ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ৮

0
2288

ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ৮
অরিত্রিকা আহানা

ভ্রমর চলে গেছে আজকে একমাস দুইদিন। এর মাঝে আর একবারের জন্যেও নাফিসা রহমান কিংবা নির্ঝরের সাথে দেখা হয় নি তাঁর। বাসা থেকেই কলেজে যাওয়া আসা করে। এদিকে বাড়ির সবাই তাকে নিয়ে অস্থির। হঠাৎ তাঁর কি হয়েছে কেউই বুঝতে পারলো না। হাজার চেষ্টা করেও ঐ বাড়ির সম্পর্কে মেয়ের মুখ থেকে একটা কথাও বের করতে পারেন নি বোরহান সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী। যতবারই জিজ্ঞেস করেছেন ভ্রমরের এক জবাব, ঐ বাড়িতে সে আর যাবে না সে। দরকার হলে হোস্টেলে উঠবে। কিন্তু ঐ বাড়িতে আর না!
শেষমেশ ভ্রমরের মেজোভাবী রেহানা সফল হলো। কৌশলে ভ্রমরের মুখ থেকে কথা বের করে ফেললেন তিনি। ব্যবসা কাজে ভ্রমরের মেজো ভাই রাসেল বাড়িতে না থাকায় সেদিন রাতে রেহানার কাছে শুয়েছিলো ভ্রমর। রেহানা চাপাচাপি করতেই নির্ঝরের কথা একে একে সব খুলে বললো তাঁকে। কথা শেষ করেই ডুঁকরে কেঁদে উঠে বললো,’জীবনে অনেক মানুষ দেখেছি ভাবী কিন্তু এমন পাথর মানুষ দেখি নি!
সব শুনে রেহানা গম্ভীর গলায় বললেন,’সবই ঠিক আছে। কিন্তু রাতের বেলা তাঁর ঘরে গিয়ে কাজটা তুই ভালো করিস নি। ওরা কি এখন আর তোকে ভালো দেখবে? ছেলেটার চোখেও তো ছোট হয়ে গেলি?’ ভ্রমর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কান্নাভেজা গলায় বললো,’আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম ভাবী। উনি আমাকে পুরো পাগল করে দিয়েছিলেন। এখনো উনার কথা মনে পড়লে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সেইজন্যই তো আর ঐ বাড়িতে যেতে চাই না।’
রেহানাও আর কথা বাড়ালো না। যুবতী বয়সে মেয়েদের আবেগ জিনিসটা বড্ড খারাপ! সহজে দমন করা যায় না! ভ্রমরকে শান্ত করে শুইয়ে দিলো।
পরেরদিনই চুপিচুপি শ্বশুরশাশুড়িকে ডেকে বুদ্ধি দিলো,’ভ্রমরকে আর ধরে রাখা ঠিক হবে না। আপনারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভরব ওর বিয়ের ব্যবস্থা করুন। ওর মনের অবস্থা ঠিক নেই, কখন কি অঘটন ঘটিয়ে ফেলে?’ মুখে না বললেও শাশুড়িকে ইশারায় নির্ঝরের ব্যপারে আলাপ করার পরামর্শই দিলো সে। ছেলের বউয়ের কথামত ভ্রমরের মা সেটা আবার বোরহান সাহেবের কানে তুললেন। স্ত্রীর কাছ থেকে আভাস পেয়ে বোরহান সাহেব মনে মনে খুশিই হলেন। যাক ভ্রমরেরও তাহলে নির্ঝরকে পছন্দ! এবার তাহলে প্রস্তাবটা দেওয়া যায়!

নির্ঝরের মাস্টার্সের রেজাল্ট বেরিয়েছে। এবারেও সর্বোচ্চ সিজিপিএ তাঁর। ফোর আউট অফ ফোর। ডিপার্টমেন্টে হাইয়েস্ট পার্সেন্টেজ অফ মার্কস নিয়ে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে সে। বর্তমানে তাঁর পিএইচডির প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটছে।। রোজ ক্যাম্পাস, ইন্সটিটিউটে দৌড়াদৌড়ি। দম ফেলার সময় নেই। নাফিসা রহমানও এক এক করে ছেলের জিনিসপত্র সব গোছাতে শুরু করেছেন। হুট করে যদি সবকিছু ফাইনাল হয়ে যায় তবে ঠিকমত গোছগাছের সময় আর পাবেন না। শেষে আফসোস হবে! তাই তিনি নিজের হাতে ছেলের সব গুছিয়ে দিচ্ছেন।
বিদেশে নিজের কাজ নিজেই করতে হয়। সেই জন্য ছেলের হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে টুকটাক কেনাকাটাও করছেন তিনি। বিশেষ কিছুই না, জাস্ট কাজ চালানোর মত খুঁটিনাটি কিছু জিনিসপত্র! নির্ঝর অবশ্য এসব কিছুই জানতো না। নাফিসা রহমানই একদিন খুব উৎসাহের সহিত ছেলেকে ডেকে নিয়ে দুটো বড় বড় লাগেজ দেখিয়ে বললেন,’তোর সব জিনিসপত্র আমি গুছিয়ে দিয়েছি। সময় করে দেখে নিস, কিছু বাদ পড়েছে কি না?’

লাগেজের ওজন এবং আয়তন দেখে নির্ঝর বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলো। মায়ের মুখের দিকে চেয়ে সকৌতুকে হেসে উঠে বললো,’মা। পুরো নাহিদ ম্যানশন পুরোটাই লাগেজে ঢুকিয়ে দিয়েছো নাকি? আমার বইপুস্তক সব বাকি রয়ে গেছে। এত কি দিয়েছো তুমি ?

-‘তোর জামাকাপড়, গামছা, শেভিংবক্স, ফার্স্ট এইড বক্স, ইলেক্ট্রিক হিটার, মাঝেমাঝে যেন নিজে রান্না করে খেতে পারিস তার জন্য ছুরি, চপার, একটা ইলেক্ট্রিক চুলা আর ছোট ছোট কয়েকটা পাতিল! আর তোর টুকটাক জিনিসপত্র ব্রাশপেস্ট, চিরুনি…. ‘

নির্ঝর হাসলো। তার মায়ের মত একজন বিচক্ষণ মহিলা ব্যাগে হাড়িপাতিল দিয়েছে? মায়েরা এমন হয় কেন? নাফিসা রহমান ছেলেকে হাসতে দেখে রাগ করে বললেন,’আমি জানি বিদেশে এসব কেউ নেয় না। কিন্তু তুই কোথায় খুঁজবি?’

তিনি এত কষ্ট করে কিনে এসেছেন অথচ নির্ঝর ঠাট্টা করছে? রাগ সামলাতে না পেরে বেশ জোরেসোরেই কথাগুলো বললেন তিনি। নির্ঝর সেটা বুঝতে পেরে দুহাতে পেছন থেকে কাধ জড়িয়ে ধরলো তাঁর। মিষ্টি হেসে নরম গলায় বললো,’আমি জানি, এগুলো দরকারি জিনিসপত্র। কিন্তু ছুরি,কাঁচি তো প্লেনে এলাউ করবে না। এয়ারপোর্টেই বাতিল হয়ে যাবে। তাছাড়া ইলেক্ট্রিক জিনিসপত্র তো বিদেশী সুপারশপ গুলোতে খুঁজলেই পাওয়া যাবে। তুমি খামোখা টেনশন করছো!’

-‘এখান থেকে নিয়ে গেলে কি সমস্যা? তুই তো হাতে করে নিচ্ছিস না? পার্সেলে যাবে।’

-‘সেটা ঠিক আছে। কিন্তু লাগেজ এলাউয়েন্স যে নির্দিষ্ট? এলাউয়েন্স অনুযায়ী প্রত্যেকটা লাগেজে নির্দিষ্ট অ্যামাউন্টের বেশি ওয়েট ক্যারি করা যাবে না। এসবের জন্য পরে দেখা যাবে আমার দরকারি বইপুস্তক নেয়ার জায়গা হবে না।’

নাফিসা রহমান এবার সমস্যাটা বুঝলেন।।চিন্তিতমুখে বললেন,’তাহলে?’

মায়ের চিন্তিমুখের দিকে চেয়ে নির্ঝর মুচকি হেসে বললো,’তাহলে আর কি? আমি সময় করে দেখে তোমাকে বলবো কি কি বাদ দিতে হবে। সেই অনুযায়ী আবার গুছিয়ে দিও।’
নাফিসা রহমান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বললেন,’ঠিক আছে।’

এদিকে ভ্রমরের বাবা বোরহান সাহেব তাঁর এক শ্যালক বরকত উল্লাহর মাধ্যমে নাফিসা রহমানের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী সালেহা যেহেতু সম্পর্কে নির্ঝরের ফুপু হোন সেই হিসেবে বরকত উল্লাহ দুই পরিবারেরই আত্মীয়। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ঘটকালি করছেন তিনি। যদিও সেটা কেবল নামেমাত্র, মূলত বোরহান সাহেবের নির্দেশেই নির্ঝরের সঙ্গে ভ্রমরের প্রস্তাবটা নিয়ে এসেছেন তিনি।

বরকত উল্লাহর কাছ থেকে প্রস্তাবটা শুনে খানিক্ষনের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন নাফিসা রহমান। এতদিন তিনি ভেবেছিলেন এসব ভ্রমরের ছেলেমানুষি! এই বয়সের মেয়েদের এরকম একটু আধটু হয়! কিন্তু এখন দেখছেন পুরো ফ্যামিলি তাঁর ছেলের পেছনে লেগেছেন। ভেতরে ভেতরে অসন্তুষ্ট হলেন তিনি। বোরহান সাহেবের কাছ থেকে এমন ব্যবহার মোটেই আশা করেন নি। বিশ্বাস করে তাঁর মেয়েকে নিজের বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার বিপরীতে এমন প্রস্তাব কোনভাবেই কাম্য ছিলো না। নাফিসা রহমান ভ্রমরকে যতই ভালোবাসুক, নিজের ছেলের ভবিষ্যতের চাইতে সেই ভালোবাসা কখনোই বড় হতে পারে না। তাছাড়া আত্মীয় স্বজন সবার কাছে তাঁর একটা সম্মান আছে। তাঁর ছেলের বউ হবে অর্ধশিক্ষিত একটা মেয়ে যার পরিবারের কেউ লেখাপড়া জানে না এই কথা জানার পর আত্মীয়স্বজন সবার কাছেই ছোট হয়ে যাবেন তিনি। আবেগ যতই বড় হোক না কেন, সেটা দিয়ে জীবন চলে না। জীবনে চলতে হলে বাস্তবতাকে মেনে নিতে হয়! যারা মেনে নিতে পারে না তাদের জন্য বাস্তবতা বড়ই কঠিন! নাফিসা রহমান এমন ভুল করবেন না।
তথাপি বরকত উল্লাহর বক্তব্য শুনে উচ্চবাচ্য করলেন না তিনি। খুবই শান্ত গলায় মাথা ঠান্ডা রেখে বললেন,’ভ্রমর মাশাআল্লাহ খুব লক্ষ্মী মেয়ে। ওকে আমার নির্ঝরের বউ করতে পারলে তো আমি খুশিই হতাম কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এত তাড়াতাড়ি তো নির্ঝর বিয়ে ধরার কোন খেয়াল আমার নেই। ভ্রমর সুন্দরি, লক্ষ্মী মেয়ে ওর জন্য ছেলের অভাব হবে না। এই তো কয়দিন আগেও আমার কাছেই ওর জন্য প্রস্তাব এসেছে। ছেলে ডাক্তার। এফসিপিএস করছে। ছেলের বয়স একটু বেশি দেখে ভাইসাহেব বারণ করে দিয়েছেন।’

বরকত উল্লাহ হেসে উঠে বললেন,’শুনেছি আমি, বুবু আমাকে সব বলেছে। ছেলের বয়স বেশি তাছাড়া ছেলের মায়েরও রেকর্ড ভালো নয়। ভদ্রমহিলা নাকি খুবই বদরাগী। তাই বুবু বারণ করে দিয়েছেন। তাছাড়া আমাদের ভ্রমর তো আর ফেলে দেওয়ার মতন নয়। রূপে গুণে সব দিক দিয়েই লক্ষ্মী। আর পাত্র যখন হাতের কাছেই আছে তাই আমি ভাবলাম প্রস্তাবটা দিয়ে দেখি। ভাবীতো ভ্রমরকে নিজে চোখেই দেখেছেন।

নাফিসা রহমান সম্মতি সূচক মাথা নাড়লেন। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বরকত উল্লাহ নিজের কথার রেশ টেনে বললেন,’নির্ঝরও তো আমাদের চোখের সামনে বড় হয়েছে, ভদ্র ছেলে। পড়াশোনাও ভালো। সম্বন্ধটা হলে বোধহয় খারাপ হতো না?’

নাফিসা রহমান বুদ্ধিমতী, তবুও কথার মারপ্যাঁচে তাঁকে আটকে দিতে চাইছেন বরকত উল্লাহ। কিন্তু তিনি জানেন নাফিসা রহমান এত সহজে বাগে আসার মতন পাত্রী নন। পুরো একটা ব্যবসা নিজের হাতে চালান তিনি। কোথায় কি বলতে হবে সেটা খুব ভালো করেই জানেন তিনি। বরকত উল্লাহর কথার জবাবে খুব সাবধানে পাশ কাটিয়ে গিয়ে বললেন,’সেটা তো আমিও জানি। আমি তো আপনাকে বললামই আমার নির্ঝরের জন্য আমি ভ্রমরের মত একটা মেয়েই খুঁজছি। একমাত্র ছেলের বউ হিসেবে টুকটুকে সুন্দর একটা মেয়েই ঘরে আনবো! কিন্তু সমস্যা হলো নির্ঝরের মামা, চাচারা কেউ আত্মীয়র ভেতরে সম্বন্ধ করতে রাজী নয়। বিয়ে শাদীর ব্যপারে তো আমার একার সিদ্ধান্তে হবে না।আত্মীয়স্বজনদেরও মতামত লাগবে। নির্ঝরের বাবা নেই, চাচারা মামারাই তো ওর মেইন গার্জিয়ান। আমি মহিলা মানুষ আর কতদিক সামলাবো! তাছাড়া এত সকাল ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার কোন চিন্তাভাবনাও নেই আমার। সবে পাশ করেছে, নিজের পায়ে দাঁড়াক। তারপর নাহয় এসব ভাবা যাবে। কিন্তু পরের মেয়েকে কতদিন আটকে রাখবো?

বরকত উল্লাহ্‌ও নাছোড় বান্দা। এত সহজে তিনি নাফিসা রহমানকে ছেড়ে দেবেন না। মুচকি হেসে বললেন,’সেরকম হলে নাহয় এ্যাংগেইজমেন্ট করিয়ে রাখলেন?’

প্রশ্নটা শেষে বরকত উল্লাহ্ ‘এবার কি উত্তর দেবেন ভাবীসাহেবা?’ টাইপ একটা দৃষ্টি নিয়ে নাফিসা রহমানের দিকে চাইলেন। নাফিসা রহমান উত্তেজিত হলেন না। বরাবরের মতই মৃদু হেসে শান্ত, স্থির গলায় বললেন,’সেটা করিয়ে রাখা যায়। কিন্তু এতদিন কোন ভরসায় আমি আপনাদের আশা দিয়ে রাখবো? আগামী তিনচার বছরের মধ্যে নির্ঝরের বিয়ে নিয়ে কোন চিন্তাভাবনা নেই আমার। তাই, এখন আমি আপনাদের আশা দিয়ে রাখলাম, এংগেইজম্যান্ট করে রাখলাম, কিন্তু পরে যদি ছেলের মত না হয়? ছেলে যদি বিয়েতে রাজি না হয়? তিনচার বছর তো কম সময় নয়?দেশে থাকলেও নাহয় একটা কথা ছিলো কিন্তু আমার চোখের সামনে তো আর থাকছে না? খুব শীঘ্রই ইনশাআল্লাহ পিএইচডি করতে বাইরে যাবে। এতদিন কোন ভরসার আমি মেয়েটাকে ধরে রাখবো? তাছাড়া ভ্রমর পড়াশোনা করছে করুক না। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার দরকার টা কি? আর যদি সেরকম ইমার্জেন্সী হয় তাহলে নাহয় আমি নিজেও খোঁজখবর নিয়ে আপনাদেরকে জানাবো। দুচারটা ভালো ছেলে আমার হাতেও আছে।’

বরকত উল্লাহ নাফিসা রহমানের পরের প্রস্তাবেটাতে তেমন উৎসাহিত বোধ করলেন না। ঘুরে ফিরে আলোচনা নির্ঝরের দিকেই নিয়ে গিয়ে বললেন,’নির্ঝর আপনার বাধ্য ছেলে ভাবী। আপনার পছন্দের ওপরে সে আপত্তি করবে না এইটুকু আত্মবিশ্বাস আমাদের আছে।’

-‘সেটা তো আমিও জানি ভাইসাহেব। আমার ছেলের ওপর আমার পূর্ণ আত্মবিশ্বাস আছে। সে আমার কথার বাইরে যাবে না। কিন্তু তবুও, বিয়ের শাদীর ব্যপারে রিস্ক নেওয়া টা ঠিক হবে বলে আমি মনে করি না।’

মামুন উদ্দিন হতাশ মুখে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর চেষ্টা তিনি করে ফেলেছেন। আর সম্ভব নয়! এই মহিলাকে সহজে বাগে আনা সহজ কথা নয়। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,’ঠিক আছে আমি তাহলে আসি ভাবী?’

নাফিসা রহমানও হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে বললেন,’জি! আবার আসবেন। আর ভাই সাহেবকে বলবেন আমি তাঁকে সালাম জানিয়েছে।’

নির্ঝর খাটের ওপর আধশোয়া হয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির সুবিধা, অসুবিধাগুলো ঘাটাঘাটি করছিলো। সেখানকার বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি গুলোতে পড়াশোনার মান, এক্সপেনসেস কেমন এসব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো সে। নাফিসা রহমান ছেলের ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে বললেন,’আসবো?’ নির্ঝর পা ভাঁজ করে সোজা হয়ে বসলো। হাসিমুখেই বললো,’এসো।’

নাফিসা রহমান ভেতরে ঢুকে খাটের ওপর বসলেন। কৌতূহলী চোখে একবার ল্যাপটপের খোলা স্ক্রিনের দিকে চেয়ে উশখুশ করে বললেন,’ব্যস্ত তুই?’

-‘না। এমনি একটু নেটে ঘাটাঘাটি করছিলাম।… কেন? তুমি কিছু বলবে?’

-‘হ্যাঁ। একটু কথা ছিল তোর সাথে।’

নির্ঝর কোলের ওপর থেকে ল্যাপটপ সরিয়ে নিলো। চশমার ফ্রেমটা ঠিক করে উৎসাহী কন্ঠে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে বললো,’বলো।’

নাফিসা রহমান ইতস্তত করলেন। কথাটা ছেলের কাছে বলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছেন না। আবার লুকাতেও চাইছেন না। শেষমেশ বলেই ফেললেন,’ভ্রমরের মামা এসেছিলো কিছুক্ষণ আগে!’

নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে ফেললো। এই বাড়িতে হঠাৎ ভ্রমরের মামার আগমনের কি কারণ থাকতে পারে সে বুঝতে পারলো না। উৎসুক দৃষ্টিতে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। নাফিসা রহমান ছেলের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মোলায়েম কন্ঠে বললেন,’তাঁরা তোর ব্যপারে আগ্রহী।’ তারপর কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললেন,’ আমি বারণ করে দিয়েছি!’

নির্ঝর অবাক হলো! চশমার ফ্রেমটা পুনরায় সোজা করে নিলো সে। প্রস্তাবটা যে ভেতরে ভেতরে নাফিসা রহমানকে হতাশ করেছে সেটা তাঁর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। নির্ঝর নিজেও হতাশ হলো! ভ্রমরের তাহলে সত্যিই পড়াশোনা করার কোন ইচ্ছে নেই? এত সহজে হাল ছেড়ে দিলো মেয়েটা? খুব সহজেই নিজের দীর্ঘশ্বাসটা গোপন করে নিলো সে। মায়ের গম্ভীর মুখের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বললো,’তো এসব কথা আবার আমাকে বলার দরকার কি ছিলো? তোমার পছন্দ হয় নি তুমি না করে দিয়েছো, এখানে আমি কি বলবো? বিয়েশাদীর ঝামেলায় আমাকে জড়ানোর কোন প্রয়োজন আছে বলে তো আমি মনে করি না!’ পুনরায় ল্যাপটপটা তুলে কাজে মনোযোগ দিলো সে। নাফিসা রহমানের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এইমুহূর্তে ছেলের মুখ থেকে ঠিক এমন কিছু শোনার প্রত্যাশাতেই ছিলেন তিনি। বরকত উল্লাহর বলা একটা কথা তখন খুব মনে ধরেছিলো তাঁর একেবারে কলিজায় গিয়ে লেগেছিলো। ‘নির্ঝর কখনো তাঁর মায়ের অবাধ্য হতে পারে না!’ কথাটা শোনার পরই খুশিতে বুকটা ভরে গিয়েছিলো তাঁর। একজন মায়ের জন্য এর চাইতে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে? তবুও নিতান্ত কৌতূহলবশতই নির্ঝরকে খানিকটা পরীক্ষা করে দেখতে চাইছিলেন তিনি। জবাবে নির্ঝিমর যা বলেছে তা শোনার পর প্রত্যাশার চাইতে অনেক বেশি উচ্ছ্বাসিত হয়েছেন তিনি। তাঁর আত্মসম্মানী মুখখানায় দেখা দিলো হাজার পাওয়ারি হাসির ঝলক। সস্তির নিশ্বাস ফেললেন তিনি। উচ্ছ্বাস চেপে রেখে সচেতন গলায় বললেন,’আমাকে খুশি করার জন্য বলছিস না তো?’ নির্ঝর ছোট শিশুদের মত মিষ্টি করে হাসলো। নাফিসা রহমানের মনে হলো পৃথিবীতে এর চাইতে পবিত্র, এর চাইতে শুদ্ধ হাসি আর কিছু হতেই পারে না। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন ছেলের নয়নকাড়া সুন্দর মুখখানা দিকে। নির্ঝর মায়ের কোলে শুয়ে দুষ্টু হেসে বললো,’তোমাকে খুশি করার জন্যই তো বলেছি। নতুবা আমার বন্ধুরা সবাই বিয়ে করে ফেলছে, খালিই আমিই বাদ আছি।’ কথা শেষ করে নিজেই হো!হো! করে হেসে উঠলো সে।
নাফিসা রহমান কৃত্রিম শাসনের সুরে চোখ পাকিয়ে তাঁর পিঠে আলতো চড় মেরে বললেন,’বদমাইশ। বিয়ে করে বউকে খাওয়াবি কি? তোকেও খাওয়াচ্ছি, তোর বউকেও খাওয়াবো?’

নির্ঝর হাসলো। বললো,’আমি তো তোমার জন্যই বলছিলাম। তুমি সারাদিন বাসায় একা থাকো।’

-‘থাক। তোমার আর আমার কথা ভেবে কাজ নেই। তুমি মন দিয়ে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাও তাতেই হবে। আজ হোক, কাল হোক বউ তো আসবেই।’

জবাবে নির্ঝর একটুখানি হেসে উঠে পড়লো। ল্যাপটপ নিয়ে নতুন করে অন্য একটা ওয়েবসাইটে ঢুকলো সে। তাঁর মনের ভেতর কি চলছে সেসব নাহয় থাক! আপাতত ক্যারিয়ারের দিকে ফোকাস করতে হবে তাঁকে। তাই ব্যপারটাকে ইচ্ছে করে হালকা করে দিয়েছে সে। নাফিসা রহমান সস্নেহে ছেলের মুখের দিকে চেয়ে মুচকি হাসলেন। আর কোন চিন্তা নেই তাঁর। মুচকি হেসে বললেন,’প্রথমে আমিও একবার ভেবেছিলাম তোকে জানাবো না। কিন্তু পরে ভাবলাম, নাহ! বলি। দেখি আমার ছেলে কি জবাব দেয়?’

নির্ঝর নিঃশব্দে ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভেসে উঠা লিখাগুলো পড়তে পড়তে বললো,’ ভালো করেছো। তবে সামনের দিকে এইসব বিয়েশাদীর আলোচনা আমার পর্যন্ত টেনে আনার দরকার নেই। তোমার পছন্দ না হলে ডিরেক্ট বিদেয় করে দেবে! ব্যস! কাহিনী খতম! নাফিসা রহমান হেসে উঠে বললেন,’বিদেশে গিয়ে এসব মনে রাখলেই হলো।’
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here