বৃষ্টি তোমাকে দিলাম❤️,পর্ব-১২

0
2079

বৃষ্টি তোমাকে দিলাম❤️,পর্ব-১২
ফাবিহা নওশীন

ভোরের আলো ফুটছে। এখনো অন্ধকার পুরোপুরি কাটেনি। জানালার স্বচ্ছ কাচ ভেদ করে মৃদু আলোয় ঘরে প্রবেশ করছে। শুভ্র রঙের পর্দাগুলো মৃদুভাবে উড়ছে। ইশারা পিটপিট করে চোখ মেলল। শরীর ভার ভার লাগছে। মনে হচ্ছে এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে। ইশারা চারদিকে চোখ বুলালো। ওর মনে পড়ল আগের ঘটনা। হটাৎ করেই একটা গাড়ি সামনে এসে পড়ে। ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। ওর মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছিল। কিছু বুঝার আগেই চোখ বন্ধ হয়ে যায়। ইশারা ভালো ভাবে চারদিকে তাকায়। পুরো রুম জুড়ে সুনসান নীরবতা। রুমের সাজসজ্জা বলছে এটা হসপিটাল। ইশারা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তাহলে এখনো বেঁচে আছে। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। হাত তুলে মাথায় হাত দিতে গিয়ে খেয়াল করল হাতে ক্যানোলা। অন্য হাতে মাথায় হাত দিয়ে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল।

অস্ফুট স্বরে বলল,
“আহ! কি ব্যথা!”

অহনা ওর বেডের উপর মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওর কন্ঠস্বর শুনে হন্তদন্ত হয়ে উঠে পড়ল।
“ইশু!”

ইশারা অহনার দিকে তাকাল।
“অহন, আমাকে এখানে কে এনেছে? উফফ কি যন্ত্রণা হচ্ছে।”

“ফারান স্যার এনেছে। রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলি। দাঁড়া স্যারকে আগে খবর দেই। সারারাত বসে আসেন এখানে।”

“এখানে মানে?”

“এখানে মানে, বাইরে বসে আছে। তার আগে ডাক্তারকে খবর দিতে হবে। তুই রেস্ট নে। আমি আসছি।”

অহনা দৌড়ে চলে গেল ডাক্তারকে খবর দিতে।

.

ডাক্তার এসে ইশারাকে চেকাপ করছে। অহনা ইশারার বেডের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ইশারা মাথায়, হাতে, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা অনুভব করছে। ফারান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
ডাক্তার যাওয়ার পর অহনা ইশারাকে জিজ্ঞেস করল,
“এ-সব কি করে হলো ইশু?”

ইশারা নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দিল,
“জানি না। এ যাত্রায় মরে গেলে ভালো হতো। দুনিয়ার ঝঞ্জাট থেকে মুক্তি পেয়ে যেতাম।”

ইশারার কথা শুনে অহনা পেছন ঘুরে ফারানের দিকে তাকাল। ফারানের কাছে সবটা শুনেছে অহনা।

ফারান ইশারা করতেই অহনা রুম থেকে বেরিয়ে আসে। ইশারা তখনও ফারানকে দেখেনি। ওর দৃষ্টি সিলিংয়ের দিকে।

ফারান ধীরে ধীরে ইশারার পাশে গিয়ে বসে। ইশারা ফারানকে দেখে শোয়া থেকে আধশোয়া হয়ে বসে। ফারানের দিকে তাকাতে পারছে না। ওর চোখে মুখে ক্লান্তি স্পষ্ট। লাল চোখগুলো নির্ঘুম রাতের সাক্ষী। মুখটা শুকিয়ে গেছে। চুলগুলো এলোমেলো। সব মিলিয়ে বিধ্বস্ত লাগছে। ইশারা চোখ নামিয়ে নিল। ফারানের দৃষ্টি ইশারার মুখের দিকে স্থির। ইশারা আরেকবার ফারানের দিকে তাকাল। ফারান তখনও চুপ। ওর চোখে গোপন ব্যথা।

ফারান শুকনো গলায় বলল,
“কেন এমন করলে? আমার উপর তোমার একটুকুও বিশ্বাস ছিল না? তুমি ছুটে বেরিয়ে কেন গেলে? তোমার যদি আজ কিছু হয়ে যেত?”
ফারানের গলা ভারি হয়ে আসছে। আর কথা বলতে পারছে না।

ইশারা ঠোঁট কামড়ে ধরে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি আর পারছি না। এত অপমান সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। অসম্মানের জীবন আমি চাই না। আপনি যা বলবেন আমি তাই করব। ওকে শুধু আমার লাইফ থেকে সরিয়ে দিন। আমি সম্মানের জীবন চাই। বাঁচতে চাই ভালো ভাবে।”

ফারান ইশারার আরেকটু কাছে এসে ওর হাত ধরে বলল,
“আমি মুক্ত করব তোমাকে। কথা দিচ্ছি। তুমি শুধু আমাকে ছেড়ে যেও না। মা মরে যাওয়ার পর আর কারো জন্য এতটা ভয় পাইনি। কাউকে হারানোর আতংকে রাত পাড় করিনি। তুমি তো নিস্তেজ দেহে এই বিছানায় শুয়ে ছিলে, সারাটা রাত আমার উপর দিয়ে কি গিয়েছে আমি জানি। কতটা অস্থিরতা, কতটা কষ্টে প্রতিটি সেকেন্ড কেটেছে আমি জানি। দেখো আমাকে আমার চেহারায় আমার কষ্টরা স্পষ্ট।”
ফারান না চাইতেও ঝরঝর করে পানি পড়ছে। ইশারার চোখ এড়ানোর জন্য দ্রুত পানি মুছে নিলেও ইশারার চোখ এড়ায়নি। ইশারা ফারানের হাত শক্ত করে ধরল। ফারান ইশারার দিকে আলতোভাবে তাকাল। ওই দৃষ্টিতেও এক সমুদ্র ভালোবাসা উপস্থিত।
ইশারা পারেনি ফারানের ভালোবাসা অগ্রাহ্য করতে, পারেনি যে মানুষটা ওর জন্য চোখের পানি ফেলছে তাকে দূরে ঠেলে দিতে। ফারানের হাত আরো শক্ত করে ধরল। চোখে চোখে হচ্ছে আলাপন। ফারানের ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটে উঠল।

.

অহনা ইশারাকে খাইয়ে দিচ্ছে। দুদিন হসপিটালে থাকতে হবে।
“ইশু, ফারান স্যার তোকে খুব ভালোবাসে তাকে দূরে ঠেলে দিস না। জীবনটাকে আরেকটা সুযোগ দিয়ে দেখ। আর হ্যাঁ তোর হয়ে আমি সোহেলের বিরুদ্ধে কেস ফাইল করেছি। নারী নির্যাতন, আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি।”

ইশারা ওর কথা শুনে অবাকের চূড়ায়। চোখ বড়বড় করে বলল,
“আমি তো আত্মহত্যা করিনি।”

“আরে জানি। কিন্তু ওর হাত থেকে বাঁচতে হলে এইটুকু মিথ্যা তোকে বলতে হবে। তাহলে আমাদের কেস স্ট্রং হবে। তুই তাই বলবি। তাহলে তোর ডিভোর্স সহজ হবে। এই পয়েন্টগুলোর জন্য তোর ডিভোর্স এপ্লিকেশন ইজি হবে। সহজেই মুক্তি পেয়ে যাবি। ফারান স্যার তাই বলেছে। আর উনিও মানহানীর দায়ে মামলা দিবে। অফিসে জোরপূর্বক ঢুকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা, কাজে বিঘ্ন ঘটানো, উনার নামে মিথ্যা এলিগেশন আনার জন্য মামলা দিয়েছে। শয়তানটা এইবার পাড় পাবে না। ইনশাআল্লাহ উচিত শিক্ষা পাবে। সেটা আজীবন মনে রাখবে। তুই সুস্থ হয়েই ডিভোর্স ফাইল করবি।”

ইশারা প্রশান্তির শ্বাস নিয়ে বলল,
“অবশ্যই। আমার উপর করা প্রতিটি অত্যাচার, অমানবিকতার হিসেব নেব। ফারানকে আমি আর কষ্ট দেব না। যে মানুষটা আমার সবটা জেনেও আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তার কাছ থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়ার কোনো মানেই হয় না।”

অহনা চোখ বড়বড় করে চেয়ে আছে। ইশারা ওর চাহুনির কারণ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,
“এভাবে চেয়ে আছিস কেন?”

“একদম ফারান! ফারান স্যার থেকে ফারান?”

ইশারা ওর কথা শুনে লজ্জা পেল। অহনা ওকে লজ্জা পেতে ফিক করে হেসে দিল।

.

এক মাস পর। ইশারা লাল শাড়িতে নিজেকে আবৃত করেছে। দুহাত ভর্তি কাচের চুড়ি। ম্যাচিং করে কানে দুল, খোলা চুল। চোখে গাঢ় কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক, কপালে টিপ। ইশারা মন খুলে সাজছে। আজ অনেকগুলো দিন পর নিজের সর্বস্ব দিয়ে নিজেকে সাজাচ্ছে। চুড়িগুলো রিনিঝিনি শব্দে সুর তুলছে। চুলগুলো অনেকটাই বড় হয়েছে তাই খারাপ লাগছে না। আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।

কলিং বেল বেজে উঠল। ইশারা শেষ বারের মতো নিজেকে দেখে নিল। না কোনো কমতি নেই। রুপ যেন উপচে পড়ছে লাল শাড়িতে। শাড়িটা ফারান নিজে পছন্দ করে এনেছে। ইশারা দৌড়ে গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলে দেখল ফারান ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ফারান ইশারাকে দেখে শকড হয়ে চেয়ে আছে। পলক পড়ছে, নিজেও নড়ছে না। এ যেন অন্য এক ইশারাকে দেখছে।

কিছুক্ষণ নিজেকে সংযত করে বলল,
“তুমি ইশারা তো?”

ইশারা মুখ ভেংচি কেটে বলল,
“না। ইশারার ছোট বোন।”

ফারান মজা করে বলল,
“তাহলে তো ভালোই হয়। বউ রূপবতী, শালী তার দ্বিগুণ। দুটোকেই বউ করে নিয়ে যাই। জীবনে আর কি চাই?”

ইশারা ফারানের হাত থেকে ফুলগুলো ছু মেরে নিয়ে বলল,
“তাই না? এত শখ তোমার?”

ফারান ইশারার চুলের দিকে তাকাল। চুলগুলো অনেকটাই বড় হয়েছে। কি সুন্দর সিল্কি চুল। ফারান ইশারার হাত থেকে ফুলের তোড়া থেকে দুটো ফুল নিয়ে কানের গাছে গুজে দিল। ইশারা ক্লিপ দিয়ে এটে দিল।

ফারান নিজের দুহাত বাড়িয়ে দিল ইশারার দিকে। ইশারা খুশি মনে নিজের হাত দুটো ফারানের হাতের অধিকারে দিল। ইশারার এই উৎফুল্ল খুশি মুখটা ওর সৌন্দর্যকে দ্বিগুন বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই হাসি ফারানকে পাগল করে দিচ্ছে। কি মুগ্ধতা ছড়ানো হাসি! কাউকে এ হাসি কেড়ে নেওয়ার অধিকার দিবে না।

চলবে…..!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here