প্রেমের শুরু,পর্ব_২
তৃধা আনিকা
মামীদের বাড়িতে দুদিন থাকার একটি দিনেও আবীরকে দেখলাম না। ও নেই।
বাধ্য হয়ে নাজু খালাকে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম,
-আবীর ভাইয়া কোথায়?
-কেন বাড়িতে?
-বাড়িতে মানে?
-ওদের বাড়িতে। পরীক্ষা চলছে তো ও’র।
-আসবে না?
-এখন কি করে আসবে? কেন এত জিজ্ঞেস করছিস রে?
-না মানে, মামী তো গল্প করলো উনার কথা।
-ছেলেটা আসলেই গল্প করার মতো। মা-বাবা হীন সম্পূর্ণ অন্যের কাছে মানুষ হওয়া ছেলে। তারপরও সবার সাথে কি মানিয়ে গুছিয়ে চলা ফেরা।
-মামী যে বললো, উনার বোনের ছেলে?
-ছেলের মতোই তো দেখেন উনারা। সেই আট বছর বয়স থেকেই তো আছে। ওর বাবার সাথে এসেছিল। বাবা ফুটফরমাস খাটতেন শেফালি আপাদের। ব্যস, বাবা মারা গেল তারপর থেকে আবীর ওখানেই।
আমি চুপ করে গেলাম। আবীর তাহলে….?
আমি মোটামুটি মফস্বলের বাছাই করা প্রভাবশালী বনেদি পরিবারের মেয়ে। আমাদের বিশাল যৌথ পরিবারে চাকর বাকরের সংখ্যাই ডজনখানেক।
স্কুলে দিয়ে আসতে একজন। আনতে যায় আরেক জন। আর সেখানে আবীর? আমার সেই কমবয়েসী আবেগের নড়বড়ে পৃথিবীটা যেন আরো নড়ে উঠলো। কিন্তু অল্পবয়েসী ঝোঁকের কাছে মনের ভেতরটা হার মানলো। ঠিক করলাম, দূর তো অনেক দূর; যতদিন হাতের কাছের সময়গুলো ততদিন আবীর এবং শুধু আবীর।
মামীদের বাড়ি থেকে ফিরে শুরু হলো আমার “অপেক্ষা” নামক বিষয়ের কাছে পরীক্ষা দেওয়া।
মন ঠিক করলাম, আমি এখন থেকে আবীরের জন্য অপেক্ষা করবো। কিন্তু আবীর কি কখনো বুঝতে পারবে, অপেক্ষা করছি আমি!
শুরু হলো, আমার এডোলসেন্সের অবুঝ সমীকরণ। দেখা যাক, এত এত গবেষণার যে অনুভূতি তার সত্যিই কোনো প্রভাব আছে কিনা! দিন যায়, রাত যায়। কিন্তু আমার সেই হঠাৎ দেখার মানুষটির কোনো খোঁজ নেই। একেবারেই নেই।
তারপর হঠাৎ করে একদিন চিঠি। সাথে ফোন নাম্বার।
জুঁই,
বাথরুমের দরকার হলেই ফোন করে দেবে। বান্দা হাজির হয়ে যাবে।
আবীর।
অপেক্ষা নামক পাগলামির সাথে নতুন করে যোগ হলো ভরসা। মাঝে মাঝে এক দু’মিনিটের জন্য আমি ফোন করতাম। আবীর হ্যালো হ্যালো করতো, আমি রেখে দিতাম। আবার আবীর ফোন করলে আমি হ্যালো হ্যালো করতাম। আবীর চুপ। বছর পোরোলো, আমার অনুভূতি যেন একটুও কমলো না।
এরপর আমার ছোট মামীর বাবু হবার পর আবার আবীরের সাথে দেখা হলো অনুষ্ঠানের দিন।
সেই আগের মতোই সবার অগোচরে টেনে নিলো আমায়। আমি চোখ বন্ধ করে সেই প্রথমের মতোই কাঁপছি।
-সিঁথি তাহলে জায়গা বদলালো?
-এক বছর ন’মাস তিন দিন পর কেউ কথা বলতে এলে আমি তাঁর সাথে কথা বলি না।
-তোমায় বলতে হবে এমন তো বলিনি আমি। শুধু আমি কথা বলবো।
আবীর নাক টিপে ধরলো আমার।
-আচ্ছা ডানপাশে সিঁথি করা এই মেয়েটাকে যদি আমি বাতাসের মতো পাতলা একটা চুমু খাই, মেয়েটা কি কেঁদে ফেলবে?
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।
আবীর আমার দু-গালে নরম করে হাত রাখলো।
চুমু খাবার আগেই আমি কেঁদে ফেললাম। আবীর এত হাসলো আমায় নিয়ে! ইশ্! আমি ছুটে পালিয়ে এলাম।
সেইদিনে আর একবারের জন্য আমি আবীরের সামনে পড়লাম না। কিন্তু পরদিন খুব ভোর বেলায়, আবীর আমায় ঘুম থেকে ডেকে তুলে বাইরে নিয়ে এলো। আমি ঘুম ঘুম চোখে টলতে টলতে এসে বারান্দায় দাঁড়ালাম।
-এত সকালে?
-আমি চলে যাবো।
-এখন?
-উঁহু, একটু পরে। একটা চুমু খাবার কথা ছিল। সবাই তো ঘুমে! ভাবলাম বেস্ট টাইম এটাই।
আমার ঘুম উড়ে গেল।
-ইশ্ কি নির্লজ্জ!
-সামান্য একটা ব্যাপারে নির্লজ্জ কি বলা যায়?
লজ্জা কম বলা যায়। একেবারে নির্লজ্জ হলে তো শর্টস পরেই চলে আসতাম, তাই না?
-আমি পারবো না।
-আমি জানতাম পারবে না। যার নাকে এখনো বাচ্চাদের মত সর্দি লেগে আছে, সে চুমু জিনিস তো বুঝেই না।
আমি চুপ করে কিছুক্ষণ নিঃশব্দ দাঁড়িয়ে রইলাম।
আবীর রেলিঙের উপর রাখা আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো। যেন খুব মজার কথা বলছে এমন করে বললো,
-আমার মা-বাবা নেই। ফাতেহা আন্টির বাড়িতে আমি আশ্রিত। আমার বাবা তাদের কাজের লোক ছিলেন। উনারা কোনোদিন তা আমায় টের পেতে দেননি। ছেলের মতোই ভালোবাসেন।
আমি টুপ করে আবীরের গালে চুমু খেলাম তক্ষুনি।
আবীর যেন টেরই পেলো না এমন করে বললো,
-মানলাম আমার সামগ্রিক অবস্থান খুব ভালো না। তাই বলে এত কম আদরের চুমু নিই না আমি।
আবীর মাথার পেছনে হাত দিয়ে মুখটা টেনে ধরলো আমার। ফিসফিস করে বললো,
-কথার কোনো নড়চড় করলে সারাজীবন নিজেকে কষ্ট দেবো আমি।
-আমি কারো হুমকি ভয় পাই না।
-ভয় পেতে বলিনি তো। শুধু যখন শাস্তি হবে তখন যাতে আপিল করা না হয়, স্যার আগে কেন জানাননি এমন কথা যাতে না আসে।
আবীর ভীষণ গাঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরলো আমায়।
আবীরের কাছে থেকে আসবার সময় আমি টের পেলাম, আবীর আমার গলায় কিছু একটা পরিয়ে দিয়েছে। একটা পাতলা চেইন। সুন্দর লকেটে ছোট্ট করে লিখা
“ইউ আর সিলড”!
আমি লকেট মুঠো করে আনন্দে কেঁদে ভাসালাম।
তারপর আবীরের সাথে আবার আমার দেখা নেই।
আমার নতুন অপেক্ষা শুরু হলো। আবীর কিছু একটা প্ল্যান করছে নিশ্চয়ই। একদিন হুট করে আমার কলেজে এসে হাজির। আমি তো ভয়ে আধমরা। এমন তো নয় বিয়ে করতে চলে এসেছে।
কলেজ লাইব্রেরির নিরিবিলি রুমে আবীর ভারী স্বরে বললো,
-এক্ষুনি চোখ বন্ধ করোতো! জাদু দেখাবো।
আমি পারবো না বলেও চোখ বন্ধ করলাম। আবীর আমার হাতের মুঠোয় কিছু একটা গুঁজে দিলো।
-উঁহু চোখ খুলবে না, জাদুর বাকিটা শোনো। কানাডায় একটা এপ্লিকেশন করেছিলাম। ওটার রেসপন্স এসেছে।
আমি চোখ মেললাম। হাতের মুঠো খুলতেই অবাক হলাম।
-এটা কি? কিসের চাবি?
-একটা হবো হবো সংসারের সুখের চাবি। তোমার হাতে দিয়ে যাচ্ছি।
-বাহ্! চাবি দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া হচ্ছে!
আবীর নাক ধরে কাছে টানলো আমায়।
-আমি আসা অবধি একদম বিয়ে করবে না তুমি।রাজপুত্র চলে এলেও না।
আমি বললাম,
-একা একা আমি পারবো না।
-পারতে হবে। না পারলে ক্ষমা নেই। কঠিন শাস্তি হবে।
-হোক শাস্তি।
আমি শক্ত করে হাত টেনে ধরলাম আবীরের।
-এক্ষুনি আমায় সঙ্গে নিয়ে গেলে কি হয়?
আবীর আমার হাতটার উপর তাঁর অন্য হাতটা রাখলো। নরম আদরে আঙুল বুলাতে বুলাতে বললো,
-এক্ষুনি বলে কিছু হয় না জুঁই। যেটা এক্ষুনির, আমি বিশ্বাস করি সেটা হৃদয় থেকে হলে আজীবনের।
লাইব্রেরিতে ওই অতগুলো মানুষের সামনে আমি বোকার মতো আবীরকে জড়িয়ে ধরলাম। নিজের বাচ্চা বাচ্চা ইচ্ছের কথাগুলো বলতে লাগলাম।
-আমরা লুকিয়ে বিয়ে করে রাখবো। ফিরে এসে তুমি বলবে সবাইকে। আমাদের বাড়িতে কেউ শুনবে না আমার কথা। বিয়েটা হয়ে থাকলে অন্তত একটু নিশ্চিত আমি।
আবীর নিজের থেকে ছাড়িয়ে দিলো আমায়।
-আমি লুকিয়ে বিয়ে করবো না জুঁই। আমার এই জীবনটাই মাথা নিচু করা। এজীবনে আর কোনো মাথা নিচু করা কাজ আমি করতে পারবো না। এবং তুমিও আমায় করতে বলবে না।
আবীর চলে গেল। আমার ওইটুকু বয়সে আর ওইটুকু বয়সের প্রেমে সেই প্রথম বিরহ নামক কঠিন শব্দটির সাথে পরিচয়। যাত্রা শুরু হলো বিরহকে সঙ্গী করে।
আবীর ওখানে যাবার পর ফোন করতো আমায়। একদিন কি করে যেন মায়ের কাছে ধরা পরে গেলাম। বাড়ি থেকে আমার উপর শাসন বেড়ে গেল। আমার লুকিয়ে চুরিয়ে ফোন করার সুযোগ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল।
তারপর একটা লম্বা বিরতি। একদিন হঠাৎ করে এক গুমট সন্ধ্যাবেলায় কয়েকজন অচেনা অতিথি আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এলেন। সেই বেড়াতে আসা মানুষদের মাঝে একজন ছিলেন, যিনি আমাকে বিয়ে করবার জন্য আমার পরিবার কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমি জানতাম না। সবকিছু এত তাড়াহুড়োর মাঝে হয়ে গেল! কি করবো? কিভাবে করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে ভুগে আমি বিশাল অনৈতিক একটা কাজ করে বসলাম। বিয়ের আগে আমি আত্মহত্যার চেষ্টা করলাম….
(চলবে)