তুমিময়_অসুখ
পর্ব-১৫ (অন্তিম)
#লেখিকা-ইশরাত জাহান ফারিয়া
৩৩.
নানুবাসায় এসে যে আমি এতোটা সারপ্রাইজড হবো, সেটা আমি ভাবতেও পারিনি। কিছুক্ষণ আগে! আমরা সবাই গাড়ি করে নানুবাড়ি এসে পৌঁছালাম। গাড়ি গ্রামে ঢুকতেই একদল বাচ্চাকাচ্চা, মহিলারা গাড়ি ঝেঁকে ধরলো। তাদের খুব ইচ্ছে শহর থেকে আসা আহমেদ পরিবারের ছেলের বউ দেখবে। এটা যদিও আমার নানুবাড়ি, তাও ছোটবেলায় এক-দুবার আসার পর আর আসা হয়নি। যাইহোক, এসব দেখে আমি এমনই অবাক হলাম যে, পাশে বসে থাকা অভ্র ভাইয়ার হাতে নখ বসিয়ে দিলাম। ওনি রেগে আমার দিকে তাকাতেই আমি অপরাধী হাসি দিলাম।
গাড়ি নানুবাড়ির গেইটের সামনে থামিয়ে যখন আমরা নামলাম, তখন গেইটে আমাদের বরণ করা হলো। বরণ করেছে স্বয়ং নানু আর তাঁর গ্রামের বান্ধবীরা। অভ্র ভাইয়া বিরক্ত হয়ে বারবার এসব করতে মানা করছেন, কিন্তু কে শোনে কার কথা? যেমন নাতি, তেমন দাদী! আর আমার নানুও অনেক স্মার্ট, এতদিন ভিনদেশে থেকে এসেছে কি এমনি এমনিই! যাইহোক, এরপরের ধাক্কার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।
নানু বলে বসলেন আমাদেরকে নাকি গ্রাম্য রীতিনীতি মেনে আবারও বিয়ে দেওয়া হবে! আমি আর অভ্র’ শুনে তো মাথায় হাত। নানু এসব কি পাগলামি শুরু করেছে! আমার ওনিতো রেগে বোম হয়ে আছেন। রেগে হম্বিতম্বি অবস্থা। বারবার বলছে, আমাকে নিয়ে ওনি এক্ষুনি বাসায় ফিরে আসবেন। কিন্তু নানুর ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের কাছে আর কিছু বলতে পারলেন না। আম্মু-আব্বু, মামা-মামানি, ভাইয়া আর ইলহামও চায় যাতে আমাদের এভাবে বিয়ে হোক। এসব দেখে অভ্র ভাইয়া রাগী গলায় বললেন, ওনি এসব পাগলামিতে অভ্যস্ত নন, ‘তাই ছোটখাটো করে যাতে অনুষ্ঠান করা হয়। ওনি বলে দিলেন, বিয়ে হচ্ছে পবিত্র বন্ধন। এর মাঝে ঢাকঢোল পিটিয়ে, মানুষ জড়ো করে, টাকা খরচ করে লোক দেখানো আহ্লাদীপনা মানায় না। তাই যত কম খরচে বিয়ে সারা যায় তাতেই মঙ্গল।’
পাশের বাড়ির এক বৃদ্ধ মহিলা পান খাওয়া লাল দাঁত নাড়িয়ে হাসলেন ওনার কথা শুনে। অস্পষ্ট গলায় বললেন, ‘শোন দাদুভাই, বিয়া তো একবারই করবি। আমরা বুড়া মানুষগুলোকে একটু আহ্লাদিপনা করতে দে। এরপরে তোর বউ আর বউ মিলে যা করতে চাস, তা-ই করিস। রাগিস না!’
অভ্র ভাইয়া কৃত্রিম হাসি হেসে আমার দিকে তাকালেন। আমিও ‘হ্যাঁ’ বলে ওনাকে ওই বৃদ্ধ মহিলাকে বলতে বললাম। অভ্র ভাইয়া আমার সম্মতি পেয়ে বিরক্ত ভঙ্গি লুকিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা। যা করার ইচ্ছা তা-ই করেন।’ এরপর গটগটিয়ে হেঁটে আমাকে নিয়ে রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলেন। রাগী গলায় বললেন, ‘এসব বিয়ের অনুষ্ঠান করার কি খুব দরকার ছিলো?’
আমি বললাম, ‘নানুরা এতো প্ল্যান করেছে এখন আমরা যদি মানা করে দিই তাহলে ওনারা কষ্ট পাবেন। আপনিই বলুন, বৃদ্ধ মানুষগুলোকে শুধু শুধু কষ্ট দিয়ে কোনো লাভ আছে? তাছাড়া ছোটখাটো গ্রাম্য বিয়েই তো।’
অভ্র ভাইয়া আমার কথা শুনে বাঁকা হাসলেন। বললেন, ‘বাবা, ওনাদের জন্য এতো দরদ? আর বরের জন্য একটুও মায়া নেই তোর! নির্দয় মহিলা।’
—“শুনুন, আমি নির্দয় নই। আপনি বেত্তমিজ এবং নির্দয়!”
—“তাই?”
—“জ্বি!”
—“তা কখন আমি নির্দয়গিরি করলাম? আমিতো সবসময়ই তোকে ভালোবাসি, আদর করি!”
—“কেল্লা করেন।”
বলেই বুঝলাম ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছি। তাই ওখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বললাম, ‘দেখি আমাকে যেতে দিন।’
—“তোর বুঝি খুব আদর খেতে মন চাচ্ছে? বললেই হতো। এতো মেলোড্রামা করার দরকার কি ছিলো?”
—“আরে আজব! আমি কখন আপনাকে এসব বলেছি।”
অভ্র ভাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আমার হাত নিজের চুলে বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘তুই খুশি তো ইরু? নাকি আগেরবারের মতো এবারেও আমাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে রাখবি?’
আমি কি বলবো ঠিক ভেবে পেলাম না। কি বলা উচিৎ সেটাও বুঝতে পারছি না। অভ্র ভাইয়া গম্ভীরমুখে আবারও বললেন, ‘আমাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে রাখলে দেখিস একদিন আমি তোর বিরহে মরেই যাবো।’
আমি হঠাৎ ওনার কপালে চুমু দিয়ে ফেললাম। আবেগআপ্লূত কন্ঠে বললাম, ‘আপনি তো জানেনই আমি আমার বরকে অনেক ভালোবাসি। তাহলে দূরে যাওয়া, মরে যাওয়া এসব কথা বলছেন কেন? আপনাকে দূরে সরিয়ে রাখার কোনো ওয়ে আছে নাকি? ঠিকই তো আমার পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করতে থাকেন। তাই এসব অলক্ষুনে কথা বলবেন না!’
৩৪.
অভ্র ভাইয়া হাসলেন। নেশাক্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি ওনার ঠোঁটে চুমু খেলাম। তারপর পগার পার! কাল ওনি, আর আজ আমি নিজেই? ছিহ,,আমি কি বেহায়া! আল্লাহ! আবার এটাও ভাবলাম, ওনিতো আমারই বর আর আমি ওনার অর্ধাঙ্গী। তাই লজ্জ্বায় লাল, নীল হওয়ার কারণ বৃথা।
তাই লজ্জ্বা শরম এক সাইডে রেখে অসীম সাহস নিয়ে নানুর দেওয়া পিঠার থালা নিয়ে উঠোনের এক কোণে চেয়ার পেতে বসে থাকা ওনার কাছে গেলাম। ওনি মোবাইল টিপাটিপি করে বিয়েবাড়ির বিরক্তিকর মুহূর্ত কাটাচ্ছেন। আমাকে দেখে এমন একটা বাঁকা হাসি দিলেন যাতে আমার কলিজা পর্যন্ত কেঁপে উঠলো। ওনি ভং ধরলেন আমি পিঠা না খাইয়ে দিলে তিনি খাবেন না। আমি ওনার কথায় পাত্তা না দিয়ে ওনার পাশে চেয়ার টেনে বসতে গিয়ে খেয়াল করলাম রাফা আর ইলহাম মিলে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের ছবি তুলছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে অভ্র ভাইয়া আমার শাড়ি ভেদ করে কোমড় জড়িয়ে ধরলেন। চেয়ারের উপর পা তুলে আবারও শুয়ে পড়লেন আমার কোলে। আমার ইচ্ছে করছে ওনাকে এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে দিয়ে মাটির ভেতর ঢুকে যাই, কি বিরক্তিকর অবস্থা। বিদেশ ফেরত ছেলেরা একটু লজ্জ্বাশরমবিহীন হয় সেটা আজ আবারও প্রমাণিত হলো।
৩৫.
বিকেলের দিকে গায়ে হলুদ করা হলো। আমাকে একটা কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি পড়ানো হলো। আম্মু মেরেধরেও সাজাতে পারেনি। লিপস্টিকও দিইনি। ইলহাম আর রাফা ইভেন সবার সাজগোজ দেখে মনে হচ্ছে ওরা কোনো প্রধানমন্ত্রীর মেয়ের বিয়ে খেতে যাচ্ছে। আর আমি বউ হয়ে ফকিন্নির মতো খালি শাড়ি পড়েছি। যাইহোক, অভ্র একটা কাঁচা হলুদ পাঞ্জাবি আর সাদা পা’জামা পড়েছেন! আমাকে আর ওনাকে যখন সবাই হলুদ লাগানোতে ব্যস্ত ওনি তখন বিরক্ত হয়ে আমার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘চল এই এলিয়েনদের এখান থেকে পালাই। যা উদ্ভট কান্ড শুরু করেছে পরে দেখবি আমাদের বাসর করতে দেবেনা।’
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, ‘চুপ করুন তো।’
অভ্র ভাইয়া রেগে সবার আড়ালে আমার পেটে খোঁচা মেরে বললো, ‘আমার দাদু’মা তোর মাথায়ও এসব ঢুকিয়ে দিয়েছে।’ তারপরে অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বললো, ‘ইরু রে! আমার খুব টায়ার্ড লাগছে। আমি ঘুমাবো। দেখ, তোকে আর আমাকে ওরা কিভাবে হলুদ লাগিয়েছে মনে হচ্ছে ময়লার ডাস্টবিন!’
আমি নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি আসলেই তাই। অভ্র ভাইয়ার অবস্থা ততক্ষণে করুণ। মাত্রাতিরিক্ত ফর্সা গালে একেবারে কাদার মতো লেপ্টে আছে হলুদ। বাড়ির সবাই এবং নানুর বুড়ো বান্ধবীরা এমনকি গ্রামের প্রায় অর্ধেক লোক এই বিয়ে নামক সার্কাস পার্টিতে হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে। আর আমরা বর-বউ বিরক্তি নিয়ে ওদের এসব সার্কাসে শামিল হচ্ছি!
৩৫.
রাতে আমাদের বিয়ে। একটা লাল রঙের ভারী বেনারসি শাড়ি আমার গায়ে। আমি যখন আম্মুকে বললাম যে, আমি সাজবো না। তখন আম্মু রেগে হ কাছে থাকা বিছানার ঝাড়ুটা নিয়ে তেড়ে আসলেন। ধুমধাম করে উত্তমমধ্যম বসিয়ে দিলো পিঠে। ঠাসঠাস চড় পড়লো গালে। আমি মুহূর্তেই কেঁদে বুক ভাসাচ্ছি। আম্মু চড়া গলায় বললো, ‘তোর বিয়ে আর তুই না সেজে বিয়ে করবি? আম্মা এতো কষ্ট করে আয়োজন করেছে অনুষ্ঠানটা সুন্দর করে করার জন্য আর তুই কিনা এখানে নাটক দেখাচ্ছিস? গায়ে হলুদে সাজিসনি মানলাম আর একটু পরে বিয়ে আর তুই এখানে ভং ধরছিস!’
আমি কান্নাকাটি করে অসহায় চোখে মা নামক রমণীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আর বিয়েতে অধরা থাকতে পারেনি তাই ইলহাম ভিডিও কলে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান আর বিয়ের যাবতীয় কর্মকাণ্ড দেখাচ্ছে। ‘আম্মু আমাকে এভাবে মেরেছে বলে ছিঁচকাদুনের মতো মোবাইলেই কাঁদা শুরু করলো। বললো, ‘আর মার খাইস না বইন। একটু সাজলে কি হবে? তোর বিয়ের ছবি নাহলে বিচ্ছিরি দেখাবে, তুই কাঁদছিস আর আমার মনে হচ্ছে আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কলিজা ফেটে যাচ্ছে, তুই কাঁদিস না ইরু!’
ওর কথা শুনে কি রিয়েকশন করা উচিৎ বুঝলাম না। বিয়ের সময় সাজগোজ নিয়ে যে বউকে তাঁর মা মারে তা আজ নিজেকে দেখে বুঝলাম। ভাইয়া এসে আম্মুর উপর রাগ ঝাড়ছে। কেন মারলো, কাঁদছি কেন? এসব জিজ্ঞেস করে করে ‘আম্মুর অবস্থা নাজেহাল করে তুলছে!’
মামানি এসব দেখে মুচকি হেসে বললো, ‘আমার ছেলে আর ছেলের বউ একই ধাতুর তৈরি। অভ্র তো কাপড়ই পড়তে চাচ্ছেনা আর এদিকে ইরু সাজতে চাচ্ছেনা। আমি জোর করে রেডি করিয়েছি ওকে।’ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ এরকম করিসনা মা। আয় আমি সাজিয়ে দিচ্ছি। আম্মা নইলে কষ্ট পাবে, একা একাই তোদের জন্য এতোসব আয়োজন করেছে, তার কথা ভাববি না!’
যাইহোক, মামানি খুব সুন্দর করে আমাকে সাজিয়ে নিয়ে গেলো বিয়ের আসরে। অভ্র ভাইয়ার পাশে বসানো হলে সবাই ফটাফট ছবিটবি তুলে উড়ায়া ফেলার উপক্রম। মনে হচ্ছে আমরা দুজন চিড়িয়াখানায় আছি। একে একে ফ্যামিলির সবাই, নানু, নানুর বুড়ি বান্ধবী, গ্রামের লোকজন সহ আমার আর অভ্র’র ছবি তোলা হলো। এতো এতো ছবি আর ভিডিও’র যাঁতাকলে পড়ে অবস্থা কাহিল। ওনার দিকে তাকিয়ে দেখি, রাগে গজগজ করছেন। যেকোনো সময় এ্যাটম বোমা ফাটাতে ওনি প্রস্তুত। হঠাৎ আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোকে নাকি ফুপ্পিআম্মু মেরেছে?’
আমি গোলগোল চোখ করে বললাম, ‘নাহ তো!’
—“আমাকে বোকা পেয়েছিস ডাফার!”
আমি আর ওনার দিকে তাকালাম না। কি লোক রে বাবা! সব কথা কিভাবে কিভাবে যেন জেনে যায়। রাগ যেন নাকের ডগায় বসবাস করে। একসময় বিয়ের পর্ব শেষ হলো। খাওয়াদাওয়া করানো হলো। সবশেষে আমাদের জন্য সাজিয়ে রাখা বাসর ঘরে পাঠানো হলো।
৩৬.
মানুষের জীবন খুবই অদ্ভুত আর চমকে ভরা। প্রতিনিয়ত ‘চমকানো’ জিনিসটা মানুষের জীবনের গতিপথ পাল্টে দেয়। কখন যে কি হয়ে যায় সেটা ভাবনার অন্তরালে। এই যে, এসবকিছু হয়ে গেলো সেটা কি আজ কয়েকঘন্টা আগ পর্যন্তও আমরা জানতাম? নানু আমাদের হুট করেই চমকে দিলো। এখন বুঝতে পারছি সবকিছু নানুর প্ল্যান ছিলো। কিন্তু গ্রাম্যরীতিতে বিয়েটা খুব উপভোগও করেছি। হাসি-কান্না সবকিছু মিলিয়ে অদ্ভুত একটা বিয়ে হলো আমাদের। আমার জীবনে ঘটা প্রতিটি ঘটনা এমন ‘হঠাৎ’ আর ‘অদ্ভুত’ কেন সেটা অদ্ভুতভাবেই আমার ধর্তব্যের বাইরে। জীবনের কিছু হিসাব কখনো মিলেনা, মিলাতে নেই-ও। অজানার মাঝেই কখনো কখনো লুকিয়ে থাকে ‘ভালোবাসার অদ্ভুত মায়াজাল’। এ জাল ছিন্ন করা সহজ নয়!
এই মুহূর্তে ক্লান্ত শরীর নিয়ে সাদা গোলাপে সাজানো বাসরঘরে বসে আছি। শাড়ি পাল্টে সাদা সালোয়ারকামিজ পড়েছি। অভ্র ভাইয়া ধূসর টি-শার্ট আর হাফপ্যান্ট পড়ে বিছানায় এলোমেলো ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন। আমাকে ধমকে বললেন, ‘তুই এসব মেকআপ, শাড়ি, গয়না পরে কিভাবে ওইখানে ছিলি ইরু? আমার তো দম আটকে আসছিলো!’
আমি হেসে বললাম, ‘বিয়ে তো একবারই হয়। তাই এটুকু কষ্ট সহ্য করতে হয়। আর তাছাড়া আপনি আমার জন্য সামান্য ভিড়ভাট্টা সহ্য করতে পারবেন না? তাহলে কিসের ভালোবাসা!’
আমি শুধু এমনিই একথাটা বললাম। কিন্তু অভ্র’ এটা সিরিয়াসলি ভেবে নিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন , ‘তুই কি আমাকে ফাউল ছেলে ভাবিস ইরু? তোর মনে হয় আমি তোকে ভালোবাসি না?’
—“আমি সেভাবে বলিনি, আপনি ভুল বুঝছেন।”
—“আসলে তুই ঠিকই বলেছিস। তুই আমাকে ভালোবাসতে পারবিনা কখনো আমি জানতাম।”
—“ভুল বুঝছেন!”
—“কোনটা ভুল আর ঠিক আমাকে বোঝাবি না প্লিজ ইরু! তোর মনে আমি কখনো জায়গা করে নিতে পারিনি!”
—“এসব আপনার ভুল ধারণা!”
—“হয়তো!”
গম্ভীরমুখে একথাটা বলে ওনি সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন। ওনার কথা শুনে রাগ হচ্ছে। কি বলি আর কি বোঝে! ‘ক’ বললে ‘কলকাতা’ বোঝে! যাইহোক, রাগ তো আমারই ভাঙতে হবে!
আমি বিছানা থেকে ধীরে ধীরে নামলাম। পা টিপে টিপে ওনার কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি আপনি এটা কি বোঝেন না? সবসময় আমাকে ভুল বোঝেন কে?’
ওনি আমার হাত সরিয়ে দিয়ে বললো, ‘যা তুই ইরু।’
আমি ওনার মুখটা আমার দিকে ফিরালাম। চুল লেপ্টে আছে চোখের উপর। ইদানীং ওনার চুলগুলো বেশ বড় হয়ে গিয়েছে। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে ওনাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিলো। আমি ওনার চোখে পানি দেখতে পেলাম। ওমা! এখানে ইমোশনাল হওয়ার কি ছিলো? আমার কথা শুনে কেউ কোনোদিন এভাবে চোখে পানি আনেনি। আর আজ কিনা আমি এই রেকর্ড ভেঙ্গে নিজের বরকে কাঁদালাম? রিডিকিউলাস ইরাম!
আমি ধীরেধীরে ওনার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবালাম। ওনি প্রথমে আমাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইলে আমি আরও শক্ত করে চেপে ধরি ওনাকে। কিছুক্ষণ পর ওনাকে ছেড়ে দিয়ে বললাম, ‘রাগ কমেছে? উল্টাপাল্টা ভেবে এতো অভিমান করা উচিৎ না!’
ওনি কিছু না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমার ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাইরে যাবি?’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এতো রাতে?’
—“হুম! নৌকায় উঠবো, বাসর রাতে পানিতে ঘুরবো!”
আমি বিদ্রুপ করে বললাম, ‘সাঁতার জানেন?’
—“না!”
—“তাহলে আমি যাবোনা। এরপর পানিতে পড়ে গেলে আমাকে বাঁচাবে কে? না বাবা, আমি না!”
ওনি একপ্রকার রেগে জোর করে আমাকে নিয়ে এলেন পানির কাছে। নানুবাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে। কিন্তু এটা ঠিক খাল নাকি নদী বুঝলাম না। অভ্র ভাইয়া আমাকে নিয়ে নৌকায় উঠলেন। নৌকাটা একটা দশ-বারো বয়সী ছোট্ট ছেলে চালাচ্ছে। এতো রাতে এই পিচ্চিকে কিভাবে পেলো ওনি বুঝলাম না। তবে দুজনের ফিসফাস কথা শুনে কিছুটা আন্দাজ করলাম যে, এই আমার অদ্ভুত বর আগে থেকেই প্ল্যান করে রেখেছিলো। অভ্র ভাইয়া সাঁতার জানেনা, সেজন্য মামানি ওনাকে কখনো নৌকায় উঠতে দেননা।
এখন প্রায় অনেক রাত। গ্রামে রাত নয়টা হলো গভীর রাত। কিন্তু এখন ঠিক কয়টা বাজে জানিনা। চাঁদটা আকাশে আলো ছড়াচ্ছে। নৌকার ধাক্কায় দুপাশের পানি ছলাৎছলাৎ শব্দ তুলে রাতের নীরবতাকে গ্রাস করছে। দূরের গাছগাছালি আর বাঁশঝাড়গুলো হিম বাতাসে দুলছে, উড়ছে। আমি এক অদ্ভুত মুগ্ধতা নিয়ে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছিলাম।
অভ্র’ আমার পাশে এসে বসলো। শুয়ে পড়লো কোলে মাথা রেখে। আমি রেগে বললাম, ‘আপনি হুটহাট আমার কোলে এসে শুয়ে পড়েন কেন?’
—“ভাল্লাগে, খুশিতে, ঠ্যালায়!”
আমি বিরক্ত কন্ঠে বললাম, ‘যত্তসব!’
—“তোর ভাল্লাগছে?”
—“জ্বি!”
—“তুই কার কথা ভাবছিস রে ইরু?”
—“কারোর না!”
—“আমার কথাও না?”
আমি হেসে বললাম, ‘আপনি আমার সাথেই আছেন, তাই আজাইরা মাথা খাটিয়ে আপনার কথা ভেবে এই সুন্দর মুহূর্ত নষ্ট করা আমার জন্য গুরুতর অপরাধ!’
ওনি ফিচেল হাসি দিয়ে বললো, ‘এখন তো এসবই বলবি। এখন আর কাউকে চিনবি নাকি!’
—“ঠিক তাই!”
—“বদ মেয়ে!”
আমি ওনাকে রাগানোর জন্য বললাম, ‘আপনি একটা বেত্তমিজ!’
ওনি গম্ভীর গলায় বললেন, ‘দেখ! সবকিছু কি হুট করে হলো, তাইনা? একবার ভেবেছি দাদু’মা এসব বাড়াবাড়ি করছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যা হয়েছে তা-ই হওয়া উচিত।’
আমি অস্পষ্ট স্বরে বললাম, ‘হয়তো!’
ওনার দৃষ্টি দূরের আকাশে। তারাভরা রাতের আকাশটা যেন আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। নদী
যেন গান গাইছে। আমি আর ওনি দুজনেই চুপ। আমি ভাবতে লাগলাম প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু। আমাদের ভাবনা কখনো শেষ হওয়ার নয়।
‘অদ্ভুত এক রোগে আক্রান্ত পৃথিবীর মানুষ। কাছের মানুষটার আসক্তি এড়িয়ে যেতে যেতে একসময় জড়িয়ে গেলাম ছোঁয়াচে রোগীর মতো। এ রোগ চলে যাওয়ার নয়, পৃথিবীও মানুষের এ রোগের কাছে মাঝেমাঝে হেরে যায়। হেরে যেতে যেতেও একসময় জিতে যায় ভালোবাসাগুলো।’
সুনশান নীরবতা ভেঙ্গে অভ্র ভাইয়া বললেন, ‘তুমিময় এ অসুখটা খুব ভয়াবহ, তাই না ইরু? এ অসুখের কোনো ঔষধ নেই। প্রেমিকরা কখনো চায়না এ রোগের ঔষধ আসুক। দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে গেলেও কখনো চায়না এ অসুখ ভালো হোক। প্রতিনিয়ত নতুন রুপে, নতুন ভাবে আক্রান্ত হতে চায় মানুষ এ তুমিময় অসুখে!’
আমি শুনলাম, ভাবলাম। কি সুন্দর করে কথা বলেন ওনি মাঝেমধ্যে। এই অসুখই তো আমাদের দুজনকে এক করেছে, তাই এ অসুখের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। অভ্র ভাইয়া আমার কপালে চুমু দিলেন। এক নিরব-নিস্তব্ধ ভালোবাসাময় রাত আমাদের অসুখটাকে আরও বাড়িয়ে দিলো। আসলেই তুমিময় অসুখটা খুব ভয়ানক, খুব!
দুঃখিত! আমি এ গল্পটা বাড়াতে চাইনা। তাই এখানেই শেষ করে দিলাম। আসলে নতুন গল্প মাথায় চাড়া দিচ্ছে, তাই সবার অনুরোধ রাখতে পারিনি। শেষ পর্বটা এতো বিদঘুটে হবে ভাবিনি। ভুল-ত্রুটি মাফ করবেন। আজ রাতে নতুন গল্প দিবো, ধন্যবাদ সবাইকে। এই গল্প লিখতে গিয়ে অনেক কথার সম্মুখীন হয়েছি, কিন্ত আমি কিছু মনে করিনি। আবারও ধন্যবাদ ❤
?”ফজরের নামাজের শেষে সূর্যোদয় এর সময় যে ব্যক্তি ২ রাকাত এশরাক নামায আদায় করবে।তার আমল নামায় একটা ওমরা হজ্জ এর সওয়াব দান করা হবে।”
-সুবহানআল্লাহ।❤
০৭-০১-২০২১