ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ১১
অরিত্রিকা আহানা
আজকে ভ্রমরের গায়ে হলুদ। বিরাট আয়োজন করেছেন বোরহান সাহেব। বিয়ের সপ্তাহ খানেক আগেই পুরোবাড়ি লাইটিং করিয়েছেন। বিয়ের গেট সাজিয়েছেন সর্বমোট পনেরোটা। বাড়ি সামনে থেকে এককিলোমিটার পর্যন্ত রাস্তায় লাইটিং এর আলোয় ঝলমল করছে। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের কলরবে সাড়াবাড়ি মুখরিত! মোটকথা আয়োজনে কোন কমতি রাখেন নি তিনি।
সন্ধ্যা ছয়টা নাফিসা রহমান রেডি হয়েছেন হলুদের অনুষ্ঠানের যাওয়ার জন্য। ছেলের ঘরে এসে দেখলেন নির্ঝর চুপচাপ পড়ার টেবিলে বসে আছে। সামনে বই খোলা রাখা! নাফিসা বেগম অবাক হয়ে বললেন,’কি রে তুই যাবি না?’
মায়ের ডাক শুনে ঘাড় ঘুরালো নির্ঝর। চাপা কন্ঠে বললো,’না। তুমি যাও!’
নাফিসা রহমান সন্দেহের দৃষ্টিতে ছেলের মুখের দিকে চাইলেন। চিন্তিতমুখে বললেন,’কি হয়েছে তোর? মুখটা এমন লাগছে কেন? শরীর খারাপ?’
ছেলের জবাবের অপেক্ষা না করে কাছে এসে কপালে হাত দিয়ে, জ্বর চেক করলেন তিনি। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। তথাপি শান্ত হয়ে বসে আছে নির্ঝর। ছেলের এমন চাপা স্বভাবে বিরক্ত হলেন নাফিসা রহমান। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে অথচ বই নিয়ে বসে আছে! ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন,’হঠাৎ করে এত জ্বর এলো ব্যপার কি? এলো কখন থেকে? আমাকে বলিস নি কেন?’
নির্ঝর জবাব দিলো না। যেমনি বসে ছিলো তেমনি বসে রইলো। নাফিসা রহমান টেনে তাঁকে পড়ার টেবিল থেকে উঠিয়ে বললেন,’এখানে এমনভাবে বসে আছিস কেন?’
-‘এমনি। ভালো লাগছে না!’
-‘তোকে কি জিজ্ঞেস করেছি শুনেছিস?’
-‘কি?’
-‘জ্বর কখন থেকে?’
-‘কি জানি।’
-‘ঠান্ডা লাগিয়েছিস?’
মায়ের জেরার সম্মুখে পড়ে নির্ঝর ভেতরে ভেতরে টেনশনে পড়ে গেলো। জ্বরের তাপে লাল হয়ে থাকা শুষ্ক ঠোঁটদুটো কিঞ্চিৎ প্রশস্ত করে মুচকি হাসার চেষ্টা করলো সে। সাবধানি গলায় বলল,’কাল রাতে ঘুম হয় নি। তাই বোধহয় শরীর গরম! নাপা আছে না তোমার ঘরে?’
-‘আছে!’
-‘দাও, একটা খাই। এমনিই কমে যাবে!’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নাপা আনতে বেরিয়ে গেলেন নাফিসা রহমান। কিন্তু মনের সন্দেহ দূর করতে পারলেন না। তার ছেলে খাচ্ছেদাচ্ছে, ঘুরছে ফিরছে,স্বাভাবিক ভাবেই চলা ফেরা করছে। কিন্তু কোথায় যেন একটা ছন্দপতন হয়েছে। নির্ঝরের মুখের দিকে তাকালে বুঝতে পারেন তিনি। মায়ের চোখ ফাঁকি দেওয়া এত সহজ নয়! নির্ঝর অবশ্য চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখেন নি। তাই এতদিনে ছেলের মনের কথা ঘুণাক্ষরেও টের পান নি তিনি। কিন্তু মনের ওপর জোর পড়লে যে শরীরেরও ওপরেও পড়ে? তাছাড়া রাত জাগার অভ্যেস নির্ঝরের আছে! সুতরাং এই কারণে নির্ঝরের শরীর খারাপ হয় নি! কারনটা কি ভ্রমর? সেদিন ভ্রমর আসার পর থেকেই তো নির্ঝরের পরিবর্তনটা ধরা পড়েছে তাঁর চোখে।
★
নির্ঝরের মাথায় পানি ঢালছিলেন নাফিসা রহমান। কিছুক্ষন ঢালার পর নির্ঝর উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো। বালতি নিয়ে বেরোনোর সময় খাটের ওপর তাঁর ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে রেহানা ভাবী লিখা। নাফিসা রহমান ঐ বাড়িতে যাবে কি না সেটা জানার জন্য ফোন করেছে ভেবে ফোনটা রিসিভ করলেন।
হ্যালো বলতেই রেহানার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শোনা গেলো। গম্ভীর গলায় বললো,’তোমার জন্য একটা খুশির খবর আছে। ভ্রমর অসুস্থ। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি আমরা! এবার নিশ্চয়ই মনের আশা পূরণ হয়েছে তোমার?’
নাফিসা রহমান অবাক হলেন। তবে তার ধারণাটাই ঠিক? বিস্মিত বললেন,’ভ্রমর অসুস্থ?’
ফোনের ওপাশ থেকে রেহানাও থমকে গেলো। সবাইকে লুকিয়ে নির্ঝরকে ফোনটা ইচ্ছে করেই করেছিলো সে। কারণ সেদিন ফোনে নির্ঝরের সাথে কথা বলার পর সে বেশ বুঝতে পেরেছিলো তোলপাড় দুদিক থেকেই হচ্ছে! একদিকে সশব্দ তোলপাড় অন্যদিকে নিঃশব্দ তোলপাড়! কিন্তু নির্ঝরের ওপর চাপা ক্ষোভ ছিলো তাঁর। রাগে, ক্ষোভে খেয়ালই করে নি ফোনটা নাফিসা রহমান রিসিভ করেছেন। কিন্তু, তাঁর কন্ঠ শুনেও রাগ কমলো না। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,’অসুস্থ হবে না? আপনার ছেলে যা মানসিক টর্চার চালিয়েছে তাঁর ওপর, ভালো থাকবে কি করে?’
নাফিসা রহমান বরাবইর ধৈর্যশীল! শান্ত গলায় বললেন,’ভ্রমর এখন কেমন আছে?
-‘কেমন আর থাকবে? গত তিনরাত একফোঁটাও ঘুমায় নি। পার্লার থেকে আসার সময় ঘুরে পড়ে গিয়েছে!’
তারপর, নাফিসা রহমান হাসপাতালের ঠিকানা চাওয়ার আগেই রাগ করে ফোন কেটে দিলো সে। হতাশ হয়ে ফোন রেখে বেরিয়ে গেলেন নাফিসা রহমান। মিনিট দশেক বাদে ফিরে এসে দেখলেন নির্ঝর কপালে হাত রেখে শুয়ে আছে! ছেলের মাথার পাশে বসে মোলায়েম গলায় ডাক দিলেন তিনি,’নির্ঝর? আব্বু?’
মায়ের গলা শুনে নির্ঝর কপাল থেকে হাত সরিয়ে উঠে বসলো। জোরপূর্বক হাসি টেনে বললো,’মা? তুমি যাও নি?’
-‘এইতো যাবো। তুইও ওঠ!’
-‘আমি? আমার ভালো লাগছে না মা।’
-‘আমরা বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছি না বাবা। ভ্রমর অসুস্থ তাকে দেখতে যাবো!’
ভ্রমর অসুস্থ? ধাক্কাটা যেন এই প্রথম খেলো নির্ঝর! নিজেকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে মায়ের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো সে! নাফিসা রহমান তাড়া দিয়ে বললেন,’ওঠ,বাবা। রেহানাকে একটা ফোন করে হাসপাতালের ঠিকানাটা জেনে নে!’
নির্ঝর মায়ের কথামত হাসপাতালের ঠিকানা জোগাড় করে নিলো। রেহানা প্রথমে দিতে চাইলো না। বারবার অনুনয় বিনয় করার পর অবশেষে রাজি হলো। হাসপাতালের ঠিকানা নেওয়া শেষে ছেলেকে তৈরী হতে বলে নাফিসা রহমান বেরিয়ে যাচ্ছিলেন খপ করে মায়ের হাত চেপে ধরলো নির্ঝর! ছোটবাচ্চাদের মত অনুতপ্ত কন্ঠে ডাক দিলো,’মা?’
নির্ঝরের হৃদয়ের অব্যক্ত অনুভূতির খোঁজ যে নাফিসা রহমান পেয়ে গেছেন তা ভেবে লজ্জা পেলো নির্ঝর। যেন বিরাট বড় ভুল করে ফেলেছে সে। অনুতপ্ত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চেয়ে রইলো।
নাফিসা রহমান ছেলের সুন্দর মুখখানার দিকে চেয়ে হাসলেন। ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,’কিচ্ছু বলতে হবে না বাবা। আমি সব জানি। আমার ছেলেকে যে আল্লাহ এত ধৈর্য দিয়েছেন তার জন্য আমি আল্লাহর দরবারে কোটি কোটি শুকরিয়া আদায় করি!’ নির্ঝর জবাব দিলো না। নাফিসা রহমান পুনরায় মিষ্টি করে হাসলেন। বাস্তবিকই ছেলের সংযম দেখে অবাক হয়ে গিয়েছেন তিনি! সস্নেহে ছেলের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,’আমার ছেলে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে,সমস্ত পৃথিবী রাজি থাকলেও তাঁর মা না চাইলে আমার ছেলে কখনো চাইবে না! আল্লাহ তোকে হাজার বছর বাচিয়ে রাখুক বাবা!
তারপর তাড়া দিয়ে বললেন,’এবার ওঠ বাবা। দেরী হ্য়ে যাচ্ছে আগে হস্পিটালে যেতে হবে!’
★
হস্পিটালে নাফিসা রহমান এবং নির্ঝর দেখে অবাক হয়ে গেলেন বোরহান সাহেব। অবাক হয়ে বললেন,’আপনারা খবর পেলেন কার কাছ থেকে?’
নাফিসা রহমান তাঁর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন,’মেয়ে কেমন আছে ভাইসাহেব? জ্ঞান ফিরেছে?’
বোরহান সাহেব জবাব দেওয়ার আগেই সাদা পোশার পরিহিতা একজন নার্স বেরিয়ে এসে বললো,’রোগীর জ্ঞান ফিরেছে। আপনারা চাইলে দেখা করতে পারবেন!’
নাফিসা রহমান বোরহান সাহেবের সামনেই নির্ঝরকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’যা। ভেতরে যা।’
নির্ঝরসহ উপস্থিত বাকি সবাই অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইল। কিন্তু কেউ প্রতিউত্তর করলো না। ভ্রমরের এখন যেই অবস্থা তাতে নির্ঝর ভেতরে ঢুকলে লোকজন কি ভাববে সেসব ভাবার পরিস্থিতিতে নেই কেউই! হঠাৎ করেই ভ্রমরকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে দেখে খুব ভয়ে পেয়ে গেছিলেন সবাই। তাই কেউ কোন প্রতিবাদ করলো না।
শুধু নির্ঝর একটু দ্বিধান্বিত কন্ঠে বললো,’মা?’
নাফিসা রহমান হাসলেন। বললেন,’তুই দেখা করে আয়। তারপর আমরা সবাই যাবো।’
.
.
.
চলবে