দু’মুঠো প্রেম,১

0
4686

দু’মুঠো প্রেম,১
ফারজানা আফরোজ

– পাত্রপক্ষ পাত্রীর বাড়িতে গিয়ে পাত্রী দেখে কিন্তু আপনি এসেছেন সরকারি হসপিটালে পাত্রী দেখতে? হাস্যকর ব্যাপার তাই না?

আদিবার কথা শোনে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফয়সাল। তার দৃষ্টি শুধু আদিবার উপর। ফর্সা গাল রাগে লাল রঙ ধারণ করেছে। কথার মাঝেও রয়েছে গালে টোল। ফয়সাল খেয়াল করলো আদিবার ডান গালে কালো রঙের একটি তিল রয়েছে যার ফলে চেহারার সৌন্দর্য দ্বিগুণ ফোটে উঠেছে। ফয়সালের তাকানো দেখে আদিবা কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে বলল,

– রাজনীতিতে যার সম্মান সবার উচুঁতে। যে ব্যাক্তি কিনা হাজার মেয়ের ক্রাশ সেই মানুষ কিনা আমার মত সাধারণ একজন মেয়েকে এইভাবে দেখছে? আপনার উপর যে মেয়েগুলো ক্রাশ খায় তারা কিন্তু ভীষণ রেগে যাবে।

ফয়সাল তখন তার আশপাশটা ভালো করে দেখলো। কেউ না থাকায় শান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

– বেশি বকবক করো তুমি। আব্বু যে, কি দেখলো তোমার মাঝে বুঝলাম না।

– আগে বলুন সরকারি হসপিটালে কেন মেয়ে দেখতে এসেছেন? পাত্রীর বাসায় গেলে কি ঝাড়ু নিয়ে পিটায়? শুনেছি বিরাট ধনী আপনারা, তাছাড়া ধনী লোকরা কিপ্টাই হয়।

– মানে?

– মানে হলো, পাত্রীর বাসায় গেলে সাথে করে মিষ্টি কিনতে হবে, পাত্রীকে কিছু টাকা দিতে হবে সেই ভয়ে হসপিটালে এসে ফ্রী-তে পাত্রী দেখছেন। আপনার মতো কিপ্টা ছেলেকে কিছুতেই বিয়ে করবো না।

ফয়সালের সাথে রাগ দেখিয়ে হসপিটালের ভিতরে চলে আসলো আদিবা। বেডে বসে আছে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড অরিন আর অরিনের মা।

এখন আসা ফয়সাল কেন হসপিটালে পাত্রী দেখতে এসেছে আর কেনই বা আদিবা রেগে আছে। আজ সকালে আদিবার বেস্ট ফ্রেন্ড অরিনের আম্মুকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। অরিনের আব্বু দেশের বাহিরে থাকায় অরিন তার মাকে নিয়ে এসেছে, অরিন একা কিছু পারবে না বলে কান্নাকাটি করে আদিবাকে সাথে করে নিয়ে এসেছে। সরকারি হসপিটালে থাকলেও ওষুধপত্র নিজেদেরই কিনতে হয় তাই আদিবা প্রেসক্রিপশন নিয়ে ফার্মেসিতে আসে মেডিসিন কিনার জন্য তখন দোকানের একটি ছেলে ফিসফিস করে বলতে লাগলো,

– কি চাই? সিনোরা নাকি জয়া?”

আদিবা বিরক্তি ও রাগ প্রকাশ করে বলল,

– লাগবে না।”

ছেলেটি তখন দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,

– আরেহ প্যাকেট করে দিবো লজ্জার কি আছে। মেয়েরা তো এইসবের জন্যই আসে।”

আদিবা এইবার ক্ষেপে গিয়ে ছেলেটির লম্বা লম্বা চুল ধরে টান দিয়ে টেবিলে মাথা বারী দিয়ে বলল,

– মেয়ে দেখলেই ভাবিস অসহায়। তোরা যেভাবে বলবি সেভাবেই সব কিছু হবে। দুর্বল ভাবছিস আমাদের তাই না। আজ তোর এই মুরোগ জুটি টেনে না ছিঁড়তে পারলে আমার নামও আদিবা নয়।”

লোকজন ভিড় করে দাঁড়ালো। কেউ কেউ বলল ” কি জল্লাদ মেয়ে রে বাবা।” আবার অনেকে বলল,ভালোই হয়েছে এই ছেলেদের কারণেই মেয়েরা নিরাপদ নয়। ফার্মেসিতে থাকা লোকজন ছেলেটিকে আদিবার থেকে দূরে সরালো আদিবা তখন রাগে গজগজ করতে করতে বলল,

– আরেকবার যদি লুইচ্ছামি করতে দেখেছি তাহলে তোর মুখ ভেঙ্গে কুকুরকে খাওয়াবো।”

আদিবার এই সাহসিকতার রূপ মুগ্ধ করেন ফয়সালের বাবা অর্থাৎ শফিক আহমেদকে। দূর থেকে তিনি আদিবাকে দেখছেন আর আনন্দের হাসি হাসছেন।

– বাহ মেয়েটা দেখছি খুব সাহসী। অন্য কোনো মেয়ে হলে চুপচাপ চলে যেতো। আজ যদি মেয়েরা এইভাবে প্রতিবাদ করতো তাহলে দেশটা এই রসাতলে যেতো না। আমার বীর ছেলের জন্য এমন বীর মেয়েই প্রয়োজন।”

তখনি উনি আদিবার পিছু নেন। পরে জানতে পারেন আদিবা তার বান্ধবীর মাকে এই হসপিটালে ভর্তি করিয়েছে। পরেই ফয়সালকে ফোন দিয়ে বলল হসপিটালে আসার জন্য। এমন পাত্রী কিছুতেই উনি হাত ছাড়া করতে চান না।

অতঃপর ফয়সাল হসপিটালে এসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো আদিবাকে। প্রথম দেখায় ভালো লাগলেও আদিবার ঝাঁঝালো কথাগুলো তাকে নিরাশ করলো। মুখ কালো করে শফিক আহমেদকে এসে বলল,

– আব্বু মেয়ে তো পুরাই ধানি লংকা। কিছুতেই সংসার করার উপযোগী নয় এই মেয়ে।

ছেলের কথা শোনে চোখে মুখে রাজ্যর বিরক্তি নিয়ে বিড়বিড় করে বললেন উনি,

– তোমার সাথে মানানসই এই মেয়ে। এই মেয়ে ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে তোমার সাথে থাকতে পারবে না। রাজনীতি করতে করতে নিজেকে মাফিয়া বানিয়ে ফেলেছো। তোমাকে শায়েস্তা করার জন্য আমার প্রয়োজন মাফিয়া বৌমা , যে কোনো কিছুতেই ভয় পাবে না। বরং বেশি তেরিং বেরিং করলে উল্টো উত্তম মধ্যম দিবে।

ফয়সাল দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল ,

– যেভাবে আম্মু তোমাকে দেয় তাই না?

– বদছেলে কোথাকার। আমাকে নিয়ে মজা তাই না? আমিও বললাম এই সাহসী মেয়েই হবে আমার বৌমা।

চলে যাবার আগে আদিবাকে ডাকলেন শফিক আহমেদ। আদিবা কাছে আসতে বললেন,

– তোমার আব্বুর নাম্বারটা দেও তো মা। উনার সাথে ইম্পর্টেন্ট কথা আছে।

আদিবা বুঝে মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হতে লাগলো। এক সময় সে এই বাপ ছেলের বিশাল বড় ফ্যান ছিলো কিন্তু আজকের পর থেকে তাদের নামের আগে থেকে ফ্যান নামক উপাধি সরিয়ে দিয়ে শফিক আহমেদকে ভুল নাম্বার দিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নম্বর বন্ধ থাকায় শফিক আহমেদ বললেন,

– মা, তোমার আব্বুর নাম্বার তো বন্ধ।”

মনে মনে ভীষণ খুশি হলো আদিবা। তবুও মুখের কষ্টের ভাব ফোটে তুলল আর বলল,

– আসলে হয়েছি কি আংকেল, এই নাম্বারে আব্বুকে শুধু রাতে পাবেন। দিনের বেলায় উনি ফোন কাছে রাখেন না।

– আচ্ছা মামুনি। আমাদের খুব তাড়াতাড়ি দেখা হচ্ছে কেমন?

– অবশ্যই আংকেল।

ফয়সাল এবং ওরা বাবা চলে যেতেই শব্দ করে বলল আদিবা,

– এই জীবনে আর কখনোই দেখা হবে না আপনাদের সাথে। বাবা গো বাবা এই গুন্ডা ছেলেকে বিয়ে করে আমার জীবন জাহান্নাম করার কোনো ইচ্ছাই আমার নাই। মজা করে একটু বকা কিংবা থাপ্পড় দিলেও সেটা নিয়ে যুদ্ধ করে রোদের মাঝে দাঁড় করিয়ে রাখবে এই রাজনীতিবিদ ছেলে।

সেদিন রাতেই অরিন ওর মাকে নিয়ে বাসায় চলে যায়। আদিবা চলে যায় তার বাসায়।

রাত নয়টা,

আদিবা তার মুঠোফোনটার দিকে সেই কখন থেকে তাকিয়ে আছে। একজনের ফোনের অপেক্ষা করতে করতেই সেই মূল্যবান ফোনটি চলে আসলো। ফোনটা কানে নিয়ে, এসে দরজা বন্ধ করে বলল,

– আজ দেরি করলেন যে ফোন দিতে? জানেন কখন থেকে ওয়েট করছি।

– সরি আদু, আম্মুর শরীরটা ভালো ছিল না উনাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম , মাত্র আসলাম। তো কেমন আছো?

– আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো তবে এখন আন্টির শরীর কেমন?

– আগের থেকে অনেকটা সুস্থ আছেন তবে রেগুলার মেডিসিন ও চেকাপ করাতে হবে। তোমাকে তো বলেছি আমার পরিবারের কি অবস্থা।

– আপনাকে কতবার বলেছি আপনার নাম, ঠিকানা আমাকে দেন দেখি আপনার কোনো হেল্প করতে পারি কিনা? কিন্তু আপনার তো সেই এক কথা ‘কারো হেল্প নিবেন না’। একাই সব সামাল দিবেন।

ফোনের ওপাশের ছেলেটি হাসলো। তিন মাস ধরে এই অচেনা অজানা ছেলেটির সাথে প্রতিদিন রাত নয়টায় কথা হয় আদিবার। রং নাম্বারে আসা এই কলের জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করে সে। কিন্তু এখনও এই ছেলের নাম কিংবা পরিচয় সে জানে না। শুধু জানে ছেলেটির বাবা বেঁচে নেই , তারা তিন ভাই তিন বোন। পরিবারের অবস্থা বেশি ভালো না থাকায় ইন্টার পর্যন্ত পড়ালেখা করে ছোটখাটো চাকরি করছে সে। এক বোনের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে আর বাকি চারজনের পড়ালেখা, মায়ের অসুস্থতার খরচ সব একা হাতে সামলাচ্ছে সে। এইসব শোনে হয়তো আদিবা ছেলেটির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। হতে পারে ছেলেটির কষ্টের কাহিনী তার মনকে আকর্ষণ করেছে। হঠাৎ দরজায় মায়ের কণ্ঠ শোনে আদিবা ফোনের ওপাশে থাকা ছেলেটিকে বলল,

– আম্মু ডাকছে, রাখছি।

– ভালো থেকো।

বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলতেই আদিবার মা বলল,

– তাড়াতাড়ি খেতে আয়। তোর বাবা অপেক্ষা করছে।

আদিবা চলে গেলো রাতের খাবার খেতে। বাম পাশের চেয়ারে বসে আছেন আদিবার আব্বু মিষ্টার নিজাম উদ্দিন আর তার পাশে বসেছে আদিবার পাঁচ বছরের ছোট্ট বোন আদুরী। আদিবার মা খাবার বেড়ে দিলেন।

– আম্মু, অরিনের আম্মু বলল আজকে নাকি ওই রাজাকারের বাচ্চা আই মীন ফয়সাল তোমাকে দেখতে এসেছে তাও আবার হসপিটালে। আচ্ছা মা ওদের টাকা পয়সা কি সব শেষ হয়ে গিয়েছে?

আদিবার বাবা রাজনীতি একদম পছন্দ করেন না সেইজন্যই তিনি ফয়সালকে রাজাকারের বাচ্চা বলেই ডাকেন।

– জানি না গো আব্বু। আমিও তো অবাক হয়েছি তখন, যখন দেখলাম বিখ্যাত ব্যাক্তি ফয়সাল আহমেদ আমাকে দেখতে এসেছে।

– তুমি কি রাজি আম্মু?

কেশে উঠলো আদিবা। মিষ্টার নিজাম উদ্দিন পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললেন,

– রিল্যাক্স আম্মু। শান্ত হয়ে খাবার খাও।

– রিলাক্স কিভাবে হবো আব্বু? তুমি জিজ্ঞাসা করছো ওই ছেলেকে বিয়ে করতে কিনা আমি রাজি নাকি? আব্বু আমার মাথার তার ছিঁড়ে গেছে এমন মনে হয় তোমার?

বিজয়ীর হাসি হাসলেন মিষ্টার নিজাম উদ্দিন। উনি এমন বড় পরিবারে কিছুতেই মেয়ের বিয়ে দিবেন না । উনি উনার সামর্থ্য অনুযায়ী এমন লোকের কাছেই মেয়ের বিয়ে দিবেন যেন কথা শোনাতে না পারে। আদুরী তখন অভিমানী সুরে বলল,

– আপু, ওই লোকগুলো মোটেও ভালো না। তোমাকে দেখে টাকাও দিলো না । আম্মুকে বলবো তোমাকে কালো টিপ পড়িয়ে দিতে। বাজে লোকগুলো নজর দিয়ে গেছে। ওই ছেলের থেকে তো আমার ক্লাসের জিসান ভাইয়া অনেক ভালো। প্রতিদিন আমাকে চকোলেট গিফট করে। আমি জিসান ভাইয়াকে বলেছি, যদি সব সময় চকোলেট গিফট করো তাহলে বড় হয়ে তোমাকেই বিয়ে করব আর না করলে তোমাকে বিয়ে করব না।

ছোট মেয়ের কথা শোনে রাগী দৃষ্টিতে তাকালেন মিষ্টার নিজাম উদ্দিন। আদুরী তার ইনোসেন্ট মার্কা মুখে পাপ্পি দিয়ে বলল,

– তুমিই তো বলেছো আমরা দুই বোন তোমার মেয়ে কম বন্ধু বেশি সেইজন্যই তো শেয়ার করলাম বন্ধু হিসেবে হিহিহিহি।

এইবার সবাই হেসে দিল। খুনসুটির ভিতরে তাদের রাতের খাবারের সমাপ্তি ঘটলো,

পরের দিন সকালে আদুরী এসে আদিবাকে বলল,

– আপু আমি মনে হয় আর বাঁচবো না।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here