তুমিময়_অসুখ পর্ব-৩
#লেখিকা-ইশরাত জাহান ফারিয়া
৫.
—“ভেজা চুলে তোকে একেবারে পেত্নীর মতো মনে হচ্ছে। এতক্ষণ তো তোকে কমলা সুন্দরী লাগছিলো কিন্তু এখন তো আমেনার মা ও লাগছে না। এই তুই কি খাস? এতো শুকনা কেন? এবার থেকে বেশি বেশি খাবি আর চুলের যত্ন নিবি।মোটাসোটা হলেই না তোকে দেখতে সুন্দর লাগবে!”
এই আপনি আপনার ফালতু কথার ঝুলি নিয়ে আমার ঘর থেকে বের হোন। দেখছেন না, আমি পড়ে গিয়েছি? একবার তো আমাকে তুলতে পারতেন।
অভ্র ভাইয়া বাঁকা হেসে বললো,আমার এতো শখ নেই তোকে তোলার। আর তুই তো যা অবস্থায় আছিস,আমি যদি তোকে এখন তুলতে যাই, তাহলে তুই লজ্জ্বায় আর কখনো আমার সামনে আসার সাহস করবি না।অবশ্য তুই চাইলে আমি তুলতেই পারি।
আমার পরক্ষণেই মনে হলো,আরে! আমি তো ওড়না ছাড়া। তাও আবার উষ্ঠা খেয়ে এই অভদ্র লোকের পায়ের কাছে পড়ে আছি! হায় কপাল!!
অভ্র ভাইয়া সন্দেহী গলায় বললো, ‘আচ্ছা! তুই কি চাইছিস আমি তোকে বাংলা সিনেমার হিরোর মতো তোকে ধরে ধরে তুলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দেবো? বা তোকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিবো?’
উনার লাগামহীন কথা বলার স্টাইল দেখে আমার ইচ্ছে হচ্ছে দিন দুনিয়া ছেড়ে বিদায় নিই। কিন্তু এই মুহূর্তে এসব বিদঘুটে চিন্তা বাদ দিয়ে এই ছেলেটাকে এখান থেকে বের করা উচিৎ। তারপর যা করার করতে হবে। আমি অভ্র ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি দিলাম।কাঁপানো গলায় বললাম,আল্লাহর দোহাই,আপনি আমার ঘর থেকে বেরুন।
—“যাচ্ছি!”
অভ্র ভাইয়া বের হয়ে যেতেই আমি তাড়াতাড়ি দরজা লাগিয়ে হাফ ছেড়ে নিঃশ্বাস নিলাম। উষ্ঠা খেয়ে আমার কোমড় মনে হয় অর্ধেক ভেঙ্গে ঝুরিঝুরি হয়ে গিয়েছে। এই উগান্ডার পাবলিক একদিনেই আমার জান নিয়ে ফেলছে, তার সাথে বিয়ে হলে এই ইরামকে আর এই দুনিয়াতে খুঁজেই পাওয়া যাবে না। কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম, নিতেই হতো। কারণ আমি চাইনা শুধু শুধু আমার জন্য সবার মাঝে সম্পর্কের ফাটল ধরুক। গায়ে ওড়না জড়িয়ে, ভেজা চুলগুলো আঁচড়ে পাউডার মেখে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাজগোজ করছি,ঠিক কখনই দরজায় আবারও কড়া নাড়ার শব্দ হলো।
আমি আঁতকে উঠে ভাবলাম,’নিশ্চয়ই অভ্র ভাইয়া।ইতস্তত করছি কিন্তু দরজা খুলছি না। ওপাশ থেকে ইলহামের গলা শোনা গেলো। বলছে,আপ্পি দরজা খোল!’
আমি তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে দিতেই ইলহাম একগাল হেসে বললো, ‘আপ্পি দেখেছিস?’
—“কি?”
—“আরে মামারা সবাই এসে পড়েছে, আমি সারপ্রাইজড! আর অভ্র ভাইয়াকে দেখেছো কত্ত হ্যান্ডসাম? সি ইজ হ..!”
আমি চোখ পাকিয়ে তাকাতেই ইলহাম বললো, ‘আচ্ছা! আসো তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিই ভাইয়ার সাথে।’
আমি বললাম, পরিচয় করানোর দরকার নেই।অলরেডি এই কার্যসিদ্ধি উনি নিজেই করে ফেলেছেন। আর তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি?
—“মানে তুমি ভাইয়ার সাথে কথা বলেছো?”
—“হুম বলেছি বজ্জাত ছেলে একটা!”
—“মোটেই বজ্জাত না। আচ্ছা আপ্পি, তুমি কি করে ভাইয়ার সাথে কথা বললে? তুমি তো কারো সাথেই কথা বলতে ইতস্তত করো!”
—“তোকে বলতে হবে?
সময়ের ঠেলায় সবসময়ই অদ্ভুত কিছু হয়ে যায়, না চাইতেও অনেক কাজ করে ফেলতে হয়। আমার সাথেও এরকমই হয়েছে।”
—“একেবারে উচিৎ শিক্ষা হয়েছে। অভ্র ভাইয়া মনে হয় তোমায় টাইট দিয়েছে সেজন্যই এরকম ফটরফটর কথা বলছো!”
আমি রেগে বললাম, এই বেশি লটরপটর করবি তো ধাক্কা মেরে রুম থেকে বের করে দিবো। বেয়াদব কোথাকার। তোর ওই সাদা ভূতে আমাকে কি টাইট দিবে রে? গুন্ডা ছেলে কোথাকার। আমি এই বজ্জাতকে টাইট দিবো দেখিস!
ইলহাম আমার অগ্নিরুপী মেজাজ দেখে দরজার সামনে গিয়ে আমাকে ভেঙ্গিয়ে ভেঙ্গিয়ে বলতে লাগলো, পারবে না। টাইট দিতে গিয়ে নিজেই টাইটিং হয়ে ফিরে আসবা। আর আমি মাজাক দেখবো, মাজাক! বাট হু কেয়ারস! আমি অভ্র ভাইয়ার কানে কথাগুলো পাচার করছি।
বলেই একদৌড়ে পগার পার। এই মেয়েটা যে আমার বোন আমার রীতিমতো ডাউট হয়।সবসময় আমাকে খাদে ফেলার জন্যই যেন ওর জন্ম হয়েছে। এখন কি করি! যত্তসব!
৬.
সকালবেলা আমি আম্মুর আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন লাগলো সবাইকে?’
—“কার কথা বলছো? সবার কথা তো মনে হয় মিন করছো না!”
—“আমি অভ্র’র কথা বলছি!”
—“দেখো আম্মু, উনি অনেক স্মার্ট,শিক্ষিত, সুন্দর।কিন্তু উনার কালচারের সাথে আমার কালচারের মধ্যে কোনো মিল নেই। আমি তো দেখতে আহামরি সুন্দরীও নই। তাছাড়া উনি বড় হয়েছেন দেশের বাইরে, আমি আমার দেশে। সেখানে উনি যেসব বিষয়গুলো অতি সহজ বা নরমাল বলে মনে করেন আমার ক্ষেত্রে সেটা অত্যন্ত কঠিন। আর আমার সাথে উনার কোনো পরিচয় নেই, উনি কেমন মানুষ সেটাও জানি না তাই আমি উনাকে বিয়ে করতে চাই না। তুমি আমার দিকটাও বিবেচনা করে দেখো প্লিজ। আর সবচেয়ে বড় কথা,আমি এখনোই বিয়ে করতে ইচ্ছুক নই।
—“তোর কথা মানলাম। কিন্তু তুই বিয়ে করতে ইচ্ছুক নস মানে কি?”
—“মানে, আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। আমার বয়স কত দেখেছো? আমি ভার্সিটি লাইফ শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই!”
—“বিয়ের পরেও তোকে ওরা পড়াশোনা করাবে!”
—“তোমার কি মনে হয়,তখন আমার পড়াশোনাটা ভালোভাবে হবে?”
—“কেন হবে না?”
—“তখন কত দায়িত্ব থাকবে আমার!কত কাজ থাকবে!”
আম্মু সন্দেহী গলায় বললেন, ‘কাজ? তোর মুখে কাজের কথা মানায়? আমাকেই একটা কাজে হেল্প করে দিস না বলছিস বিয়ের পর সংসারের কাজ করবি! হারামি হয়েছিস!
আমি আম্মুকে রাগানোর জন্য বললাম, ‘শুনো!মেয়েদের জন্মই হয়, বাড়িতে বসে বসে খাওয়ার জন্য। শপিং করার জন্য, ঘুরাঘুরি করার জন্য।’
আম্মু আমার কান মলে দিয়ে বললেন, ‘বেশি কথা শিখে গেছিস?’
আম্মু ছাড়ো তো। আর তোমার ভাইপুত্রকে গিয়ে বলে দাও, ‘আমি উনাকে বিয়ে করবো না।’
আম্মু বললেন, ‘আমি কথা বলবো ওর সাথে।’
আমি রুমে চলে এলাম। আনন্দে প্লাজু আর লুঙ্গি ড্যান্স দিতে ইচ্ছা করছে। আম্মু যে এত সহজে বিষয়টা মেনে নেবে আমি ভাবিইনি। এই মুহূর্তে উড়াধুরা নাচ করবো বলে ঠিক করলাম,নইলে পা দুটো কিছুতেই শান্ত হবে না। পাশের রুম থেকে আব্বুর লুঙ্গি এনে মিউজিক বক্সে লুঙ্গি ড্যান্স সং বাজিয়ে দরজা বন্ধ করে উরাধুরা নাচ শুরু করলাম। লাফালাফির কারণে আমার মনে হচ্ছে, আমার খাট বাবাজি এইবার আমাকে উনার উপর থেকে ফেলে দিবেন। কিন্তু খাট বাবাজি আমার সাথে এই বেইমানি করার আগে আমি নিজেই খাট থেকে নেমে ফ্লোর বাবা জীবনের উপর প্লাজু ড্যান্স শুরু করলাম। এত খুশি লাগছে কেন আমার?টিভিতে ব্রেকিং নিউজ করা উচিৎ, “উগান্ডার পাগল ছেলে অভ্র আহমেদ ফারবিনকে রিফিউজ করে দিয়ে সম্মানিত সিঙ্গেল মহিলা হয়ে জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত আনাইরা ইশতি ইরাম!”
কিন্তু কে জানতো, আমার এই খুশি কারো সহ্য হবে না? আজ! একটু আগের ঘটনাটাই ধরি,এই উগান্ডার পাগল ছেলে আমার কাছ থেকে রিফিউজ হয়ে রাত বিরেতে ড্রিংকস করে আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়ে গেলো? যত্তসব!
৭.
উনার এসব হুমকি ধমকিতে ভয় না পেয়ে আমি সাহসী রমণীর মতো চিন্তা করছি। কিন্তু আমার হাতে চেপে ধরার ফলে হাতটা লাল হয়ে ফুলে গিয়েছে। প্রচন্ড ব্যথা করছে। কিন্তু কাউকে তো আর বলতেও পারবো না যে,এই খরুচ এসে আমার এ অবস্থা করেছে। হুহ!
আমি চোখমুখ মুছে হাতটা পানিতে ভিজিয়ে রাখলাম,তাতেও কিছু হলো না। ব্যথা বাড়ছে ক্রমশই। ঠিক এমন সময় আমার ফোনে একটা ম্যাসেজ এলো। সেখানে লেখা,’তোর এখন ঔষধ খাওয়া দরকার,সো ঔষধ খেয়ে নিস। অসুস্থ হলে খবর আছে।’
আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, ‘এ আবার কোন আপদ? আমি তো এই নাম্বার চিনি না,তাহলে? আর জানলোই কিভাবে যে আমার এখন ঔষধ খাওয়া দরকার?’
ভাবছি তো ভাবছিই। তখনই আবার আরেকটা ম্যাসেজ এলো। লেখা আছে, ‘আমি অভ্র। তোর কি মনে হচ্ছে তোর কোনো গোপন প্রেমিক? তুই বিয়ে করতে চাস না আমাকে, কিন্তু আমি তো চাই। তুই খুব খারাপ ইরাম, খুব খুব খুব খারাপ। আমাকে নিয়ে ভাবিস না। ঘুমা। আর হ্যাঁ! ঔষধ খেয়ে নিস।’
ম্যাসেজ পড়ে আমি হতভম্ব। উনি আমার ফোনের নাম্বার কোথায় পেলেন? আর আমার এখন ঔষধ দরকার, সেটা উনি কিভাবে জানলেন? এতো রাতে এসে আমাকে হুমকি ধমকি দিয়ে এখন আবার দরদ দেখানোর মানেটা কি আমি বুঝতে পারছি না।
আবারও টুং করে ম্যাসেজ এলো। ম্যাসেজ সিন করে দেখলাম সেখানে লেখা,
‘মেয়ে তুই জানিস,আমার একটা গভীর অসুখ হয়েছে?
এই অসুখ বুকের ভেতর গভীরতর অসুখ সৃষ্টি করেছে!
তোর চোখে তাকালে সে অসুখ আমার মনকে অসুস্থ করে দেয়!
মেয়ে তুই জানিস,আমার গভীর সেই অসুখের নাম?
তবে জেনে রাখিস,
তুমিময় অসুখ আমার মনকে গ্রাস করেছে।’
?’হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই আপনার নিয়ামতের বিলুপ্তি, আপনার অনুকম্পার পরিবর্তন, আকস্মিক শাস্তি এবং আপনার সমস্ত ক্রোধ থেকে।’
(আবু দাউদ)
চলবে…ইনশাআল্লাহ!