দু’মুঠো প্রেম,১০,১১

0
3247

দু’মুঠো প্রেম,১০,১১
ফারজানা আফরোজ
১০

আরিফ কিছু বলতে যাবে তার আগেই অরিন এমন একটি কাজ করে বসলো যাতে আরিফের চোখ কপালে। রসগোল্লার মতো চোখগুলো তাকিয়ে আছে অরিনের দিকে,

অরিন আরিফের মুখ চেপে ধরে অন্য হাত আরিফের ঘাড়ে রেখে চিমটি কেটে মিষ্টি হেসে বলে উঠলো,

— আসলে হয়েছে কি ফয়সাল ভাই, আপনার এই বন্ধুর সাথে আমার দুই মাসের পরিচয়। তো উনি আমাকে অনেকবার প্রপোজ করেছে রাজি না থাকায় এখন সে নালিশ জানাতে আসছে আপনার কাছে। একটু বুঝিয়ে বলুন আপনার এই অকেজো বন্ধুকে যে, একটা মেয়ের ভালোবাসা পেতে অনেক কাঠখড় পুড়াতে হয়।

আরিফ যেন অরিনের কথার জালে আটকে পরে চুপচাপ হয়ে গেছে। সে হিসাব করছে তাদের পরিচয় এক সপ্তাহও হলো না কিন্তু এই মেয়ে বলছে দুইমাস। এক বাজার থেকে কিনে আরেক বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে ফেলবে এই মেয়ে তাকে। ফয়সাল তখন হট্ট হাসিতে মেতে উঠলো।

— ছিঃ আরিফ তোর থেকে এমন কিছু আশা করেনি। বাই দা ওয়ে, শালীকা যাও তোমরা পিছনের সিটে বসে নিজেদের মধ্যে সব ঠিকঠাক করে নাও আর এইদিকে আমরাও।

অরিন যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু এখনও আরিফের মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে সে বলে দিবে ফয়সালকে তাই কোনো রিস্ক না নিয়ে আরিফের হাত ধরে টেনে পিছনে গিয়ে বসে পড়লো। আদুরী সব কিছু ভালো করে লক্ষ্য করে মুখ ফুলিয়ে বলল,

— আগে জানলে কখনই আসতাম না। তোমরা সবাই কাপল হয়ে ঘুরতে যাচ্ছো আর আমি কিনা একা একা ঘুরবো।

আদিবা চোখ পাকিয়ে কড়া গলায় বলল,

— বাচ্চা মেয়ে বাচ্চাদের মত থাকবে একদম বড়দের মত কথা বলবে না। বেশি পকপক করলে গাড়ি থেকে নামিয়ে বাসায় দিয়ে আসবো।

আদুরী বলল,

— ওকে দেও। আমিও গিয়ে আব্বুকে বলব, জানো আব্বু আপু না ওই রাজাকারের বাচ্চার সাথে সাজেক ঘুরতে যাচ্ছে, ওরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে। তখন দেখবে তোমার কি হয়।

আদিবা নিরুপায় হয়ে বলল,

— একদম মিথ্যা কথা বলবি না। আমার কোনো সম্পর্ক নেই এই লোকের সাথে।

— নাহ থাকুক। আমাকে না নিয়ে গেলে বলে দিবো।।

— ওকে তোকে নিয়ে যাবো ।

— গুড গার্ল।

ফয়সাল তখন আদুরীকে জিজ্ঞাসা করলো,

— রাজাকারের বাচ্চা কে?

আদুরী তখন দাঁত বের করে হেসে দিয়ে বলল,

— তুমি। আব্বু তো তোমাকে রাজাকারের বাচ্চা বলেই জানে হিহিহিহি।

শশুর মশাইয়ের প্রতি এক রাশ রাগ হলো ফয়সালের। মনে মনে ভাবতে লাগলো সাজেক থেকে আসার পরেই শশুর মশাইয়ের একটা ব্যাবস্থা সে করবে।

আদিবার চিন্তা হচ্ছে অরিনকে নিয়ে। পিছনে তারা দুজন কি করছে কে জানে। বাস এখনও ছাড়ে নাই তাই সে সিট থেকে দাঁড়িয়ে উল্টো ঘুরে পিছনে তাকিয়ে দেখলো অরিন বেশ রেগে আছে। আরিফ তাকে টিজ করছে। আদুরী চিপসের প্যাকেট জানালা দিয়ে ফেলবে বলে ফয়সালের কোল থেকে নেমে জানালার কাছে গিয়ে হাত বাড়ালো তখনি বাস ছেড়ে দেওয়াতে দুই বোন এসে ফয়সালের গায়ের উপরে পরে গেলো।

— বাহ বাহ আগে একটা পাই না এখন দুজনেই দেখছি আমার কোলে উঠার জন্য পাগল হয়ে গেছে। একেই বলে ভালোবাসা।

— ভালোবাসা না ছাই। ইচ্ছা করে পড়েনি বাস ছেড়ে দেওয়াতে পড়েছি।

আদিবা নিজের সিটে গিয়ে বসলো আদুরী ফয়সালের কোলে চিপস খেয়ে ফয়সালের প্যান্টে হাত মুছতে লাগলো বেচারা ফয়সাল মুখ বুজে সব সহ্য করতে লাগলো।

অন্যদিকে,

— ওই তুমি মিথ্যা কেন বললে? আমাদের পরিচয় কিভাবে দু মাস?

— মাথার ভিতরে গিলু আছে আপনার? আপনি যদি বলতেন সত্য কথাগুলো তখন আপনার বন্ধু আমাকে তো মরিচ ছাড়াই চিবিয়ে খেত। ওহহ গুড কেন যে আমাদের দুই নিষ্পাপ বান্ধবীর সাথে আপনাদের দুই বন্ধুর দেখা হলো? জীবনটা তেজপাতা বানিয়ে ফেলতেছেন এখন।

— আমার সামনে আর কোনোদিন গুড শব্দটি ইউজ করবে না। পছন্দ করি না আমি এই শব্দ কারণ, আল্লাহতায়ালা কোরআনে বলেছেন…

“হে রাসূল! আপনি বলে দিন ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি এক ও অদ্বিতীয়। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি কাউকে জন্ম দেননি, কারো থেকে জন্ম নেন নি। তাঁর সমতুল্য বা সমকক্ষ্য কেউ নেই।”

আর যদি আমরা হিন্দুদের ছান্দগ্য উপনিষদের দিকে যায় তাহলে দেখা যাবে অধ্যায় ৬, পরিচ্ছেদ ২, অনুচ্ছেদ ১ এ উল্লেখ করা আছে…

“বলো তিনিই আল্লাহ যিনি এক ও অদ্বিতীয়। স্রষ্টা মাত্র একজনই দ্বিতীয় আর কেউ নেই”

আর যদি গুড এর সাথে ফাদার যুক্ত করি তাহলে হয় গডফাদার এর অর্থ দাঁড়ায় সৃষ্টিকর্তার বাবা।
কিন্তু মহান আল্লাহ এর কোন লিঙ্গ নেই। আর যদি GOD এর সাথে S যুক্ত করি তাহলে হয় GODS এর অর্থ অনেকগুলো সৃষ্টিকর্তা কিন্তু ইসলামে অনেকগুলো সৃষ্টিকর্তা বলে কিছু নেই।

যার প্রামণ হিন্দুধর্মের শ্বেতা পত্র উপনিষদে অধ্যায়-৬ পরিচ্ছে্দ-৯ এও আছে….
“তাঁর কোন বাবা মা নেই, তাঁর কোন প্রভূ নেই, তাঁর চেয়ে বড় আর কেউ নেই।”
সুতরাং বলা যায় আমরা ইংরেজীতে god নামে আল্লাহ কে ডাকবো না, প্রয়োজনে Almighty ব্যবহার করবো। আল্লাহ ডাকটি কত মধুর। শুনতে যেমন ভালো লাগে ডাকতেও তেমন ভালো লাগে। আল্লাহ্।।

অরিন অনেকটা অবাক হলো। সে ভাবেনি আরিফ এমন ধরনের কথা বলতে পারে।

— তাহলে তো আমরা অনেক বড় ভুল করি প্রতিদিন। ধন্যবাদ, ভুল শুধরে দেওয়ার জন্য, ওহ হ্যাঁ আপনি তো হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন, ধর্ম পরিবর্তনের ইচ্ছা আছে না কি?

— একদমই নয়। আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে দুইজন হিন্দু ফ্রেন্ড ছিল সেই কারণে একটু আকটু জানি। তবে ধর্ম পরিবর্তন করে নাস্তিক হতে চাই না। আমি মুসলমান এইটা আমার বড় পরিচয়।

ভীষণ অবাক আর খুশি হলো অরিন। আরিফের মুগ্ধকর কথা বার্তা তাকে মুগ্ধ করে ফেলেছে। শান্ত চোখে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দেখলো আরিফকে। আরিফ ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই সে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বাহিরের দিকে নজর নিক্ষেপ করলো।

আরিফ ভাবলেশহীন ভাবে বলল,

— আমরা কি বন্ধু হতে পারি? বন্ধু তো হতেই পারি কজ তোমার জন্য প্রাণ প্রিয় বন্ধুকে মিথ্যা বলেছি। তোমাকে হেল্প করানোর জন্য হলেও তো বন্ধু হতে পারি আমরা?

কয়েক মিনিটে আরিফের কথায় মুগ্ধ হয়ে অরিন রাজি হয়ে পড়লো। নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে মনে মনে একটি কবিতা বলল আরিফ,

আমি জয় করেছি আজ-
বিশাল সিন্দু,
জয় করেছি –
পর্বতমালা হিমালয়;
যা ছিল অসাধ্য,
করেছি যেন সব সাধ্য।

ফয়সাল বেশ কিছুক্ষন ধরে তাকিয়ে আছে আদিবার দিকে। আদুরীর কারণে সে কিছুই বলতে পারছে না হাজার হোক ছোট বাচ্চা তার সামনে এমন আচরণ করা উচিৎ নয় যার ফলে খারাপ কিছু হতে পারে। আদুরী ফয়সালকে জড়িয়ে ধরে চিন্তা ভাবনাহীন ভাবে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে নিশ্চিন্তে এই বুকে ঘুমাতে পারবে, যেখানে তার কোনো ভয় নেই। এই প্রথম ফয়সাল তার বুকে কিছু একটা অনুভূতি বুঝতে পারল। ছোট একজন ভাই অথবা বোন থাকা কতখানি জরুরি এখন সে বুঝছে। আদুরীর মাথায় এক হাত বুলিয়ে দিয়ে আরেক হাতে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ অনুভূতি নিতে শুরু করলো। আদিবার নজর এই দুই ব্যক্তির উপর। মনে হচ্ছে, ফয়সাল ও আদুরী একে অন্যের বহু পরিচিত। যে কেউ দেখলে ভাববে এই ছেলে হয়তো এই বাচ্চাটির বাবা নয়তো ভাই। দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দি করে রাখলো আদিবা। চুলগুলো খোলে দিয়ে জানালার বাহিরে তার দৃষ্টি। হঠাৎ করেই ফয়সাল বলে উঠলো,

— এই শোন, এই মেয়ে, আরে তোমাকেই বলছি। এই মেয়ে, এই…. আজব তো। তোমাকে জলজ্যন্ত একটা মানুষ ডাকছে তুমি শুনছ না?

ফয়সালের কণ্ঠস্বর কানে আসলেও না শোনার ভান করে বাহিরে তাকিয়ে আছে আদিবা। সে চায় আরো ডাকুক তাকে ডাকতে ডাকতে যখন বিরক্ত হবে তখন আরো বিরক্ত করার জন্য তো সে আছেই।

প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে ফয়সাল আদিবার চুল ধরে টেনে বলল,

— চুলগুলো খোঁপা করবে নাকি কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলবো?

চলবে,

দু’মুঠো প্রেম
ফারজানা আফরোজ
১১

— চুলগুলো খোঁপা করবে নাকি কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলবো?

— আমার চুল আমি খোলা রাখবো নাকি খোঁপা করব সম্পূর্ণই আমার ইচ্ছা। আপনি বলার কে?

— তোমার অবাধ্য চুলগুলো আদুরীকে জ্বালাচ্ছে তাড়াতাড়ি খোঁপা করো নয়তো ওর ঘুমের অসুবিধা হবে।

আদিবা খেয়াল করলো আসলেই তার লম্বা চুলগুলো আদুরীর মুখে গিয়ে পড়ছে। এই প্রথম তার মনে ফয়সাল সম্পর্কে অন্য এক ধারণা সৃষ্টি হলো। নিজের চুল খোঁপা করে চোখ বুজে সিটে হেলান দিয়ে শুয়ে রইলো সে।

প্রায় ছয় থেকে সাত ঘণ্টা পর এসে পৌঁছাল সাজেক তারা। ঠাণ্ডা পরিবেশ। আকাশে চাঁদ তাঁরা না থাকলেও জায়গাটা তাদের ভীষণ আকর্ষণ করেছে। দুইটা রুম বুক করা হলো। একটিতে থাকবে অরিন, আদিবা ও আদুরী। অন্যটিতে ফয়সাল ও আরিফ।

সারাদিনের ক্লান্তি তাদের সবাইকে ঘিরে ধরেছে। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। রাত এগারোটা, আদিবার প্রচণ্ড ক্ষুধা লাগায় ঘুম থেকে উঠে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো সেই অচেনা অজানা মানুষটির চেনা নাম্বারটি তাকে রাত নয়টায় তিনটা কল দিয়েছে। তড়িঘড়ি করে ফোনটা নিয়ে সেই নাম্বারে ডায়াল করতেই দেখলো ফোন বন্ধ। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

— আপনি মানুষটি বড় অদ্ভুদ। যেখানে রাত বেড়াতে ছেলে মেয়েদের চোখের ঘুম কেড়ে নেয় এই মুঠোফোন সেখানে আপনি ফোন বন্ধ করে ঘুমাচ্ছেন। অদ্ভুদ বলেই আপনার সাথে কথা বলতে ভীষণ ভালো লাগে। কিন্তু এই ভালো লাগা কখনোই ভালোবাসা হতে পারে না। কারণ আমরা দুজন ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। আমি জানি আপনি আমাকে কিছু বলতে চান সব বুঝা সত্বেও আমি এড়িয়ে চলি কারণ, আমি চাই আমরা অচেনা অজানা থেকেই বন্ধু হয়ে থাকতে। যে সম্পর্কের কোনো নাম নেই শুধু আছে অনুভূতি।

ফোনটা বিছানার উপরে রাখলো। অরিন ও আদুরী বেঘোরে ঘুমাচ্ছে কিন্তু তার চোখের ঘুম এখন আর আসবে না। তাই ধীরে ধীরে দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা খুলে বারান্দা দিয়ে একদম কর্নারে গিয়ে দাঁড়ালো। মৃদু বাতাসে তার খোলা চুলগুলো বার বার এলোমেলো হয়ে দুল খাচ্ছে। আকাশে কয়েকটা তারা আর অর্ধেক চাঁদকে দেখে মুচকি হাসলো। সামনে দেখা যাচ্ছে বিশাল পাহাড় দাঁড়িয়েছে আছে। লাইটের আলোতে ভীষণ চমৎকার চারপাশটা বুঝা যাচ্ছে তবে সাদা মেঘের ভেলা স্পষ্ট বুঝা না গেলেও অস্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে আদিবার চোখে। হাতে ফোন না থাকায় ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। এই সময়ে তো কয়কটি পিক সে তুলতেই পারতো কিন্তু এখন মোটেও তার যেতে ইচ্ছে করছে না রুমে। এত সুন্দর প্রকৃতির ভালোবাসা রেখে কি করেই বা সে যাবে।

“বালিকা তুই ভুল করিয়া
খুলিসনে তোর চুল
না হয় আমি নয়ন জুড়িয়ে
করতে পারি ভুল
নয়ন জুড়ানো রেশমি চুলে
হৃদয় ছুঁয়ে যায়
আদর করে দিবো তোকে
আমার স্বপ্নে আয়“।

আবেগময়ী কণ্ঠস্বর শোনে পিছন ঘুরে ফয়সালকে দেখতে পেতে রেলিংয়ের উপর হাত রেখে উত্তর দিল আদিবা,

— আপনি এইখানে? ঘুমাননি?

— তোমার খোলা চুলের নেশা যদি আমার চোখ থেকে না কাটে তাহলে ঘুমাবো কিভাবে? খোলা চুল তুমি বলে দাও কেনো মুগ্ধ না হবে কেউ তোমার মায়ায়?

ফয়সালের কবি কবি ভাবের কথা শোনে মুচকি হাসলো আদিবা। ফয়সাল এইবার সেই হাসির দিকেই তাকিয়ে থেকে চোখ বন্ধ করে শ্বাস ছেড়ে বলল,

— আমাকে ভালোবাসা যায় না? তোমার আব্বু আর তুমি কেন আমায় দেখতে পারো না। আমি তো খারাপ কোনো কাজ করি না বরং লোকের উপকার করি। আমার কাজ নিয়ে তো তোমার কিংবা তোমার পরিবারের গর্ব করা উচিৎ।

আদিবা কথা ঘুরানোর জন্য বলল,

— প্রচণ্ড ক্ষুধা লাগছে কিছু খেতে পারবো?

মুচকি হেসে উত্তর দিলো ফয়সাল,

— চলো।

রাতের খাবারে ছিল ব্যাম্বু চিকেন। যা ওখানকার বিশেষ খাবারের মধ্যে অন্যতম। এখানেও সেই বাঁশের সুনিপুণ ব্যবহার। আগুনের অনিয়ন্ত্রিত তাপে বাঁশের ভেতরেই সেদ্ধ হয় মুরগির মাংস। আর সাথে পরোটা।

খাওয়া শেষে ফয়সাল ও আদিবা রাতের সৌন্দর্য দেখতে এগিয়ে গেলো হেলিপ্যাডের কাছাকাছি একটি জায়গায়। যেখানে বেঞ্চের ধারেই অর্ধেক চাঁদের আলোয় আলোকিত ছিল পুরো উপত্যকা। কয়েকটি তাঁরা থেকে এখন শত শত তাঁরা আকাশে বিরাজ করছে। হঠাৎ আকাশে হালকা মেঘ তাদের দুজনের চোখের মধ্য ভেসে উঠলো।

— দেখেছেন জায়গাটা কত সুন্দর দেখেই চোখে নেশা ধরে যাচ্ছে।

— একদম তোমার এলোমেলো কালো লম্বা চুলের মতো। যতবার দেখি ততবারই নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি আমি।

— বড্ড অসভ্য লোক আপনি। আচ্ছা বলেনতো সাজেকের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা কোনটি?

— সাজেকের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা হচ্ছে কংলাক পাহাড় ও হ্যালিপ্যাড। কংলাক পাহাড়ের সৌন্দর্যের কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সাজেক ভ্রমণে আসা ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে এক প্রধান আকর্ষণ এই কংলাক পাহাড়। এটি মূলত কংলাক পাড়ায় অবস্থিত। যা সাজেক ভ্যালির একেবারে শেষ প্রান্তে অবস্থিত লুসাই জনগোষ্ঠীর দ্বারা অধ্যুষিত একটি এলাকা। কংলাক পাহাড়ের পরেই আসে হেলিপ্যাডের কথা। সূর্যোদয়ের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখা যায় এই হেলিপ্যাড থেকে।

— সাজেক ভ্যালী নিয়ে দেখছি পিএসডি অর্জন করে ফেলেছেন।

— যখনি শুনেছি তুমি আসবে তখন থেকেই সাজেক নিয়ে পড়াশোনা করতে থাকি।

অবাক হয়ে গেলো আদিবা। সাজেক নিয়ে পড়াশোনা করা যায় নাকি? মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে বলল,

— সাজেক নিয়ে পড়াশোনা আবার হয় নাকি?

— হাহাহা। নাহ আসলে সাজেক ভ্যালি সম্পর্কে জানার জন্য গুগোল, ম্যাপ, ইউ টিউব, এমনকি বন্ধুরের কাছ থেকে অনেক কিছু জেনেছি। কোথায় কি আছে? কোন জায়গা ভীষণ সুন্দর এই আর কি। তোমাকে তো ঘুরাতে হবে তাই না। বিয়ের পর আমরা শুধু ঘুরবো কেমন?

— অসভ্য লোক। আমি একটা বললে উনি আরেকটা বলে। রুমে চলুন আদুরী উঠে পরবে।

আদুরীর কথা মনে হতেই ফয়সাল বলল,

— বুড়িটা কিছু খেয়েছে? অরিনও মনে হয় খায়নি কিছু।

— ওরা ঘুমাচ্ছে।

ফয়সাল দোকান থেকে কিছু খাবার প্যাকেট করে নিয়ে গেলো। রিসোর্টে গিয়ে আদিবার হাতে দুইটা খাবারের প্যাকেট তুলে দিয়ে বলল,

— রাতে না খেয়ে থাকা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এখন ওদের ডেকে খাইয়ে দিবে। আর শুনো জোরে জোরে ডাকবে না আস্তে আস্তে ভালোবেসে ডাকবে। ঘুমানো ব্যাক্তিকে জোরে ডাকলে তার ব্রেনের সমস্যা হয়। বুঝছো?

আদিবা তার মাথা এদিক ওদিক হেলিয়ে বুঝালো সে বুঝছে। খাবারের প্যাকেট নিয়ে রুমে যেতে নিলেই আচমকা ফয়সাল হাত ধরে টান দিয়ে একদম কাছে মিশিয়ে আদিবার চুলে মুখে ডুবিয়ে চুলের উপর ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে মুচকি হেসে বলল,

— নেশাটা কমানোর জন্য এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সরি আদু। লাভ ইউ। যাও ঘুমিয়ে পড়ো।

আদিবা আর কথা বাড়ালো না। সে চলে গেল রুমে। রাতে আদুরীকে আর অরিনকে ঘুম থেকে উঠিয়ে খাবার খাইয়ে দিয়ে তিনজন একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালে গরম চা হাতে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়ের আমেজ উপভোগ করছে আদিবা ও অরিন। আদুরী এখনও ঘুমাচ্ছে। অরিন আকাশ পানে তাকিয়ে থেকে বলল,

— শুভ্র মেঘের পিছুপিছু ছুঁটে যেতে কার না ইচ্ছে করে। মেঘের ভেলায় হারিয়ে যেতে, আকাশের মেঘদের সাথে কথা বলতে চায় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু কংক্রিটের এই শহরে মেঘেদের নাগাল পাওয়া দায়। তাইতো মানুষ মেঘের রাজ্যে গমন করার জন্য ছুঁটে আছে এই সাজেক। চোখের সামনে যখন বিশাল বড় পাহাড় আর শুভ্র মেঘের ছোঁয়া পাওয়া যায় তখন এই মন বারবার বলে উঠে, কংক্রিটের শহরে না থেকে চলে আয় প্রকৃতির সবুজ রঙের দেশে, চলে আয় শুভ্র রাঙা মেঘের দেশে।

আদিবা শব্দ করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,

— ভদ্রতার খাতিরে নিশব্দে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে এসেছি এতদিন কিন্তু আজ প্রকৃতির সাথে থেকে মনের ভিতরে থাকা বড়োলোকের ভাবটা কমিয়ে ভীষণ ভালো লাগছে। নিশব্দে চায়ের কাপে চুমুকের নেই কোনো আনন্দ কিন্তু শব্দে করে চায়ের কাপে চুমুক দিলে মনে হয় চায়ের কাপটা বলছে, আজ বেজেছে নূপুরের শব্দের মতন তোমার ঠোঁটের শব্দ আমার গায়ে। এই শব্দে আমি বারবার হারাতে চাই কিন্তু তোমরা ভদ্রতার নাম করে বড়লোকি স্বভাবের কারণে আনন্দ থেকে বঞ্চিত হই আমি।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here