ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ১৩

0
1861

ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ১৩
অরিত্রিকা আহানা

বিয়েটা ভাংতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে বোরহান উদ্দিন সাহেবকে। তারেকের বাবা তো রেগে ভয়াবহ অবস্থা! খুবই স্বাভাবিক কারণ, যত ভালো মানুষই হোক না কেন বিয়ের আগের দিন কেউ এমন ছেলেমানুষি কেউই মেনে নেবে না। মামলা করার হুমকি দিলেন তিনি। ব্যতিব্যস্ত দুপক্ষের গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ ভ্রমরের ভাইয়েরা সবাই দৌড়াদৌড়ি করে শেষমে্যহ কথাবার্তার মাধ্যমে ঝামেলা মিটমাট করলো। তবে দোষ যেহেতু মেয়েপক্ষের তাই কিছু ক্ষতিপূরণ অবশ্যই দিতে হলো। আত্মীয়স্বজনরা সবাই ভ্রমরের উপরে অসন্তুষ্ট হলেন। বোরহান সাহেব তো রাগ করে দুদিন মেয়ের সাথে কথাই বললেন না।
কিন্তু ভ্রমর অনুতপ্ত কন্ঠে বারবার মাফ চাওয়ার পর আর মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারলেন না। যতই হোক, ছয় ছেলের পরে এই একটামাত্র মেয়ে তাঁর! অনেক আদরে একে তিনি মানুষ করেছেন। তাই মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সব অপমান নিরবে সহ্য করে নিলেন।

আগামী মাসের দুই তারিখে নির্ঝরের ফ্লাইট! ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্যারাসাইট জিনোম এর ওপর পিএইচডি করতে যাবে সে। কম করে হলেও তিনচারবছরের ব্যপার। তাই সবদিক বিবেচনা করে নাফিসা রহমান চাইছিলেন ভ্রমর আর নির্ঝরের বিয়েটা সেরে ফেলতে। খুব বেশি ধুমধাম করে নয়, জাস্ট পারিবারিকভাবে। পরে নির্ঝর ফিরে এলে অনুষ্ঠান করা হবে। তাই বিয়ের ব্যপারে তিনি ছেলেমেয়েদের (নির্ঝর এবং ভ্রমরের) অলক্ষ্যে নির্ঝরের মামা, চাচা এবং বোরহান সাহেবসহ তাঁর পরিবারের লোকজনদের সবাইকে নিয়ে আলাপে বসলেন। উদ্দেশ্য বিয়ের ব্যপারে জরুরী সিদ্ধান্ত নেওয়া।
যেহেতু ছেলেমেয়ে দুজন দুজনকে পছন্দ করে তাই কেউ আর অমত করলো না। দুপক্ষেরই সবাই মিলে বসে সিদ্ধান্ত ছিলো আপাতত ঘরোয়াভাবে বিয়েটা হয়ে যাক। তারপর নির্ঝর পিএইচডি করতে চলে যাবে এই ফাঁকে ভ্রমরও তাঁর পড়াশুনা শেষ করে ফেলবে।
কিন্তু সব কথা শুনে ভ্রমর বেঁকে বসলো। সে এখন কিছুতেই বিয়ে করবে না। রেহানা এবং অন্যান্য ভাবীরা সবাই বোঝালো কিন্তু ভ্রমর তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়! বিয়ে এখন সে করবেই না।

ভ্রমর বিয়েতে অমত করায় সবাই চিন্তায় পড়ে গেলো। নির্ঝর চলে যাবে তিন চারবছরের জন্য। হয়ত সুযোগ পেলে ছুটিতে আসবে কিন্তু তখন তো আর বিয়েশাদীর ঝামেলা করা যাবে না। তাই দুইপরিবারই অনিশ্চয়তায় পড়ে গেলো। শেষমেশ ছেলের সাথে আলাপ করলেন নাফিসা রহমান। সব শুনে নির্ঝর মুচকি হেসে বললো,’ও যখন রাজি হয় নি তখন কি আর করা? পড়াশুনা শেষ করুক তবে!’

-‘কিন্তু বিয়েটা হয়ে গেলে একটু নিশ্চিন্ত হওয়া যেত।’

মায়ের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির বিপরীতে নির্ঝর চুপ করে রইলো। ভ্রমর যা খেপেছে তাতে নির্ঝরও কনফিউজড! এইমুহূর্তে ভ্রমর বিয়েতে রাজি হবে না। আর নির্ঝরকে তো না-ই!
হঠাৎ করেই একটা প্রশ্ন মাথার ভেতর উঁকি দিলো নির্ঝরের, ভ্রমরের জেদটা টি শুধু পড়াশোনার জন্য? নাকি অন্যকিছু? পড়াশোনা শেষ করে ভ্রমর সত্যিট নির্ঝরকে বিয়ে করতে রাজি হবে তো? নাকি বাস্তবিকই সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে নির্ঝরের দিক থেকে? নাফিসা রহমান ছেলের চিন্তিতমুখের দিকে চেয়ে ম্লান গলায় বললেন,’এখন কি করি বলতো? মেয়েটা যে এভাবে বেঁকে বসবে আমি তো স্বপ্নেও ভাবি নি!’

নির্ঝর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’তোমার যা মন চায় করো।’

-”এটা কোন জবাব হলো?.. ‘তোমার যা মন চায় করো।’ এখন আমি যদি তোকে তিনটা বিয়ে করতে বলি তুই করবি?”

মায়ের বলার ধরণ দেখে হেসে ফেললো নির্ঝর। চশমার ফ্রেমটা উঁচু করে বললো,’উদাহরণ দেওয়ার জন্য আর কিছু খুঁজে পেলে না তুমি? সোজা তিনটে বিয়ে? তাহলে আর এই জন্মে পিএইচডি করা হবে না আবার!’ কথা শেষ করে আবার হাসলো সে। নাফিসা রহমান বিরক্ত মুখে বললেন,’আমি তোর কাছে বুদ্ধি চাইছি আর তুই হাসছিস?’

নির্ঝর হাসি থামিয়ে মাকে শান্ত করার জন্য বললো,’আহা মা! এত হাইপার হচ্ছো কেন? বিয়েটা যে এখুনি করতে হবে তাঁর তো কোন মানে নেই! ভ্রমর যখন পড়াশুনা শেষ করতে চাইছে করুক না। তারপর যা হয় দেখা যাবে!’

নাফিসা রহমান হতাশ হয়ে বললেন,’বুঝেছি তোর দ্বারা কিছু হবে না। যা করার আমাকেই করতে হবে।’


ল্যাপটপে মুভি দেখছিলো নির্ঝর। তার পাশে ধূমায়িত কফির কাপ। একটু একটু করে কফিতে চুমুক দিয়ে আরামে বসে কফির স্বাদ অনুভব করছে সে। ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই মুভি পজ করে রিসিভ করলো। রেহানা ফোন করেছে।সালাম দিয়ে বললো,’কি খবর ভাবি? কেমন আছন?’

ওপাশ থেকে রেহানা সালামের উত্তর দিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,’আমি ভালো আছি। কিন্তু ভ্রমরের কাহিনী শুনেছো?’

নির্ঝর হাসলো। রেহানার রহস্যজনক কথাবার্তার আগাগোড়া কিছুই বুঝলো না সে। স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করলো,’না তো! কেন কি হয়েছে?’

-‘ও তো বিয়ের জন্য বারণ করে দিয়েছে।’

-‘ও আচ্ছা এই ব্যাপার? হ্যাঁমা আমাকে বলেছেন। ভালোই হয়েছে! এই জেদটা যদি শেষ পর্যন্ত থাকে তাহলে হলো। পড়াশুনাটা অন্তত শেষ করবে!’

-‘তারপর? তারপর যদি তোমাকে বিয়ে করতে রাজী না হয়?’

কথাটা শোনামাত্রই যেন নির্ঝরের হৃদপিন্ড ধড়াস করে লাফিয়ে উঠলো। পেটের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠলো। ভ্রমর কি সত্যিই এমন কিছু করবে? এতবড় শাস্তি কি সে নির্ঝরকে দেবে? পরোক্ষনেই মাথা থেকে সমস্ত নেতিবাচক চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেলে রেহানার প্রশ্নের জবাবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’হবে!’

-‘কি জানি ভাই আমার ভয় লাগছে। ওর যা রাগ চেপেছে তাতে একবার যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় তাহলে আর কারো কথা শুনবে না। তুমি বরং ওর সাথে একবার কথা বলে দেখো না।’

-‘ও আমার নাম্বার ব্লক করে দিয়েছে ভাবি!’, ওপাশ থেকে ছোট্ট করে জবাব দিলো নির্ঝর।

রেহানা অবাক হলো। নির্ঝরের নাম্বার ব্লক করেছে ভ্রমর? এতটা খেপেছে সে। নরম, মোলায়েম কন্ঠে বললো,’আমার ফোন থেকে কথা বলবে? ডেকে দেই?’

-‘ও কি কথা বলবে?’

-‘দেখো না একবার। হয়ত বলতেও তো পারে!’

-‘ঠিক আছে, আমি লাইনে আছি।’

রেহানা তড়িঘড়ি করে ভ্রমরকে নিয়ে রুমে ঢুকলো! ভ্রমর প্রথমে বুঝলো না, রেহানা কি কারণে তাঁকে জোর করে ধরে নিয়ে এসেছে। রেহানা খাটের ওপর থেকে ফোনটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,’ধর কথা বল।’

‘ধর কথা বল।’ বলার এক্সপ্রেশনেই ভ্রমরের বুঝতে বাকি রইলো না ফোনের ওপাশে কে আছে। রাগে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো সে। রেহানা পথ আটকে দাঁড়িয়ে বললো,’এভাবে তাঁকে ঝুলিয়ে না রেখে যদি কিছু বলার থাকে সরাসরি বলে দে। কেন ঘোরাচ্ছিস? তাকে যদি বিয়ে না করার হয় একবারেই মানা করে দে?’

-‘আমি উনার সাথে কোন কথা বলবো না।’

-‘না বললে আমি তোকে ঘর ছেড়ে বেরোতে দেবো না।’

ফোনের ওপাশ থেকে সবই শুনছিলো নির্ঝর। রেহানার কান্ড দেখে জোর হাসি পেলো তাঁর। প্রথম প্রথম রেহানাকে খুব রাগী মনে হলেও আস্তে আস্তে বেশ ভালো সখ্যতা হয়ে গেছে দুজনের। সেদিন ভ্রমরের সাথে কথা শেষ করে নির্ঝর মুখ কালো করে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসার পর রেহানাই প্রথম ছুটে এসেছিলো কি হয়েছে জানার জন্য। সেই থেকে আস্তে আস্তে দুজনের আলাপ শুরু। সব কথা রেহানাকে খুলে বলেছে নির্ঝর! তার শৈশব, কৈশোর, ভ্রমরকে ভালোলাগার কথা, মাকে দেওয়া কথা সব! সব শুনে রেহানা মনে মনে আফসোস করেছিলো। নির্ঝরর জন্য মায়া হলো তাঁর। বেচারা না পারছিলো সইতে না পারছিলো কিছু বলতে! তারপর থেকে নির্ঝরের ভক্ত সে!

ভ্রমর রেহানার কথায় বিরক্ত হয়ে বললো,’ তুমি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছো ভাবি?’

-‘করলে করছি। তুই আগে ফোন ধর!’

-‘আমি কিন্তু ভাইয়াকে ডাকবো?’

-‘কোন লাভ হবে না। তোর ভাইয়াকে আমি ভয় পাই নাকি?’

রেহানার গোয়ার্তমিতে বাধ্য হয়ে ভ্রমর ফোন কানে নিলো। হ্যালো বলতেই নির্ঝর মুচকি হেসে বললো,’এতক্ষন অপেক্ষা করিয়ে রাখলে? দয়ামায়া নেই বুঝি?’

নির্ঝরের কন্ঠটা এত মিষ্টি শোনালো যে না চাইতেও মুগ্ধ হলো ভ্রমর। তথাপি গম্ভীর গলাহ বললো,’এসব ফালতু কথা শোনার সময় আমার নেই। কি বলবেন তাড়াতাড়ি বলুন!’

আপমানটা গায়ে মাখলো না নির্ঝর। হেসে উঠে বললো,’করো, করো। যত ইচ্ছে অপমান করো। কিচ্ছু বলবো না। এখন তো সময় তোমারই! আমি শুধু শুনবো।’

-‘রাখছি আমি?’

-‘এই, না, না। একদম রাখবে না।’

-‘কেন? আপনার কিছু বলার আছে?’

-‘অনেক কিছু বলার আছে। কিন্তু তুমি শুনবে তো?’

এবারেও মিষ্টি নরম, কোমল কন্ঠে প্রশ্নটা করল নির্ঝর। জবাবে ভ্রমর থমথমে গলায় বললো,’না। আমি শুনবো না। আমি আপনার কোন কথা শুনবো না। আপনার কথা শোনার জন্য তো আপনার মা আছেন। তাঁকে গিয়ে শোনান।’

নিমিষেই হাসি উধাও হয়ে গেলো নির্ঝরের। ভ্রমরের তিরস্কারটা তীক্ষ্ণভাবে কানে এসে বিঁধলো। আকস্মিক চেহারাটা কঠিন হয়ে গেলো তাঁর। গম্ভীর গলায় বললো,’মানে?’

-‘মানে। আপনার মাকেই জিজ্ঞেস করুন। আমার এত সময় নেই আপনাকে মানে বুঝিয়ে দেওয়ার মত!’

-‘কথাটা তো আমার মা বলে নি, তুমিই বলেছো?’

-‘হ্যাঁ। তো?’

রাগতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো নির্ঝর। পরিস্থিতে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো,’দেখো ভ্রমর তোমার সাথে কোনরকম ঝগড়া করার কোন ইচ্ছে আমার নেই। মাকে নিয়ে তো ন-ই! তাই প্লিজ তোমাকে আমি রিকোয়েস্ট করছি, আমার মায়ের ব্যপারে কথাবার্তা হিসেবে করে বলবে প্লিজ !’

-‘আপনি কি আমাকে থ্রেট দিচ্ছেন? বলবো না আমি হিসেব করে কথা। কি করবেন আপনি? মায়ের কাছে গিয়ে নালিশ করবেন? তো করুন না ধরে রেখেছে কে আপনাকে? আপনার মাকে কি আমি ভয় পাই? একটা অহংকারী, দাম্ভিক মহিলা! অহংকারে যার মাটিতে পা পড়ে তাঁকে নিয়ে কথা বলতে আমার বয়েই গেছে।’

শরীরের সমস্ত রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠলো নির্ঝরের! অনেক বেশি বলে ফেলেছে ভ্রমর! আর তাঁকে সুযোগ দেওয়া যাবে না। রাগে দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে বললো,’ঠাস করে একটা চড় দিয়ে তোমার সমস্ত দাঁত ফেলে দেবো অসভ্য বেয়াদপ মেয়ে! তুমি কোন সাহসে আমার সামনে আমার মাকে নিয়ে উল্টোপাল্টা কথা বলো? এতবড় সাহস তোমাকে কে দিয়েছে? ভালোবাসি বলে তুমি কি ভেবেছো তোমার সব কথা মুখবুজে সহ্য করে যাবো? কি মনে হয় তোমার? আমার মা না চাইলে তোমার বাসায় কোনদিন বিয়ের প্রস্তাব যেতো? কোনদিন যেতো না। নাফিসা রহমান এখনো এতটা সস্তা হয়ে যান নি যে তার ছেলে তার কথার বাইরে গিয়ে কোন কাজ করবে। একটা কথা মনে রেখো, আমার মা যদি একবার তোমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে আমার একসেকেন্ডও সময় লাগবে না তোমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার মত অতোটুক ক্ষমতা আমার আছে। নাফিসা রহমানের জন্য শুধু তোমাকে কেন তোমার মত এমন হাজারটা ভ্রমরকে আমি ত্যাগ করতে পারি।’

ভ্রমর রাগে দাঁতেদাঁত চেপে বললো,’তবে তাই করুন না। মা ছেলে মিলে শান্তিতে থাকুন। আমাকে কেন বিরক্ত করছেন?’ কথা শেষ করেই ফোন কেটে দিলো সে। নির্ঝর হতভম্ভ হয়ে ফোনের দিকে চেয়ে রইল! কি থেকে কি হয়ে গেছে? ভ্রমর কেন এমন করলো? ওপাশ থেকে রেহানাও চোখ বড়বড় করে ভ্রমরের দিকে চেয়ে আছে!
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here