বৃষ্টি তোমাকে দিলাম❤️,পর্ব-১০
ফাবিহা নওশীন
ফারান দু’হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। ইশারা ইতস্তত করছে। ও চাইছে না পুরনো কথা নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে। জীবন যেভাবে আছে সেভাবেই চলুক। উঠে যেতে চাইছে ফারান চোখ পাকিয়ে তাকায়। ইশারা আবারও মিইয়ে যায়।
ফারান দাঁড়ানো থেকে ইশারার বরাবর একটা চেয়ার নিয়ে কিছুটা দূরত্বে বসে পড়ল। অন্যের স্ত্রীতে ওর অধিকার নেই তাই এই দূরত্ব।
ইশারা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“ছোটবেলায় মা মারা যায়। মায়ের চেহারাও আমার মনে নেই। তিনি কিভাবে মারা গেছেন তাও জানি না। একেকজন একেক কথা বলে। আমি অনেক চেষ্টা করি তাকে স্মরণ করার কিন্তু পারি না। তার কোনো ফটো নেই আমার কাছে। বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী মায়ের সমস্ত স্মৃতি বাড়ি থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। ব্যবহার্য জিনিসপত্র সব কিছু ফেলে দিয়েছেন। পারলে হয়তো আমাকেও ফেলে দিতেন। কিন্তু সমাজ মানত খুব তাই হয়তো পারেনি। উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্ম আমার। আমার বাবা অঢেল সম্পদের মালিক। কিন্তু আমি সাধারণ ঘরের মেয়ের মতোই বড় হয়েছি। হুট করে দেখে কেউ বলতে পারবে না আমি কোন সোসাইটি বিলোং করি। আমার মা মানে সৎ মা কাজের লোককে দুহাত ভরে দিতে কার্পণ্য করেন না যত সমস্যা আমার বেলায়। ভালো স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি কোনোটাই পাইনি। বাড়িতে তিনজন কাজের লোক থাকা স্বত্তেও তার কোন কাজ আমাকে ছাড়া হয় না। পরীক্ষা চলছে আমার। দম নিতে পারছি না পড়ার চাপে। তখন তার আমাকে আরো বেশি প্রয়োজন পড়ে। অথবা তুচ্ছ কাজে আমাকে ব্যস্ত রাখেন। আর যদি সামান্য এদিক থেকে সেদিক হয় তবে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতেন। আমার মা একটা অকর্মা জন্ম দিয়ে তার ঘাড়ে চেপে মরেছে। একা কেন মরল আমাকে সাথে নিতে পারল না। সব কিছু সহ্য করতে পারলেও এসব কথা আমি সহ্য করতে পারতাম না। অনেক কষ্ট হতো। মাঝে মাঝে মনে হতো মরে যাই কিন্তু সাহস হয়নি। বাবাও এসব বলত। আমাকে এক প্রকার বোঝা মনে করত। ভাইবোনেরাও একই ব্যবহার করত। আমার চেয়ে ওরা ছোট হলেও তুই তুকারি করে কথা বলত। কিছু মনে করতাম না। ওদের সব হুকুম মেনে চলতাম। ছোট থেকেই কেউ একটু আদর করে ভালোবেসে কথা বললে গলে যেতাম। কারণ আমি ভালোবাসার কাঙাল ছিলাম। অনেক অবহেলা, বঞ্চনার স্বীকার হয়েছি। সকালে ঘুম ভেঙেছে তিক্ত কথা শুনে, ঘুমাতেও গিয়েছি তিক্ত কথা শুনে। নানা কারণে আমি সময়মতো স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে যেতে পারতাম না। তাই স্যারদের বকা প্রতিদিন খেতে হতো। কেউ বন্ধুত্ব করত না। কেউ ছিল না যে একটু সময় নিয়ে আমার কথা শুনবে। দুই বছর আগে অহনার সাথে পরিচয় হয়। ও একমাত্র আমার দুঃখের সঙ্গী।
ভাবলাম পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াব৷ নিজের মতো বাঁচব। কারো কাছে সামান্য খাওয়ার জন্য পড়ে থাকব না। কিন্তু সেটাও হলো না। ফাইনাল পরীক্ষার পরপরই আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। তখন রেজাল্টও পাবলিশ হয়নি। বাবা সোহেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করলেন। সোহেল বাবার মতো ধনাঢ্য ব্যক্তি না হলেও উচ্চপদস্থ পদে চাকরি করত। আমার তো ধন সম্পদ চাইনা। একটু ভালোবাসা, সম্মান চেয়েছি। সোহেল বাবা-মার একমাত্র ছেলে। ওর বাবা নেই। পরিবার বলতে একমাত্র মাই আছে। ওর মা রোজ আমাকে ফোন করতেন। আমার খোঁজ খবর নিতেন। এত আদুরে গলায় দরদ মেখে কথা বলতো যে আমার চোখে পানি এসে পড়ল৷ মনে হতো এই বুঝি মা’কে পেয়েছি। সোহেল বিয়ের আগে দু’বার ফোনে কথা বলেছে। তখন ওকে আমার পৃথিবীর সেরা ছেলে মনে হয়েছে। এত নম্র-ভদ্র মানুষ যেন পৃথিবীতে আর দুটো নেই।”
ইশারা আলতো হাসল। তারপর বলল,
“ও যে কত ভালো মানুষ সেটা বিয়ের প্রথম দিনই টের পেয়েছি। প্রথম দিনই জঘন্য আর তিক্ত অভিজ্ঞতার স্বীকার হয়েছি।”
ইশারার গলা ধরে এসেছে। ওর কথা শুনে ফারান বুঝতে পারছে আসলেই তিক্ত অভিজ্ঞতার স্বীকার হয়েছে।
ইশারা চোখের পানি মুছে আবারও বলতে লাগল,
“দু-মাসের সংসারে কখনো হেসে দু’টো কথা বলেনি। পাঁচটা মিনিট সময় নিয়ে আমার খোঁজ খবর নেয়নি। প্রয়োজন মনে করেনি। বাড়িতে তেমন থাকত না। সকালে অফিসের জন্য বের হতো আর ফিরতো রাত বারোটা কি একটায়। কখনো আবার ফিরতো না। যেটুকু সময় বাড়ি থাকতো দাসির মতো বিহেভ করত। এটা দেও, ওটা দেও চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করত। ভালো ভাবে একটা কথা বলতো না৷ আমি শুধু প্রয়োজন ছিলাম আর কিছু না। তবুও চেষ্টা করেছি মানিয়ে নেবার। বিয়ের মাসখানেক পরে বুঝতে পারলাম ওর এফেয়ার আছে। রাতভর মেয়েদের সাথে কথা বলতো। প্রথম প্রথম বারান্দায় গিয়ে কথা বলত তারপর আমার পাশে শুয়েই কথা বলতো। সে সাধারণ কথা নয়। ঘৃণায় আমার দৌড়ে পালাতে ইচ্ছে করত। কিন্তু সেটা সম্ভব ছিল না। কান পঁচে যেত। মুখ চেপে ধরে কাঁদতাম। এমন একটা মানুষের সাথে আছি ভাবতেই গা ঘিনঘিন করত।”
ফারানের ঘৃণা হচ্ছে পুরুষজাতির প্রতি। একটা মেয়েকে কিভাবে ট্রিট করেছে। ওর কন্ঠস্বর বদলে যাচ্ছে। কম্পিত কণ্ঠে বলল,
“প্রতিবাদ করোনি?”
ইশারা শুকনো হাসল। তারপর বলল,
“করেছিলাম। যার ফলাফল আমার শরীরের ক্ষত গুলো।”
ফারান চমকে উঠল।
“ও তোমার গায়ে হাত তুলতো?”
ইশারা হেসে বলল,
“আগে তুলতো না। প্রতিবাদ করার পর শুরু হয়। ও একটা পাষণ্ড ছিল। নিষ্ঠুরের মতো মারত। একটু মায়া দয়া হতো না। আমার চোখের পানি ওর হৃদয় স্পর্শ করত না। তারপর শাশুড়ী মাকে জানালাম। তিনি অবাক হলেন না,কষ্ট পেলেন না, রাগও করলেন না। তিনি বললেন, পুরুষ মানুষের ওমন একটু দোষ থাকেই, মানিয়ে নিতে হয়৷ ভুল পথ থেকে ফেরানোই স্ত্রীর কাজ। সেদিন বুঝলাম শাশুড়ী আমার জ্ঞাত ছিল এই বিষয়ে। আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনি সব জেনে শুনে কেন একটা মেয়ের জীবন ধ্বংস করলেন? আমার সাথে কেন এমন করলেন? আপনার ছেলে দুশ্চরিত্র, রাতের পর রাত অন্য মেয়ের সঙ্গে কাটায় এটা জেনেও কেন? তিনি বললেন, ছেলেকে সংসারী করার জন্য, ভালো পথে ফিরিয়ে আনার জন্যই তোমাকে এনেছি। স্বামীর প্রতি মনোযোগী হও। সেদিনের আগ পর্যন্ত তিনি দরদী মা ছিলেন। তারপর থেকে তার অন্যরুপ দেখতে পেলাম। সবকিছুতে আমার ভুল ধরতে থাকে। সোহেলের বিষয়ে কিছু বললে বলত আমি নাকি সোহেলের যোগ্য স্ত্রী হয়ে উঠতে পারিনি। ওকে ধরে রাখতে পারিনি। আমি ওর অযোগ্য। সব দোষ আমাকেই দিতো। ছেলেকে বিন্দুমাত্র শাসন করেনি। এরপর থেকে দু’জনের অত্যাচার শুরু হলো। একজন মানসিক আর আরেকজন শারীরিক অত্যাচার করত। আমার শরীর এখনো ওর অত্যাচারের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে৷ শাশুড়ীর ধারণা ছিল আমাকে ভয় দেখিয়ে চাপে না রাখলে আমি সংসার ছেড়ে চলে যাব৷ তিনি চাইতেন না তার ছেলেকে রেখে চলে যাই। চলে গেলে তার এই ছেলেকে নিয়ে কি করবে? যদি নতুন করে ঘর করতে না পারে? তাই তার ছেলেকে দিয়ে নানাভাবে মার খাওয়াতেন। নিজে গায়ে হাত তুলত না। জীবন দিন দিন দুর্বিষহ হয়ে উঠছিল।”
ফারানের চোখ ছলছল করছে। অবাক হয়ে ইশারাকে দেখছে। ওকে দেখে কে বলবে এতকিছু সহ্য করেছে?
“পুলিশকে জানাও নি?”
“বাড়িতে বলেছিলাম। মা সোজা বলে দেন ও সংসার ছাড়লে উনার বাড়িতে আমার জায়গা হবে না। বাবা বলেন মানিয়ে নিতে, বিয়ে দিয়েছেন তার দায়িত্ব শেষ। আত্মীয়রা বাবার ভয়ে চুপ থাকত। আমি কি করব, কোথায় যাব? তাই সহ্য করে যাচ্ছিলাম। একটু আশ্রয়ের জন্য। কিন্তু একদিন তো বাড়াবাড়ি করে ফেলল। সোহেলের চাচাত ভাই এলো বাড়িতে। তিনি সোহেলের বড় ছিলেন এবং বিবাহিত ছিলেন। একদিন হুট করে বিকেল বেলায় বাড়িতে এলো। মা আমাকে বলল আমি যাতে চা করে দেই। চা দিয়ে ড্রয়িংরুম থেকে চলে যাচ্ছিলাম। ভাইয়া ডেকে বলল,
” ভাবি আপনার চুলগুলো মাশাল্লাহ। রিতুকে একটু টিপস দিয়েন তো। ওর চুল বড় হয় না বলে বেশ আপসোস করে। রিতু উনার স্ত্রীর নাম। আমি শুধু হেসে বলি, জি অবশ্যই। সেটা সোহেল অফিস থেকে ফিরে দেখে ফেলে।”
ইশারা শব্দ করে কাঁদতে থাকে। ফারান চোখের কোন থেকে আঙুল দিয়ে পানি মুছে বলল,
“কি হয়েছিল?”
ইশারা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। পেছন ঘুরে পেছনের দিক থেকে হিজাব তুলছে। ফারান অবাক হয়ে দেখছে। ইশারা কি দেখাতে চাইছে বুঝতে পারছে না। ওর ছোট ছোট চুলের একটা ঝুঁটি দেখতে পাচ্ছে।
ইশারা ঝুঁটিতে হাত দিয়ে নাড়িয়ে দেখিয়ে সামনে ঘুরে বলল,
“অনেক ছোট থেকেই আমার কোমড়ের নিচ পর্যন্ত চুল ছিল। খালামনি বলতো মায়ের মতো আমার চুল। তারও নাকি বড় বড় চুল ছিল। আমি তাই চুলগুলো আগলে রাখতাম। মায়ের একটা বৈশিষ্ট্য নিজের মধ্যে বহন করতে চাইতাম। খুব যত্ন করতাম। চুলগুলো যেন আমার জীবন ছিল। সোহেল আমার চরিত্র নিয়ে আজেবাজে কথা বলল, খুব মারধর করল। আমি নাকি ওর অনুপস্থিতিতে ওর ভাইয়ের সাথে নষ্টামি করি। এটুকুতেই শান্ত হলো না। আমার চুলগুলো ধরে টেনে হিঁচড়ে রান্নাঘরে নিয়ে গেল। তারপর গোড়া থেকে কেটে ফেলল। আমি অনেক আকুতি মিনতি করেছি শুনেনি। ঘাড় পর্যন্ত করে দিল চুল। এই কয়েক মাসে এটুকু হয়েছে। তাই সব সময় হিজাব পড়ি। সেদিন আমি পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। চুপ করে গিয়েছিলাম। শাশুড়ী সেদিন শুধু বলেছিল সোহেল বউয়ের চুল কেটে দিলি মানুষ কি বলবে? বউকে কেমন দেখাচ্ছে? এ চুল তো গজাতে অনেক সময় লাগবে। মানুষকে কি জবাব দেব?”
ইশারা একটু থামল। ফারান আর পারেনি চোখের পানি আঁটকে রাখতে৷ একটা ছেলে এতটা অমানুষ কি করে হতে পারে?
ইশারা বলল,
“সেদিন শুধু বলেছিলাম তুমি একটা কুকুর, অমানুষ, জানোয়ার। এর শাস্তি তুমি পাবে। তোমাকে আমি ঘৃণা করি। সোহেল হেসে বলল, আমি অমানুষ তো? ঠিক আছে এইবার অমানুষের আসল রুপ দেখবে।
আমি তখনও বুঝতে পারিনি কি করবে। অহনাকে সব ঘটনা খোলে বলতে বলল ও সংসার করতে হবে না। আমি পুলিশ নিয়ে আসব আগামীকাল। তুই দরকার পড়লে রাস্তায় ভিক্ষা করে খাবি তবুও এই অমানুষের সাথে থাকবি না। আমিও ভাবলাম আর নয়।
সারাদিন কেঁদেছি, খাওয়াদাওয়া হয়নি৷ অনেক রাতে পানি খেতে উঠি। তখন ওকে কারো সাথে মোবাইলে কথা বলতে শুনি। ও কাউকে বলছে ও যা চায় তা যদি পেতে সাহায্য করে তবে নিজের বউকে একদিনের জন্য দিয়ে দিবে। এটা শোনার পর আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল। আমার হাত থেকে গ্লাস পড়ে যায়। সোহেল আমাকে দেখে চমকে যায়। আমি আর কিছু না ভেবে হাতের জগের পানি ফেলে সজোরে ওর মাথায় আঘাত করি। ও মা বলে চিৎকার করে মেঝেতে পড়ে যায়। তারপর সেন্স হারায়। আমি খুব ভয় পেয়ে যাই।
মানুষ খুন করে ফেললাম? আমার শরীর থরথর করে কাঁপছিল। ওর মা ছুটে আসে চিৎকার শুনে। এসেই বলতে লাগল খুন করে ফেললি ডাইনি, খুনি তুই। তোকে ছাড়ব না। নানান কথা। আমার হাত চেপে ধরে রেখেছিল। আমি ভয়ে তাকে সজোরে ধাক্কা মেরে ফেলে পালিয়ে এলাম। বড় খালার বাড়িতে উঠলাম। সব বলার পর বলল ওর কিছু হবে না। শয়তান এত সহজে মরে না। তার পরের দিন জানতে পারলাম আসলেই শয়তান এত সহজে মরে না। সুস্থ হয়ে হন্য হয়ে আমাকে খুঁজছিল। বাবাও খালার বাড়িতে অনেক বার এসে খোঁজ করেছে। খালা সব অস্বীকার করেছে। তারপর এখানকার চাকরি হওয়ার পর এখানে চলে আসি। এই আমার দু-মাসের সংসার। তারপর সবকিছু আপনার সামনে।”
ফারানের মাথায় আগুন জ্বলছে। কান দিয়ে ধোঁয়া উড়ছে। রাগে সারা শরীর ফেটে যাচ্ছে। টেবিলে সজোরে আঘাত করে ক্ষিপ্ত গলায় বলল,
“ব্লাডি বিচ! নিজের বউকে অন্যের কাছে পাঠানোর কথা কি করে বলতে পারে?”
তারপর ইশারার ডান বাহু চেপে ধরে বলল,
“তুমি ওকে আজ এখুনি ডিভোর্স দিবে। তারপর দেখি ও তোমার ছায়া মারায় কি করে।”
চলবে…..