ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ১৪

0
2211

ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ১৪
অরিত্রিকা আহানা

ভ্রমর ফোন কেটে দেওয়ার পর রেহানা বিস্মিত, বিরক্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললো,’এটা তুই কি করলি ভ্রমর?’

-‘যা করেছি বেশ করেছি। উনি কেন আমাকে ফোন দিয়েছেন?’, রাগত স্বরে জবাব দিলো ভ্রমর।

ভ্রমরের কথার জবাবে কপালে কুঞ্চন দেখা দিলো রেহানা। বিরক্ত, হতাশ কন্ঠে বললো,’পাগলের মত কাজ করেছিস তুই। তোর রাগ নির্ঝরের ওপরে ছিলো,কিছু বলার হলে তাঁকে বলতে পারতি। শুধুশুধু তাঁর মাকে টানলি কেন?’

-‘কে বলেছে আমার রাগ শুধু উনার ওপরে? উনার মায়ের ওপরেও আমার অনেক রাগ। কি ভেবেছেন উনারা? আত্মসম্মান বোধ কেবল উনাদেরই আছে? আমাদের নেই? মামার কাছে আমি সব শুনেছি ভাবি। নাফিসা রহমান জেনেশুনে আমার সাথে এমন করেছেন। আমি উনার ছেলেকে পাগলের মত ভালোবাসি সেটা জানার পরেও উনি শুধুমাত্র আমার বাবা,ভাইদের পড়াশুনা একটু কম বলে বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। একটাবার আমার কথা ভাবেন নি। মানুষকে তো মানুষই মনে করেন না তিনি।’

-‘মামা তোকে এসব বলেছে?’

-‘না। কিন্তু যা বলেছে তাঁর মানে তো এসবই দাঁড়ায়।’

রেহানা টেনে ভ্রমরকে বিছানায় বসালো। শান্ত গলায় বললো,’না। দাঁড়ায় না। তুই নিজে নিজে যদি সব কথার একটা মানে বের করে নিস তাহলে তো হলো না? সবটা না জেনে কারো সম্পর্কে এমন ভুল ধারণা পোষণ করা মোটেই উচিৎ না।’

রেহানার যুক্তির বিপরীতে ভ্রমর তাঁকে সম্পূর্ণ নিরাশ করে দিয়ে বিরক্ত হয়ে বললো,’প্লিজ ভাবি। আমি আর এসব নিয়ে কোন কথা বলতে চাই না। সামনে আমার পরীক্ষা। আমি শুধু পড়াশোনার দিকে মনোযোগ দিতে চাই। দয়া করে এসব কথা আর আমার সামনে আলোচনা করো না ‘

কথা শেষ করে ভ্রমর বেরিয়ে গেলো। রেহানা মুখ কালো করে বসে রইলো। ভ্রমরকে সে নিজের ছোট বোনের মত ভালোবাসে। মনেপ্রাণে ভ্রমরের ভালো চায়। কিন্তু ভ্রমর যা করছে তাতে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনছে সে। মুখে যতই না বলুক না কেন, রেহানা ভালো করেই জানে নির্ঝরকে ছাড়া ভ্রমর থাকতে পারবে না। সাময়িক রাগ থেকে কথাগুলো বলছে সে। কিন্তু রাগের মাথায় বলা এইকথাগুলোই শেষে কাল হয়ে দাঁড়াবে তাঁর জন্য। বাধ্য হয়ে সে নিজেই ফোন করলো নির্ঝরের নাম্বারে।

ভ্রমর ফোন কেটে দেওয়ার পর ফোন হাতে নিয়ে হতভম্ভ হয়ে বসে আছে নির্ঝর! বুকের ভেতরটা ভার হয়ে আছে তাঁর! ভ্রমর এ-কি আগুনে পোড়াচ্ছে তাঁকে? সবকিছু যখন ঠিক হয়ে আসছিলো ঠিক তখনই ভ্রমর কেন নির্ঝরের মনের ভেতরে একরাশ সন্দেহ, দ্বিধা, ভয় ঢুকিয়ে দিলো? নির্ঝর এখন কি করবে? ভ্রমরকে ভুলে যাবে? মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো তাঁর! কেন ভ্রমর এতটা অবুঝ হলো?
সমস্ত পৃথিবী তছনছ হয়ে গেলেও সহ্য করে নিতে পারবে নির্ঝর কিন্তু নাফিসা রহমানের অসম্মান? কিছুতেই না। নির্ঝরের কলিজার টুকরা তার মা! মায়ের জন্য হাসিমুখে সব কিছু মেনে নিতে রাজি আছে! কিন্তু ভ্রমর কি এই কথাটা কখনো বুঝবে?

বুঝলো না তো! তবে? কি করবে এখন নির্ঝর? ভ্রমরকে ভুলে যাবে? সেটা কি আদৌ সম্ভব? নাহ! সম্ভব নয়। কিন্তু ভোলাটা হয়ত সম্ভব নয়, দূরে সরে যাওয়াটা তো সম্ভব? ফের বুকের ভেতর খামচি মেরে উঠলো নির্ঝরের! তবে কি সে সম্পর্কে জটিলতা থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে? কিন্তু তাতে কি নাফিসা রহমানের প্রতি ভ্রমরের যেই অশ্রদ্ধা তৈরী হয়েছে তা কোনদিন মিটবে? ভ্রমর তো সবকিছুর জন্য তাকেই দায়ী করছে! নাহ! নির্ঝর পালাবে না। ভ্রমরকে সে তাঁর মত করে ভালোবাসতে শেখাবে।
নাফিসা রহমান কারো তিরস্কারের পাত্রী নন! ভ্রমরের হৃদয়ে নাফিসা রহমানকে সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত করবে নির্ঝর! তাদের দুজনের ভালোবাসার মাঝখানে মধ্যমনি হয়ে থাকবেন নাফিসা রহমান। ভ্রমর একদিন ঠিকই বুঝবে নাফিসা রহমান কখনোই তাদের ভালোবাসার অন্তরায় ছিলো! তাদের ভালোবাসার অন্তরায় ছিলো ভ্রমর নিজে!


দুবার রিং হওয়ার পর রিসিভ করলো নির্ঝর। রেহানা মুচকি হেসে বললো,’এমন জানলে আমি কখনোই ভ্রমরের সাথে কথার বলার জন্য জোরাজুরি করতাম না ভাই! তুমি ওর কথায় কিছু মনে করো ন। চারদিকের চাপে ওর মাথা ঠিক নেই কি বলতে কি বলে ফেলেছে।’

-‘হুম।’ ছোট করে জবাব দিলো নির্ঝর। তখনো ভ্রমরের বলা কথাগুলো নিয়ে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন ছিলো সে। রেহানার কথাগুলো তার কানে গেলো কি না সন্দেহ আছে। এদিকে রেহানা বুঝতে পারছিলো না নির্ঝর ঠিক কতটা রেগে আছে। তাঁকে শান্ত করার জন্য মিথ্যে বললো সে,’রাগে তখন বলে ফেলেছে কিন্তু তারপর থেকেই কাঁদছে ভ্রমর। কিছুতেই শান্ত করতে পারছিলাম না। বাধ্য হয়ে তোমাকে ফোন দিয়েছি।’

-‘কাঁদুক। ওর জন্য কান্নাই ঠিক আছে।’

-‘এসব তুমি কি বলছো ভাই? ও অবুঝ হলে তুমিও অবুঝ হবে নাকি?’

-‘আপনি সবসময় ওকে সাপোর্ট করা বন্ধ করুন ভাবি। আজকে ও যা করেছে একদমই ভালো করে নি। সব জেনেও আপনি কেন ওকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন? এতে ওর ক্ষতি করছেন আপনারা।’

নির্ঝরের কন্ঠে কিঞ্চিৎ রাগ! রেহানা বিস্মিত,হতভম্ভ, ব্যথাতুর কণ্ঠে বললো,’আমি ওর ক্ষতি করছি?’

রেহানার মৌনকন্ঠের বিপরীতে চট করে নিজেকে সংযত করে নিলো নির্ঝর। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’সরি ভাবি। আসলে মাথা খারাপ হয়ে আছে। কিছু মনে করবেন না।’

-‘ঠিক আছে।’

রেহানার গলাটা তখনো ভার শোনালো। সেটা বুঝতে পেরে নির্ঝর বিনয়ী, আন্তরিক কন্ঠে বললো,প্লিজ ভাবি। আপনি অন্তত আমার ওপরে রাগ করে থাকবেন না!”

রেহানা হাসলো। বললো, ‘ঠিক আছে করলাম না। এবার তুমি আমার একটা প্রশ্নের জবাব দাও তো? ভেবেচিন্তে উত্তর দেবে কিন্তু? ‘

-‘ঠিক আছে।’

-‘ভ্রমরকে তো তুমি ভালোবাসো?’

এমনকিছুই প্রত্যাশা করছিলো নির্ঝর। জবাব দিলো না সে। নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রেহানা ধৈর্যহারা কন্ঠে পুনরায় প্রশ্ন করে বললো,’কি হলো বাসো না?’

-‘বাসি!’ ছোট, লাজুক, অভিমান মিশ্রিত কন্ঠস্বর নির্ঝরের।

রেহানা হাসলো। বললো,’তবে ওকে তুমি নিজের মত করে গড়ে নাও না?’

এবারে নির্ঝরও হাসলো! বললো,’না নিয়ে আর উপায় কি? আমার মাকে তো আর আমি ছোট হতে দিতে পারি না?’

-‘মানে?’ এই কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝলো না রেহানা।

নির্ঝর আবারো মুচকি হেসে বললো,’মানে? আপনার ননদকে আমি আমার মত করে ভালোবাসতে শেখাবো।

রেহানা কিঞ্চিৎ ঠাট্টামিশ্রিত কন্ঠে বললো,’ভালোবাসা বুঝি শেখানোর জিনিস?’

-‘না। ভালোবাসা মোটেও শেখানোর জিনিস হয়। এটা আপনা আপনি হয়ে যায়। কিন্তু ভালোবাসার ধরণটা নিজেকে তৈরী করে করে নিতে হয়। আপনি কাকে কতটা ভালোবাসবেন, কেমন ভালোবাসবেন সেটা একান্তই আপনার চিন্তাধারা এবং ভালোবাসার গভীরতার ওপর নির্ভর করে! আমি জানি ভ্রমর আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসে হয়ত ভালোবাসার দিক দিয়ে আমি ওর থেকে পিছিয়ে কিন্তু ওর ভালোবাসার ধরণটা অনেক ক্ষেত্রেই অসুস্থ। অবশ্য এটা ওর দোষ নয়! কতটুকুই বা বয়স হয়েছে! সবে উনিশ! এই বয়সে এমন চিন্তাধারা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই অনেক ভেবে দেখলাম, ওকে সোজা করতে হলে আমাকেই মাঠে নামতে হবে।’

রেহানা এতক্ষন ধৈর্যসহকারে সব শুনে যাচ্ছিলো নির্ঝরের শেষ কথাটা শুনে হেসে ফেলল। ইসশ! কি মধুর! ভ্রমর যদি শুনতে পেতো। উৎসাহী কন্ঠে বললো,’মানে,তোমার ঠিক প্ল্যানটা কি একটু বলবে?’

নির্ঝর মুচকি হেসে বললো,’মানে এখন বুঝতে পারেন নি ভাবি? মানে হচ্ছে এবার আপনার ননদকে আমি সোজা করবো। খুব ডাঁট বেড়েছে তাঁর! নিজেকে সে মনে মনে হিন্দি সিনেমার হিরোইন বানিয়ে ফেলেছে! সেইজন্য আমাকেও হিরো বানাতে চাইছে। তাই এসব ভূত ওর ঘাড় থেকে নামিয়ে এবার ওকে বাস্তবতার জগতে টেনে আনবো। কি করে সুস্থভাবে ভালোবাসতে হয় সেটা শেখাবো!’

-‘তুমি আমার ননদকে পাগল বলছো?’

নির্ঝর মুচকি হেসে কৃত্রিম অবাক হওয়ার ভান করে বললো,’কেন ভাবি আপনার কি কোন সন্দেহ আছে?’

রেহানা আবারো হেসে ফেললো। হাসিমুখেই বললো,’নাহ। তোমার কথাই মেনে নিলাম। কিন্তু পাগল সামলাতে পারলেই হলো!’ তারপর আরেকদফা হাসাহাসির পরে উৎসাহী কন্ঠে বললো,’তুমি করবে টা কি?’

-‘আপাতত আপনার পাগল ননদের সাথে প্রেম করবো। মানে বিরহের আগুনে ওকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে কয়লা করে ফেলবো।’

-‘সেই আগুনে তো বেচারি শুরু থেকেই জ্বলছে।’

-‘ননদের টাই দেখলেন? আমি বেচারা যে আপনার ননদের বিরহে রাত দিন চোখের জল ফেলছি সেটা আপনার চোখে পড়লো না?’

নির্ঝরের বলার ধরণ দেখে রেহানা হেসে উঠে বললো,’খালি আমার ননদের দোষ। এখন কে সিনেমাটিক কথাবার্তা বলছে?’

নির্ঝর দুষ্টু হেসে বললো,’আপনার ননদের আছর পড়েছে ভাবি।’

রেহানা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। দুষ্টুটার মাথায় নিশ্চয়ই কোন বুদ্ধি এসেছে। নতুবা এমন হাসিখুশি কন্ঠে তাঁকে কোনদিন কথা বলতে দেখে নি রেহানা। মুচকি হেসে বললো,’হ্যাঁ। সব দোষ তো আমার ননদের। এবার তোমার প্ল্যানের কথা বলো।’

-‘বলবো ভাবি। আপনাকেই তো বলবো, আপনি ছাড়া আমার আপন আর কে আছে বলুন? আপনাকে যে আমি কতভালোবাসি সেটা তো আপনি জানেন না।’

-‘রং ট্র‍্যাকে কেন যাচ্ছো ভাই? তোমার ভালোবাসার কথাগুলো আমাকে না বলে আমার ননদকে বলো। কাজে লাগবে!’

-‘আপনার সাথে ট্রায়াল দিচ্ছি!’

নির্ঝরের কথায় রেহানা মুখের হাসি মিলিয়ে যাওয়ার কোন জো নেই। লাগাতর হেসে যাচ্ছে সে। কৃত্রিম শাসনের সুরে বললো,’পাঁজি! হঠাৎ আমাকে দিয়ে ট্রায়াল দেওয়ার প্রয়োজন পড়লো কেন?’

-‘কারণ আপনার হিংসুটে ননদ প্রথমেই ভালোবাসাবাসির চ্যাপ্টার বুঝতে পারবে না। তাই আগে প্রেম তারপর ভালোবাসা!

-‘সেই তো একই হলো প্রেম যা ভালোবাসাও তো তাই।

-‘মোটেই না। দুটো আলাদা জিনিস!’

-‘কিরকম আলাদা?

-‘উত্তরটা আর কিছুদিন বাদে আপনার ননদই দেবে। আপাতত একটু ধৈর্য ধরুণ! আগে আমি তাকে একটু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে কয়লা বানিয়ে নেই!’ নির্ঝরের কথা শেষ হতেই ওপাশ থেকে আবারো রেহানার জোর হাসির শব্দ শোনা গেলো। নির্ঝরও হাসলো! বলা বাহুল্য, তার হাসির কারণটাও ভ্রমর! অনেক জ্বালিয়েছে পাঁজি মেয়েটা তাঁকে! এবার নির্ঝরের পালা!
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here