আঁধারের মাঝে আলো,পর্বঃ ০৩
লেখকঃ আবির খান
ময়ূরীর দেওয়া কষ্ট আবিদ সেদিন আর সহ্য করতে পারে নি। এতটা অপমান এতটা কষ্ট ওকে সেদিন অনেক ব্যথিত করেছে৷ ও বাসায় এসে ওর বাবা-মাকে সব বলে দেয়। ওর বাবা সবটা শুনে বলে,
– বাবা তোকে আমি আমার শিক্ষায় বড়ো করেছি। বলেছিলাম কখনো কোন মেয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করবি না, বেয়াদবি কিংবা খারাপ কিছু করবি না৷ তোর কারণে যেন কখনো কারো কোন ক্ষতি না হয় আমি তোকে সেই শিক্ষাই দিয়েছি। তুই সেটাই মেনেছিস। দরকার নেই ওই ভার্সিটিতে আর পড়ার। আমি আমার বন্ধুর সাথে কথা বলে যেভাবে হোক তোকে অন্য একটা ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিব। তুই একটুও মন খারাপ করিস না৷ একটা কথা মনে রাখবি, যে যা করবে সে তা আবার ফিরে পাবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। মেয়েটা তোর সাথে ভালো করে নি৷ আল্লাহ ওকে ওর ভুল বুঝার তৌফিক দান করুক।
আবিদ সেদিন অনেক কাঁদে। কেঁদে কেঁদে মনের সব কষ্টগুলো ঝেড়ে ফেলে। তারপর কদিনের মধ্যেই ওকে নতুন আরেকটা ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দেয় ওর বাবা। অবশ্য অনেকটা দৌড়াদৌড়ি করে ওকে ভর্তি হতে হয়েছিল। ও ভেবেছিল এই ভার্সিটিতেও হয়তো ওকে কষ্ট পেতে হবে। লাঞ্চিত হতে হবে৷ কিন্তু ভাগ্যক্রমে আবিদের মতোই ওর ক্লাসে আরও কয়েকজন কালো ছেলে ছিল। ওকে পেয়ে তারা তো অনেক খুশি। ওদের নিজেদের মধ্যে ভালো একটা বন্ডিং আর গভীর বন্ধুত্ব হয়ে যায়। আবিদ ভুলেই যায় ও কালো। কারণ এখানে কেউ ওদের নিয়ে মজা করে না৷ সবাই মধ্যবিত্ত পরিবারের। আবিদের জীবনটা এবার সঠিক লাইনে চলে আসে। ওর মতো সৎ ছেলের সঙ্গ পেয়ে ওর বন্ধুরাও পড়াশোনায় অনেক মনোযোগী হয়ে যায়। ওরা খুব ভালো রেজাল্ট করতে থাকে। সবাই ওদের সাথে মিশে পড়াশোনা নিয়ে গল্প কথা করতে থাকে৷ আবিদ ভুলেই যায় যে কালোকে কেউ পছন্দ করে না৷ ওর চোখমুখে হাসি ফিরে আসে। সত্যিকারের ভার্সিটি জীবনটা আবিদ এবার ফিল করতে থাকে। ও ভার্সিটিতে পড়াকালীন ওর বন্ধুর সাথে একটা পার্টটাইম জব শুরু করে। আস্তে আস্তে ওরা সামনে এগোতে থাকে। ওরা মোট পাঁচ বন্ধু ছিল। আবিদ,নিলয়,শুভ,শামীম আর সাদমান। আবিদ আর শুভকে জব করা দেখে বাকি তিনজনও ওদের সাথে জয়েন করে৷ ওরা পাঁচ বন্ধু একসাথে জব করতে থাকে। খুব মজা খুব আনন্দ হতো ওদের মাঝে। ওদের আলাদা একটা দুনিয়া ছিল। আবিদ’দের ভার্সিটি লাইফ যেদিন শেষ হয় ওদের প্রত্যেকের হাতেই অনেকগুলো টাকা জমা ছিল। ওরা সবাই একসাথে বসে ভাবে এবার কি করবে৷ আবিদ অনেক ভেবে বলে উঠে,
– জানিস আগে আমার ইচ্ছা ছিল কোন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করবো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে ইচ্ছা আর কাজে দিবে না৷ তোদের সঙ্গ আমি কোন ভাবে হারাতে চাই না৷ আমি চাই আমরা পাঁচ বন্ধু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একসাথে থাকবো। তোরা যদি সম্মতি দিস তো আমরা পাঁচজন মিলে আমাদের জমানো টাকা দিয়ে একটা ব্যবসা শুরু করতে পারি৷ যেখানে আমরা সবাই মালিক এবং আমরা সবাই কর্মচারী। রাজি থাকলে বল।
– ভাই তুই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণ। তুই যা বলবি আমরা তাতেই রাজি। কিন্তু কি ব্যবসা করবি? (সালমান)
– একটা সুপার শপ দিব। বর্তমানে আমাদের দেশের মানুষেরা সবচেয়ে বড়ো যে সমস্যায় ভুগছে তা হলো, ফরমালিনমুক্ত খাবারের। আজকাল সবাই বিভিন্ন খাবারে ফরমালিন মিশিয়ে বিক্রি করছে। কিন্তু আমাদের শপ হবে একদম আলাদা। যেখানে একদম র্ খাবার এবং ভালো মানের জিনিসপত্র বিক্রি করা হবে৷ আমরা ডিরেক্ট কৃষকদের কাছ থেকে এসব জিনিসপত্র আনবো। তাহলে তাদেরও লাভ হবে আর আমাদেরও। আমরা যদি একবার মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারি তাহলেই আমরা সফল। জানি পথটা খুব কষ্টের তাও একটু পরিশ্রম করলে সফলতা আমাদের। এবার বল আইডিয়াটা কেমন?
– অনেক অনেক ভালো দোস্ত। আমরা সবাই তোর সাথে আছি। (সবাই)
আবিদ ওর প্রিয় বন্ধুদের সাথে নিয়ে বিজনেসটা শুরু করে। প্রথম কয়েকমাস ওদের সবাইকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়৷ অনেক প্রতিকূল পরিবেশ পাড় করে ওরা একসময় সফল হয়ে যায়৷ এমন সফলই ওরা হয়ে টানা ৩ বছরের ভিতরে ক্রেতাদের ডিমান্ডে দেশের প্রতিটি বিভাগে ওদের সুপার শপ খোলা হয়। শুধু তাই না ঢাকায় ওদের নিজেস্ব জায়গায় ওরা এখন বিশাল বড়ো একটা মার্কেট বানাচ্ছে। লক্ষ টাকা নিয়ে শুরু করা ওদের সেই বিজনেস এখন কোটি কোটি টাকায় পরিণত হয়েছে। আবিদের জীবনে এখন সুখের অভাব নেই। ওর বাবা-মা ওর জন্য মন ভরে শুধু দোয়া করছে। কারণ আবিদ পেরেছে ওর স্বপ্নটা পূরণ করতে।
একদিন আবিদ ওর পার্সোনাল গাড়িতে করে একটা প্রেসকনফারেন্সে এ যায়। সেখানে সাক্ষাৎকার দিয়ে ও যেই ব্যাক করতে নিবে ঠিক তখনই,
– আবিদ…
আবিদ ওর গাড়িতে উঠতে নিয়েছিল। পিছন থেকে ডাক শুনায় ও তাকিয়ে দেখে রানা৷ এই সেই রানা যে ওকে সেদিন ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ক্লাস থেকে বের করে দিয়ে খুব হাসাহাসি করেছিল। আবিদ হাসি দিয়ে বলে,
– আরে রানা তুমি? কেমন আছো? এখানে কি করছো?
– আবিদ আমি সেদিনের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। প্লিজ আমাকে মাফ করে দেও।
– আহ! কি করছো। তুমি ক্ষমা চেয়েও না৷ তুমি সেদিন আমাকে বের না করে দিলে আমি হয়তো কারো পায়ের নিচে চাপা পড়ে সারাজীবন কাজ করে যেতাম। কিন্তু সেদিনের সেই ধাক্কায় আজ আমি কোথায় দেখো। বরং তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার অনেক বড়ো উপকার করেছো। জানো আমাকে আজ কালো বলে কেউ ছোট করে না৷ বরং আমার সাথে একটু দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে থাকে অনেকেই।
– সব জানি আমি। টিভিতে প্রায়ই তোমার উন্নতির খবর দেখি আমরা।
– হাহা৷ আচ্ছা ময়ূরী কেমন আছে? ওর বিয়ে হয়েছে তাই না? অনেক সুখে আছে নিশ্চয়ই। ও যে সুন্দরী হয়তো কোন সুন্দর হ্যান্ডসাম ছেলেকেই ও বিয়ে করেছে তাই না?
রানার মুখটা হঠাৎ নিচু হয়ে যায়। আবিদ ভ্রুকুচকে বলে,
– কি হলো মাথা নিচু করলে কেন?
রানা হঠাৎ কান্নাসিক্ত হয়ে বলে,
– আবিদ ময়ূরী তোমার সাথে যা করেছে তার শাস্তি ও পেয়েছে এবং এখনো পাচ্ছে। ওর জীবন থেকে অনেক আগেই সুখ শান্তি সব হারিয়ে গিয়েছে। প্রথমে এর বাবার বিজনেসে এ লস। আর ঠিক তারপরই…
– কি হলো থামলে কেন? কি হয়েছে ওর?
– আবিদ প্লিজ তুমি একবার ওর কাছে যাবে? তাহলে ও হয়তো একটু হলেও শান্তি পেতো। ও তোমার কাছে মাফ চাইবে বলে অপেক্ষায় বসে আছে। প্লিজ একবার যাবে আবিদ?
– এড্রেস দেও। আমি এখনি যাচ্ছি।
রানার কাছ থেকে এড্রেস নিয়ে আবিদ ওর গাড়ি নিয়ে সোজা ময়ূরীর বাসায় চলে যায়৷ এই বাড়ির চার তলায় নাকি ওরা এখন ভাড়া থাকে৷ আবিদ সোজা চার তলায় গিয়ে ময়ূরীর বাসায় বেল দেয়৷ দুইটা বেল দিতেই একজন ভদ্র মহিলা দরজা খুলেন৷ দরজা খুলে তিনি কিছুক্ষণ আবিদের দিকে তাকিয়ে থেকে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
~ বাবা তুমি আবিদ?
— জি আণ্টি আমি আবিদ।
~ তুমি আসছো তাহলে বাবা। আমার মেয়েটা তো শেষ। তুমি ওকে মাফ করে দেও৷ ও অনেক ভুল করেছে তোমার সাথে। সেই ভুলের মাশুল ও এখন দিচ্ছে। সারাদিন কাঁদে আর তোমার কথা বলে ও। একটু ওর কাছে যাও বাবা। আমার মেয়েটার জীবন শেষ। সব শেষ আমাদের৷
— আণ্টি ও কোথায় আমাকে নিয়ে যান৷
ময়ূরীর মা আবিদকে নিয়ে ভিতরে একটা রুমের সামনে ওকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে,
~ ও নিজেকে অন্ধকারে ঢেকে ফেলছে। আজ অনেক বছর হলো আমার মেয়েটা আলোতে আসে না। খুব ভয় পায়।
আবিদ কিছুই বুঝতে পারছে না৷ ও দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখে পুরো রুম ঘুটঘুটে আঁধারে ছেয়ে আছে। আবিদ অনেক কষ্টে রুমের লাইটের সুইচ খুঁজে সেটা অন করতেই পুরো রুম আলোতে ভরে ওঠে। আবিদ তাকিয়ে দেখে ময়ূরী রুমের এককোণায় দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে মাটিতে বসে আছে হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে। আর মুখের উপর ওর চুলগুলো পড়ে আছে। ফলে ওর মুখখানা দেখা যাচ্ছে না৷ আবিদ এ দৃশ্য দেখে আঁতকে ওঠে। ও আস্তে করে বলে উঠে,
— ময়ূরী আমি আবিদ। আমি এসেছি। এই যে দে…
আবিদের কথা শেষ না হতেই ময়ূরী নড়েচড়ে যেই ওর মুখের সামনে থেকে চুলগুলো সরিয়ে আবিদের দিকে তাকায় আবিদ ভয়ে চিৎকার করে পিছনে সরতে গিয়ে রীতিমতো মাটিতে পড়ে যায়। কারণ ময়ূরীর পুরো মুখখানা ঝলসে গিয়েছে। মানে কেউ এসিড মেরেছে ওর মুখে। একদম বিভৎস লাগছে ওকে৷ আবিদ ওকে দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না৷ এটা তো ওর সেই ভালো লাগা ময়ূরী না৷ এ কে? ময়ূরী আবিদের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে৷ আর আবিদ বাকরুদ্ধ হয়ে আছে৷ কি হলো ময়ূরীর সাথে?
চলবে..?