ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ১৬

0
2105

ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ১৬
অরিত্রিকা আহানা

গেইম খেলায় মন বসছে না নির্ঝরের। সে অপেক্ষমাণ ভ্রমরের একটা ফোন কলের আশায়। খেলা বন্ধ করে চিন্তিতমুখে ফোনের দিকে চেয়ে রইলো সে। ভ্রমর কি তবে ফোন করবে না?
আরেকটু কি ওয়েট করবে নির্ঝর? নাকি শুয়ে পড়বে? কিন্তু মন সায় দিলো না। অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোন হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে রইলো সে।

এদিকে বিগত আধঘন্টা যাবত চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে ভ্রমর। কিন্তু ঘুম আসছে না! মনটা ভীষণ অস্থির লাগছে! রেহানার বলা কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে! সত্যি যদি নির্ঝর বিয়ে করে নেয়? শেষমেশ বিছানা ছেড়ে উঠলো সে। ফোন হাতে নিয়ে একসেকেন্ডও ভাবার সময় নিলো না, ভাবলেই আবার দ্বিধায় পড়ে যাবে। একেবারে,ডিরেক্ট কল দিলো নির্ঝরের নাম্বারে!

হাতের মুঠোয় ফোন ভাইব্রেট হতেই চমকে উঠলো নির্ঝর! স্ক্রিনের ভেসে ওঠা নাম্বার দেখে মুচকি হাসলো সে। যাক! অবশেষে, ডাকিনীর সুমতি হলো! তবে সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করলো না সে। ধীরেসুস্থে রিসিভ করে হ্যালো বললো। প্রত্যাশা মতনই ওপাশ থেকে কোনরকম জবাব এলো না। নির্ঝর আগেই ধারণা করে রেখেছিলো ভ্রমর ফোন দিলেও কথা বলবে না। আলোচনার সূত্রপাত তাকেই করতে হবে। সেই মোতাবেক প্রস্তুতি নিয়েই বসে ছিলো সে। গলাটা পরিষ্কার করে বললো,’কথা না বললে ফোন রেখে দিচ্ছি?’ ইচ্ছে করেই ফোন কেটে দেওয়ার হুমকি দিলো সে!
কিন্তু তবুও ওপাশ নিরব! ভ্রমরের একটা নিশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত শোনা গেলো না। নির্ঝর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’কি হলো? মাঝরাতে ফোন দিয়ে কথা বলছো না কেন?’

এবারে সটাং জবাব এলো,’আমার ইচ্ছে।’

-‘তোমার ইচ্ছে?’

-‘হ্যাঁ। আমার ইচ্ছে।’

-‘তোমার ইচ্ছে তবে তোমার কাছেই রাখো না। আমাকে কেন ফোন দিয়েছো?’

-‘কারণ আপনি আমাকে ফোন দেন নি তাই!

-‘নাম্বার ব্লক করে রাখলে ফোন দিবো কি করে?’

-‘ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়।’

-‘না। হয় না। অনেক কিছুতেই ইচ্ছে থাকলেও উপায় হয় না!’

-‘যেমন?’

-‘বলতে চাইছি না। তোমাকে বলে লাভও নেই।’

-‘আসল কথা আপনি বলতে পারবেন না। কারণ ওসব আপনার বাহানা!’

-‘তবে সত্যিটা কি?’

-‘সত্যিটা হচ্ছে আপনি আমাকে ভালোবাসেন না।’

-‘তাই নাকি? তা এতদিন পর তোমার বুদ্ধি খুললো?’

ভ্রমর হতাশ হলো। মুখে সে যতই না বলুক, তার সচেতন কিংবা অবচেতন মন যাইহোক না কেন বারবার করে চাইছিলো নির্ঝর তাঁর বলা কথাগুলো নিয়ে প্রতিবাদ করুক। জোর গলায় বলুক, সে ভ্রমরকে ভালোবাসে! কিন্তু পাষন্ডটা উলটো ভ্রমরের কাটা গায়ে নুনের ছিঁটে দিচ্ছে! কেন যে ভ্রমর এমন একটা পাষাণ, কঠিন হৃদয়ের মানুষকে ভালোবাসতে গেলো? দিনরাত জ্বলে মরছে! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মৌনমুখে বললো,’মাঝে মাঝে আমার কি মনে হয় জানেন?…মাঝে মাঝে মনে হয় খুব করে আপনাকে অভিশাপ দেই। আপনার সব শান্তি কেড়ে নেই! কিন্তু পারি না।’ কথা শেষ করে আবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ভ্রমর।

‘আমার সব শান্তি তুমি অনেক আগেই কেড়ে নিয়েছো ভ্রমর!’ কথাটা বলতে গিয়েও নিজেকে সংযত করে নিলো নির্ঝর। এইমুহূর্তে এসব বলা যাবে না। সুযোগ পেয়ে ভ্রমর তবে আবার বেঁকে বসতে পারে। তাই ফোন কানে নিয়ে চুপ করে শুনে গেলো সে। তাঁকে চুপ থাকতে দেখে ভ্রমর মৌনমুখে বললো,’কথা বলছেন না যে?’

-‘কি বলবো?’

-‘কিচ্ছু বলার নেই?’

-‘না। বলার জন্য তো তুমি ফোন করেছিলে?’

-‘ঠিক আছে তবে,একটা প্রশ্নের সত্যি করে জবাব চাইছি, দেবেন?’

-‘না! তোমার কোন প্রশ্নের জবাব আমি দেবো না।’

-‘কেন?’

-‘আমার ইচ্ছে।’

এবার আর রাগ হলো না ভ্রমরের। হতাশা, আক্ষেপ মিশ্রিত কন্ঠে বললো,’আপনি কেন এতটা স্বার্থপর বলুন তো? নিজের টা ছাড়া কেন আর কারোটা বুঝতে চান না?’

-‘আমার কাছে তো মনে হয় তুমি স্বার্থপর! তুমি নিজেরটা ছাড়া আর কিচ্ছু বুঝতে চাও না।

জবাবটা রেডিই ছিলো ভ্রমরের। কিঞ্চিৎ তিরস্কারের সুরে বললো,’সেইজন্যই বুঝি এখন বিয়ে করছেন?’

এতক্ষণে আসল কথায় এসেছে সে। নির্ঝর গম্ভীর গলায় বললো,’তোমাকে কে বললো আমি সেইজন্য বিয়ে করছি?’

-‘তবে আর কিসের জন্য। স্বীকার না করলে কি হবে কিন্তু আমার বলতে বাধা নেই, আপনার খুব অহংকার!’

-‘এখানে অহংকারের কি দেখলে?’

-‘অহংকার নয়ত কি? আমি একবার না করতেই কেন আপনি বিয়েতে রাজী হয়ে গেলেন? আপনার ইগোতে লেগেছে। কিন্তু আমি তো রাজি হই নি? আপনি আমাকে বারবার অপমান করে ফিরিয়ে দেওয়ার পরেও আমি রাজী হই নি!’

কিঞ্চিৎ ফোঁপানো আওয়াজ কানে গেলো নির্ঝরের। বারান্দায় থেকে হাঁটতে হাঁটতে রুমে এসে ঢুকলো সে। বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো। একটা হাত মাথার নিচে দিয়ে মুচকি হেসে বললো,’মোটেও একবার নয়। তুমি আমাকে মোট তিনবার ফিরিয়ে দিয়েছো। হস্পিটালে একবার, মা তোমাদের বাসায় প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার পর একবার তারপর সেদিন ফোনে। যা খুশি তাই বলেছো আমাকে। সাইড নোট হিসেবে, আমার নাম্বার ব্লক দেওয়া আর বিশেষ দ্রষ্টব্য হিসেবে আমার মায়ের সম্পর্কে উল্টোপাল্টা কথা বলাতো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য! এই পয়েন্টটার পাশে গুণে গুণে ঠিক সাতটা স্টার মার্ক হবে! দিজ ইজ দ্যা মোস্ট ইম্পর্টেন্ট পয়েন্ট। বলতে পারো, বাকিসব পয়েন্টগুলা জাস্ট বলার জন্য বলা। ‘

-‘সেটা তো আমি না জেনে বলে ফেলেছি। আপনি তো জানেম আমি ইমোশন একদম চেপে রাখতে পারি না। আপমার মত সেই ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা আমাকে দেন নি। তাইজন্যই হয়ত বারবার অপদস্থ হতে হয়েছে আমাকে!’

-‘ব্যপারটা ইমোশনের নয় ভ্রমর। ব্যপারটা ম্যাচিউরিটির! তোমার কাছ থেকে আমি এমনটা আশা করি নি। সত্যিই আশা করি না। হয়ত না জেনেই বলেছো কিন্তু না জেনে আমার মায়ের সম্পর্কে যা খুশি তাই বলার অধিকার তো আমি তোমাকে দেই নি? তোমাকে আমি ভালোবাসি তারমানে তোমার যাবতীয় অধিকার সব আমার ওপর ছিলো! আমার মায়ের ওপর নয়। কথাটা তোমার মাথায় রাখা উচিৎ ছিলো।’

-‘তাই বলে আপনি বিয়েতে রাজী হয়ে যাবেন?’

-‘কেন তোমার কাছে কি বিষয়টা এখনো গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না ?’

ভ্রমর জবাব দিলো না। আসলে এই মুহূর্তে নির্ঝরকে দেওয়ার মত জবাব তাঁর মাথায় আসছেও না। সেদিন না জেনে রাগের মাথায় নাফিসা রহমানের নামে উল্টোপাল্টা কথা বলে ফেলেছে সে। একবারেও জন্যে মাথায় আসে নি সবকিছু ঠিক হয়ে গেলেও এইকথাগুলো নির্ঝর কোনদিন ভুলবে না। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে ঝোঁকের বসে কতবড় ভুল করে ফেলেছে সে। চুপ করে রইলো। মৌন কন্ঠে বললো,’অনেক রাত হয়েছে। রাখি এবার?

-‘হ্যাঁ।’

-‘হ্যাঁ?’ অবাক হলো ভ্রমর! নির্ঝরের কি তবে আর কিছুই বলার নেই? বিস্মিত কন্ঠে পুনরায় প্রশ্ন করলো সে,’হ্যাঁ মানে?’

জবাবে নির্ঝর কিঞ্চিৎ ঠাট্টারসুরে বললো, ‘হ্যাঁ মানে হ্যাঁ। ইংরেজিতে ইয়েস! এরপরেও বুঝতে না পারলে একটু ওয়েট করো আমি গুগলে সার্চ দিয়ে অন্যকোন ভাষায় তোমাকে বোঝাতে পারি কি না দেখি!’

-‘লাগবে না বোঝানো। রাখছি আমি!’

ভ্রমর এবার সত্যিই ফোন রেখে দেবে বুঝতে পেরে নির্ঝর বাধা দিয়ে বললো,’ফোন করলে কি জন্য তা তো বললে না?’

-‘বলার কি আর প্রয়োজন আছে? কোন লাভ আছে বলে?’

-‘লাভ ক্ষতির হিসেবে তুমি কোনকালেই পাকা ছিলে না। তুমি বরাবরই বোকা ছিলে, আছে, এবং থাকবে। সুতরাং আজকে যদি আরেকটু বোকামি করো তবে তেমন কোন ক্ষতি হবে বলে আমার মনে হয় না।’

-‘আমি বোকা হলে আপনিও তো বোকা। কারণ আমি যেই কারণে ফোন করেছি আপনিও তো ঠিক সেই কারণেই রাত জেগে বসে আছেন!’

নির্ঝর হাসলো। অনেকটা গা জ্বালানো ধরণের হাসি। হাসি থামিয়ে বললো,’রাত জাগার অভ্যেসটা যে আমার অনেক আগে থেকেই আছে সেটা তুমি ভালো করেই। কিন্তু তোমার কথা কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না। বাই এনি চান্স তুমি কি ভেবেছো তোমার জন্য জেগে বসে আছি?’

ভ্রমর রাগত স্বরে বললো, ‘আমি কি ভেবেছি না ভেবেছি সেটা জেনে আপনি কি করবেন। আপনি আপনার বিয়ে, সংসার নিয়ে সুখে থাকুন।’

কথা শেষ করে ফোন রেখে দিচ্ছিলো সে।
কিন্তু নির্ঝর তাকে অবাক করে দিয়ে বললো,’না মানে আমি বলতে চাইছিলাম যদি সেকরম কিছু ভেবে থাকো তবে একদম ঠিক ভেবেছো। আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। তোমাকে একটা কথা বলবো বলে অপেক্ষা করছিলাম।’

কিঞ্চিৎ শীতল হয়ে এলো ভ্রমরের কন্ঠ। নরম, মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,’কি কথা?’

-‘আমার বিয়েতে তুমি প্লিজ এসো।’ কথাটা শেষ
করে মুচকি হেসে জিভ কাটলো নির্ঝর। সামনে থাকলে নিশ্চই এক্ষুনি তাঁর মুন্ডুপাত করতো ভ্রমর। তবুও ফোনের ওপাশ থেকে ভ্রমরের রিয়েকশন কি হতে পারে মনে মনে ধারণা করে নিয়েছে সে। ভ্রমর নিশ্চয়ই তাঁর চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে ফেলছে।

ঠিক তাই! অসহ্য রাগে ভ্রমর দাঁতমুখ খিঁচে বললো,’আপনি ঠিকই বলেছেন আমি একটা বোকা। ইমোশোনাল ফুল। কিন্তু আর একটা কথা আপনি বলতে ভুলে গেছেন। সেটা হচ্ছে আপনার গায়ে মানুষের চামড়া নেই। গন্ডারের চামড়া। আর কলিজাটা হচ্ছে শক্ত পাথরের মত। আবেগ, অনুভূতিহীন। আপনি একটা অসহ্যকর লোক! আর জীবনেও ফোন দেবো না আমি আপনাকে।’
ফোনটা কান থেকে সামান্য সরিয়ে একহাতে কান চেপে ধরলো নির্ঝর। ভ্রমরকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো,’আস্তে ভ্রমর। তোমার চিৎকারে বাড়িসুদ্ধ লোক সজাগ হয়ে যাবে।’ তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোন কেটে দিলো ভ্রমর। নির্ঝর ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। মনের অজান্তেই ফোনের স্ক্রিনে আলতো করে চুমু খেলো সে। আগুন ভালোমতই জ্বলতে শুরু করেছে! এবার শান্তি মত একটা ঘুম দেওয়া যাবে!
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here