দু’মুঠো প্রেম,৪,৫

0
2619

দু’মুঠো প্রেম,৪,৫
ফারজানা আফরোজ

আদিবা ও আদুরী রাস্তা ধরে হাঁটছে। ফুচকার দোকানের সামনে আসতেই আদুরী বায়না করলো সে চটপটি খাবে। আদিবা নিজের জন্য এক প্লেট ফুচকা ও আদুরীর জন্য এক প্লেট চটপটি নিলো। দুই বোন খুনসুটি করেই শেষ করলো খাবারগুলো। বিল মিটিয়ে আবারো হাঁটা ধরলো দুই বোন।

– আপু আসো আমরা দৌঁড় দৌঁড় খেলি। আমি দৌড়াবো আর তুমি আমাকে দৌঁড়ে ধরবে।

– একদমই না। রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করলে মানুষ এসে পাগল ভেবে পাবনা পাঠিয়ে দিবে।

কে শোনে কার কথা। এক দৌঁড়ে চলে গেলো আদুরী। আদিবা ছুটলো তার পিছু।

তিন রাস্তার মোড়ে দরবার বসেছে। মানুষজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। একজন ছেলে রাস্তায় এক মেয়েকে বিরক্ত করেছে। শুধু বিরক্ত নয় মেয়েটির ওড়না জোর করে রেখে দিয়েছে। সেই ছেলেকেই ধরে বেঁধে গাছের সাথে বাঁধা হয়েছে। ফয়সাল কয়েক দফা মেরে রক্ত বের করেছে ছেলেটির শরীর থেকে। সিদ্ধান্ত হলো গরম তেল ছেলের ডান হাতে ঢালা হবে। ভবিষ্যতে যেনো আর কোনো মেয়ের সাথে এমন অসভ্যতম কাজ করতে না পারে।

আদুরী দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে দরবারে মাঝে চলে আসে আর তার পিছন পিছন আদিবা। হঠাৎ আদিবার খেয়াল হলো সে মানুষের ভিড়ে এসে পড়েছে। সবাই তাকে দেখছে। আদুরীর এক হাত টেনে ধরে আস্তে আস্তে বলল,

– চল তাড়াতাড়ি।

আদিবা চলে যেতে নিলেই ফয়সালের দৃষ্টি পরে তার উপর। রাগী মাথা এইবার ভীষণ রেগে যায় আদিবাকে দেখে। দৌঁড়ে এসে আদিবার হাত টেনে ধরে। কর্কশ কন্ঠে বলে উঠে,

– লাজ শরমের মাথা খেয়ে রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছো? বাবা মা শিক্ষা দীক্ষা দেইনি মনে হয়। আর কিসব জামা পড়েছো। এইসব জামা পড়ার চেয়ে না পড়লেই তো ভালো ছিল। তোমাদের মত কিছু মেয়েদের জন্য যুবক সমাজ নষ্ট হচ্ছে। নিজেরা শরীর দেখিয়ে চলবে আর ছেলেরা তাকালেই ছেলেদের চোখ খারাপ। কেন বাসা থেকে ঢোলা জামা কাপড় পড়ে বের হতে পারো না? নাকি টাকা পয়সার অভাব?

ফয়সাল হতে বুঝতে পারছে না সে কি বলছে। রাগের বশে মুখে যা আসছে তাই বলে ফেলছে। এতগুলো মানুষের সামনে আদিবা লজ্জায় মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে।

ফয়সাল তখন ওই ছেলেটির কাছে গিয়ে দু’গালে দুইটা থাপ্পড় মেরে চেঁচিয়ে উঠলো,

– আর এদের মত ছেলেদের জন্য সব ছেলের বদনাম হচ্ছে। যে মেয়ে পাত্তা দিবে না তার পিছনে ঘুরতে কেন যাস? বিয়ে করার ইচ্ছে থাকলে আগে নিজে কাজকর্ম কর পরে বাবা মাকে বলে বিয়ে কর। রাস্তা ঘাটে মেয়েদের বিরক্ত করতে ভীষণ ভালো লাগে তাই না? আজ চোখের পর্দা করিস না বলেই এইসব হচ্ছে। ইচ্ছা করছে গরম তেল তোর চোখে আর যে মেয়েগুলো ফিগার দেখিয়ে জামা কাপড় পড়ে তাদের গায়ে ঢালতে। তাহলেই দুর হবে এই ধর্ষণ, ইভটিজিং।

আদিবা এখনও কান্না করছে। লজ্জায় তার মরে যেতে ইচ্ছা করছে। ফয়সাল এই কাজ সবার সামনে না করলেও পারতো কারণ তার জামা কাপড় এতটাও খারাপ নয়। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো আজকের পর সে বাসা থেকে বের হবে না। কারণ রাস্তায় তাকে কেউ দেখলেই বলবে, আরে ওইটা ওই মেয়ে না যাকে ফয়সাল ভাই সবার সামনে অপমান করেছে। এইসব মেয়েদের এইভাবেই বলতে হয়।

বিকালের মিষ্টি রোদ এসে পড়ল আদিবার কান্না মাখা মুখে। টপটপ করে পানি তার গাল বেয়ে নিচে পড়ছে। ফয়সাল খেয়াল করলো আদিবার কান্না মাখা মুখ। বুকের ভেতর আচমকাই ব্যাথা শুরু হলো তার। জীবনে প্রথম এই মেয়েটিকে তার ভালো লেগেছিল। কত কত মেয়ের সাথে তার পরিচয় কিন্তু কখনও কাউকে এইভাবে দেখেনি সে। শুধুমাত্র আদিবাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে সে। বাবার পছন্দ বলে কথা তার উপর বাঘিনী। কথাটি মনে হতেই কিছুটা শান্ত হলো সে। আদিবার কাছে এসে শান্ত গলায় রাগী দৃষ্টিতে বলল,

– আজকের পর থেকে রাস্তাঘাটে দৌড়াদৌড়ি করলে পা দুটো ভেঙ্গে হাতে ধরিয়ে জাম তলায় বসিয়ে রাখবো। মানুষ এসে দু-এক টাকা যাই দিবে তা নিয়েই বাকি জীবন কাটাতে হবে। বলে দিলাম।

আদুরী এইবার রেগে বোম হয়ে ফয়সালের প্যান্টের ডান পায়ের দিকে খুচাতে শুরু করলো। ফয়সাল পায়ের দিকে তাকাতেই মিষ্টি ছোট্ট একটা পুতুল দেখে পা ভাঁজ করে আদুরীর মুখ বরাবর তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,

– সমস্যা কি?

– খাম্বা। আমার আপুকে বকা কেন দিলে? তুমি পঁচা একটুও ভালো না। দেখতে যেমন খাম্বা জিরাফের মতো আর আচরণেও ভিলেনের মত। নায়ক নায়ক ভাব কিন্তু কথাবার্তা পুরাই ভিলেন। এই আদুরী বদ দুআ দিলো তোমাকে, জীবনেও বিয়ে হবে না। যদিও হয় সারাদিন বউ আর শালী, শালা সবার হাতে মাইর খেতে হবে। আরেকটা দুআ দিলাম যেন তোমার পকেটের টাকা তোমার বউ শালী কেড়ে নিয়ে তোমাকে ফকির বানায়।

ফয়সাল বুঝতে পারছে না সে হাসবে নাকি কান্না করবে। আদুরীর কথাগুলো এতই ভালো লেগেছে যে সে জোড়ে জোড়ে হাসতে লাগলো।

– ওয়াও কি কিউট।

– একদম পটাতে এসেছো না। আদুরী তোমার মত বুড়ো, ভিলেন ছেলেকে বিয়ে করবে না। এতদিনে বিয়ে করলে আমার মত নাতি নাতনী থাকতো তোমার। যাও বাসায় গিয়ে বাবা মাকে বলে বিয়ে করে ফেলো।

ফয়সালের চোখ এখন কপালে। মুখ হা করে তাকিয়ে আছে আদুরীর দিকে। আদুরী তখন আবারো ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,

– শুনো পরের বার যদি আমাদের দেখা হয় তাহলে হাঁটু পর্যন্ত পা কেটে পড়ে এসো। ইসস কত্ত লম্বা। হাঁটু মুড়ে বসেছো তবুও নাগাল পাচ্ছি না।

আদুরী আর কিছু না বলে আদিবার হাত ধরে যেতে লাগলো। তাদের যাবার পানে তাকিয়ে রইলো ফয়সাল। লোকজন ভাবছে, হঠাৎ কি হলো ফয়সাল ভাইয়ের, পিচ্ছি মেয়েটা কত কথা বলল আর তিনি কিনা হাসছে। আশ্চর্য!

আদিবা বাসায় এসে এখনও কান্না করছে। তার ফর্সা মুখ এখন লাল রঙ ধারণ করেছে। আদুরী এসেছিল বুঝাতে কিন্তু বড় বোনের ধমক খেয়ে মাথা নিচু করে চলে গিয়েছে সে।

অন্যদিকে ফয়সাল বাসায় এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। আজকাল নিজের প্রতি একটুও খেয়াল রাখে না সে।

– কত মেয়ের ক্রাশ আমি আর ওই পিচ্ছি মেয়ে কিনা বলল আমি বুড়ো? বড় বোনের তেজ যেমনি হোক ছোট বোন তার হাজারগুণ হবে। এইটুকু বয়সে যদি এমন ঝাঁঝ থাকে তাহলে বড় হলে কিরকম হবে তার হিসাব নেই।

বিড়বিড় করে কথাগুলো বলছে তখনি নজর পড়ল তার চুলের দিকে। পাকা পাকা চারটা চুল তার সামনে ঝিকঝিক করছে। মুখটা কালো করে বলল,

– আসলেই তো আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। আচ্ছা তাহলে মেয়েরা কি আমার পাওয়ার দেখে আমাকে পছন্দ করে নাকি টাকা?

পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল আরিফ। গলার কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,

– দোস্ত কি প্রেমে পড়েছিস? জানিস প্রেমে পড়লে মানুষ ঘনঘন আয়না দেখে। তো সেই সুন্দরী রমণী কে রে?

আরিফের মুখ সরিয়ে বিরক্তি ভাব নিয়ে বলল ফয়সাল,

– শালা গেঁ। তোকে কি আর শুধু শুধু গেঁ বলি? তোর স্বভাবে বলি। দূর থেকে কথাগুলো বলা যেতো না? এইভাবে জড়িয়ে ধরে বলতে হয়? ওই তুই কি তোর তিন চারটা গার্লফ্রেন্ডের সাথেও এমন করিস নাকি?

আরিফ তার মাথা চুলকিয়ে আস্তে আস্তে বলল,

– শুধু জড়িয়ে ধরা নয় অনেক কিছু করি কিন্তু তোকে বলা যাবে না। জানলেই আমাকে জেলে দিয়ে আসবি।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল ফয়সাল,

– একদিন দেখা যাবে রাস্তাঘাটে তোর হাজার হাজার ছেলে মেয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। গার্লফ্রেন্ড একটা আরেকটার সাথে ঝগড়া লেগে মারামারি শুরু করে দিয়েছে। সেদিন তোর বিচার যদি আমাকে করতে হয় ট্রাস্ট কর তোকে কেটে টুকরো টুকরো করে সবার মাঝে ভাগ করে দিবো।

– শোন ভাই তুই যা ভাবছিস আমি ওতো খারাপও নই। এখন বল আয়না কেন দেখছিস?

– চুল পেকে গেছে বুড়ো হয়ে গেছি আমি।

ফয়সালের কথা শোনে আরিফ বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। হাসতে হাসতে বলল,

– বিয়ে করতে চাচ্ছিস ভালো কথা। এইভাবে ঘুরিয়ে পেচিয়ে কেন বলছিস। কবে থেকে লজ্জা পাচ্ছিস রে তুই?

ফয়সাল এইবার আরিফের উপরে উঠে বসলো। আরিফের চুল টেনে বলা শুরু করলো,

চলবে,

দু’মুঠো প্রেম
ফারজানা আফরোজ

ফয়সাল এইবার আরিফের উপরে উঠে বসলো। আরিফের চুল টেনে বলা শুরু করলো,

– আমি বুড়ো হলে তুই কি? শালা, তুই তো বুইড়া খাটাস।

আরিফকে এইবার সুড়সুড়ি দিতে লাগলো ফয়সাল। অনেকক্ষণ ধরে দুই বন্ধুর ঝগড়া, খুনসুটি চলতে লাগলো। ফয়সাল খাটের এক মাথায় শুয়ে মাথার নিচে হাত রেখে আরিফকে উদ্দেশ্য করে বলল,

– জানিস আরিফ, এই প্রথম কোনো মেয়েকে দেখে এতটা ভালো লেগেছে। তার ঝাঁঝালো কথা, কান্না মাখা মুখ এক কথায় অসাধারণ। দোস্ত আসলেই আমি প্রেমে পড়েছি রে। আমার ইচ্ছা করছে আমার প্রেম ভালোবাসা ওই মেয়েটার দু’হাতের মুঠোয় রেখে দিতে। যেন তার ছোঁয়া আমি সব সময় অনুভব করি। আমি যে কাউকে ভালোবাসতে পারবো কখনও ভাবিনি।

আরিফ তখন এক হাতে ফয়সালকে জড়িয়ে ধরে বলল,

– মেয়েটা কে? আংকেলের সেই পছন্দ করা মেয়েটি নাকি?

– হুম। কিন্তু আমি না ওর সাথে খুব খারাপ কাজ করেছি। লোকজনের সামনে অপমান করেছি যা আসলেই আমার করা উচিৎ হয়নি। আসলে প্রচুর রেগে ছিলাম তার উপর ও রাস্তাঘাটে দৌড়াদৌড়ি করছে দেখে মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেলো। কেন বের হবে সে রাস্তায়? জানে না অন্য কেউ ওকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখলে আমার রাগ হয়? ভালো নজর কিংবা খারাপ নজর দুইটাই আমি দেখবো অন্য কেউ নয়।

– ইসস প্রেম শুরু হবার আগেই ভুল বুঝাবুঝি। তোকে কতবার বলছি মাথা সব সময় শান্ত রাখবি। জানিস মেয়েরা রাগী বর কখনও পছন্দ করে না। মুভি, উপন্যাসে রাগী ছেলের প্রেমে পড়লেও সত্যিকার অর্থে প্রেম হয় না। কোন মেয়ে চায় কথায় কথায় মার খেতে বল তুই? উপন্যাসে পড়ি, নায়ক নায়িকাকে মেরে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে তবুও সেই নায়িকা কিনা নায়কের জন্য পাগল। বাস্তব জীবনে যদি এমন হয় পরের দিনই ছেলেটির নামে কেস করে বসবে মেয়েটি। এখন ভালো বুদ্ধি দিচ্ছি যত পারিস মেয়েটার সামনে শান্ত থাকার ট্রাই করবি, রোমান্টিক ভাব নিয়ে চলবি, আর মেয়েরা গিফট পেলে ভীষণ খুশি হয় বিশেষ করে চকোলেট, শাড়ি, পুতুল, টেডি এইসব। ওইগুলো দিয়ে সারপ্রাইজ দিবি। দেখবি খুব তাড়াতাড়ি তোর বিয়ের রাস্তা ক্লিয়ার হয়ে যাবে।

আরিফের কথা শোনে ফয়সাল এইবার নিজেই জড়িয়ে ধরলো আরিফকে। আরিফ এতদিনের সঞ্চিত প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ হাত ছাড়া না করে বলেই ফেলল,

– এই ছিঃ ছিঃ তুইও দেখছি আজকাল গেঁ হয়ে যাচ্ছিস। লজ্জা বলে একটা শব্দ আছে মাথায় রাখ। বিয়ের পর বউকে এইভাবে জড়িয়ে ধরিস ছাড় বলছি।

ফয়সাল জোড়ে জোড়ে হাসতে হাসতে বলল,

– ছেড়ে দে শয়তান, তুই আমার দেহ পাবি কিন্তু মন পাবি না, হাহাহা।

– ওইটা পেলেই হবে। হাহাহাহা। বাংলা সিনেমার ডায়লগ মানেই তো এইসব। হাহাহা।

__________________

সন্ধ্যার পর আদিবা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ পানে তাকিয়ে থেকে চোখের পানি ফেলছে। কিছুতেই সে সেদিনের অপমান ভুলতে পারছে না। হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা বাতাস বইয়ে গেলো আদিবার শরীর স্পর্শ করে। কেঁপে উঠলো সে। মনের ভিতর শুরু হলো সেদিনের কংকালের ভয়ার্ত মুহূর্তের কথা। ভ্যাপসা গরমেও এখন তার শীত করছে। পৌষ মাঘ মাসের শীত যেনো এসে পড়েছে তার। ভয়ে ছাদ থেকে নামতে নিতেই কিছু একটার সাথে পা বেজে নিচে পড়ে গেল সে। শব্দ করে চিৎকার দিলো সে, মনে হলো কিছু একটা ছিল তার আশপাশে, কিন্তু কি ছিল? সে তো কিছু দেখতে পায়নি শুধু অনুভব করেছে। মনে মনে দু’আ পড়লো অনেকগুলো। সাহস জুগিয়েে দৌঁড় দিলো সে। ড্রয়িং রুমের কাছে আসতেই জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। আদিবার মা বড় মেয়েকে এইভাবে দেখতে পেয়ে দৌঁড়ে কাছে আসতেই আদিবা হাত দিয়ে তাকে ইশারা করলো সে পানি খাবে। এক গ্লাস পানি আদিবার কাছে নিয়ে যেতেই ঢকঢক করে সবটুকু শেষ করে কান্না করতে থাকলো,

– মা কি হয়েছে তোর? ভয় পেয়েছিস?

– আম্মু আমার মনে হয় কেউ আমাকে ফলো করছে। সে মানুষ নয় অন্য জগতের কেউ। আচ্ছা আম্মু ভুত, আত্মা, জীন বলে কিছু আছে?

– ইসলামে বলা হয়েছে, মহান আল্লাহতায়ালা মানুষ ও জিনদের সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি জিন ও মানুষকে কেবলমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা আজ-জারিয়াত, আয়াত : ৫৬) তাই জ্বীন আছে আমরা তা বিশ্বাস করতে বাধ্য তবে ভুত, আত্মা এইসব বলে কিছু নেই। মনে রাখবি মৃত ব্যক্তি কখনও ফিরত আসে না। তবে কিছু পাজি জ্বীন মৃত ব্যক্তি কিংবা মানুষের রূপ ধারণ করে ভয় দেখায়।

– আম্মু আমার পিছনে জ্বীন পড়েছে। আমাকে নিয়ে যাবে।

কথাগুলো বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো আদিবা। সন্ধ্যার কাহিনী বলল মাকে। আদিবার মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলল,

– এইসব কল্পনা মা। তুই হয়তো কিছু নিয়ে ভাবছিলি সেইজন্যই এমন মনে হয়েছে। হ্যালুসিনেশন থেকে এমন হয়েছে তোর। হ্যালুসিনেশন হলো এমনি একটি মানসিক অবস্থা যেখানে ব্যক্তি কোনো প্রকার উদ্দীপনা ছাড়াই বিশেষ ইন্দ্রিয়ানুভূতি লাভ করে। এ অনুভূতির সঞ্চার স্বাভাবিক অনুভূতির মতোই ঘটে। সন্ধ্যায় বাতাস বইতে পারে স্বাভাবিক, প্লাজোতে উষ্টা খেয়ে অনেকবার পড়েছিস তুই সো এইটাও এমন কিছু হতে পারে, ভয় থেকে তোর মাথায় ঢুকেছে কেউ তোকে ফলো করছে। বাজে চিন্তা ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। আর হুম এখন থেকে নিয়মিত নামায আদায় করিস বাজে কিছু তোকে স্পর্শ করতে পারবে না।

অনেকটা স্বস্তি বোধ করলো আদিবা। মায়ের কোলে মাথা রেখে কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে নিজের রুমে হাঁটা দিল সে।

__________

ক্যান্টিনে চুপচাপ বসে আছে আদিবা ও অরিন। মুখে তাদের রাজ্যর বিরক্তি। ভার্সিটির এক সিনিয়র ভাইয়া তাদের সামনে বসে আছে সাথে রয়েছে বেশ কিছু ছেলে। বড় ভাইদের সাথে লাগলে সমস্যা সেই কারণে তাদের কথামত তারা দুইজন চুপচাপ বসে আছে। শ্যাম বর্ণের একটি ছেলে আমতা আমতা করে অরিনের উদ্দেশ্য বলতে লাগলো,

– আপনার নাম কি?

পিছন থেকে তাদের দলের একজন ছেলেটির পিঠে হালকা চড় মেরে ধমকের সুরে বলল,

– বিড়ালের মত মিউ মিউ করছিস কেন? আপনি আপনি না করে সোজা বল, তুই ওই মেয়েকে পছন্দ করিস। এখন আপাতত প্রেম করতে চাচ্ছিস।

কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে আদিবার চোখের দিকে তাকাল অরিন। আদিবা শান্ত ভঙ্গিতে ইশারা দিয়ে বুঝাতে লাগলো,

– চিন্তা করিস না। মেয়ে হয়ে জন্মেছিস প্রেমের অফার আসবে। স্বাভাবিক। এখন চুপচাপ ওদের কথাগুলো গিলতে থাক।

আদিবার ইশারা বুঝে চুপ করেই রইলো অরিন। আচমকাই ছেলেটি অরিনের হাত জোড়া চেপে ধরে বলতে লাগলো,

– প্লিজ ফিরিয়ে দিও না। তাহলে কিন্তু আমি বাঁচতে পারব না। হঠাৎ তোমাকে দেখেই আমার মনে প্রেম প্রেম অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে প্লিজ শুরুতেই শেষ করে দিও না।

ক্ষেপে গেলো আদিবা। পাবলিক প্লেসে একটা মেয়ের হাত ধরে প্রোপজ করা, মেয়েটার অনুমতি ছাড়াই। কিন্তু এখন শক্ত কণ্ঠে কথা বললে এতে বিপরীত কিছু হয়ে যেতে পারে সেইজন্য কিছুক্ষণ চিন্তা করলো না। এরেই মাঝে তার মাথায় শয়তানি এক বুদ্ধি এসে গেলো। মনে মনে নিজেকে বাহবা দিতে লাগলো সে,

– ওয়াও আদু, ইউ আর আ গ্রেট বেবি। এই রকম একটা বুদ্ধি যদি মাথায় সব সময় ঘুরাঘুরি করতো তাহলে তুই তো ফেমাস হয়ে যেতে এতদিনে।

আদিবা এইবার উচ্চ সুরে বলে উঠলো,

– ভাইয়া ও কিন্তু রাজনীতিবিদ ফয়সাল আহমেদের গার্লফ্রেন্ড। ফয়সাল ভাই যদি জানে উনার গার্লফ্রেন্ডকে নিজের গার্লফ্রেন্ড বানানোর প্ল্যান করছেন তখন কি করবে আপনাদের জানেন? কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ফেলে আসবে। বলবো কি ভাইয়াকে?

ফয়সাল আহমেদ নামটি শোনে ভয়ে ঢুক গিললো ছেলেগুলো। যে ছেলে প্রপোজ করেছিল সে ভয়ে ভয়ে বলল,

– আরেহ আমি তো মজা করছি। প্লিজ ভাইয়াকে কিছু বলবেন না। এখন থেকে আপনারা আমাদের ধর্মের বোন। আজ থেকে যদি কেউ আপনাদের বিরক্ত করে আমাদের বলবেন কেমন? দেখবেন কি অবস্থা করি। প্লিজ তবুও ভাইকে কিছু বলবেন না।

ছেলেগুলো দৌঁড়ে পালালো। আদিবা তো হেসে কুটিকুটি। অরিন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

– মিথ্যা কেন বললি?

– নিজেদের বাঁচানোর জন্য। শোন এখন থেকে আমরা ভেজাল মুক্ত তাছাড়া ফয়সাল ভাই আর এইদিকে আসবে বলে মনে হয় না। উনি কাজ নিয়েই পরে থাকেন সব সময়।

– কি বুদ্ধি রে তোর।

আদিবা এখন নিজের বুদ্ধি নিয়ে গর্ববোধ করছে। এতদিন পর তার ফাঁকা মাথা ভালো কিছুতে ভরপুর হয়েছে বলেই শান্তি শান্তি ভাব নিচ্ছে।

__________

আদুরী গালে হাত দিয়ে বসে আছে। খেলার মতো কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না। পাজি তুহিন সবাইকে চকোলেট খাইয়ে নিজের দলে নিয়ে গিয়েছে। কেউ এখন আদুরীর সাথে খেলছে না। মাঠের এক কোনায় মুখ কালো করে অন্যদের খেলা দেখছে সে এমন সময় প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে নায়ক নায়ক ভাব নিয়ে এন্ট্রি ঘটে তুহিনের। ভ্রু নাচিয়ে আদুরীর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলে,

– কি রে কেউ খেলে না তোর সাথে? বিচ্ছু মেয়েদের সাথে কেউ খেলতে চায় না রে।

আদুরী এইবার কান্না করে দিলো। এমনিতেই সে কষ্টে আছে এখন আবার তুহিন তাকে কষ্ট দিচ্ছে। এত কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বেচারি মেয়েটা এইবার কেঁদে বন্যা বানাতে শুরু করে দিলো। তুহিন তখন কষ্ট মাখা ভাব নিয়ে বলল,

– হইছে আর কান্না করতে হবে না। চল খেলি আমরা।

তুহিন আদুরীর এক হাত টেনে নিয়ে যেতে লাগলো খেলার জন্য। আদুরী মনে মনে বলল,

– চান্দু কি ভেবেছিস এত সহজেই আদুরীকে হারাবি? অপেক্ষা কর , তুই যদি হিরো সালমান খান হস আমিও কিন্তু আদুরিনি। আমার বুদ্ধির সাথে তুই একটা তিন দিনের বাচ্চা। আজ খেলার ছলেই তোর মাথা ফাটিয়ে বলব, আমি কিছু জানি না কারণ তোর সাথে তো আমার ঝগড়াই হয়নি। আমি তো গুড গার্ল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here