অচেনা কবি❤,পর্ব-১
লেখনীতেঃ কথা চৌধুরী❤
১.
গত তিনমাস ধরে ঘরে বন্দী জীবন পার করছি। কোবিড ১৯ জীবনকে একদম জাহান্নাম বানিয়ে তুলেছে। মার্চের ১৬ তারিখে ঘরবন্দী হয়েছি আর এখন চলছে জুন মাস। বাইরে বের হওয়া তো দূর ঘরের দরজা খুলেও দেখা হয়নি। এভাবে আর কত দিন পার করব? ফেইসবুক আইডি আছে কিন্তু সেখানে নেই কোনো বন্ধু-বান্ধব, নেই আত্মীয় স্বজন। আমার মতো একরোখা মানুষ যে সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে একুশ বছর পার করেছে এটাই বা কম কীসের?
এই নিঃসঙ্গ জীবনে আমার প্রিয় একজন মানুষ ছিল। আমার মামাতো বোন স্পৃহা যার সাথে লকডাউনের সময়টুকু দিব্যি পার করা যেত বকবক করে। কিন্তু সে এক সুপুরুষের প্রেমে মজে আমাকে পর করে দিয়েছে। ওর জন্য ওর বড় ভাইয়া, রাজের কাছে কত অপমান সহ্য করেছি। আর সেই স্পৃহা আজকে আমাকে পর করে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। ও আমার অভ্যসে পরিনত হয়েছিল। তাই ওকে হারানোর পর আমি উন্মাদের মত কেঁদেছি সবার অগোচরে। কাউকে বুঝতে না দিলেও একাকিত্ব আমাকে নিঃশেষ করতে শুরু করে।
প্রতিনিয়ত আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করত কিন্তু আত্মহত্যা করা তো মহাপাপ। তাই একাকিত্ব দূর করবার বিকল্প পথ খুঁজতে শুরু করলাম আর পেয়েও গেলাম। ফেইসবুকে অনেকে গল্প লিখে পোস্ট করে, সেসব নাড়াচাড়া করতে লাগলাম। তেমন করে কারোর লেখা মন ছুঁতে পারেনি, একজন বাদে। তাই আবার ডায়েরি লেখার অভ্যসে ফিরে এলাম সাথে বইপড়ায়।
আমি ছোট্টবেলা থেকে একটু আধটু ডায়েরি লিখতে পছন্দ করতাম। নিজের অনুভূতি আর ভাবনার জগৎকে কালো কালিতে রূপ দিতাম আমার পুরাতন ডায়েরিতে। তেমন করে না লিখলেও ডায়েরি লেখা হয় প্রায় প্রতিদিনই। বড্ড ভালো লাগে ভাবতে আর ভাবনাগুলোকে ডায়েরিতে আবদ্ধ করতে। আসে পাশে অনেক কিছুই ঘটে। সেগুলোর সাথে আমার অনুভূতি আর ভাবনাটাকে মিশিয়ে একটা কিছুর রূপ দিতেই ডায়েরি লেখা হয়। সেটায় পুনরায় ফিরে এসে মনে হলো আমিও তো ফেইসবুকে অন্য সবার মত গল্প লিখে পোস্ট করতে পারি। পরক্ষনেই ভাবনার উদয় হলো আমার লেখা কেউ পড়বে কি? সাহস হলো না তাই ভাবনাটা দমিয়ে রেখে কেবল ডায়েরি আর উপন্যাসের বইতে সীমাবদ্ধ রইলাম।
এখন সদ্য সকাল। ফোন হাতে নিতেই টুং শব্দ হলো ফোনে। শব্দের উৎসের খোঁজ করতে গিয়ে দেখি রাজ ভাইয়া কীসের লিংক যেন আমাকে শেয়ার করেছেন। উনার নাম দেখেই নাক ছিটকে এলো আমার। কপাল ভালো যে উনি সামনে নেই নয়ত আমার মুখের ভঙ্গি দেখে উনি আমাকে কষে চড় লাগাতেন। লিংক চেক না করে আগে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কীসের লিংক ভাইয়া?”
সাথে সাথেই জবাব পেলাম, “আমি পেইজ খুলেছি। পেইজে লাইক দিয়ে পোস্টেও লাইক দাও।”
সকালবেলা উনার এমন হুকুমের ভঙ্গিতে ম্যাসেজ দেখে মেজাজ বিগড়ে গেল আমার। কিন্তু কিছু বলতে গেলে উনি আমায় আবার ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করবেন। তাই জবাব দিলাম, “ঠিক আছে।”
লিংকে ঢুকে উনার পেইজ নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করলাম আর ঘাটাঘাটি করে মনে হলো নিজেরও একটা পেইজ থাকা খুব দরকার। তাই সাততাড়াতাড়ি ইউটিউবে খোঁজ করলাম, কীভাবে পেইজ খুলতে এবং লেখা পোস্ট করতে হয়?
দশ কি পনেরো মিনিটের মধ্যে পেইজ খোলার কাজ সমাধা করে ফেললাম। আর প্রথম পোস্ট করলাম, “খুব শীগ্রই পেইজে প্রথম গল্প পোস্ট করা হবে। সবাইকে পড়ার আমন্ত্রণ রইলো।”
বেশ খুশি খুশি মন নিয়ে ছুটে এলাম কিচেনে। আমাকে ছুটে আসতে দেখে মা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? এমন ছুটছিস কেন?”
“মা, রাজ ভাইয়া না পেইজ খুলেছে?”
মা তরকারি নাড়া দিয়ে আমায় আবার জিজ্ঞেস করল, “তাতে কী হয়েছে?”
“আমিও পেইজ খুলেছি।”
“তুই পেইজ দিয়ে কী করবি?”
“টুকটাক তো লেখালেখি করি, সেটাই সবার সাথে শেয়ার করব।”
“ঠিক আছে, কর। সমস্যা নেই।”
খুশিতে গদোগদো হয়ে, “সত্যি মা?”
“হ্যাঁ রে, সত্যি।”
বাসায় বসে আছি আবার পড়াশোনাও নেই। তাই বিনা কৈফিয়তে মা’র কাছ থেকে অনুমতি পেয়ে গেলাম। কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো লেখা শুরু করব কীভাবে?
অনেকদিন থেকে একটা কাহিনি মাথায় ঘুরঘুর করছিল। ভাবলাম, সেটা দিয়েই যাত্রা শুরু করব। ভেবেচিন্তে গল্পের নাম নির্ধারণ করলাম ‘হঠাৎ বৃষ্টিতে’ আর এই ‘হঠাৎ বৃষ্টিতে’ গল্প দিয়েই লেখালেখিতে নিজের নামকে জুড়ে দিলাম, কথা চৌধুরী।
প্রথম গল্প তারপর ফেইসবুকে কী করে পোস্ট করতে হয়, কতটুকু লিখতে হয়, লেখার ধরন কেমন? এসবের কোনো ধারনাই নেই আমার। আবার ফোনেও সমস্যা কত-শত। লকডাউন থাকার কারনে ফোন সারানোর কোনো উপায়ও নেই। তাই ছোট করে পর্ব পোস্ট করতে হচ্ছে। একে একে অনেক গুলো পর্ব দিয়ে দিলাম।
স্পৃহার সাথে আমার খুব একটা যোগাযোগ নেই। তাও ভাবলাম ওকে পেইজের কথা জানিয়ে দেই। কারণ ওকে কোনো কিছু না বলতে পারলে নিজের মনের ভেতর কেমন যেন খচখচ করে। কিন্তু ওর সাথে তো সম্পর্কও ভালো নয়। তাই যতটা সংক্ষেপে জানানো যায়, ততটা সংক্ষেপে জানিয়ে দিলাম, “স্পৃহা, আমি পেইজ খুলেছি। মা-ও অনুমতি দিয়েছি। গল্পসল্প লিখে পোস্ট করি। তুই একটু পেইজটা ঘুরে দেখিস। আর পেইজে লাইক দিয়ে দিস।”
ম্যাসেজ দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো জবাব এলো না। মন খানিকটা ভার হয়ে এলো আমার সাথে ভাবনাও এলো কত-শত, “স্পৃহা, আমি কি তোর কাছে খুব বেশি বিরক্তিকর হয়ে গিয়েছি? একটুও কি মায়া, ভালোবাসা জন্মায় তোর আমার প্রতি?”
২.
দেখতে দেখতে ‘হঠাৎ বৃষ্টিতে’ চল্লিশ পর্ব দেওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু তেমন কোনো ধারনা নেই বলে গল্পের মান খুবই নিম্নমানের হলো। গল্পটা যখন নিজে পড়ি, তখন নিজেরই ভীষণ রাগ লাগে। কিন্তু আমার কিছু পাঠক প্রিয় ভাই-বোন আমাকে উৎসাহ দিতেন তাদের গঠনমূলক মন্তব্যের মাধ্যমে।
‘নিজের লেখাকে কখনো খারাপ বলবেন না। কখনো বলবেন না, আমার কবিতা হয় না। বললেই লোকে বলবে, ও নিজেই বলে ওরটা হয় না। আমরা কেন ওরটা কবিতা বলবো?’_____শামসুর রাহমান
নিজের লেখার প্রতি আমাকে উদাসীন হতে দেখে কেউ একজন আমাকে শামসুর রহমানের উক্তি দিয়ে বললেন, “হাজারো বাঁধা আসবে আর সেগুলোই তোমাকে অতিক্রম করে তোমার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। আর তুমি তো নতুন তাই ভুল হবেই। হাজারবার ভুল করবে আর সেখান থেকেই নতুন কিছু শিখবে।”
মনে সাহস জুগিয়ে আর পাঠকদের ভালোবাসা নিয়ে লেখালেখি চালিয়ে যেতে লাগলাম। আস্তে আস্তে দ্বিতীয় গল্প ‘অনেক ভালোবাসি তোমায়’ দিতে শুরু করলাম।
‘হঠাৎ বৃষ্টিতে’ গল্পটা আমার আর বাড়াতে ইচ্ছে করছে না। ছোট করে দেওয়ার কারনে এটা ৫৩ পর্ব হয়ে গেল। তাই অনেক অবশিষ্ট রেখে গল্পটা শেষ করে দিলাম। নতুন গল্প ‘অনেক ভালোবাসি তোমায়’ নিয়ে অনেক বেশি চিন্তা হতে লাগলো। ভাবলাম, “গল্পটা কি ভালো হবে? নাকি সবাই বলবে কী সব যা তা লেখা নিয়ে পেইজ খুলে বসেছি?”
কোনো পর্ব পোস্ট করে সেটাতে কী কমেন্ট পড়লো, কে কেমন রিয়েক্ট দিলো? সেগুলো অনেকটা সময় ধরে বসে বসে দেখি। তখন মনের মাঝে একটা প্রশান্তি কাজ করে। আমি কখনোই রিয়েক্ট বা কমেন্টের কাঙ্গালি নই। তবে একেবারেই প্রত্যাশা করি না সেটা বললেও ভুল হবে। আমার সাধনার ফল মনে করি পাঠদের গঠনমূলক মন্তব্যকে। কেউ ভালোবেসে গঠনমূলক মন্তব্য করলে সেটা খুব যত্নে নিজের কাছে গচ্ছিত করে রাখি। এসব আমার পাগলামি বলে গণ্য হলে আমি পাগলই বটে।
সন্ধ্যার দিকে ‘অনেক ভালোবাসি তোমায়’ গল্পের ষষ্ঠ পর্ব পোস্ট করলাম। ভাবলাম একটা গান শুনতে শুনতে কমেন্টগুলো দেখে উত্তর দিবো। ফোনে গান খুঁজতে শুরু করলাম। পছন্দের একটা গান প্লে করে কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিলাম,
“জানে এই মন জানে
তুমি যে আমার
তোমারই স্বপ্নে আমার
রোজ পারাপার
ভালোবাসার খামে
চিঠি লিখে তোমার নামে
পাঠিয়ে দিলাম আমি
পড়ে নাও এবার
জানে এই মন জানে
তুমি যে আমার
তোমারই স্বপ্নে আমার
রোজ পারাপার”
হঠাৎ ফোনে টুং শব্দ হলো। নোটিফিকেশন চেক করে দেখি ‘মিরাজ’ নামক আইডি থেকে কেউ একজন কমেন্ট করেছেন, প্রথম পর্বে। আইডির নামটা আমাকে একটু ভাবালেও আমি কমেন্ট পড়তে লাগলাম,
“শুরুটা অতি সাধারণ
তবে শেষটা হতে পারে অসাধারণ।
লেখনী করেছে মুগ্ধ আমায়;
মন্দ নয় গল্পটা, নামটি যে তার
‘অনেক ভালোবাসি তোমায়।”
এমন কবিতার ছন্দে মন্তব্য দেখে চমকে গেলাম। চমকিত নয়ন আর ঠোঁটে একটুখানি হাসির রেখা টেনে মন্তব্যে যথারীতি লাভ রিয়েক্ট দিয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলাম, “শুকরিয়া ভাইয়া।”
ভেবেছিলাম উনি হয়ত এর জবাব দিবেন। কিন্তু আমায় হতাশ করলেন জবাব না দিয়ে। এই বিষয়ে আমি আর তেমন কিছু ভাবলাম না। সাধারণ বিষয় মনে করে ভুলে গেলাম।
৩.
বিকেল চারটা নাগাদ কলিংবেলের শব্দ কানে পৌঁছাতে ছুটে এলাম দরজা খুলতে। দরজা খোলার যেই আগ্রহ ছিল সেটা খোলার পর হারিয়ে গেছে। মুখে কালো রঙের মাস্ক পড়া থাকলেও শরীরের গঠন আর গায়ের রং দেখতে চিনতে অসুবিধে হয়নি যে উনি রাজ ভাইয়া। মনের কোণে একরাশ বিরক্তি চাপা দিয়ে জোরপূর্বক হেসে বললাম, “ভেতরে আসুন।”
ভেতরে এসে আমায় জিজ্ঞেস করলেন, “ফুপ্পি কোথায়?”
“আপনি বসুন আমি ডেকে দিচ্ছি।”
আমি মাকে নিয়ে হাজির হতে মা উনাকে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছো বাবা? ভাই আর ভাবী কেমন আছে?”
“সবাই ভালো আছে ফুপ্পি। মা চালের রুটি আর মাংস পাঠিয়েছেন।”
ব্যাগ হাতে নিয়ে, “তুমি দাঁড়িয়ে কেন? বসো।”
“না ফুপ্পি, আমাকে যেতে হবে। করোনা এতো বাড়ার পথে। তাই আজকে দেরি করবো না।”
” ওহ।”
আমার মা’র আদরের ভাতিজা দেরি করবেন না বলে উনার মুখ ভার হয়ে গেছে৷ নিজের মা হলেও মাঝে মাঝে মা’র উপর খুব রাগ লাগে আমার। নিজের মেয়ে রেখে উনার ভাইয়ের ছেলের প্রতি মায়া বেশি। অবশ্য একটু হলে মানা যেত কিন্তু সেটা যে অতিরিক্ত পরিমাণে। তাই তো হিংসের দরুন কান দিয়ে মাঝে মাঝে ধোঁয়া বের হয় আমার।
চলবে…