ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,21 অন্তিম_পর্ব

0
5610

ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে,21 অন্তিম_পর্ব
অরিত্রিকা আহানা

রিসেপশনের পর অবশেষে অফিসিয়ালি নিজের বউকে কাছে পেলো নির্ঝর। বিছানায় বউ সেজে বসে আছে ভ্রমর। লাল টুকটুকে একটা লেহেঙ্গা পরনে তাঁর। গা-ভর্তি দামী গহনা। বিয়ে উপলক্ষ্যে দুপক্ষই খরচে কোন কমতি রাখে নি! জাঁকজমকভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে।
সব অনুষ্ঠান শেষে ঘরে ঢোকার অনুমতি পেলো নির্ঝর। এর জন্যে ভ্রমরের কাজিনরা ভাবিরা মিলে খুব বড়সড় একটা অ্যামাউন্ট খসিয়েছে তাঁর কাছে থেকে। ঘরে ঢুকে দরজার ছিটকিনি তুলে দিলো নির্ঝর। চোখ থেকে চশমাটা খুলে টেবিলের ওপর রাখলো। গলার টাইটা সামান্য ঢিলা করে হাত ঘড়িটা খুলতে খুলতে ভ্রমরকে উদ্দেশ্য করে বললো,’যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।’

ভ্রমর অবাক! চোখ কপালে তুলে বললো,’আপনি দেখবেন না?’

নির্ঝর হাসলো! হাসিমুখেই বললো,’দেখেছি। সারাদিনই এই ভারী মেকাপ নিয়ে ছিলে। এবার ফ্রেশ হয়ে আসো।’

-‘সেটা আমি বুঝবো। আপনার দেখার আছে আপনি দেখুন। আমি এখন মেকাপ তুলবো না।’

নির্ঝর আবারো হাসলো। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে তাঁর! সারাদিনের খাটুনি! বন্ধুবান্ধবের সাথে হৈ-হুল্লোড় সব মিলিয়ে ভীষণ পরিশ্রান্ত সে। নিচের ঠোঁটটা কামড়ে বিস্মিত, পরিশ্রান্ত কন্ঠে মিষ্টি হেসে বললো,’তুমি এখনো আগের মতই আছো ভ্রমর! একটুও বদলাও নি!’

-‘কেন বদলে গেলে আপনি খুশি হতেন?’

-‘সব আমার খুশির জন্যই কেন করতে হবে? নিজের কথাও তো একটু ভাবতে পারো।’

কথা শেষ করে নির্ঝর আলমারি থেকে ফ্রেশ হওয়ার জন্য জামাকাপড় বের করতে গেলো। সে চলে যাওয়ার পর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ভ্রমর। এতগুলো বছরেও নিজেকে একটুও পরিবর্তন করতে পারে নি সে। শক্ত রাখতে পারে নি সে! বাইরে থেকে যদিও তাকে এখন অনেকটাই ম্যাচিউর মনে হয় বস্তুত এখনো আগের সহজ সরল ভ্রমরই রয়ে গেছে সে! তাঁর মনটা এখনো আগের মতনই নির্ঝরের কাছে পাওয়ার জন্য উন্মাদ! এতগুলো বছরে তাঁর এই চাওয়াটুকুর ছিটেফোঁটাও পরিবর্তন হয় নি! বরং বেড়েছে। এখনো নির্ঝর কাছে এলে তার সব কেমন যেন ওলটপালট হয়ে যায়! নিজেকে প্রমাণের কোন মিথ্যে নাটক তাঁর আসে না! হয়ত নির্ঝরকে খুব বেশি কাছে পায় নি বলেই এমন হয়! কিংবা ভালোবাসায় মাত্রাতিরিক্ত অন্ধ সে, অথবা সে চায় তার কাছের মানুষটা তাঁর সমস্ত খুঁতগুলোকে, সমস্ত পাগলামিকে মেনে নিয়ে তাঁকে ভালোবাসুক! যেমনটা সে বেসেছে! এত কিছুর পরেও তাঁর কাছে নির্ঝর নিখুঁত! নির্ঝরের কোন কিছুই তাঁর খারাপ লাগে না! তাঁর প্রতিটা কাজ, প্রতিটা কথা ভ্রমরের কাছে পরম সত্য! তাই নির্ঝরের কথার জবাবে মুখটা গম্ভীর করে বসে রইলো সে! নির্ঝর নিরবে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো! বস্তুত মুখে না বললেও সে নিজেও চায় না ভ্রমর বদলাক! কিন্তু এই কথা গুলো না বললে নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হবে তাঁর! তাই মির্থ্যে কর্তব্যের কথা গুলো বলতে হয় তাঁকে! তবে আজকে আর চুপ রইলো না। ভ্রমরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,’একটা সত্যি কথা বলি?’

-‘কি?’

-‘এই কর্তব্যের কথাগুলো কেন বলি জানো?

-‘কেন?’

-‘কারণ এগুলো আমাকে বলতে হয়! কিন্তু সত্যি কথাটা হলো, আমি চাই না তুমি বদলাও! আমি চাই, আমাকে কাছে পাওয়ার আকুলতা যেন এমনি করে তোমার সারাজীবন থাকে। তাহলে আমি নিশ্চিন্তে জীবন পার করে দিতে পারবো!’

ভ্রমর খুশি হলেও কিঞ্চিৎ ঠাট্টার সুরে বললো,’তাই নাকি?’

নির্ঝর চট করে তাঁর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। মুচকি হেসে বললো,’শুনতে হয়ত কিছুটা স্বার্থপর মনে হতে পারে! কিন্তু আমি সত্যিটা চাই না তুমি বদলাও! আমি ভ্রমরকে সারাজীবন এমন বোকা, সহজ সরল হিসেবে চাই!’

-‘হ্যা! আমাকে বুদ্ধু পেয়েছেন। খালি আমিই ভালোবেসে যাবো, ভালোবাসার কথার বলে যাবো আর আপনি ভাব নেবেন!’

নির্ঝর ভ্রমরের ডান হাতটা নিজের মাথায় রেখে ইশারায় ভ্রমরকে বিলি কেটে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বললো,’তুমি তো সেটাই করো। এখন আমি বললাম দেখে ভাব হয়ে গেলো?’

-‘হ্যাঁ গেলো।’

-‘ঠিক আছে। আমি আর কিচ্ছু বলবো না, তোমার যা খুশি তুমি করো।’

ভ্রমর তাঁর চুলে বিলি কেটে দিতে দিতেই বললো,’আমি কিচ্ছুই করবো না। ইনফেক্ট এখন থেকে আমি আর ভালোবাসবো না আপনাকে। এখন থেকে আপনি আমাকে ভালোবাসবেন।’

নির্ঝর হাসলো। ঠাট্টামূলক গা জ্বালানো হাসি! খপ করে ভ্রমরের হাতটা ধরে ফিসফিস করে বললো,’বাসবে না আমাকে ভালো?’

-‘না!’

নির্ঝর আবারো হাসলো। পুনশ্চ গাত্রদাহী হাসি! হাসতে হাসতেই আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে বললো,’পারবে না! আমাকে ভালোবেসে না বেসে তুমি থাকতে পারবে না!’

-‘এত কনফিডেন্স ভালো নয়!’

-‘নিজের ওপর না হলেও তোমার ওপর আমার পুরো কনফিডেন্স আছে! তোমার চোখের দিকে তাকালেই আমি তোমার ভালোবাসার গভীরতা বুঝতে পারি!’
তারপর না থেমেই বললো,’তোমার চোখদুটি হচ্ছে আকাশ। আর আমি হলাম সেই আকাশের তারা।’ এরপর গুনগুন করে গাইলো সে,’ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে আমি হয়ে গেছি তারা।’ গান শেষে মিষ্টি হেসে বললো,’গানটা বোধহয় আমার জন্যই লিখা হয়েছে তাই না?’
ভ্রমর হাসলো। নির্ঝর অনুরোধের সুরে বললো,’গাও না একটু? তোমার গলায় শুনি!’

-‘পারবো না। এতরাতে সবাই আমাকে পাগল বলবে!’

নির্ঝর দুষ্টু হেসে বললো,’তুমি তো পাগলই! একেবারে বদ্ধ পাগল!’

-‘আপনি কি?’

-‘তোমার বর!’

-‘ঢং!’

-‘প্লিজ?’

-‘আচ্ছা ঠিক আছে গাইবো কিন্তু তার আগে আপনাকে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে?’

-‘কী প্রশ্ন?’

-‘ভালোবাসা এবং প্রেমের মধ্যে পার্থক্য কি?’

নির্ঝর এবার শব্দ করে হাসলো। হাসতে হাসতেই জিজ্ঞেস করলো,’ভাবি জিজ্ঞেস করেছে তাই না?’

-‘হ্যাঁ। আমাকে করেছিলো। কিন্তু আমি পারি নি।’

-‘পারবে কি করে তুমি তো একটা বোকা!’

ভ্রমর ভেংচি কেটে বললো,’হ্যাঁ! আমি বোকা! তো চালাক হয়ে আপনি কোন দুনিয়ার কি উদ্ধার করে ফেলেছেন? বিয়ে তো সেই আমাকেই করতে হলো!’

এবার নির্ঝরের হাসিটা বেশ জোরালো হলো। পুরো ঘর কাঁপিয়ে হো!হো! করে হেসে উঠলো সে। হাসির চোটে চোখে পানি চলে এলো। বহু কষ্ট হাসি থামিয়ে বললো,’বাহ! কি সুন্দর যুক্তি! সাধে কি তোমাকে আমি পাগল বলি?’

ভ্রমর মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো মানুষটার হাসির দিকে! ইশ কি সুন্দর! কিন্তু মোটেই বোকা নয় ভ্রমর! একমাত্র নির্ঝরের সামনে এলেই সে বোকা হয়ে যায়! সত্যিই বোকা হয় কি না কে জানে? নাকি বোকা হবার ভান করে! নির্ঝরের কথার জবাবে কোনরকম তর্কে না জড়িয়ে বললো,’আচ্ছা ঠিক আছে আমি বোকা! এবার আপনি আমাকে উত্তরটা বলুন?’

-‘আমি কি পাবো?’

ভ্রমর অধৈর্য কন্ঠে বললো,’বললাম তো গান গাইবো!’
নির্ঝরের ভেবেছিলো এই সুযোগে ভ্রমরের সাথে খানিকটা দুষ্টুমি করবে সে। কিন্তু ভ্রমরের বিরক্ত মুখের দিকে চেয়ে দমে গেলো। শোয়া থেকে উঠে বসলো সে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মুচকি হেসে বললো,’ওকে? তাহলে তোমার কোয়েশ্চেন কি ছিলো? ভালোবাসা এবং প্রেমের মধ্যে পার্থক্য কি? তাইতো?’
ভ্রমর উপরে নিচে মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বোঝালো! নির্ঝর মুচকি হেসে বললো,’ভালোবাসা এবং প্রেমের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে,..ভালোবাসা সার্বজনীন কিন্তু প্রেম সার্বজনীন নয়! ভালো সবাইকে বাসা যায়। যেমন আমি তোমাদের সবাইকে ভালোবাসি। কিন্তু মাকে সবার চাইতে বেশি ভালোবাসি। আর প্রেম? প্রেম মানেও ভালোবাসা! তবে একটু অন্যরকম ভালোবাসা!’

-‘কিকরম?’

-‘প্রেম করতে হয় কেবল প্রিয়তমার সঙ্গে। প্রিয়তমা ছাড়া প্রেম হয় না! আর আমার সেই প্রিয়তমাটা হচ্ছো তুমি!’

ভ্রমর মুচকি হাসলো! জবাবটা তাঁর পছন্দ হয়েছে! তবে মুখে স্বীকার না করে কিঞ্চিৎ অভিমানের সুরে বললো,’প্রিয়তমা না ছাই। প্রিয়তমা হলে এত দুঃখ দিতে পারতেন?’

আবারো ভ্রমরের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো নির্ঝর! দুষ্টু হেসে বললো’শেক্সপিয়ার বলেছিলেন,’যন্ত্রণা নাও, নিখুঁত হও।’

-‘কচু!’ বিরক্তিতে কুঞ্চন দেখা দিলো ভ্রমরের কপালে! নির্ঝর ডান হাতের আঙুলগুলো চুলের গোড়ায় বোলাতে বোলাতে বললো,’ঠিকই বলেছো কচু। কচু টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি! জ্ঞানীরা সব ভুল বলে গেছেন! নতুবা রবীঠাকুরও তো বলেছিলেন,’সে আমাকে অল্প পাইয়াছিলো বলিয়াই আমাকে পাইবার আকাঙ্ক্ষা তাহার কিছুতেই মিটিতে চাহিত না।’ কিন্তু এই কথাটাও সম্পূর্ণ ভুল।’

-‘এখানে ভুল কি দেখলেন? ঠিকই তো বলেছেন উনি?’

-‘তোমার জন্য ঠিক হতে পারে কিন্তু আমার জন্যে না। আমি কাছে ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা কখনোই অল্প পাওয়া কিংবা বেশি পাওয়ার ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে ভালোবাসার তীব্রতার ওপর। কে কাকে কতটা ভালোবাসে তার ওপর। নতুবা আমি তো তোমাকে পুরোটা পেয়েছি! তুমিই তো বলো,তুমি আমাকে নিজের চাইতে বেশি ভালোবাসো! তাহলে এর পরেও কেন আমি তোমাকে আরো বেশি চাই। এবং আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি এই আকাঙ্ক্ষা আমার সারাজীবন থাকবে!’

ভ্রমর পুনশ্চ খুশি হলেও চেপে গেলো। নির্ঝর যখন ভালোবাসার কথা বলছে তখন একটুখানি ভাব তারও নেওয়া চাই। মুখ ভেংচি কেটে বললো,’মোটেও বিশ্বাস করি না আমি আপনার কথা। এতই যদি ভালোবাসতেন তবে আমাকে ঘর থেকে চূড়ান্তভাবে অপমান করে কেন বের করে দিয়েছিলেন?’

আত্মবিস্মৃত নির্ঝর সম্বিৎ ফিরে পেলো। সচেতন চোখে তাকালো ভ্রমরের মুখের দিকে চেয়ে! গম্ভীর গলায় বললো,’তুমি ভেবো না তোমাকে সেদিন ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলাম বলে আমি অনুতপ্ত! আমি মোটেও তাঁরজন্য অনুতপ্ত নই। সেদিন আমি তোমার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলাম, ইনফেক্ট শুধু সেদিন নয় প্রায় প্রতিদিনই আমি খারাপ ব্যবহার করেছিলাম তোমার সঙ্গে। তাই আমার কষ্ট হয়! কারণ আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো, হয়ত ভালোবাসো বলেই পাগলামিগুলো করেছো! কিন্তু তাঁর মানে এই নয় যে তোমার করা সব পাগলামি আমার কাছে জাস্টিফাইড! তুমি যদি তেমন ভেবে থাকো দ্যান ইউ মাইট বি রঙ! ভুল ভেবেছো তুমি!
আমার কাছে ভুল মানে ভুল, সবসময়ই ভুল! তাই তোমার করা কাজগুলোও ভুল। নান অফ দিজ আ জাস্টিফাইড টু মি! নট ইয়েট অ্যান্ড নট বিফোর!

ভ্রমর হতাশ, কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললো,’আসল রূপ ঠিক সামনে বেরিয়ে এলো তো? এতক্ষন কি বলছিলেন? আমাকে ভালোবাসেন? মিথ্যেবাদী! কচু বাসেন আপনি আমাকে!’

তাঁর রিয়েকশন দেখে হেসে ফেললো নির্ঝর। মুচকি হেসে বললো,’এখন আর এসব বলে লাভ কি? বিয়ে তো হয়ে গেছে আমার সাথে! চাইলেও আর আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না!’

-‘ও তারমানে সত্যি আপনি আমাকে ভালোবাসেন না?’

-‘আমি সেটা কখন বললাম?’

-‘তাহলে আমি যখন বলেছি আপনি প্রতিবাদ করলেন না কেন?’

নির্ঝর চিন্তিতমুখে মাথা নাড়িয়ে বললো,’তাইতো প্রতিবাদ কেন করলাম না? এরজন্য কি শাস্তি পাওয়া উচিৎ? সেদিনের মত দুশোবার কানে ধরে উঠবস? ওকে আমি রেডি। তুমিও আসো!’ কথা শেষ করেই উঠে বসলো সে। কিন্তু খাট থেকে নামলো না! চেপে ভ্রমর শুইয়ে দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে বললো,’প্র‍্যাক্টিকালি প্রতিবাদ করলে হবে?’

ভ্রমর লাজুক হেসে বললো,’ছাড়ুন! আমি ফ্রেশ হবো।’

-‘উহু! এখন আমি দেখবো। আমার টুকটাক সুন্দর বউটাকে দেখবো! তারপর ভালোবাসবো! তারপর তুমি ফ্রেশ হবে!’

ভ্রমর চুপচাপ মাথাটা এলিয়ে দিলো নির্ঝরের বুকে। ফিসফিস করে বললো,’আপনি সারাজীবন এভাবে আমাকে ভালোবাসলে আর কোন অভিযোগ থাকবে না আমার।’

নির্ঝর আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে নিলো তাঁকে। ফিসফিস করে বললো,’এবার গানটা গাও! ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে আমি হয়ে গেছি তাঁরা!’

-‘না গাইবো না!’

-‘কেন?’

-‘কারণ আপনি মোটেও আমার আকাশের তারা নন। আমার পুরোটা আকাশটাই আপনি!’

-‘ঠিক আছে তাহলে গাও,’ওগো আমার তারা দুটি চোখে তুমি হয়ে গেছো আকাশ!’

ভ্রমর হেসে ফেললো। আদুরে কণ্ঠে বললো,’গুনগুন করে গাই?’

-‘গাও!’

অতঃপর…..


ভ্রমর ঘরে ঢুকে দেখলো ড্রেসিংটেবিলের ওপর থেকে তাঁর ফাউন্ডেশন নিয়ে ফ্লোরে মাখাচ্ছে তাদের চার বছরের মেয়ে নাতাশা। তার হাতপা-ও ফাউন্ডেশনে মাখামাখি। ভ্রমর রাগে কটমট করে একবার নির্ঝরের দিকে একবার নাশাতার দিকে চাইলো! এই দৃষ্টির মানে নির্ঝরের বুঝতে বাকি নেই! এইমুহূর্তে মেয়ের কপালে শনি আছে। অতএব ভ্রমর নাতাশার কাছে পৌঁছানোর আগেই তাঁকে কিছু একটা করতে হবে। সেই উদ্দেশ্যেই খাট থেমে নেমে একঝটকায় মেয়েকে কোলে তুলে নিলো সে। ভ্রমর এগিয়ে আসতেই তাঁকে বাধা দিয়ে বললো,’খবরদার ভ্রমর! ওর গায়ে একদম হাত তুলবে না তুমি?’

-‘আপনি ওকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন কেন? ও জিনিস নষ্ট করছে আপনি দেখতে পাচ্ছেন না?’

-‘করুক। ওর বাপের কি কম আছে নাকি? তোমার কয়টা লাগবে বলো, আমি কিনে দেবো?’

ভ্রমর কোমরে হাত রেখে রাগে চোখমুখ লাল করে বললো,’আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে ওকে আপনি একাই ভালোবাসেন? আমি বাসি না?’

-‘আমি এত কিছু জানি না। তুমি আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলতে পারবে না ব্যস!’

-‘মেয়েকি আপনার একার? জিনিস নষ্ট করছে সেটা দেখতে পাচ্ছেন না? এই অভ্যেস ভালো? এখন থেকে শাসন না করলে বড় হওয়ার পরেও আগের অভ্যেস থেকে যাবে। আপনার এই ভালোবাসা ওর ক্ষতি করছে!’

ভ্রমরের কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু নির্ঝরই বা কি করবে? সে না ধরলে এক্ষুনি তার আদরের মেয়েটার পিঠে ঠাস ঠাস করে দুঘা বসিয়ে দিতো ভ্রমর। শাসন করার জন্য নির্ঝর বারণ করছে না কিন্তু তাই বলে যখন তখন গায়ে হাত তোলাটাও ঠিক নয়। এতে করে ভয় উঠে যায়।
এদিকে নিশাতা বাপের গলা জড়িয়ে ধরে গোল গোল চোখে ভ্রমরের দিকে চেয়ে গেছে। বিরক্ত লাগছে ভ্রমরের। রাগে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো সে। নির্ঝর ওর হাত টেনে ধরে নিজের পিঠটা এগিয়ে দিয়ে বললো,’প্লিজ ভ্রমর রাগ করো না। দরকার হলে তুমি আমাকে মারো, যত ইচ্ছা মারো। কিন্তু আমার সামনে আমার মেয়েটার গায়ে হাত তুলো না প্লিজ। আমার কলিজায় লাগে!’
নির্ঝরের করুণ মুখের দিকে চেয়ে হাসি পেয়ে গেলো ভ্রমরের। হাসি চেপে গম্ভীর দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে চাইলো। ডর ভয় বলে কিছু আছে না কিনা সন্দেহ আছে! ড্যাবড্যাব করে মায়ের দিকে চেয়ে আছে। সে বুঝে গেছে যতক্ষণ বাপের কোলে আছে
ততক্ষণ ভ্রমর তার কিছু করতে পারবে না। সুতরাং চিন্তার কোন কারণ নেই! অতঃপর মা মেয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে নিরব যুদ্ধ ঘোষণা করলো। নাতাশার ভাবখানা এমন যেন,’পারলে মেরে দেখাও।’ আর ভ্রমর? তাঁর চোখে ‘তোকে আমি পরে দেখে নেবো’ টাইপ দৃষ্টি!

দুদিন বাদের ঘটনা! মুখ গোমড়া করে খাটের ওপর বসে আছে ভ্রমর। তার পাশে বসে আছে নির্ঝর। বলা বাহুল্য আজকেও ভ্রমরের মেজাজ খারাপের কারণ নাতাশা। স্কুলে অ্যাডমিশনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো তাঁকে। সেখানে বারবার বলে দেওয়ার পরেও মিসের সামনে ঠিকই একই ভুলটা আবার করেছে নাতাশা। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো তাঁর বাবা কি করে? নাতাশার জবাব ছিলো তার বাবা মা দুজনেই ডাক্তার। অথচ বাসা থেমে ভ্রমর বারবার করে শিখিয়ে দিয়েছিলো মিস জিজ্ঞেস করলে বলবে তোমার বাবা টিচার, মা ডাক্তার! অ্যাডমিশন ফর্মেও তাই দেওয়া হয়েছে! কিন্তু নাতাশার এক কথা, তাঁর বাবার নামের আগে যেহেতু ডক্টর আছে তাঁর মানে তাঁর বাবাও ডাক্তার। জবাব শুনে ভ্রমর রেগে গেলেও নির্ঝর মুখটিপে হাসলো। মিসও হাসলেন! হাসিতে খানিকটা ভরসা ছিলো ভ্রমরের প্রতি!
কিন্তু তবুও ভ্রমর চিন্তায় গেলো না। যদি অ্যাডমিশন না হয়? এত ভালো একটা স্কুল! তাই বাসায় ফেরার পর থেকেই খেপে আছে সে। সুযোগ বুঝে নির্ঝরও আগেই মেয়েকে নাফিসা রহমানের ঘরে রেখে এসেছে। ভ্রমর যা খেপেছে কখন যেকোন মুহূর্তে মেয়ের ওপর চড়াও হতে পারে। অতএব তাঁকে নাফিসা রহমানের কাছে দিয়ে আসাটাই উত্তম!

ভ্রমরের চিন্তিত মুখের দিকে চেয়ে নির্ঝর মিটিমিটি হাসলো। এই তো সেদিনের কথা, কতটা ছেলেমানুষ ছিলো ভ্রমর! নির্ঝরকে পাওয়ার জন্য কত পাগলামিই না করেছিলো সে! সেই ভ্রমর এখন কতটা দায়িত্ববান, কতটা সচেতন মেয়ের প্রতি! টাইম ফ্লাইজ! মুচকি হেসে ভ্রমরের পাশে বসলো সে। ফিসফিস করে বললো,’নাতাশা তো ঠিকই বলেছে। তার বাবাও কিন্তু এক হিসেবে ডক্টর। তার পাগল মা-টাকে সুস্থ বানিয়েছে তো তাঁর বাবাই!’

-‘মজা রাখুন। আমার বিরক্ত লাগছে!’

ঠাট্টা জমবে না। ভ্রমর বাস্তবিকই খেপে আছে। অতএব ক্ষ্যান্ত দিলো নির্ঝর। সান্ত্বনার সুরে বললো,’এত সিরিয়াস হওয়ার কি আছে ভ্রমর? এই স্কুলে না হলে অন্য স্কুলে পড়বে। স্কুলের কি অভাব আছে নাকি? তারচেয়ে বরং নাতাশার সৃজনশীলতা নিয়ে ভাবো। ওর ছোট মাথায় যে এটুকু কাজ করেছে সেটাও তো অনেক।’

এবার খানিকটা শান্ত হলো ভ্রমর। বস্তুত, নাতাশাকে নিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি টেনশন করে সে। মাঝে মাঝে সেটা বাড়াবাড়িতে রূপ নেয়! হয়ত মেয়েকে অতিরিক্ত ভালোবাসে বলেই এমন করে কিংবা নিজের অতীতের ভয় থেকে! কম অপমান তো সহ্য করতে হয় নি তাঁকে! তাই নাতাশাকে সে মানুষের মত মানুষ করে তুলতে চায়! সৃষ্টিকর্তার কাছে তাঁর একটাই প্রার্থণা তাঁর মেয়েটা যেন পড়াশোনা করে নিজেকে যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে!

-‘কি হলো?’, জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নির্ঝরের। ভ্রমর
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নির্ঝরের বুকের কাছে ঘনিয়ে গিয়ে বললো,’কিছু না!’

-‘তবে? মুখটা এমন বানিয়ে রেখেছো কেন?’

এবারে ভ্রমর চেপে রাখা ভয়ের কথা স্বীকার করে নিলো নির্ঝরের কাছে। মলিন মুখে বললো,’আমার ভয় হয় জানেন, আমার মেয়েটাকেও যদি আমার মতন কষ্ট পেতে হয়? তাই আমি ওকে ছোটথেকেই লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতন মানুষ করে গড়ে তুলতে চাই।’ নির্ঝর হাসলো। ছোট্ট ভ্রমরের কত চিন্তা! ভ্রমরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,’তুমি মেয়ের মা! তোমার ভয় হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে এখনি এত চিন্তার কিছু নেই। নাতাশা এখনো অনেক ছোট..!’
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ভ্রমর বললো,’কিন্তু ছোট থেকেই তো ওর প্রতি যত্ন নিতে হবে?’

-‘হ্যাঁ! ছোট থেকেই ওর প্রতি যত্ন নিতে হয় এটা ঠিক। কিন্তু তাই বলে তো এখনই পড়াশুনা নিয়ে ওর মনে ভেতরে ভয় ঢুকিয়ে দিও না। এতে বরঞ্চ ওর ক্ষতি হবে।’

-‘তবে কি করবো?’

-‘আরেকটু সফট হও ওর প্রতি। তোমার প্রতি ওর ভরসা তৈরী করো। পড়াশুনার ব্যপারে ধৈর্য রাখো।

-‘ধৈর্য?’

-‘হ্যাঁ ধৈর্য। পড়াশুনার ক্ষেত্রে ধৈর্য খুব বড় একটা জিনিস! তোমার কি ধারণা যারা ঘন্টার পর ঘন্টা পড়াশুনা করে তাঁরা কি এমনি এমনি করে? এই যে আমার কথাই ধরো, ইউনিভার্সিটি জয়েন করেছি কিন্তু তাঁরপরেও তুমি আমাকে পড়তে দেখলে বকাবকি করো। কি মনে হয় তোমার? এমনি এমনি পড়ি? এমনি এমনি পড়তে কারো ভালো লাগে? না! এমনি এমনি পড়তে কারো ভালো লাগে না। আমারও লাগে না। কিন্তু পড়াশুনা করে আনন্দ পাই, মজা লাগে তাই করি। না পড়লে নিজেকে কেমন যেন খালি খালি মনে হয়! নাতাশাকেও তেমনি ভাবে গড়ে তুলতে হবে। ও যেন বাধ্য হয়ে নয়, আনন্দের সাথে পড়াশুনা করতে পারে সেইভাবে ওর মনমানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।’

-‘তবে আপনার মতন করে গড়ে তুলুন না ওকে?’

-‘ওমা! মেয়েকে মারার বেলায় তোমার মেয়ে! এই বেলায় আমি একা? কেন?’

-‘আমার ভয় করে ও যদি আমার মতন ফাঁকিবাজ হয়?’

নির্ঝর হো!হো! করে হেসে উঠে বললো,’সত্যি কথাটা তবে এতদিনে ফাঁস হলো? দোষ খালি আমার মেয়ের! মেয়ের মা ফাঁকিবাজ হলে মেয়ের আর ভালো হবে কি করে?’

তাঁর হাসির চোটে ভ্রমরও হেসে ফেললো। নির্ঝরের পিঠে আলতো চাপড় মেরে বললো,’অলক্ষুণে কথা বলবেন না তো। আমি জানি, আমার মেয়ে মোটেও ফাঁকিবাজ হবে না।’

-‘কি করে বুঝলে?’

-‘কারণ ওর বাবা আপনি।’

নির্ঝর হাসিমুখেই বললো,’পয়েন্ট টু বি নোটেড! কিন্তু আমি যে চাই আমার মেয়েটা যেন তার মায়ের মতন সরলসোজা,বোকা আর মিষ্টি হোক। যাকে ভালো না বেসে থাকা যাবে না!’

-‘আর পড়াশুনা?’

-‘ওটার দায়িত্ব মেয়ের বরের! আমি যদি মেয়ের মাকে সোজা করতে পারি তবে আমার মেয়ের দায়িত্বও জামাইয়ের! অতএব নো চিন্তা, নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও!’

কথা শেষ করে আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সে। ভ্রমর কপট রাগ দেখিয়ে বললো,’আপনি আমাকে সোজা করেছেন? আমি নিজে পড়াশুনা না করলে আপনি আমাকে দিয়ে করাতে পারতেন? নাকি আমার পড়া আপনি পড়ে দিয়ে ছিলেন?’

নির্ঝরের হাসি থামলো না। ভ্রমরকে টেনে জড়িয়ে ধরে বললো,’বিশ্বাস করো পারলে তাই দিতাম! পারলে তোমার পড়া আমিই পড়ে দিতাম!’ ব্যস! ভ্রমরের রাগ উধাও! এটুকুতেই গলে গেলো সে! নির্ঝরের সাথে একেবারে সেঁটে গিয়ে হাতের মুঠোয় তাঁর শার্টের কোনা খামচে ধরলো। অতঃপর স্বামী-স্ত্রীকে একদফা ভালোবাসাবাসির প্রস্তুতি চলছিলো ঠিক সেইমুহূর্তেই নাতশার খিলখিলিয়ে হাসির শব্দ শুনে দুজনেই চমকে উঠলো। কিছু বলার আগেই দুহাতে চোখ চেপে ধরে হাসতে হাসতেই দৌড় দিয়ে আবার ঘর চেয়ে বেরিয়ে গেলো নাতাশা। ভ্রমর ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,’ওকে ধরুন। মায়ের ঘরে গিয়ে কি উল্টোপাল্টা বলবে কে জানে!’

নির্ঝরের কোন নড়নচড়ন হলো না। ভ্রমরকে জড়িয়ে ধরে কাঠ হয়ে শুয়ে রইলো সে! ভ্রমর ঠেলা দিয়ে বললো,’কি হলো?’

-‘নাতাশা থাক মায়ের ঘরে। মা বুঝবে।’

-‘ছিঃছিঃ মা বুঝবে মানে? আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’

-‘হুম। বিয়ের পরে সব ছেলেদের একটু মাথা খারাপ হয়। আর যার বউয়ের এত সুন্দর সুন্দর কার্ভ আছে তাঁর তো আরো বেশি করে হয়! আমারও হয়েছে।’

ভ্রমর ঠাস করে নির্ঝরের হাতের উল্টোপিঠে একটা চড় মেরে বললো,’ভাষার কি শ্রী! উনি নাকি আবার প্রফেসর!’

-‘প্রফেসর হলে বউয়ের তারিফ করা যাবে না এটা তোমাকে কে বলেছে?’

-‘এটা তারিফ?’

-‘অবশ্যই তারিফ!’

প্রতিবাদে ভ্রমর আবারো কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখনি ঘরে নাতাশার আগমন। ভ্রমরকে ছেড়ে দিলো নির্ঝর। হাসিমুখে মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’আসো মা! কাছে আসো।’

নাতাশাও রাজকীয় ভঙ্গিতে বাপের দিকে এগিয়ে গেলো। তারপর সিংহাসনে অধিষ্ঠানের মত করেই নির্ঝরের বুকের ওপর উঠে বসলো। যেন এই আসনটা কেবল তাঁর জন্যই নির্ধারিত! নির্ঝর সকৌতুকে ভ্রমরের দিকে চাইলো। ভ্রমর হেসে ফেললো! মেয়ের গালে চুমু খেয়ে বললো,’একেবারে আমার জায়গাটাই দখল করতে হলো? পাঁজি মেয়ে! আগে আমার বর তারপর তোর বাবা।’ নাতাশা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু জায়গা ছাড়লো না। হাত পা ছড়িয়ে বাপের বুকের ওপর শুয়ে পড়লো সে। নির্ঝর দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে মুচকি হেসে বললো,’আমার মা জননী! আমার কলিজার টুকরা। আমার আম্মাজান!’ ভ্রমর মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলো দুজনার দিকে। জীবন আগের চেয়ে অনেক বেশি মধুর! মানুষের কল্পনার বাইরে মধুর! গুনগুন করে গেয়ে উঠলো সে,
“গানে নতুন করে এলো সুর
এ যেন আগের চেয়ে সুমধুর
নিয়ে এলে আমায় তুমি আজ বহুদূর
বয়ে চলেছে যে তাই ভালবাসার একধারা
এই জীবন ছিল
নদীর মতো গতিহারা দিশাহারা
ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে
আমি হয়ে গেছি তারা!”

.
.
.
সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here