ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ৩

0
2156

ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ৩
অরিত্রিকা আহানা

মাত্রই আসরের নামাজের সালাম ফিরিয়েছেন নাফিসা রহমান। মুনাজাত ধরবেন তার আগেই নির্ঝর ঘরের পর্দা সরিয়ে বললো,’আসবো মা?’

নাফিসা রহমান মুনাজাত ধরতে গিয়েও থেমে গেলেন। ইশারায় ছেলেকে ভেতরে ঢুকার নির্দেশ দিলেন। মুখ কালো করে ভেতরে ঢুকলো নির্ঝর। খাটের ওপর বসে গম্ভীর গলায় বললো,’তোমার সাথে কিছু জরুরী কথা ছিলো!’

ছেলের গম্ভীর মুখের দিকে চেয়ে নাফিসা রহমান ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। নির্ঝরের আচমকা মুড অফের কোন কারণ তিনি খুঁজে না পেলেন না। একটু আগেও তো ভালো ছিলো! হঠাৎ করে আবার কি হলো? কৌতূহল চেপে রেখে নরম, মোলায়েম কন্ঠে বললেন,’মুনাজাতটা শেষ করে নেই?’

নির্ঝর মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলো। পকেট থেকে ফোন বের করে ফোনে মনোযোগ দিলো সে। নাফিসা রহমান মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজ গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললেন,’তুই কি বলবি বলছিলি?’

-‘হ্যাঁ।’, সচেতনভাবে ফোন পকেটে ঢুকিয়ে নিলো নির্ঝর।

-‘বল।’

ছেলের পাশে খাটের ওপর বসলেন নাফিসা রহমান। নির্ঝরও নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলো। দরজার দিকে উঁকি দিয়ে দেখলো কেউ আছে কি না! তারপর মায়ের একটা হাত ধরে কোনরকম ভনিতা ছাড়াই বললো,’ঐ মেয়েটাকে কি এই বাড়িতে রাখা ঠিক হচ্ছে মা?’

আকস্মিক ছেলের এমন প্রশ্নে নাফিসা রহমান ভেতরে ভেতরে শংকা বোধ করলেন। তাহলে কি এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই ভ্রমরের আচরণে কোন অস্বাভাবাবিকতা নির্ঝরের চোখে ধরা পড়েছে? নতুবা সে এত বিরক্ত কেন? কিন্তু নাফিসা রহমানের চোখে তো তেমন কিছুই পড়লো না। হ্যাঁ! মেয়েটা হয়ত একটু হাসিখুশি কিন্তু অশালীন নয়। ভেতরের উৎকণ্ঠা চেপে রেখে ছেলের কথার জবাবে মৃদু হাসলেন তিনি। হাসিটা বজায় রেখেই বললেন,’ওর নাম ভ্রমর! সম্পর্কে তোর বাবা ওর মামা হন। আপন নয় অবশ্য! ওর মায়ের চাচাতো ভাই।’

‘ভ্রমর’ নামটা মনে মনে আউড়ে নিলো নির্ঝর। নামটাতেই যেন একটা প্রেম কাজ করে! কিন্তু এই প্রেমটাই তো নির্ঝরের আসল সমস্যা। মাকে তো সেটা বুঝতে হবে! হ্যাঁ,এখনো মেয়েটার প্রেমে ঠিক পড়ে নি নির্ঝর, কিন্তু পড়ে গেলে? তখন কি হবে? গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,’হ্যাঁ ভ্রমর। কিন্তু ওকে তুমি এখানে কেন থাকতে বলেছো মা? বাড়িতে আমি আর তুমি ছাড়া তৃতীয় কোন প্রাণী নেই।লোকে শুনলে কি বলবে?’

নাফিসা রহমান বুদ্ধিমতী। এবার ছেলেটা ইঙ্গিতটা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারলেন তিনি। ভেতরে ভেতরে খুশি হলেন। নির্ঝরের জায়গায় অন্য কেউ থাকলে হয়ত এতসহজের প্রশ্নটা করতে পারতো না। মনের কথা মনেই রেখে দিতো। সেই জন্যই ছেলেকে এতটা বিশ্বাস করেন নাফিসা রহমান। আর সত্যি তো! নির্ঝরের কথাগুলো তো ফেলে দেওয়ার মতন না। নির্ঝর এবং ভ্রমরের বয়সী দুটো ছেলেমেয়েকে একবাড়িতে রাখাটা নিশ্চয়ই খুব বুদ্ধিমানে কাজ নয়। কিন্তু নির্ঝরের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা আছে তাঁর। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললেন,’তুই তো জানিস কেউ পড়াশোনার কথা বললে আমি না করতে পারি না?’

নির্ঝর ঠিক বুঝতে পারলো না নাফিসা বেগম কি বোঝাতে চাইছেন। মায়ের মুখ থেকে আরো কিছু শোনার অপেক্ষায় চুপ করে রইলো!
ছেলের উৎসুক মুখের দিকে চেয়ে নাফিসা রহমান একে একে ভ্রমরদের পারিবারিক ইতিহাস সব খুলে বললেন তাঁকে। সব শুনে নির্ঝর অবাক হয়ে মায়ের দিকে চেয়ে রইলো! ভ্রমরকে দেখলে কোনভাবেই বোঝার উপায় নেই তাদের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড এতটা হতাশাজনক! নাফিসা রহমান ছেলের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে অনেকটা, কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতেই বললেন,’ভ্রমরের বাবা বলছিলো ওদের বাসা থেকে নাকি ভ্রমরের কলেজ খুব দূর হয়ে যায় তাই ভাবলাম আসা যাওয়ার সমস্যার কারণে যদি মেয়েটার পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়? ওদের তো আবার ভরসা নেই! কিংবা হুট করে ধরে মেয়ের বিয়েও দিয়ে দিতে পারে। তাছাড়া, মেয়েমানুষ রোজ রোজ জার্নি করলে অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনাও আছে। তাই ভাবলাম,আমাদের নিচের ঘরগুলোতো খালিই পড়ে আছে। ও থাকলে ক্ষতি কি?’

-‘কিন্তু মা..?’

নাফিসা রহমান ছেলেকে থামিয়ে দিলেন। সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,’তোকে এত ভাবতে হবে না। আমার ছেলের ওপর আমার পূর্ন বিশ্বাস আছে। আমি জানি, আমার ছেলে কোন ভুল কাজ করবে না।’

নির্ঝরের আর কিছু বলার বাকি রইলো না। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। নিজের প্রতি মায়ের এমন অটুট বিশ্বাসেই তাঁর এত ভয়ের কারণ। এই বিশ্বাসটা যেন কোনভাবেই না ভাঙ্গে তার জন্য পূর্বসতর্কতা হিসেবেই ভ্রমরের থাকা নিয়ে এত বেশি আপত্তি করেছিলো সে। কারণ, মানুষের মন চির পরিবর্তনশীল! এই পরিবর্তনের ওপর কারো হাত নেই! ভালোবাসার ওপরেই নেই! কিন্তু এইমাত্র মা যখন দ্বিধাহীনভাবে নিজের ভরসার কথা জানালেন তখন মনে মনে, মাথা থেকে অন্যসব চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেলার সংকল্প করে ফেললো সে। মায়ের জন্য হলেও এই বাড়ির সম্মানে কোনরকম আঘাত লাগতে দেওয়া যাবে না। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো। নাফিসা রহমান পুনরায় ছেলের হাত চেপে ধরলেন। মায়ের দিকে ফিরলো নির্ঝর। ইশারায় জানতে চাইলো,’কি?’

-‘আমি কি কোন ভুল করেছি? আমার ছেলে আমার বিশ্বাস রাখবে তো?’

নাফিসা রহমান এমন একজন অভিজাত মহিলা যিনি অল্প বয়সে স্বামী মারা যাওয়ার পরে সমস্ত ব্যবসাবাণিজ্য সব একা হাতে সামলেছেন কিন্তু তাঁর চালচলনে কেউ কোনদিন এতটুকু খুঁত ধরতে পারে নি। চারিত্রিক দিক থেকে একেবারে স্বচ্ছ জলের মত পরিষ্কার এই মহিলা! তাঁর শালীন, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্বের জন্যই আত্মীয়স্বজন সবার কাছে অত্যন্ত সম্মানীয়া তিনি। তাই ছেলের কাছ থেকে পাকাপোক্ত ভাবে কথা আদায় করে নিতে চাইলেন। কারণ তিনি জানেন তাঁর ছেলে কখনো তাঁর কাছে দেওয়া কথার বরখেলাপ করবে না। নির্ঝর হাসলো। মায়ের শান্ত, কোমল, মায়াময়ী মুখের দিকে চেয়ে বললো,’রাখবে! নিশ্চয়ই রাখবে।’

ছেলের মুখ থেকে এমন কিছু শোনার প্রত্যাশাতেই ছিলেন নাফিসা রহমান। স্বস্তির হাসি হাসলেন। ছেলের হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিয়ে বললেন,’আয়! তোর মাথায় বিলি কেটে দেই।’
নাফিসা রহমানের প্রস্তাব এইমুহূর্তে অনেকটা ঘুষ দেওয়ার মত মনে হলো নির্ঝরের কাছে। হাসি পেলো তাঁর। কোনরকম প্রতিবাদ করলো না। চোখ থেকে চশমা খুলে খাটের পাশে রেখে মায়ের কোলে মাথা দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো। নাফিসা রহমান যত্নসহকারে ছেলের মাথায় বিলি কেটে দিতে লাগলেন।

মাগরিবের নামাজের কিছুক্ষন আগে চা নিয়ে নাফিসা বেগমের ঘরে ঢুকলো ভ্রমর। নাফিসা রহমান বারান্দায় তছবীহ্ পড়ছেন। তাঁর বিছানায় পাশ বালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে নির্ঝর। গতকাল রাতে মাত্র দুঘন্টা ঘুমিয়েছিলো সে। নাফিসা রহমান চুলে বিলি কেটে দিতেই আরামে ঘুমিয়ে পড়লো।

নাফিসা রহমান বারান্দার দরজার দিকে পিঠ দিয়ে বসায় ভ্রমরের উপস্থিতি টের পান নি। সেই সুযোগে ভ্রমর স্থিরভাবে কিছুক্ষন নির্ঝোরের পরিশ্রান্ত মুখের চেয়ে থেকে বারান্দায় চলে গেলো। চায়ের কাপটা নাফিসা রহমানের হাতে দিয়ে ইশারায় নির্ঝরকে ইঙ্গিত করে বললো,’উনি এইসময় ঘুমাচ্ছেন যে? একটুপর তো আযান দেবে?’
নাফিসা রহমান চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন,’ঘুমাক। আযান দিলে, তুলে দেবো। সারারাত ঘুমায় নি।’

ভ্রমর চুপ করে গেলো। নাফিসা রহমানের সাথে খুব বেশি মেশার সুযোগ হয় নি তাঁর। ইনফেক্ট এখানে আসার আগেই সে কোনদিন দেখেই নি ভদ্রমহিলাকে। তাই খানিকটা আড়ষ্টতা কাজ করছে। সেটা দূর করতেই নতুন করে কথা পাড়লো সে,’আপনারা নায়লার বউভাতে যাবেন না?’

-‘যাবো। কেন তুই যাবি না?’

নাফিসা রহমান মুখ থেকে হঠাৎ করে তুই ডাকটা শুনে খুশি হলো ভ্রমর। ডাকটা অনেক বেশি আন্তরিক। এতক্ষন খুব আড়ষ্ট লাগছিলো, কিন্তু এখন আর লাগছে না। ডাকটা শুনেই যেন সব আড়ষ্টতা কেটে গেছে! নাফিসা রহমান ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বললেন,’তুই করে বলেছি বলে মাইন্ড করিস নি তো আবার?’

-‘মোটেই না। বরং খুশি হয়েছি!’

নাফিসা বেগম মুচকি হাসলেন। কৃত্রিম অবিশ্বাসের সুরে বললেন,’সত্যি খুশি হয়েছিস কি না কে জানে। আজকালকার ছেলেমেয়েদেরকে তো আবার তুই বললে আত্মসম্মানে লাগে!’

জবাবে ভ্রমরও মিষ্টি করে হাসলো। বললো,’এমন করে বলছেন যেন আপনি খুব বুড়ো হয়ে গেছেন?’

-‘হয়নি আবার। কদিন পর ছেলে বিয়ে দেবো। আমার কি আর দিন আছে!’

‘নির্ঝরের বিয়ে?’ মনে মনে অবাক হলো ভ্রমর! কিন্তু আবার মনে হলো, অসম্ভব তো নয়? মাস্টার্সের সেমিস্টার ফাইনাল দিচ্ছে নির্ঝর। খুব বেশি বয়স না হলেও বিয়ে করিয়ে দেওয়ার মতন বয়স হয়েছে তাঁর! নাফিসা রহমানের কথাটা অমূলক নয়। কিন্তু তিনি কি বিষয়টা নিয়ে বাস্তবিকই গম্ভীরভাবে ভেবে কথা বলেছেন নাকি নেহায়েত ঠাট্টা করে বলেছেন। যদি সত্যি সত্যি বলেন তবে? হঠাৎ করেই যেন একটা ধাক্কা খেলো ভ্রমর! বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করে উঠলো। নির্ঝরকে ভ্রমর ভালোবাসে কি না তা ভ্রমর নিজেও জানে না। এমনকি ভালোবাসা এত তাড়াতাড়ি, এত সহজে হয় কি না তাও জানে না। কিন্তু নির্ঝরের কথা শুনলেই তার বুকের ভেতর অদ্ভুত রকমের এক উত্তেজনা শুরু হয়ে যায়। তাঁর কথা ভাবলে মনে অজান্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠে। না দেখেই মানুষটার সান্নিধ্য কামনা করেছিলো সে। কিন্তু দেখার পর থেকে সেই চাওয়া আরো বেড়ে গেছে। আরো বেশি করে নির্ঝরের সান্নিধ্য চায় সে।

নাফিসা রহমান নিজের কথা চালিয়ে গেলেন। কথার ফাঁকে ফাঁকে তছবীহ্ও গুনছেন। তাঁর পরের কথাগুলো খুব চেষ্টা করেও মাথায় ঢোকাতে পারলো না ভ্রমর! মাথায় শুধু ঘুরছে ‘নির্ঝরের বিয়ে!’ উপায়ান্তর না জোরপূর্বক একটা হাসির রেশ টেনে নিলো মুখে। খালি চায়ের কাপ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’আমি যাই!’

-‘শোন?’

থমকে গেলো ভ্রমর। কিন্তু পেছন ফেরার সাহস হলো না। পাছে নাফিসা রহমান তার বিব্রত মুখ দেখে ফেলেন। কাপ হাতে নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো সে। নাফিসা রহমান অবশ্য এতকিছু খেয়াল করলেন না। তিনি খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললেন,’আমাকে আপনি করে বলার দরকার নেই। তুমি করে বলবি।’ কথা শেষ করে পুনরায় তছবীহ্ পড়ায় মনোযোগ দিলেন তিনি। ভ্রমর স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় খুব সন্তর্পণে একবার নির্ঝরের ঘুমন্ত মুখ খানার দিকে চাইলো! পলকেই আবার ধুপধুপ শুরু হলো বুকের ভেতরটায়! ঝিমঝিম করে উঠলো সমস্ত শরীর!
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here