ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ১৮

0
2180

ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,পর্বঃ১৮
অরিত্রিকা আহানা

রাত নটায় নির্ঝরের ফ্লাইট। এখন বাজে বিকেল চারটা। ভ্রমরদের বাসার ড্রয়িংরুমে সে নাফিসা রহমান, তাঁর বেশকয়েকজন মামা এবং চাচা বসে আছেন। মাগরিবের নামাজের পর তার এবং ভ্রমরের বিয়ে পড়ানো হবে। বিয়ে পড়ানো শেষেই এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হবে নির্ঝর। লাগেজ পত্র সব নিয়ে একসঙ্গে বাসা থেকে বেরিয়েছে সে। নাফিসা রহমান ছেলের পাশে শুকনো মুখে বসে আছে। বাকিদের সঙ্গে বিয়ের আনন্দে সামিল হতে পারছেন না তিনি। তাঁর ছেলেটা আজকে চলে যাবে, ভাবতেই বুকের ভেতর খচখচ করছে। নির্ঝর মায়ের মুখের দিকে চেয়ে হাসলো। শান্ত, মোলায়েম কন্ঠে বললো,’ছুটি পেলেই চলে আসবো মা।’

দুপক্ষের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে বিয়ের পড়ানো সম্পন্ন হয়ে গেলো। বিয়ে পড়ানো শেষে শ্বশুর শাশুড়ি, মুরুব্বীদের সবাইকে সালাম করলো নির্ঝর। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যপার হচ্ছে সকাল থেকে একবারও ভ্রমরের দেখা পায় নি সে। লজ্জায় কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারছে না। আফটার অল এখন সে এই বাড়ির নতুন জামাই! হিসেব করে কথাবার্তা বলতে হবে। কিন্তু ভ্রমর যে রাগ করে বসে আছে? সেদিনের পর থেকে নির্ঝরের নাম্বারটাও আবার ব্লক করে দিয়েছে। রেহানার ফোনে অবশ্য দু একবার ট্রাই করেছিলো নির্ঝর কিন্তু রেহানা ভয়ে ভ্রমরের কাছে নিয়ে যাওয়ার সাহস পায় নি। ভ্রমরের কড়া নিষেধ রেহানা যদি ভুল করেও নির্ঝরের ফোন রিসিভ করে তবে তাঁর মাথা ফাটিয়ে দেবে সে। অতএব কোন চেষ্টাতেই কোন লাভ হলো না। হতাশ হয়ে নির্ঝর চুপচাপ বসে রইলো।

মিষ্টিমুখ করানোর সময় রেহানাকে দেখে নির্ঝর মনে মনে খুশি হলো। যাক এবার অন্তত ভ্রমরের খোঁজ পাওয়া যাবে। ফিসফিস করে বললো,’ভাবি? আপনার ননদের দেখা কি পাবো না? সে কি আমার সঙ্গে দেখা করবে না? আমি চলে যাচ্ছি যে?’

তার প্রশ্নের জবাবে রেহানা মুচকি হাসলো। বিজ্ঞের মত মাথা নাড়িয়ে বললো,’করবে, করবে। তুমি ওকে চেনো না? যাওয়ার সময় দেখবে ঠিক হাজির হবে।’ নির্ঝর হাসলো। ভেতরের ঘর থেকে একে একে সবাই ভ্রমরের সাথে দেখা করে আসছে কিন্তু তাকে এখনো যেতে দেওয়া হচ্ছে না। অপেক্ষামান হয়ে বসে রইলো সে।

অবশেষে ভ্রমরদের বাসা থেকে বেরোনোর কিছুক্ষন আগে তাঁর সাথে দেখা করার অনুমতি পেলো নির্ঝর। ঘরের দরজায় উঁকি দিয়ে দেখলো একটা বালিশ কোলে নিয়ে খাটের ওপর চুপচাপ বসে আছে ভ্রমর। নির্ঝর গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,’মে আই কাম ইন?’

রাগে পিত্তি জ্বলে গেলো ভ্রমরের। বিয়ের দিনেও তাকে ফর্মাল থাকতে হবে। ‘মে আই কাম ইন?’ নির্ঝরের বলা কথাটা অনুকরণ করে ভেংচি কাটলো সে। কিন্তু এর পরেও নির্ঝরকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে মনে মনে আরো একবার হতাশ হলো। কার ওপর রাগ দেখাচ্ছে ভ্রমর? সে এদিকে রাগ করে বসে থাকবে ঐ দিকে দেখা যাবে অনুমতি না পেলে সত্যিই ঘরে ঢুকবে না নির্ঝর। এই লোকের বিশ্বাস নেই। দাঁতমুখ খিঁচে বললো,’হ্যাঁ স্যার নির্ঝরচন্দ্র বিদ্যাধর, আসুন! আপনার জন্যই তো অপেক্ষা করছি।’

নির্ঝর মুখটিপে হাসলো। ভেতরে ঢুকে চারপাশে চোখ বুলিয়ে বললো,’এটা তোমার ঘর?’

ভ্রমর জবাব দিলো না। মৌনমুখে বসে রইলো। নির্ঝর হাত ঘড়ি চেক করে দেখলো এখনো আধঘন্টার মত সময় আছে। কিন্তু কি দিয়ে কথোপকথন শুরু করবে বুঝতে পারছিলো না। উশখুশ করে বললো,’একগ্লাস পানি খাওয়াতে পারবে?’

-‘জি না।’

নির্ঝর অবাক হয়ে বললো,’কেন?’

-‘নতুন বউয়ের ঘর থেকে বেরোতে নেই!’.

নির্ঝর হাসলো। ভ্রমরের আপাদমস্তক খেয়াল করে দেখলো, হলুদ একটা সুতির সেলোয়ার কামিজ পরেছে ভ্রমর। ওড়নাটা মাথায় বউদের মত ঘোমটা টানা। নাকে ছোট একটা নাকফুল,আর হাতে দুগাছি চিকন চুড়ি। গলায় কিছু পরেছে কি না দেখা যাচ্ছে না। নাহ! সত্যিই বউ বউ লাগছে তাঁকে। তাঁর ঘোর ভাঙলো ভ্রমরের কথার আওয়াজে। ফোন করে রেহানাকে পানি নিয়ে আসার কথা বলছে সে। নির্ঝর মুগ্ধ হয়ে দেখছিলো! অতি সাধারণের মাঝেও কোথাও যেন অসাধারণ! ভ্রমর গম্ভীর গলায় বললো,’এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’

নির্ঝর পাল্টা প্রশ্ন করে বললো,’তাকাবো না কেন?’

-‘কারণ আমার অসহ্য লাগছে!’

-‘কিন্তু আমার অসহ্য লাগছে না।’

-‘ধন্য হলাম।’

-‘তবে সুন্দর করে হাসি দিয়ে আমাকেও ধন্য করো।’

ভ্রমর আবারো রাগে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো দরজায় খটখট আওয়াজ পেয়ে দুজনেই চমকে উঠলো। রেহানা শরবত, নাশতা, পানি সহ দাঁড়িয়ে আছে। নতুন জামাই খালি পানি সামনে দেওয়া যায় না তাই সঙ্গে করে নাশতা নিয়ে এসেছে। তবে সময় নষ্ট করলো না সে। নাশতার ট্রেটা টেবিলের ওপর রেখে মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় দরজাটা বাইরে থেকে সামান্য ভেজিয়ে দিয়ে গেলো। নির্ঝর পানির গ্লাসটা তুলে নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেলো। ভ্রমরের সরু চোখে সেদিকে একবার চেয়ে বললো,’আসবেন কবে আপনি?’

-‘কি জানি ছুটি পাই কবে!’, স্বতঃস্ফূর্ত জবাব নির্ঝরের।

ভ্রমর চুপ করে গেলো। নির্ঝর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’তুমি আমার ওপর খুব রাগ করে আছো তাই না ভ্রমর?’

-‘আমার রাগের আপনি কেয়ার করেন?’

এই কথার পর শত চেষ্টা করেও আলোচনা জমাতে পারলো না নির্ঝর। স্থিরভাবে কিছুক্ষণ ভ্রমরের মুখের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সুযোগটা হাতছাড়া করলো না ভ্রমর। গম্ভীর গলায় বললো,’কথা বলছেন না যে? নাকি আপনি ভেবেছেন রাগ করার অধিকার শুধু আপনার একার আছে?’

-‘তা কেন হবে? কিন্তু যাওয়ার সময় আমার সাথে ঝগড়া করবে?’

-‘সেজন্যই তো বলছি কথা বাড়াবেন না। নিজের কাজে যান।’

-‘আজকে আমাদের বিয়ে হলো। সবকিছু ভুলে আজকে কি একটু হাসিমুখে কথা বলা যায় না?’

-‘না যায় না। আপনি যা করেছেন এর পরে আর আপনার সাথে হাসিমুখে কথা বলা সম্ভব না।’

আবারও দরজায় খটখট। ভ্রমরের মেজো ভাই এসে জানালো নিচে সবাই নির্ঝরের জন্য অপেক্ষা করছে, ফ্লাইটের সময় হয়ে যাচ্ছে তাঁর। ভ্রমর দরজার দিকে ইশারা করে বললো,’যান আপনার দেরী হয়ে যাচ্ছে।’

নির্ঝর বুঝলো এভাবে কাজ হবে না। চট করে উঠে দাঁড়ালো সে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে ভ্রমরের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,’ঠিক আছে যাচ্ছি। কিন্তু ধরো, যাওয়ার পর হঠাৎ করেই খবর পেলে লন্ডনের যাওয়ার পথে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটা বিমান ক্র‍্যাশ হয়েছে। এবং সেই দুর্ঘটনায় নির্ঝর রহমান নামক এক যুবকের মৃত্যু! তখন কি করবে?’

কেউ যেন গলিত লোহা ঢেলে দিলো ভ্রমরের কর্ণকুহরে। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো তাঁর।ভয়ে আঁতকে উঠলো সে। রাগে, ক্ষোভে দিশেহারা হয়ে নির্ঝরের দিকে চাইলো। চেঁচিয়ে উঠে বললো,’আপনি কি মানুষ? আপনার কি মায়া দয়া বলতে কিচ্ছু নেই? নিজের স্বার্থে আপনি আমাকে এমন জঘন্যভাবে ভয় দেখাতে পারলেন? একটুও বুক কাঁপলো না আপনার। আশ্চর্য?’ বলতে বলতেই কেঁদে ফেললো সে। নির্ঝর হতভম্ভ! তাঁর বলা কথাগুলো ভ্রমরকে এতটা আঘাত করবে ভাবতেই পারে নি সে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে মুচকি হেসে বললো,’জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে সয়ং সৃষ্টিকর্তা ঠিক করে দেন। সব কিছুই অনিশ্চিত। যে কোন মুহূর্তে আমরা যে কেউ মারা যেতে পারি। আমি তো শুধু সম্ভাবনার কথা বলেছি।’

ভ্রমর ধমকে উঠে বললো,’আবার? সরে যান, সরে যান আপনি আমার সামনে থেকে।’

নির্ঝর বিপাকে পড়ে গেলো। নিজের কথায় নিজেই ফেঁসেছে সে। ভ্রমরের রাগ কমাতে গিয়ে উল্টো তাকে কাঁদিয়ে দিয়েছে। নিরুপায় হয়ে প্রসঙ্গ পরিবর্তনের চেষ্টা করে পকেট থেকে একটা গিফট বক্স বের করে ভ্রমরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’এটা আমি নিজে পছন্দ করে কিনেছি তোমার জন্য। ভালো লাগলে পরো প্লিজ।’ বক্সটা টেবিলের ওপর রেখে অন্য পকেট থেকে নিজের ব্যবহারের রুমালটা বের করে ভ্রমরকে দিলো, চোখ মোছার জন্য।
রুমাল নিয়ে চোখ মুছলো ভ্রমর। ভ্রমর শান্ত হয়েছে ভেবে নির্ঝর মিষ্টি হেসে বললো,’আসি?’
তারপরই বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো সে।কিন্তু ভ্রমর পথ আটকালো। কি ভীষণ একটা ভয় তার মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে মানুষটা? সে কি জানে,যে যতক্ষণ না লন্ডন গিয়ে পৌঁছাচ্ছে ততক্ষন আর একমুহূর্তও শান্তিতে থাকতে পারবে না ভ্রমর। তাঁর সকরুণ মুখের দিকে চেয়ে ঠোঁট কামড়ালো নির্ঝর। মজা করে ফেলার পর এখন আফসোস হচ্ছে। এভাবে বলাটা একদম ঠিক হয় নি। ভ্রমর বাস্তবিকই ভয় পেয়েছে। ব্যপারটাকে হালকা করার চেষ্টা করে মুচকি হেসে বললো,’পৌঁছে তোমাকে ফোন দেবো কেমন?’

ভ্রমর জবাব দিলো না। মুখ ফিরিয়ে নিলো। নির্ঝর আরো একবার ঘড়ি দেখে বললো,’দেরী হয়ে যাচ্ছে যে ভ্রমর?’
ভ্রমর চোখ মুছে গম্ভীর গলায় বললো,’তো যান না আমি কি আপনাকে ধরে রেখেছে?’

-‘একটু তো হাসো প্লিজ। কালরাত থেকে মা-ও কাঁদছে। এখন তুমি মুখ ভার করে আছো। আমার ভালো লাগছে না। যাওয়ার সময় তুমি একটু হাসো প্লিজ।’

-‘অকারণে হাসতে পারবো না।’

-‘ঠিক আছে। তবে বলো কি করলে তোমার রাগ কমবে?’

ভ্রমর জবাব দিলো না। নির্ঝর কি করলে তাঁর রাগ কমবে এটা সে জানে না। কিন্তু এইমুহূর্তে অন্যরকম দুশ্চিন্তা, ভয় তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তাঁকে চুপ করে থাকতে দেখে নির্ঝর হতাশমুখে বললো,’আমি তবে আসি?’ ঠিক তখুনি আকুতিভরা কন্ঠে বলে উঠলো সে,’যাওয়ার আগে আপনি আমাকে একটু ছুঁয়ে দিয়ে যান প্লিজ।’

নির্ঝর হতভম্ভ হয়ে চেয়ে রইলো। ছুঁয়ে দেবে মানে? ব্যপারটা বোধগম্য হতেই মুচকি হেসে ভ্রমরকে কাছে টেনে নিয়ে স্নেহভরে তাঁর কপালে চুমু খেয়ে বললো,’তোমার সব অভিমান, রাগ, অভিযোগের পাওনা আমার কাছে জমা আছে ভ্রমর। আজকের টাও নাহয় তোলা থাক! ফিরে এসে হিসেব সমেত বুঝিয়ে দেবো সব। এবার আমি আসি কেমন? মন দিয়ে পড়াশুনা করো তুমি।’

ভ্রমরের একফোঁটাও জবাব দিলো না। দুহাতে নির্ঝরের শার্টের কলার চেপে ধরে হুহু করে কেঁদে ফেললো। নির্ঝর বেশ বুঝতে পারলো তার ইতোপূর্বে বলা কথাটার ফলাফল স্বরূপই এসব হচ্ছে। মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে সে। ভ্রমরের এভাবে ভয় দেখানো মোটেই উচিৎ হয় নি তাঁর। এখন ভ্রমরের কান্না দেখে তাঁর নিজেরই ভয় হচ্ছে। তথাপি ভ্রমরের মাথায় একটা হাত রেখে বললো,’ইনশাআল্লাহ কিচ্ছু হবে না আমার। আমি পৌঁছেই তোমাকে ফোন দেবো।’

ভ্রমরের কান্না থামার কোন লক্ষ্মণই নেই। সে হাউমাউ করে কাঁদছে। কান্নার আওয়াজ যেন বাইরে না যায় তাই দরজার ছিটকিনি তুলে দিলো নির্ঝর। টেনে ভ্রমরকে খাটের বসালো। নিজে তাঁর মুখোমুখি বসে বললো,’তাকাও আমার দিকে?’ ভ্রমর চাইলো না। নির্ঝর হাত একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,’বোকার মত কেন কান্নাকাটি করছো ভ্রমর? ভাগ্যের ওপর কারো হাত নেই। কখন কার সঙ্গে কি হবে তা কেউ বলতে পারে না। আমাদের সবার জীবনই অনিশ্চিত! তাই আমাদের কাজ হচ্ছে কেবল সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা রাখা। একটা কথা সব সময়, মনে রাখবে তোমার সাথে যা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে যা হবে সব তোমার ভালোর জন্যই হবে। সব কাজের মধ্যেই সৃষ্টিকর্তা তোমার জন্য কল্যান নিযুক্ত করে রেখেছেন। আল্লাহ যা করেন মানুষের মঙ্গলের জন্যই করেন। ‘

এবার ভ্রমর কিছুটা শান্ত হলো। কান্না থামলো তাঁর। নির্ঝর হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে তাঁর চোখের পানি মুছে দিয়ে মিষ্টি হেসে বললো,’যা বলেছি মনে থাকবে?’
তারপর ভ্রমরের জবাবের অপেক্ষা না করেই উঠে দাঁড়ালো সে। ভ্রমর তার একটা হাত চেপে ধরলো। অবনত মস্তকেই ভীত, অনুচ্চস্বরে সরে বললো,’আমি আপনাকে ভালোবাসি। অনেক, অনেক,অনেক ভালোবাসি। এত ভালো আমি কোনদিন কাউকে বাসি নি!’ নির্ঝর মিষ্টি করে হাসলো। বললো,’আমি জানি। তাই জন্যই এত নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। আমার পাওনার চাইতে অনেক বেশি ভালোবেসেছো তুমি। কিন্তু সত্যি বলতে, আমাকে এতখানি ভালো না বেসে যদি এর কিঞ্চিৎ পরিমানও নিজেকে ভালোবাসতে তবে আমি আরো অনেক বেশি খুশি হতাম ভ্রমর! বিশ্বাস করো এর চেয়ে অনেক, অনেক, অনেক বেশি খুশি হতাম!’

নির্ঝরের এই কথাটা মানতে পারলো না ভ্রমর। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। এই আঁতেল লোকটা নিজে যেমন স্বার্থপর ভ্রমরকেও তেমন স্বার্থপর হতে বলছে। গোঁজমুখে বললো, ‘তবে আমিও তো বলতে পারি, আপনি পড়াশোনাকে আরেকটু কম ভালোবেসে আমাকে আরেকটু বেশি ভালোবাসলে আমি আপনার চাইতে আরো বেশি খুশি হতাম। বলবো না কারণ আমি আপনার মত স্বার্থপর নই।’

নির্ঝর শব্দ করে হাসলো। হাসির মাঝেই ফের দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। আপন মনেই বললো,’এটা অবশ্য ঠিক বলেছো। আদর্শ প্রেমিক আমি সত্যিই হতে পারি না। তোমার মত করে নিজের সমস্তটা দিয়ে তোমাকে আমি ভালোবাসতে পারি নি। সমাজ, পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে তোমার চাইতে অনেক উপরে রেখেছি। অনেক আঘাত, অপমানে তোমাকে দূরে সরানোর চেষ্টা করেছি। সেই আঘাতে আমি নিজে কতটা জর্জরিত হয়েছি সেসব থাক। কারণ তোমার পাহাড়সম ভালোবাসার কাছে মুখফুটে নিজের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করতে আমার ভয় হয়। লজ্জা হয়! তবুও আজকে একটা কথা তোমাকে বলতে চাই ভ্রমর। তোমাকে আমি একান্তে যতটুকু ভালোবেসেছি তাতে কোন খাদ ছিলো না, সেটুকু একান্তই তোমার ছিলো। আমি তোমাকে আমার প্রেমিকার চাইতে বেশি অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে কামনা করছি। তাই হয়ত তুমি আমার মনের গভীরে ছিলে কিন্তু প্রকাশে ছিলে না।’

ভ্রমর অবাক, মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছে। হঠাৎ করেই নিজেকে কোন এক স্বার্থক উপন্যাসের হিরোইন মনে হচ্ছে তাঁর। আঁতেলটা এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে? এসব যেন তো স্বপ্নেও ভাবে নি ভ্রমর! হোক না কথাগুলো নাটকীয় কিন্তু ভ্রমরের হৃদয়কে তো স্পর্শ করেছে! তাঁকে অবাক, পলকহীনভাবে হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে নির্ঝর খানিকটা লজ্জা পেলো। গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,’যাই হোক, দুর্ভাগ্যক্রমে যখন আমার মতন একটা স্বার্থপর লোকের সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়েই গিয়েছে তখন তো আর কিছুই করার নেই? তাই এই স্বার্থপর লোকের আরেকটা স্বার্থ আছে তোমার কাছে।

-‘কি?’ অদৃশ্য খুশির ঝলক ভ্রমরের চোখেমুখে।

পুনরায় ব্যথিত হলো নির্ঝর! ভ্রমরের খুশিতে সামিল হতে পারলো না সে! আফসোস ফুটে উঠলো চেহারায়! কেন সে এইমুহূর্তে কথাগুলো বললো? আহা! অবুঝ নারীহৃদয়! ভ্রমর যদি সব অপমান ভুলে যায়? কিন্তু নির্ঝর তো চায় না ভ্রমর এত সহজে সব কিছু ভুলে যাক! সে চায় ভ্রমর মাথা উঁচু করে দাঁড়াক! নিজ জ্ঞানের আলোয় জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠুক! তার ভেতরে নির্ঝরকে দেখিয়ে দেবার স্পৃহা তৈরী হোক! তবেই তো মুক্তি নির্ঝরের! নতুবা ভ্রমরকে করা আঘাতগুলো যে শান্তিতে থাকতে দেবে না তাঁকে! ভ্রমরের প্রশ্নের জবাবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’আমি চাই তুমি তোমার অভিমানের পালা জারি রাখো। আমি চলে যাচ্ছি ভেবে যেন কোন অবস্থাতেই পড়াশুনায় কোন গাফলতি না করো। ফিরে এসে আমি যেন আমার বউয়ের নামের পাশে সুন্দর করে ডাক্তার লিখাটা দেখতে পাই! নয়ত বুঝবো তুমি আমাকে ভালোবাসো নি। ‘

-‘তখন যদি আমি আপনাকে ছেড়ে চলে যাই?’

নির্ঝর হাসলো। বললো,’তবুও আমি চাই, তুমি সবাইকে দেখিয়ে দাও! মানুষ চাইলে সবই পারে। তুমিও পারবে।’

-‘কিন্তু এই রিস্কটা নিয়ে আপনার লাভ?’

-‘শান্তি পাবো। মনে হবে নির্ঝরের ভ্রমর তাঁর অপমানের যোগ্য জবাব দিতে জানে। বিশ্বাস করো সেদিন অনেক শান্তি পাবো।’

‘নির্ঝরের ভ্রমর?’ মনে মনে আউড়ে নিলো ভ্রমর। উহুঁ! ভ্রমরের নির্ঝর!
‘নির্ঝরের ভ্রমর’ নাকি ‘ভ্রমরের নির্ঝর’ কোনটাবেশি সুন্দর? আপন মনেই হাসলো সে। চিকচিক করা চোখের পানি লুকিয়ে বললো,’এতদিন কেন বলেন নি ?’

-‘বলেছি! কিন্তু দাবি করতে পারি নি।’

-‘কেন করেন নি? সেই অধিকার তো আমি আপনাকে দিয়েছি!’

-‘তুমি দিলেই যে আমি নিতে পারি তেমন যদি হতো তবে যেদিন তুমি আমার ঘরের দরজায় হানা দিয়েছিলে সেদিনই তো নিতে পারতাম? এত অপেক্ষা কেন?’

-‘সেদিন আমি ভুল করেছিলাম। কিন্তু এর পরেও তো আরো অনেকবার আপনার কাছে ছুটে গেছি?’

-‘সেই ছুটে আসাতেও যে ভুল ছিলো সেটাও তুমি একদিন বুঝতে পারবে। এভাবে হয়ত গোটা আমিটাই একদিন তোমার কাছে ভুল প্রমাণিত হবো। তাই আগে থেকেই বেধে ফেললাম তোমাকে। আজ থেকে তুমি সম্পূর্ণ আমার! তোমার সবকিছুর ওপর শুধু আমার অধিকার!’

মিনিট খানেক নিরবে নির্ঝরের মুখের দিকে চেয়ে রইলো ভ্রমর। থেকে বললো,’উল্টোটাও তো হতে পারে? হতে পারে কখনোই আমার কাছে ভুল মনে হলো না?’

নির্ঝর মুচকি হাসলো। সহাস্যে মাথা দুলিয়ে বললো,’পারে! কারণ উল্টোদিকের মানুষটা তুমি! আর সেজন্যই হয়ত কথাগুলো এত নিশ্চিন্ত মনে আমি বলতে পেরেছি!’

ভ্রমর জবাব দিলো না। কাছে এসে নিরবে সালাম করলো নির্ঝরকে। অপ্রত্যাশিত হলেও হেসে ফেললো নির্ঝর। ভ্রমরের মাথায় একটা হাত রেখে দুষ্টুমির স্বরে বললো,’নিজেকে আজকে পতি পরমধন মনে হচ্ছে! ঐযে কথায় আছে না পতি নারীর গতি! ঠিক তেমন।’ তারপর হাসতে হাসতেই ভ্রমরের মাথায় হাত রেখে বললো,’দোয়া করি, বেঁচে থাকো আমার বুদ্ধিহীন, অবুঝ, নির্বোধ প্রিয়তমা! স্বামী সন্তান নিয়ে হাজার বছর বেঁচে থাকো। আর সারাজীবন ঠিক এভাবেই বোকার মত এই অধমকে ভালোবেসে যাও।’ কথা শেষ করে আবারো জোরে সোরে হেসে উঠলো সে। ভ্রমরও সুযোগ হাতছাড়া করলো না। সজোরে নির্ঝরের পায়ে চিমটি কেটে বললো,’দুনিয়াতে সব বুদ্ধি কেবল আপনিই আছে না? আর বাদবাকি সবাই বোকা।’

লাফ দিয়ে সরে গেলো নির্ঝর। পা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো,’উফ! ব্যথা পাই নি বুঝি? আমি কি বাদবাকি সবাইকে বোকা বলেছি? বাকি সবাই ঠিকই আছে। বোকা শুধু তুমি।’

ভ্রমর কোমরে হাত রেখে মারমুখী ভঙ্গিতে বললো,’সালাম করেছি বলে ভাব বেড়ে গেছে না? বিয়ের দিন বরকে সালাম করতে হঅয় তাই করেছি। এত ভাব নেওয়ার কিছু নেই।’ নির্ঝর পুনরায় হেসে উঠে কিছু বলতে যাচ্ছিলো ভ্রমর তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,’আপনার দেরী হয়ে যাচ্ছে না?’

নির্ঝর ঘড়ি দেখে আঁতকে উঠলো। ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,’সর্বনাশ! এবার না বেরোলে প্ল্যান আমাকে রেখেই লন্ডনে চলে যাবে।’

এতক্ষনে হাসি ফুটলো ভ্রমরের ঠোঁটে। শব্দ করে হেসে উঠে কিঞ্চিৎ ঠাট্টার সুরে বললো,’বেশ হবে। স্যার নির্ঝরচন্দ্র বিদ্যাধর থেকে আবার একেবারে নির্ঝর রহমানে নেমে আসবেন!’ তার হাসি দেখে নির্ঝরও হাসলো। প্রশান্তির হাসি! হাসিমুখেই বললো,’সে নাহয় বেশ হবে। কিন্তু তুমি যদি পড়াচোর মিসেস রহমান থেকে ডাক্তার জিনাত রহমানে (ভ্রমর) কনভার্ট না হয়েছো তবে দেখো আমি তোমার কি করি?’
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here