তোমাকে ঘিরে আমার অনুভূতি?,পর্ব_১৫,১৬
Anika Fahmida
পর্ব_১৫
অনু আদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল,
–এতোটা ভালোবাসো আমায়?
আদ্র মুচকি হেসে অনুকে বলল,
–তোর যা মনে হয়।
–ঘুমাবে না আদ্র?
— আমি একটু পড়ে অন্য রুমে ঘুমিয়ে পড়বো। তুই শুয়ে পড়।
অনু ভয় পাওয়া স্বরে আদ্রকে বলল,
–না, না, তুমি অন্য রুমে যেও না। আমার ভয় করবে।
আদ্র অনুর দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
–ভয় করবে কেন?
–ভূত আসবে তাই।
আদ্র অনুর কথা শুনে হাসল। অনু কতটা ভীতু হলে এমন বোকা বোকা কথা বলতে পারে তা ভেবেই বেশি হাসি পাচ্ছে। আদ্র হেসে অনুকে বলল,
–পাগলী মেয়ে একটা। আচ্ছা আমি কোথাও যাবো না। সোফায় শুয়ে পড়ব। তুই ভয় পাস না।
অনু আদ্রের কথা শুনে আদ্রের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে শুয়ে পড়ল। আদ্র অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। ধীরে ধীরে অনুর চোখে ঘুম চলে আসলো।
সকাল বেলা আদ্র অনুকে গাড়ি করে অনুর বাসার সামনে পৌঁছে দিল। অনু আদ্রকে জিজ্ঞেস করল,
–আদ্র আমাদের বাসার ভিতরে আসো?
আদ্র অনুকে বলল,
–না, অনু। পড়ে আরেকদিন আসবো।
অনু মন খারাপ করে আদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। আদ্র অনুর মন খারাপ দেখে জিজ্ঞেস করল,
–কি হলো অনু মন খারাপ কেন তোর?
–এমনি।
আদ্র গাড়ির সিটের পাশ থেকে একটা বক্স বের করে অনুর হাতে ধরিয়ে দিল। অনু হাতের বক্সটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আদ্রকে জিজ্ঞেস করল,
–এই বক্সে কি আছে আদ্র?
–বাসায় গেলে দেখে নিস অনু।
–আচ্ছা।
আদ্র অনুর গালে চুমু দিয়ে অনু্কে বলল,
–আবারও আমাদের দেখা হবে অনু।
আদ্র গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল। অনু গালে হাত দিয়ে আদ্রের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বাসায় পৌঁছাল। অনু হাতে বক্স নিয়ে বাসায় পৌঁছানোর সাথে সাথেই অনুর মা আমেনা বেগম অনুকে দেখতে পেয়ে দ্রুত জড়িয়ে ধরেন। জড়িয়ে ধরার ফলে অনুর হাত থেকে বক্সটা হাত ফসকে পড়ে যায়। আমেনা বেগম বিচলিত স্বরে কান্না করে অনুকে বলতে লাগল,
–অনু মা তুই ঠিক আছিস তো? আদ্র তোকে কোথায় তুলে নিয়ে গিয়েছিল? আমার মেয়েটাকে এভাবে কেন আদ্র নিয়ে গিয়েছিল! আমি কত চিন্তা করেছি।
অনু কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও আমেনা বেগমকে শান্ত স্বরে বলল,
–আম্মু আমি ঠিক আছি। আমার কিছু হয় নি। আর আদ্র ভাইয়া আমার উপর রেগে ছিল। তাই শাস্তি দেওয়ার জন্য তুলে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আম্মু তুমি এটুকু বিশ্বাস কর আদ্র ভাইয়া আমার কোনো ক্ষতি করে নি। শুধু সারা রাত কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল৷ কারণ কেন আমি তার ফোন ধরি নি তাই৷
আদ্র অনুকে কোনো শাস্তি দেয় নি। তবুও অনু আমেনা বেগমকে মিথ্যা বললেও আমেনা বেগম অনুর কথা বিশ্বাস করে ফেলে। আমেনা বেগম বলল,
–এই ছেলেটার এতো রাগ কেন আমি বুঝি না। এইটুকু কারণের জন্য আমার মেয়েকে এভাবে শাস্তি দিবে! আমি আজকে আপাকে সব খুলে বলবো।
অনু তাড়াতাড়ি করে আমেনা বেগমকে বলল,
–না আম্মু। খালামনিকে কিছু বলার দরকার নেই। তুমি আদ্র ভাইয়াকে ক্ষমা করে দাও।
আমেনা বেগম অবাক হয়ে অনুকে বলল,
–অনু তুই এই কথা বলছিস?
–হ্যা আম্মু আমি এই কথা বলছি।
অনুর বাবা আরমান রহমান ঘর থেকে বেরিয়ে অনুকে দেখে রাগী স্বরে জিজ্ঞেস করল,
–অনু তোকে আদ্র কেন কিডন্যাপ করেছে?
অনু ভয় পাওয়া স্বরে আরমান রহমানকে বলল,
–আব্বু তুমি রেগে যাচ্ছো কেন? আদ্র ভাইয়া আমাকে কিডন্যাপ করে নি আব্বু। এমনি শুধু কান ধরে শাস্তি দেওয়ার জন্য নিয়ে গিয়েছিল। আমি আদ্র ভাইয়ার ফোন ধরি নিতো এজন্য।
আরমান রহমান রেগে গিয়ে অনুকে বলল,
–আমাকে তোরা ভুলভাল বুঝাবি আর আমি বুঝে নিব? আমি আদ্রকে খুব ভালো ছেলে মনে করতাম৷ কিন্তু সে এতো খারাপ আগে জানতাম না। আর সামান্য ফোন না ধরার জন্য কেউ এভাবে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়?
–আব্বু তুমি আদ্র ভাইয়াকে ভুল বুঝছো।
আরমান রহমান ধমকে অনুকে বলল,
–চুপ থাক। আর মাটিতে এগুলো কি পড়ে আছে?
অনু নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল আদ্রের দেওয়া সেই বক্স। আর বক্স থেকে চুড়ি আর চকলেট ফ্লোরে পড়ে ছড়াছড়ি করছে। অনু মনে মনে বলল,
–আদ্র তারমানে আমাকে চুরি আর চকলেট দিয়েছে । কিন্তু এখন আমি কি করি? আব্বু তো এই চুড়ি, চকলেট দেখলে এখন আমাকে অনেক বকা দিবে।
আরমান রহমান মাটি থেকে বক্সটা তুলে দেখলেন অনেক চকলেট আর চুড়ি। এতগুলো চকলেট আর চুড়ি দেখে আরমান রহমান অবাক হলেন। তিনি অনুর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
–এগুলো তোকে কে দিয়েছে অনু?
অনু আমতা আমতা করে বলল,
–আব্বু এগুলো… এগুলো…
–কি হলো বলছিস না কেন?এগুলো তোকে আদ্র দিয়েছে?
–হ্যা আব্বু আদ্র ভাইয়া কিনে দিয়েছে।
আরমান রহমান মেয়ের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর রেগে বক্সটা ছুঁড়ে মাটিতে ফেললেন। সবগুলো চুড়ি চকলেট এখানে সেখানে পড়ে আবারও ছড়িয়ে গেল৷ অনু আরমান রহমানের রাগ দেখে ভয় পেয়ে গেল। আরমান রহমান রেগে গিয়ে আমেনা বেগমকে বলল,
–আমেনা তোমার মেয়েকে ঘরে নিয়ে যাও।
আমেনা বেগমও অনুকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বলল,
–অনু তোর আব্বু রেগে গেছে।
–কিন্তু কেন আম্মু?
–গতকাল বিকালে আদ্র তোকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পড় পাড়া প্রতিবেশীরা নানান কথা আমাদের বলতে লাগে। আদ্র তোকে তুলে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য প্রতিবেশীরা দেখে ফেলে। আর সেসবই তোর বাবাকে সব বলে দেয়।
অনু ভয় পাওয়া স্বরে আমেনা বেগমকে বলল,
–এখন কি হবে আম্মু?
–কিছুই হবে না। কিছুদিন পর দেখবি তোর বাবার রাগ চলে গেছে৷ তুই আপাতত বাসার বাইরে বের হবি না।
অনু মন খারাপ করে আমেনা বেগমকে বলল,
–ঠিক আছে আম্মু।
আমেনা বেগম রুম থেকে চলে যাওয়ার পর অনু বিছানায় বসে চোখের জল ফেলতে লাগে। আদ্র কত শখ করে অনুর জন্য চকলেট, চুড়ি কিনল আর অনুর বাবা তা ফেলে দিল! অনু তা মানতে পারছে না। অনুর ফোন বেজে চলেছে। আদ্র যখন অনুকে তুলে নিয়ে যায় তখন অনুর ফোনটা বিছানায় পড়ে থাকে। এখনও ফোনটা বিছানায় রয়েছে। অনু চোখের জল মুছে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল পল্লব ফোন করেছে। এতকিছুর মাঝে পল্লবের কথা অনু ভুলেই গিয়েছিল। কল রিসিভ করে অনু বলল,
–হ্যালো পল্লব বলো।
পল্লব বিচলিত হয়ে অনুকে বলল,
–এই অনু তোমাকে আমি কতবার ফোন করেছি তার কোনো ধারণা আছে তোমার? ফোন কেন ধরো নি? আর শুনলাম কাল রাত তুমি বাসায় ছিলে না। কোথায় গিয়েছিলে?
অনু অবাক হয়ে বলল,
–আমি বাসায় ছিলাম না তা তুমি কি করে জানলে?
–তোমার বাসায় আমি গিয়েছিলাম। সেখানে তোমার খুঁজ নিলে জানতে পারলাম তুমি বাসায় নেই। ফোন ধরো নি কেন?
–আসলে পল্লব আমার ফোনটা বাসায় ছিল।
–ফোন বাসায় রেখে তুমি রাতে কোথায় ছিলে?
অনু আর কিছু না ভেবে পল্লবকে বলেই দিল,
–পল্লব আমি আসলে আদ্রের সাথে ছিলাম।
অনুর মুখে কথাটা শুনে পল্লবের বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল। কিছুক্ষণের জন্য পল্লব স্তব্ধ হয়ে গেল। পল্লব কথা বলছে না দেখে অনু পল্লবকে জিজ্ঞেস করল,
–হ্যালো পল্লব তুমি কি আমার কথা শুনছো?
পল্লব নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলল,
–হ্যা অনু শুনছি৷ কি যেন বললে? ওহ হ্যা আদ্রের সাথে ছিলে? আদ্র ফিরে এসেছে? আদ্র কখন লন্ডন থেকে এসেছে অনু?
অনু শান্ত স্বরে আদ্রকে বলল,
–হ্যা গতকাল আদ্র দেশে ফিরে এসেছে।
পল্লব অনুকে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল,
–আদ্র কি তোমাকে টাচ করেছে অনু?
পল্লবের কথা শুনে অনু রেগে গিয়ে বলল,
–এসব কি ধরনের কথা পল্লব?
পল্লব যেন মুখ ফসকেই কথাটা বলে ফেলেছে। তাই নিজেকে দ্রুত স্বাভাবিক করে বলল,
–আই এম সরি অনু।
অনু বিরক্ত স্বরে পল্লবকে বলল,
–ইট’স ওকে। আমি এখন ফোন রাখলাম। বাই।
অনু বিরক্তি নিয়ে ফোন রেখে দিল। পল্লব একটু বেশি পারসোনাল কথা অনুকে জিজ্ঞেস করছিল যা অনুর একদম পছন্দ হচ্ছিল না।
এদিকে অনু ফোন কেটে দেওয়ায় পল্লব হতাশ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল। পল্লবের বুকের ভিতরটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। পল্লব আপনমনে বলতে লাগল,
–অনুর আদ্র চলে এসেছে! এখন কি অনু আমাকে ভুলে যাবে? আমাদের ফ্রেন্ডশিপটাও কি নষ্ট হয়ে যাবে?
আমি যে অনুকে নিজের অজান্তে ভালোবেসে ফেলেছি। ভালোবাসি কথাটা অনুকে আজ পর্যন্ত বলতেও পারলাম না। যদি অনু আমাকে ভুল বুঝে এই ভয়ে বলা হলো না আমার ভালোবাসার কথা। আদ্র আসায় অনু আমার থেকে দূরে সরে যাবে নাতো? তাহলে আমার কি হবে? আমি যে অনুর সাথে কথা না বলে থাকতে পারি না।
আদ্র নিজের বাসার ড্রইংরুমের সোফায় বসে আছে। নিজের কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে গম্ভীরভাবে আদ্র বসে আছে। সামনে আদ্রের বাবা আনোয়ার হোসেন দাঁড়িয়ে আছেন।রেহেনা পারভিন তার ছেলে আসাতে অনেক খুশি কিন্তু আপাতত আনোয়ার হোসেনের রাগ দেখে তিনি চুপ করে আছেন। আনোয়ার হোসেন আদ্রের উপর যথেষ্ট রেগে আছেন। তাই আনোয়ার হোসেন আদ্রকে গম্ভীর স্বরে বলল,
–এভাবে মান সম্মান ধুলোয় না মিশালে তোমার শান্তি হচ্ছিল না আদ্র?
আদ্র তার বাবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
–এতে মান সম্মান নষ্টের কি আছে বাবা? আমি তো বললাম আমি কোনো ভুল করি নি। তাও কেন বার বার একই কথা বলছো?
আনোয়ার হোসেন রেগে আদ্রকে বললেন,
–অনু তোমার খালাতো বোন হয় আদ্র। তুমি কিনা অনুকে এভাবে সকলের সামনে থেকে তুলে নিয়ে কোথাও গায়েব হয়ে গেলে! আবার বলছো তুমি কিছু ভুল করো নি?
–বাবা অনু আমার খালাতো বোন হয়৷ মানে আমার কাজিন হয়। অনু আমার নিজের বোন না। অনুর উপর আমার অধিকার আছে। আর সেই অধিকারবোধ থেকেই আমি অনুকে নিয়ে গিয়েছিলাম।
–এখন তুমি অধিকারবোধ দেখাচ্ছো?
–হ্যা দেখাচ্ছি। আর আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই বাবা।
আনোয়ার হোসেন গম্ভীর স্বরে আদ্রকে বলল,
–কি বলতে চাও?
আদ্র বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আনোয়ার হোসেনের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
–বাবা আমি অনুকে ভালোবাসি। আমি অনুকে বিয়ে করতে চাই।
চলবে…
তোমাকে ঘিরে আমার অনুভূতি?
পর্ব_১৬
Anika Fahmida
আদ্র অনুকে বিয়ে করতে চায় এই কথাটা আদ্রের মুখ থেকে শুনে আনোয়ার হোসেন রেগে গেলেন। তাই রাগের ফলস্বরূপ আনোয়ার হোসেন আদ্রের গালে ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। আদ্র কখনো ভাবে নি তার বাবা আজ তাকে এভাবে থাপ্পড় দিবে। যেই বাবা কখনো আদ্রের গায়ে হাত তুলেনি আজ সেই বাবাই আদ্রকে থাপ্পড় দিল! এদিকে আদ্রের মা রেহেনা পারভিনও এই দৃশ্য দেখে কেঁদে ফেললেন। আদ্র ব্যথিত স্বরে অবাক হয়ে আনোয়ার হোসেনকে বলল,
–বাবা তুমি আমাকে মারলে?
আনোয়ার হোসেন কড়া গলায় আদ্রকে বলল,
–হ্যা মারলাম। তুই কি করে বললি যে তুই অনুকে বিয়ে করতো চাস? মুখে একবারও আটকালো না? নেহাতই তোরা ছোট বেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছিস তাই তোদের আমি কিছু বলতাম না। কাজিনরা গল্প আড্ডা করে ভেবে এতো কিছু মনে করতাম না। কিন্তু আজ তুই বেশি অতিরিক্ত বলে ফেলেছিস। অনুদের পরিবারের স্টেটাস আর আমাদের পরিবারের স্টেটাস আকাশ পাতাল তফাৎ। অনু মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। আমি কখনো আমার ছেলের বিয়ে কোনো মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের সাথে দিব না।
রেহেনা পারভিন আনোয়ার হোসেনকে বলল,
–তুমি আমার বোনের পরিবার নিয়ে আর একটা বাজে কথাও বলবে না। আমার বোন তোমার খায় পড়ে না।
আনোয়ার হোসেন রেহেনা পারভিনের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
–বাহ্ যেমন ছেলে তার তেমন মা। মায়ের যদি এরুকম কথাবার্তা হয় তাহলে ছেলেও তো তেমনই হবে।
আদ্র চোখ বন্ধ রাগ কনট্রোল করার চেষ্টা করে আনোয়ার হোসেনকে বলল,
–বাবা প্লিজ তুমি মাকে কিছু বলো না। আমাকে যা বলার বলো। কিন্তু মাকে কিছু বলো না।
আনোয়ার হোসেন গম্ভীর স্বরে আদ্রকে বলল,
— কেন বলবো না? তোর মায়ের অতিরিক্ত আশকারা পেয়েই তো তুই এমন বেয়াদব হয়েছিস। আদ্র একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ আমি অনুকে আমার ঘরের পুত্রবধু হিসেবে কখনো মেনে নিব না। তুই অনুকে ভুলে যা। অনু তোর কাজিন ঠিক সেই সুবাদে কাজিন হয়েই থাকবে। আমি দেশের নামকরা বিজনেসম্যানের মেয়ের সাথে তোর বিয়ে দিব।
আদ্র একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে আনোয়ার হোসেনকে বলল,
–নামকরা বিজনেসম্যানের মেয়েকে আমি বিয়ে করতে পারব না বাবা। আমার অনুকেই লাগবে। তুমি অনুকে পত্রবধু হিসেবে মানো বা না মানো আমি অনুকেই বিয়ে করব। ভালোবাসায় স্টেটাস মানে না বাবা। স্টেটাস মানে না। আমি অনুকে ভালোবাসি। তাই আমি অনুকেই বিয়ে করব। তুমি আমাকে আটকাতে পারবে না।
আদ্র সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে নিজের রুমে চলে গেল। আদ্রের মা রেহেনা পারভিনও আদ্রের রুমের দিকে ছুটলো। আনোয়ার হোসেন ভাবতেও পারছেন না যে আদ্র অনুর জন্য এতোটা পাগল হয়ে গেছে। কি করে তিনি আদ্রকে আটকাবে সেই চিন্তাই মাথায় ঘুরতে লাগল।
আদ্র নিজের রুমে এসে রেগে পাশে রাখা বড় ফুলদানিটা আঁচড়ে ভেঙে ফেলল। ফুলদানিটা টুকরো টুকরো হয়ে গেল। আলমারির আয়নাটাও গিটার দিয়ে ভেঙে ফেলল। আদ্রের সবচেয়ে প্রিয় গিটারটাকেও আদ্র আঁচড়ে ভেঙে টুকরো করে ফেলল। রেহেনা পারভিন আদ্রের রুমে এসে ভয় পেয়ে আদ্রের হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বলল,
–আদ্র এসব কি করছিস তুই? রুমের জিনিসপত্র ভেঙে ফেলছিস কেন? থাম বাবা। এগুলো ভাঙলে কোনো সমাধান হবে না। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।
আদ্র রেহেনা পারভিনকে বলল,
–কিছু ঠিক হবে না মা। কিছু ঠিক হবে না। বাবা কি করে আমার আর অনুর সম্পর্কটাকে অস্বীকার করতে পারল? আমি অনুকে ভালোবাসি জেনেও বাবা কি করে আমাকে এতোগুলো কথা শুনাতে পারল? আমার চাওয়া পাওয়ার কি কোনো মূল্যই কি বাবার কাছে নেই? মা আমি যদি অনুকে না পাই আমি কিন্তু সব কিছু ধ্বংস করে ফেলবো। নিজেকেও শেষ করে দিব।
রেহেনা পারভিন আদ্রকে বলল,
— না বাবা এমন কথা বলে না। শান্ত হ। তোর বাবার আপত্তি থাকলে কি হবে? আমি তো অনুকে মন থেকে পুত্রবধু হিসেবে মেনে নিয়েছি। তুই অনুকে বিয়ে করে নিয়ে আয় বাবা। আমার বোনের মেয়েটা আমার ছেলের বউ হবে তা ভাবতেই আমার যে খুশি লাগছে।
রেহেনা পারভিনের কথা শুনে আদ্রের রাগ কমে গেল। আদ্রের খুশি হয়ে রেহেনা পারভিনকে বলল,
–সত্যি মা অনুকে তুমি মেনে নিয়েছো?
–হ্যা রে বাবা অনুকে আমি মেনে নিয়েছি।
আদ্র হেসে রেহেনা পারভিনকে বলল,
–লাভ ইউ মা। এজন্য তোমাকে এতো ভালোবাসি।
–পাগল ছেলে আমার। আচ্ছা আমি তোর জন্য খাবার বানিয়ে নিয়ে আসছি। আর মন খারাপ করে থাকিস না৷
–ঠিক আছে মা।
রেহেনা পারভিন আদ্রের রুম থেকে চলে গেলেন। আদ্র নিজের বিছানায় বসে অনুর নাম্বারে ডায়াল করে কল দিল। অনুর ফোনটা বেজে উঠল। অনু ঘরের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। বিছানা থেকে ফোন বেজে উঠার শব্দ পেয়ে অনু মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল আদ্র কল করেছে। অনু ফোন রিসিভ করে বলল,
–হ্যালো আদ্র?
আদ্র গম্ভীর স্বরে অনুকে জিজ্ঞেস করল,
–তোর বাসায় কোনো ঝামেলা হয় নি তো অনু?
অনু মন খারাপ করে আদ্রকে বলল,
–আদ্র আমি বাসায় আসার পর থেকেই আব্বু আমাকে অনেক বকেছে। আদ্র তোমাকে আব্বু ভুল বুঝছে। আব্বু ভাবছে তুমি বাজে ছেলে। কি থেকে কি হয়ে গেল বলো। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। মাথা কাজ করছে না।
–আমি থাকতে তোর এতো চিন্তা কিসের? আচ্ছা অনু বিয়ে করবি আমাকে? আজকে রাতে তোকে আমি বিয়ে করতে চাই।
অনু আদ্রের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। মুখে কোনো কথা আসছে না৷ আদ্র আবারও অনুকে জিজ্ঞেস করল,
–কি হলো কিছু বলছিস না কেন?
অনু ভয় পাওয়া স্বরে আদ্রকে বলল,
–আদ্র আব্বু জানলে কি হবে?
–কি হবে? কিছুই হবে না।
–আব্বু আমাদের বিয়ে মেনে নিবে না আদ্র। কিছুতেই মেনে নিবে না। আমার ভীষণ ভয় করছে আদ্র।
–অনু তোর ভয় আমি দূর করে দিব। আর কোনো কথা নয়। আজকে রাতেই আমরা বিয়ে করছি।
–আদ্র আমি তোমাকে কিছুদিন পর বিয়ে করি? আমি আসলে মানষিকভাবে বিয়ের জন্য তৈরি নই। আমার কথাটা একটু বুঝার চেষ্টা কর।
–কিন্তু আমি তোকে আজ বিয়ে করতে চাই অনু। বিয়ে করতে হলে আবার মানষিকভাবে তৈরির কি আছে?
–আদ্র সামনে আমার এক্সাম। আমাকে অনেক পড়তে হবে৷ এই অসময়ে বিয়ে করতে আমি চাই না। আর বাবার অমতে আমি কি করে তোমাকে বিয়ে করি তুমিই বলো? বাবা বিয়েটা মেনে নিবে না। বাবার রাগ আগে কমে নিক তারপর নাহয় তুমি আমাকে বিয়ে করো। তখন বাবা এতো রেগে যাবে না
–তারমানে তুই বলতে চাইছিস তুই আমাকে বিয়ে করবি না? এটাই বলতে চাইছিস?
–আদ্র তুমি আমাকে ভুল বুঝছো। আমি তোমার কাছে কিছু টাইম চাইছি। এইটুকু সময় আমাকে দিবে না?
আদ্র রাগী স্বরে অনুকে বলল,
–ওকে তোর যত টাইম লাগে তুই নিয়ে নে। কিন্তু আজ হোক বা কাল তোকে আমি বিয়ে করবই অনু ।
আদ্র ফোন কেটে দিল। অনুর ভয়ে হাত পা কাঁপছে। আদ্র এতো তাড়াহুড়ো করে বিয়ে কেন করতে চাইছে অনু বুঝতে পারছে না। এদিকে অনুর বাবা ভীষণ রেগে আছে। সামনে কি হবে অনুর জানা নেই।
গভীর রাতে অনু ড্রইং রুম গিয়ে আদ্রের দেওয়া চুড়ি আর চকলেটগুলো কুড়িয়ে নিয়ে নিজের রুমে নিয়ে আসলো। তারপর চকলেট, চুড়িগুলে টেবিলে রাখল। টেবিলে রাখা চুড়ি আর চকলেটগুলোর দিকে তাকিয়ে অনু মুচকি হাসল এই ভেবে যে আদ্র অনুকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। অনু আদ্রের দেওয়া চকলেটগুলোর প্যাকেট খুলে খেতে লাগল৷
এদিকে গভীর রাত হওয়া সত্বেও আদ্রের চোখে ঘুম নেই। অনুকে আবারও একটা ফোন দিতে মন চাইছে কিন্তু অনুর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে ভেবে আদ্র আর ফোন দিল না৷ আদ্র বারান্দায় গিয়ে চেয়ারে বসে রইল৷ নিজের এক গালে হাত দিয়ে অন্যকিছু ভাবার চেষ্টা করলেও বারবার অনুর চিন্তাই আদ্রের মাথায় আসছে। আদ্র মনে মনে বলল,
–কেন অনু তুই এমন করছিস? বিয়েতে রাজি হলে কি এমন হতো? আমি যে তোকে কোনোভাবেই হারাতে চাই না। তুই কি বুঝিস না আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না? নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করিস!
আদ্র মন খারাপ করে গান গাইতে লাগল,
বড় ইচ্ছে করছে ডাকতে
তার গন্ধ মেখে থাকতে
কেন সন্ধ্যে সন্ধ্যে নামলে সে পালায়
তাকে আটকে রাখার চেষ্টা
আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে তেষ্টা
আমি দাঁড়িয়ে দেখছি শেষটা জানলায়
বোঝেনা সে বোঝেনা
বোঝেনা সে বোঝেনা
বোঝেনা সে বোঝেনা
বোঝেনা সে বোঝেনা
বোঝেনা বোঝেনা বোঝেনা বোঝেনা
পায়ে স্বপ্ন স্বপ্ন লগ্নে
তার অন্য অন্য ডাকনাম
তাকে নিত্য নতুন যত্নে কে সাজায়
সব স্বপ্ন সত্যি হয় কার
তবু দেখতে দেখতে কাটছি
আর হাঁটছি যেদিক আমার দুচোখ যায়
বোঝেনা সে বোঝেনা
বোঝেনা সে বোঝেনা
বোঝেনা সে বোঝেনা
বোঝেনা সে বোঝেনা
বোঝেনা বোঝেনা বোঝেনা
বোঝেনা বোঝেনা বোঝেনা
আদ্র গান গাইতে গাইতে চেয়ারেই চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ল। হয়তো স্বপ্নে অনুকে দেখার ইচ্ছেটা আদ্রের মনে প্রবল হচ্ছে।
বেশ কিছুদিন অনুকে বাড়ির বাইরে যেতে দেওয়া হয় নি। আজ বাইরে যাওয়ার পারমিশন অনু পেয়েছে। তাই আজ অনেকদিন পর অনু ভার্সিটিতে গেল। ভার্সিটিতে গিয়েই পল্লবের সাথে অনুর দেখা হলো।পল্লব হেসে অনুর দিকে তাকিয়ে বলল,
–আসলে তাহলে।
অনু বুঝতে না পেরে পল্লবকে বলল,
–কোথায় আসার কথা বলছো?
–এই যে অবশেষে ভার্সিটিতে আসলে সেটাই বললাম। তোমাকে খুব মিস করছিলাম।
–ওহ। বন্ধুকে মিস করবে এটাই স্বাভাবিক।
–তুমি মিস করো নি?
–পল্লব আমার ক্লাস আছে। আমি গেলাম।
পল্লব অনুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে হতাশ হলো। এই অনুটা কেন যে পল্লবকে একটু বুঝল না। আদ্র এসে যাওয়ার পর থেকেই অনু পল্লবের সাথে কম কথা বলে যা পল্লবের কাছে ভালো লাগছে না। অনু যেতে যেতেই ব্যাগের মধ্যে ফোন বেজে উঠল। আদ্র ফোন করেছে। অনু রিসিভ করার সাথে সাথেই আদ্র বলল,
–কি করছিস অনু?
অনু শান্ত স্বরে আদ্রকে বলল,
–আদ্র আমি ভার্সিটিতে এসেছি।
–ব্রেকফাস্ট করেছিস?
–টাইম পাই নি।
–কেন করিস নি? না খেলে অসুস্থ হয়ে পড়বি রে বোকা মেয়ে। কিছু খেয়ে আসতে হয় এটাও জানিস না?
–আমি পড়ে সময় পেয়ে খেয়ে নিব।
আদ্র কিছু না বলে ফোনটা কেটে দিল। অনু অবাক হলো। এমনি হঠাৎ করে ফোনটা কেটেও দিল? অদ্ভুত!ভার্সিটির ক্লাস শেষ হওয়ার পর অনু বের হলে পল্লব অনু্কে দেখতে পেয়ে অনুর সাথে সাথে হাঁটতে হাঁটতে লাগল। অনু পল্লবকে জিজ্ঞেস করল,
–আমার সাথে কোথায় যাচ্ছো?
–তোমাকে বাসায় এগিয়ে দিব।
–দরকার নেই। আমি একা যেতে পারব।
–এমন করে কেন বলছো অনু?
অনু এবং পল্লব ভার্সিটির মাঠ পেড়িয়ে গেটের কাছে আসতেই চোখের সামনে আদ্রকে দেখে অনু অবাক হলো। আদ্র অনুর দিকে একবার তাকাচ্ছে তো একবার অনুর পাশে দাঁড়ানো পল্লবের দিকে তাকাচ্ছে। অনু ভয় পেয়ে গেল। সাথে ঘাবড়েও গেল। আদ্রের যেই রাগ। এখন কি হবে?
চলবে…