজ করতাম। এক সাথে আসতাম।”

ইশারা মুচকি হেসে বলল,
“এখনও পারব। মন খারাপ করার কিছু নেই। আলাদা ইউনিট, ডিপার্টমেন্ট হলে সমস্যা কি? পাশাপাশি বিল্ডিংয়ে আছি। এক সাথে যাব এক সাথে আসব।”

“পাশাপাশি কই? কম পক্ষে পাঁচ-সাত মিনিট লাগবে তোর সাথে দেখা করতে গেলে। তাছাড়া এত কাজের চাপ থাকে যে পাশের ডেস্কের দিকে তাকাতে পারি না। আর মেডাম, সবার কাজ এক সাথে শেষ হয় না। আগে পরে হয়।”

ইশারা মন খারাপ করে বলল,
“ওহ! অনেক চাপ কাজের?”

“হ্যাঁ বলতে পারিস। এই জন্যই তো বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে অতিরিক্ত এতজন কর্মী নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কপাল ভালো যে দুজনেই সিলেক্ট হয়ে গেছি। তুই সিলেক্ট না হলে আমার মন খারাপ হতো আর আমি না হলে তোর।”

অহনা আর ইশারা এক সাথে ঢাকায় পড়াশোনা করলেও অহনার মামা বাড়ি রাজশাহী। পড়াশোনা শেষ। এক আত্মীয়ের কাছে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পেয়ে ট্রাই করে ইশারাকে জানালে ইশারাও ট্রাই করতে চায়। তারপর দুজনই সিলেক্ট তবে সেম ডিপার্টমেন্ট নয়। অহনার জয়েনিং আরো তিন দিন আগে হয়ে গেছে। তাই অহনা আগেই পৌঁছে গেছে। মামার প্রতিবেশীর বাড়িটাও ফাঁকা থাকায় সহজেই বাড়ি ভাড়া পেয়ে যায়। অহনা আর ইশারা দুজন শেয়ারিং করে থাকবে এখানে।

ইশারা ডিনার করে বিছানায় গা এলিয়ে দিল আগামীকাল নতুন অফিসে যাবে। সবাই কেমন হবে, নিজের কাজটা ঠিকঠাক করতে পারবে কি-না এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল।

সকালে সময়মতো ইশারা অফিসের জন্য তৈরি হয়ে গেল। ঘাড় অবধি চুলগুলো ঝুঁটি করে ক্রিম কালার জামার সাথে ম্যাচিং করে হিজাব পরলো। সাথে সাদা রঙের সু। ব্যাগ রাতেই গোছানো ছিল। রুম থেকে বের হয়ে দেখল অহনা রেডি হয়ে সামনে নাস্তা নিয়ে ইশারার জন্য অপেক্ষা করছে। ইশারা ওর সামনে গিয়ে হাসিমুখে উচ্ছলতা প্রকাশ করে বলল,
“অহন, দেখ তো আমাকে কেমন লাগছে?”

অহনা উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে ওকে ঘুরে ঘুরে দেখছে। তারপর বলল,
“লাগছে ঠিকঠাক।”

ইশারা মুখ কালো করে বলল,
“ঠিকঠাক? শুধু ঠিকঠাক? ভালো লাগছে না তাই না?”

অহনা ওর গাল টেনে বলল,
“অনেক সুন্দর লাগছে। সবাই জাস্ট ফিদা হয়ে যাবে।”

ইশারা মুখ ভেংচি কেটে বলল,
“আমি কি সবাইকে ফিদা করতে যাচ্ছি? কাজ করতে যাচ্ছি। সেখানে পার্সোনালিটি প্রকাশের জন্য লুক নিয়ে চিন্তিত আর কিছু না।”

অহনা হতাশ হয়ে বলল,
“ওকে।”

.

আজও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। কিন্তু গতকালের মতো নয়। ইশারা ছাতা নিয়ে বের হয়েছে। ছাতা বন্ধ করে অফিসের ভেতরে প্রবেশ করল। ওয়াচম্যানকে জিজ্ঞেস করে নিজের ডিপার্টমেন্টে চলে গেল। পিয়নের সাহায্যে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসল। বিশাল বড় অফিস। ইশারা চুপচাপ বসে আছে আর চারদিক দেখছে। কারণ ও জানে না ওর কাজটা কি। কি করতে হবে। কিছুক্ষণ পরে একটা মেয়ে এসে ওকে সহ কয়েকটা মেয়েকে নিয়ে একটা কক্ষে গেল। ওরা পাশাপাশি বসল। মেয়েটা কম্পিউটারে দেখাচ্ছে ওদের কি কাজ করতে হবে, হাতে কলমে প্রশিক্ষণও দিচ্ছে। পুরো দিন কাজ শিখতে শিখতে চলে গেল। লাঞ্চের জন্য শুধু একটু সময় পেয়েছে। প্রথম দিন এভাবেই গেল। দ্বিতীয় দিন ইশারা নিজের ডেস্কে বসে কাজ করছে। ওর পুরো মনোযোগ শুধু কাজের মধ্যে। পাশের মেয়েটা ওকে আলতো করে ধাক্কা দিল। ইশারা ওর দিকে তাকাল। মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। সামনের দিকে ইশারা করল। ইশারা দেখল সবাই দাঁড়িয়ে আছে। স্কুলে যেমন ক্লাসে স্যার এলে সবাই দাঁড়িয়ে যায় ঠিক তেমন। ইশারাও দাঁড়াল। সবার দৃষ্টি একজনের দিকে।
দুজন ভদ্রলোক এক সাথে দাঁড়িয়ে কি যেন বলছে। যার সাথে কথা বলছে তাকে ইশারা চিনে। উনাকে গতকালই দেখেছে। কারো কাজে কোনো সমস্যা হলে বুঝিয়ে দেন। কিছুক্ষণ আগে এসে ইশারাসহ কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছে কোন সমস্যা হচ্ছে কি না। কিন্তু বাকি দুজনকে চিনে না। সেই দু’জন লোক পেছনের দিকে আসছে। স্যুট কোর্ট, চশমা পরা একজন ভদ্রলোক সামনে হাঁটছে আর পেছনে একজন সাদা শার্ট, টাই ফর্মাল লুকে উনার পেছনে পেছনে আসছেন। কিছুটা সামনে আসতেই ইশারা চোখ বড়বড় করে তাকাল। ও যেন স্বপ্ন দেখছে। চোখ বন্ধ করে আবারও খুলল। তারপর ভালো করে দেখল। না একদম ভুল দেখেনি।

ইশারা পাশের মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল,
“আপু, ইনি কে?”

মেয়েটা এখানকার পুরনো কর্মচারী। তাই চেনার কথা।
“হি ইজ আওয়ার বস।”

ইশারা বিস্ময় নিয়ে বলল,
“বস! কোম্পানির মালিক?”

মেয়েটা মুচকি হেসে বলল,
“উহু। উনি আমাদের ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বে আছেন। আমাদের সব দায়িত্ব উনার। আর আমরা উনার আন্ডারে কাজ করি তাই উনি আমাদের বস। এই কোম্পানির মালিক সে দেশে থাকেন না। হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক তিনি। বিভিন্ন দেশের সাথে তার কোম্পানির শেয়ার আছে। আর এখানেও বিদেশী কোম্পানির শেয়ার আছে। বুঝলে?”

ইশারা মাথা নাড়াল। তারপর আবার সামনের দিকে তাকাল। সামনের লোকটা মানে ওদের বস স্বয়ং ফারান।
তারপর আবার ওর পাশের কলিগকে বলল,
“উনি নিশ্চয়ই খুব ভালো মানুষ।”

“হ্যাঁ অবশ্যই ভালো মানুষ। তবে অনেক কড়া। কোম্পানির ভালো পজিশনে আছে কি-না। ছয় ডিজিটের স্যালারি পান। বিশাল ব্যাপার। তবে স্ট্রং পার্সোনালিটি স্যারের। কারো কাছে মাথা নত করেন না। সবার কাছ থেকে কাজ আদায় করে নেন। ছাড় দেন না একদম।”

ফারান ইশারার দিকেই আসছে। ইশারা অন্যদিকে কাত হয়ে আছে আর চোখ মুখ চুলকানোর বাহানায় নিজেকে আড়াল করছে।

ফারান ওর এসিস্ট্যান্ট আবিরকে নিয়ে কর্মস্থল পরিদর্শন করছে। সবাই ঠিক মতো কাজ করছে কি না, কারো কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না এসব জিজ্ঞেস করছে। সবার ডেস্কের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। ইশারা নিজেকে আড়াল করায় ফারান ওকে দেখে নি।
ফারান চলে যাওয়াতে ইশারা হাফ ছেড়ে বাঁচল। ফারান চলে যাওয়ার পর ইশারা আবারও নিজের কাজে মন দিল।

অফিসের তৃতীয় দিন ইশারা দৌড়ে দৌড়ে ভেতরে ঢুকছে। কারণ লেট করে অফিসে আসা বস একদম পছন্দ করেন না। তিনি নিজেও সময়ের আগে চলে আসেন। ইশারা চায় না তিন দিনের মাথায় চাকরিটা চলে যাক। বসের কেবিনের সামনে দিয়ে চোখ বন্ধ করে দ্রুত পা ফেলছে। দরজা ডিঙিয়ে চলে যেতে পেরে ইশারা প্রচন্ড খুশি। কিন্তু এ খুশি বেশীক্ষণ স্থানী হয়নি।

পেছনে থেকে একটা গম্ভীর কন্ঠস্বর বলল,
“এক্সকিউজ মি..”

ইশারা থমকে দাঁড়িয়ে গেল কিন্তু পেছনে ঘোরার সাহস পাচ্ছে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

পেছনে থেকে সেই কন্ঠস্বর আবারো বলল,
“ইয়েস ইউ।”

ইশারা ধীরে ধীরে পেছনে ঘুরে। ঝাঝালো গলায় কিছু বলতে গিয়ে থমকে যায় ফারান। স্থির দৃষ্টিতে ইশারার দিকে চেয়ে আছে। ইশারা আমতা আমতা করে ফারানের দিকে তাকাল। ফারানের চোখে বিস্ময়। ও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না এটা ইশারা।

ফারান দু’পা এগিয়ে এসে বলল,
“তুমি সেই মেয়েটা না? বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় আঁটকে পড়েছিলে?”
ফারান শিওর এই মেয়েই সেই মেয়ে। কিন্তু তবুও কেন জিজ্ঞেস করছে জানে না।

ইশারা কাচুমাচু হয়ে বলল,”জি।”

“তুমি এখানে কি করছো? এই অফিসেই কাজ করো?”

ইশারা মাথা নাড়িয়ে বলল, “জি।”

“কার আন্ডারে? রহমান সাহেবের না খান সাহেবের?”

ইশারা স্নিগ্ধ হেসে বলল,
“আপনার আন্ডারে।”

ফারানের নিজেকে বোকা মনে হচ্ছে। এমন বোকামী কি করে করছে, কি করে বোকার মতো কথা বলছে? ইশারা যখন ওর কেবিন ওর ইউনিটের সাথে তাহলে অন্যের আন্ডারে কেন হবে? সব গুলিয়ে যাচ্ছে কেন বুঝতে পারছে না।

“আমার আন্ডারে কাজ করছো অথচ আমিই জানি না? কি অদ্ভুত!”

“জি না স্যার অদ্ভুত না। আমি তিনদিন ধরে জয়েন করেছি। আপনার আন্ডারে কত মানুষ কাজ করে এত মানুষকে কি আপনার মনে রাখা সম্ভব? একদমই না। আমি আপনাকে চিনি কারণ আপনি আমার বস তাই।”

ফারান কথা বলছে না। লেট করে আসায় ওকে বকুনি দেওয়া উচিত কিন্তু তা পারছে না।
“ওকে। মন দিয়ে কাজ করো। কোন সমস্যা হলে জানাবে।”

ইশারা আর ফারানকে বিব্রত করতে চাইছে না। তাই মুচকি হেসে নিজের ডেস্কের দিকে গেল।

ফারান এসে দূর থেকে ইশারাকে কয়েকবার দেখে গেল। ও নিজের মতো কাজ করছে চুপচাপ। কারো সাথে কথা বলে না, কারো দুকে তাকায় না। ক্লান্ত হয়ে পড়লে চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে। একটু পানি খায়। ফারান ওর কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা দেখে মুগ্ধ হচ্ছে।

হটাৎ করে ইশারার এক মেয়ে কলিগ ফারানের এসিস্ট্যান্ট আবিরের কাছে ছুটি চাইল। তিনি প্রেগন্যান্ট। ভারী শরীর জানান দিচ্ছে ছ সাত মাসের জার্নিতে আছেন। শরীর খারাপ লাগছে। কিন্তু আবির কিছুতেই ছুটি দিতে চাইছে না। ইশারা সেদিকে তাকাল। মেয়েটাকে দেখে মায়া হচ্ছে। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। ইশারা মনে মনে বলছে যদি উনার জন্য কিছু করতে পারতাম।

তখনই ইশারা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“স্যার। উনার শরীর নিশ্চয়ই খুব খারাপ। চেহারা তাই বলছে। আমি উনার বাকি কাজগুলো করে দেব। উনাকে যদি সম্ভব হয় ছেড়ে দিন। আমার কাজ শেষ করে উনার কাজ করে দেব।”

মেয়েটা সহ আবির ইশারার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে। কি বলছে এসব? এত কাজের চাপ,কেউ নিজেরটা করতে চায় না সেখানে অন্যেরটা করে দেবে? যদিও ইশারার এসবে অভ্যাস আছে।

আবিরের চোখ ফারানের দিকে পড়ল। ফারান ইশারা করল। আবির বলল,
“ঠিক আছে।”

মেয়েটি অশ্রুসিক্ত নয়নে বলল,
“অনেক অনেক শুকরিয়া। আল্লাহ তোমার সহায় হোক।”

ইশারা মুচকি হাসল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here