বৃষ্টি তোমাকে দিলাম❤️,পর্ব-৩

0
2273

বৃষ্টি তোমাকে দিলাম❤️,পর্ব-৩
ফাবিহা নওশীন

বিকেল সাড়ে চারটা। প্রতিদিন চারটায় অফিস ছুটি হয়ে যায়। ফাঁকা অফিসে পিনপতন নীরবতা বিরাজমান। এত বড় অফিসকে নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরেছে। ইশারা নিজের মনে কাজ করছে। ফারান উঁকি দিয়ে ইশারাকে দেখল একবার। সাথে হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল। তারপর ইশারার দিকে এগিয়ে গেল। ইশারা এক ধ্যানে কাজ করছে। ফারান ওর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা টেরই পায়নি। ফারান গলা খাকাড়ি দেওয়ায় ইশারা চমকে উঠল। ফারানকে দেখে বসা থেকে দুম করে দাঁড়িয়ে গেল।

তারপর আমতা আমতা করে বলল,
“জি, স্যার।”

“আর কাজ করতে হবে না। সব গুছাও।”

ইশারা ইতস্তত করে বলল,
“কেন স্যার?”

“বাইরের অবস্থা দেখেছো? কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামবে।”

ইশারা কালো রঙের একটা ছাতা দেখিয়ে বলল,
“আমি আজ ছাতা নিয়ে এসেছি। তাছাড়া অটো, রিকশা না পেলেও সমস্যা নেই। হেঁটে হেঁটে আধ ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাব।”

ফারান বিরক্তি নিয়ে বলল,
“এত বেশি বুঝো কেন?”

ইশারা ফারানের কথা শুনে থমকে গেল। কিছুটা বিব্রত বোধ করছে। তারপর বলল,
“কিন্তু স্যার, আবির স্যারকে যে বলেছি কাজ কমপ্লিট করে যাব।”

ফারান ওর টেবিলে হাতের ভর দিয়ে শীতল কন্ঠে বলল,
“আমি বস না তুমি?”

শীতল কন্ঠস্বর শুনে ইশারার ভেতরেও শীতল প্রবাহ বয়ে গেল।
“জি আপনি।”

ফারান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত গুজে বলল,
“সো….?”

ইশারা স্নিগ্ধ হেসে বলল,
“আমি সব গুছিয়ে নিচ্ছি।”

তারপর ইশারা সব গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ফারান স্থান ত্যাগ করল। ফারান যেতেই ইশারা চোখ তুলে একবার ফারানের যাওয়ার দিকে তাকাল।

.

গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। ইশারা ছাতা খুলে মাথার উপরে দিয়ে মেইন গেট থেকে বেরিয়ে এল। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ডানে বামে দেখছে। একটা রিকশাও পেয়ে গেল।
রিকশাওয়ালা সামনে আসতেই ইশারা উঠতে গিয়েও থেমে গেল।
“মামা, ভাড়া কত?”

রিকশাওয়ালা মাথায় গামছা বাঁধতে বাঁধতে বলল,
“ষাট টাকা।”

ইশারা চোখ কপালে তুলে বলল,
“কি? ত্রিশ টাকার ভাড়া ষাট টাকা? ডাবল ভাড়া কেন দেব?”

“আপা, আবহাওয়া দেখছেন? জোরে বৃষ্টি আইব।”

ইশারা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তো? জোরে বৃষ্টি আসলে কি আপনার রিকশা হেলিকপ্টার হয়ে যাবে না বৃষ্টির পানি থেকে আমাকে বাঁচাতে পারবে? তাহলে ডাবল ভাড়া কেন চাচ্ছেন? ঠিক আছে চল্লিশ টাকা দেব।”

“না আপা, হইবো না।”

“না হলে বৃষ্টিবিলাশ করুন।”

“আচ্ছা পঞ্চাশ টাকা দিয়েন।”

“এক টাকাও বাড়াব না। দরকার পড়লে ভিজে ভিজে হেঁটে যাব।” তারপর মুখ বাঁকালো। রিকশাওয়ালাও ভাব দেখিয়ে চলে গেল। ইশারা আবারও ডানে বায়ে চেয়ে রিকশা খুঁজছে।

ফারানের গাড়ি ওর সামনে এসে থামল। ফারান গ্লাস নামিয়ে বলল,
“এই যে মিস আসুন, আমি আপানাকে পৌঁছে দেব।”

ইশারা হালকা হেসে বলল,
“প্রয়োজন নেই আমি যেতে পারব।”

“আরে উঠ। আমি তোমাকে কিডন্যাপ করব না।”

ইশারা ফারানের কথা শুনে লজ্জা পেল। অস্বস্তি নিয়ে বলল,
“আসলে তা নয় স্যার। আপনি চলে যান আমি যেতে পারব।”

ইশারার কাছে বিষয়টা মোটেও ভালো লাগে না। বসের গাড়িতে গেলে মানুষ কি ভাববে? আর কেনই না যাবে? সেদিন নাহয় খুব বিপদে পড়েছিল তাই বলে রোজ রোজ? নিজের কাছেও তো খারাপ লাগে৷

ফারান গম্ভীরমুখে বলল,
“ঠিক আছে৷ তোমাকে হেল্প করতে চাওয়াটাই আমার ভুল হয়েছে। শুধু শুধু টাইম ওয়েস্ট। সেদিন তো হেল্প নিয়েছিলে আর আজ এমন ভাব করছো যেন আমার গাড়িতে উঠলে তোমার ক্ষতি হয়ে যাবে।”

ইশারা বুঝতে পারছে ফারান রেগে যাচ্ছে। তাই বলল,
“ওকে স্যার আসছি।”

ইশারা গাড়িতে উঠে বসল। ফারান একটা কথাও বলেনি। ইশারাও চেষ্টা করেনি। গায়ে পড়ে কথা বলার মেয়ে ও নয়। তাই চুপচাপ বসে আছে।
বাড়ির কিছুটা কাছে আসতেই ফারান জিজ্ঞেস করল,
“তোমার ফ্যামিলিতে কে কে আছে?”

ফারানের প্রশ্ন শুনে বুকটা ধুক করে উঠল। মুখটা শুকিয়ে গেল ইশারার। ঢোক গিলে জোরপূর্বক শুকনো হেসে বলল,
“আমার কেউ নেই।”

ফারান ওর কথা শুনে শকড হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইল। ইশারার চোখে পানি ছলছল করছে। ফারান ছোট্ট করে বলল,
“সরি।”

ইশারা নিজেকে সামলে বলল,
“ইট’স ওকে। একা থাকতেই ভালো লাগে। কেননা পরিবার সব সময় সুখের কারণ হয় না।”

ইশারার বাড়ির সামনে গাড়ি থামল। ইশারা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। ফারান আর কিছু প্রশ্ন করার সুযোগ পায়নি। ইশারা বিব্রতবোধ করে ব্যক্তিগত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে।

ইশারা গাড়ি থেকে নেমে ফারানের দিকে চেয়ে বলল,
“ধন্যবাদ স্যার।”

ইশারা নিজের রুমে গিয়ে ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে বসে আছে। মনে হচ্ছে শরীরে আগুন জ্বলছে। অহনা ওর আগে এসে ফ্রেশ হয়ে খেয়েও নিয়েছে। ইশারার রুমে এসে এই অবস্থা দেখে বলল,
“এই ঠান্ডার মধ্যে ফ্যান ছেড়েছিস, তাও ফুল স্পিডে? শরীরে কি আগ্নেয়গিরির লাভা ছড়িয়ে পড়েছে?”

ইশারা উঠে বসে বলল,
“ভালো লাগে না। সবাই আমার ব্যক্তিগত বিষয়, আমার পরিবার নিয়ে প্রশ্ন করে। আমি উত্তর দিতে পারি না। বরং আমার বিরক্ত লাগে যখন কেউ আমাকে এসব প্রশ্ন করে। ভদ্রতার জন্য চুপ থাকি।”

অহনা ওর পাশে বসে বলল,
“এত চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। এটা স্বাভাবিক। তুই, আমি যখন নতুন কারো সাথে পরিচিত হই তখন তার পাশাপাশি তার পরিবার সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হই। ওরাও হচ্ছে। এত প্যারা নেওয়ার কিছু হয়নি। চিল। যা ফ্রেশ হয়ে আয়। তারপর এক সাথে মুভি দেখব। কি সুন্দর মেঘাচ্ছন্ন ওয়েদার। আহ!”

ইশারা উঠে ফ্রেশ হতে গেল। জামাকাপড় ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল।

মাত্র মুভি শেষ করে উঠেছে ইশারা আর অহনা। ইশারা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বিকেলে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়লেও এখন ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি পড়ছে। চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির ঘ্রাণ নিচ্ছে। ব্যাগ থেকে পুরনো সিমটা বের করল। খালাকে ফোন করবে। ইশারা সিন ইন করে মোবাইল অন করতেই ভু ভু শব্দে মোবাইলসহ হাত কেঁপে উঠল। অনেকগুলো মেসেজ জমা হয়ে তবেই ক্ষান্ত হলো।
ইশারা ইগ্নোর করে ওর খালামনিকে কল করল। কয়েকবার রিং হওয়ার পর উচ্ছাসিত কন্ঠস্বর বলল,
“তুই কেমন আছিস ইশু? কোন সমস্যা হয়নি তো?”

ইশারা জোরে শ্বাস ফেলে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। সব কিছু ঠিক আছে। ওদিকে কি অবস্থা?”

“এইদিকে কি সিচুয়েশন হবে সেটা তো জানাই ছিল। এদিকের ঝড় এখনো থামেনি। এসব বাদ দে। তুই এ-সব নিয়ে একদম মাথা ঘামাস না। নিজের খেয়াল রাখিস। যত্ন নিস।”

“জি খালা মনি দোয়া করো।”

“আমার দোয়া সব সময় তোর সাথে আছে।”

“তুমিও নিজের খেয়াল রেখো, ভালো থেকো।”

“আচ্ছা, অনেক রাত হয়েছে খেয়ে শুয়ে পড়।”

“আচ্ছা রাখছি।”

কল কেটে ইশারা না চাইতেও একটা মেসেজ ওপেন করল।
“তুমি কি ভেবেছো পালিয়ে বাঁচতে পারবে? আমি তোমাকে খুঁজে পাব না? দেখি কতদিন পালিয়ে বাঁচতে পারো। তুমি নিজে থেকেই আমার কাছে ধরা দেবে। আর সেদিন আমি তোমার জীবন নরক বানিয়ে দেব। সেদিনের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে দিন পাড় করছি।”
ইশারা মেসেজটা পড়ে চোখ বন্ধ করল। ওর অজানা নয় এই আননোন নাম্বার কার আর কে মেসেজ করেছে। তারপর ছোট করে শ্বাস ফেলে মোবাইল থেকে সিমটা বের করে বিরবির করে বলল,
“আমি তোমার হাতে ধরা দেওয়ার আগে আকাশের বাসিন্দা যেন হয়ে যাই।”

ইশারা ওইদিন আর রাতের খাবার খায়নি। শুয়ে শুয়ে নিজের অতীতের কথা ভাবছে। বুঝ হবার আগেই মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মা’কে হারায়। সেদিন থেকে জীবনের দুর্দশা শুরু হয়। সেই দুর্দশা যেন আজো নিয়ে ঘুরছে। সেদিনের পর থেকে খুশি থাকা ভুলে গেছে। সুখ কি জিনিস অনুভব করতে পারেনি। জীবন কালো অন্ধকারে ঢেকে গেছে আজ আলোকিত করার উদ্যোগ নিয়েছে।

.

ইশারা সেই প্রেগন্যান্ট কলিগের সাথে দেখা করে তার খোঁজ খবর নিল। ওর নাম পারুল। ইশারার সাথে খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক কথা বলে ওরা। ইশারা লাঞ্চ বক্স নিয়ে পারুলের টেবিলের দিকে যাচ্ছে। তখনই এক ভদ্রলোক পারুলের টেবিলের উপর হাত ভর দিয়ে কি যেন বলছে। ইশারা এগিয়ে গেল আরেকটু সামনে।

ভুড়িওয়ালা লোকটা পারুলের শরীরের দিকে কামুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। প্রেগ্ন্যাসির জন্য নাদুসনুদুস পারুলের শরীর ভারীর পাশাপাশি অনেক ভাজ পড়ে গেছে।

লোকটা অদ্ভুত চাহুনি দিয়ে বলল,
“ভালোই তো আজকাল তোমাকে আর কাজ করতে হচ্ছে না। যখন তখন চলে যাচ্ছ। ভারী পেটের কত সুবিধা তাই না?”
তারপর ফিক করে বিশ্রীভাবে হেসে দিল। পারুলের গায়ে আগুন ধরে যাচ্ছে। কিন্তু কিছু বলছে না।

তারপর হাসি থামিয়ে বলল,
“না আসলেই তো পারো তোমার এই পেট নিয়ে।”
বিশ্রীভাবে আবারও তাকাল।

ইশারার শরীরেও আগুন ধরে যাচ্ছে। কেউ কোনো মেয়েকে বাজে নজরে দেখলে, তাকে নিয়ে আজেবাজে কথা বললে কিংবা অত্যাচার করলে ওর সহ্য হয় না। কিন্তু নতুন তাই কিছু বলছে না। যদি চাকরি চলে যায়? এই চাকরি ওর ভীষণ প্রয়োজন।

ইশারা ঠাস করে বক্স রেখে বলল,
“কি সমস্যা আপনার? বিরক্ত করছেন কেন উনাকে?”

ইশারার দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল,
“তুমিও তো পারুলের কাজ করে দেও। কত ভালো সার্ভিস দেও ওকে। আমাদের দিকেও মাঝেমধ্যে নজর দিও।”

ইশারা চটপট উত্তর দিল। ঠিক উত্তর না প্রশ্ন।
“কেন আপনি কি প্রেগন্যান্ট? পেটে বাচ্চা লালন পালন করছেন?”

লোকটা ভ্রু কুঁচকে ক্ষিপ্তভাবে ওর দিকে তাকাল। ইশারা হালকা হেসে বলল,
“পেট তো তাই বলছে৷ কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব? ওহ আচ্ছা, অখাদ্য খেয়ে ভুড়ি বানিয়েছেন?”

লোকটা ইশারাকে পারলে খেয়ে ফেলে। দাঁত খিটমিট করে বলল,
“এই মেয়ে। তুমি দেখছি ভারী অসভ্য। বসের কাছে নালিশ করে তোমার চাকরি খাচ্ছি দাঁড়াও।”

পারুল ভয়ার্ত চোখে তাকাল। ইশারা চুপ করে চেয়ার টেনে বসে বলল,
“অখাদ্য খেয়ে হয়নি এখন আমার চাকরি খাবে।”

লোকটা হনহন করে চলে গেল। পারুল বলল,
“কি করলে এটা? ডেঞ্জারাস লোক উনি। তোমার চাকরিটা আর রইল না।”

ইশারা ভেবেছিল ফাঁকা আওয়াজ কিন্তু এখন পারুলের কথা শুনে ভয় লাগছে খুব৷ চাকরি চলে গেলে ইশারার জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়বে৷ এই চাকরির বলে নিজের শহর ছেড়েছে। এখন যদি চাকরিটাই না থাকে তবে খাবে কি? উনি অফিসের সিনিয়র আর বিশ্বস্ত একজন। উনার প্রায়োরিটিই বেশি হবার কথা।

চলবে….!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here