অচেনা কবি❤,পর্ব-৭

0
1286

অচেনা কবি❤,পর্ব-৭
লেখনীতেঃ কথা চৌধুরী❤

আমি উনার কথায় অবাক হয়েছি বুঝাতে এবার বিস্ময় ইমোজি দিলাম। ইমোজি দেখে উনি জবাব দিলেন, “হা হা হা। আমি জানতাম তুমি অবাক হবে। আর তোমার মাঝে জানার কৌতূহল আরও বাড়বে। কিন্তু মিস কাব্যু, কৌতূহল হলেও যে তোমার কৌতূহলের অবসান এতো তাড়াতাড়ি ঘটাতে পারছি না। তবে খুব শীগ্রই সব জানতে পারবে। আর যেদিন জানবে সেদিন তোমার কাজল কালো চোখে থাকবে অপরিসীম বিস্ময়, থাকবে একটু অভিমান আর থাকবে একটু…”

“কাজল?” বিস্ময় ভরা মন আমার নিজের কাছে প্রশ্ন রাখলো সাথে উনাকেও জিজ্ঞেস করলাম, “কাজল কালো চোখ? আপনি জানেন কী করে জানলেন আমি চোখে কাজল দেই?”

“আহা! তুমি সবকিছুতে এত কেন অবাক হও? তোমার গল্পেই তো উল্লেখ করো, তোমার কী কী পছন্দ আর কী কী পছন্দ নয়?”

“ওহ আচ্ছা, কিন্তু আপনি কী যেন থাকবে বললেন, ঐ যে একটু? সেই একটু কী?”

“তোমাকে তো বলেছি, ম্যাসেজ দিবে না ব্যথাযুক্ত হাতে। তাহলে কেন দিলে?”

“দুঃখিত আর দিবো না। আসলে বুঝি না তো, তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম।”

“এত বুঝতে হবে না তোমায়, ঠিক আছে?”

এবার ম্যাসেজ দেওয়ার সাহস হলো না। কারণ মনে হচ্ছিল উনি রেগে আছেন। তাই আমি কেবল সম্মতিসূচক লাইল ইমোজি দিলাম।

“একা দিন, ফাঁকা রাত নিভেছে আলো
তুই নেই, কেউ নেই লাগছে না ভালো।

একা দিন, ফাঁকা রাত নিভেছে আলো
তুই নেই, কেউ নেই লাগছে না ভালো।

তোর নাম না জানা অভিমানে,
কত দূরে ভাসা যায়?
আমি চাইছি তবু পারছি না তো
থামাতে আমায়।

একা দিন, ফাঁকা রাত নিভেছে আলো
তুই নেই, কেউ নেই লাগছে না ভালো।”

এই গানটা ম্যাসেজ আকারে পাঠিয়ে উনি আমায় জিজ্ঞেস করলেন, “এটা তোমার পছন্দের গান না?”

সব যেহেতু উনি আমার লেখা গল্প থেকেই জেনেছেন। তাই এবার গানটা নিয়ে আমার মাঝে কোনো বিস্ময়ের সৃষ্টি হলো না। কিন্তু উনাকে সেটা বুঝাতে ইচ্ছে করলো না বিধায় অহেতুক বিস্ময় প্রকাশ করে বিস্ময় ইমোজি দিলাম। এটা দেখে উনি এবার ম্যাসেজ দিলেন, “হা হা হা। অবাক হয়ে গেলে তো। উম, এটা তো সবে শুরু মিস কাব্যু। তোমার অবাক হওয়ার পরিমাণ বাড়ানোর জন্য আমার কাছে অনেক কিছুই আছে। সে যা-ই হোক, তোমার হাতের অবস্থা যেহেতু ভালো নয়, সেহেতু আলাপচারিতার এখানেই ইতি টানা ভালো। নিজের এবং নিজের হাতের যত্ন নিও। আল্লাহ হাফেজ।”

১২.

রাত দশটা বেজে গেছে অথচ রাতের খাবার এখনও পেটে আমার পড়েনি। বরাবরের মতো ফোনে ডুবে ছিলাম আমি। তাই ফোন বিছানায় রেখে নামতে উদ্যোগ নিচ্ছিলাম এরমাঝে ফোনটা বেজে উঠল ভুবন কাঁপিয়ে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাই বলে উঠলাম, “ধ্যাত! এমনিতেই পেটের ক্ষুধায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আবার কে আমার মাথা খেতে কল করল?”

আমি ভেবেছিলাম হয়ত সীম কোম্পানির কল তাই এতটা উত্তেজিত হলাম। কিন্তু ফোন হাতে নিয়ে দেখি রাজ ভাইয়া কল। কালকে বাসায় আসার পর আজকে উনার আমার সাথে কী কথা থাকতে পারে, সেটা আমার বোধগম্য হলো না। মনের হাঁড়িতে বিস্ময় যেন উপচে উপচে পড়ছে। কত-শত বিস্ময় নিয়ে কল রিসিভ করলাম, “হ্যালো।”

“কী করছো?” কন্ঠে উনার শীতলতা আর বচনে মিষ্টতা। এমন বচনে হঠাৎ মনে মৃদু হাওয়া বয়ে গেল। হাওয়াটা মৃদু হলেও আমি অপরিচিত এই হাওয়ার সাথে। তাই ভয় এসে আমার ঘাড়ে চড়ে বসতে শুকনো একটা ঢোক গিলে জবাব দিলাম, “ভালো, আপনি কেমন আছেন?”

“তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? আমি জানতে চেয়েছি, তুমি কী করছো? আর তুমি আমায় কীসব বলছো?”

উনার কথা শুনে হুঁশ হলো আমার। অবাকে আমার চোখ ছানার বড়ার আকার পেল আর মন বলে উঠল, “কথামনি, তুই কি পাগল হয়েছিস? এমন আবোলতাবোল কেন বলছিস উনার সাথে? আজকে তো প্রথম উনার সাথে কথা হচ্ছে না। তাহলে তোর মন এলোমেলো হচ্ছে কেন?” এত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি নীরবতা আঁকড়ে ধরলাম। পিনপতন নীরবতায় সেই শীতল কন্ঠে আমার সম্বোধন, “কথামনি, কী হয়েছে তোমার?”

কাঁপা কাঁপা গলায় আমার জবাব, “কই? কিছু হয়নি তো।”

“তোমার কি শরীর খারাপ করেছে? কথাবার্তা কেমন যেন অন্যরকম শোনাচ্ছে।”

“শরীর নয় হয়ত আমার মনের অসুখ করেছে।” আমার এই মনের কথা কি উনাকে বলা যাবে? হয়ত যাবে না। তাই তো উনাকে কেবল বললাম, “আমি ঠিক আছি, আমার কিছু হয়নি।”

“না হলেই চিন্তামুক্ত থাকতে পারব। আচ্ছা শোনো।”

“জ্বী।”

“আমি হয়ত আমার ইয়ারফোন তোমাদের বাসায় ফেলে রেখে এসেছি। একটু খুঁজে দেখবে?”

“ঠিক আছে, দেখছি।”

“না, না, এখন নয়। পরে দেখে কালকে সকালে আমাকে জানিও। আমি ঠিক মনে করতে পারছি না কোথায় রেখেছি। তাই বলতেও পারছি না ঠিক করে।”

“সমস্যা নেই। আমি খুঁজে কালকে আপনাকে জানিও দিবো।”

“ঠিক আছে, এখন রাখছি।”

“হুম।” আমার ছোট্ট জবাব পেয়ে উনি কল কেটে দিলেন। হঠাৎ করে আমার নিজেকে বড্ড অপরিচিত লাগছে। এমন অন্যরকম নিজেকে আর কখনও বোধ করিনি। আর উনার কথাগুলোও অন্যরকম লাগলো সাথে উনার কন্ঠস্বর। রাতারাতি কারো গলার স্বর বদলে যায়?

সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে খাবার সন্ধানে চলে এলাম রান্নাঘরে। এসে দেখি মা খাবার গরম করতে ব্যস্ত। আমি মা’র পাশে দাঁড়িয়ে বললাম, “হে মাতঃ, খাদ্যং দেহি মে।” কথাটা বলে নিষ্পাপ বাচ্চার মতো দাঁড়িয়ে আছি আর মা গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। মা’র চাহনি দেখে মনে হচ্ছে আমি যেন মাকে গালি দিয়েছি। আমার কথাটা হয়ত মার বোধগম্য হয়নি অবশ্য না হওয়ারই কথা। তাই তো চমকিত নয়নে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কী বললি?”

প্রতুত্তরে আবারও বললাম, “হে মাতঃ, খাদ্যং দেহি মে।”

আবারও একই কথা শুনে মা’র ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল। আমার উপর কিঞ্চিৎ বিরক্তি অনুভব করে বলল, “ফাজিল মেয়ে, এমন চাং চুং ভাষায় হাজারবার বললেও তো বুঝবো না। সোজা বাংলায় বল, কী বলতে চাস?”

“মা, এটা চাং চুং ভাষা না। আমি সংস্কৃত ভাষায় বললাম যে, আমি খাবার খাবো।”

“খাবার খাবি ভাল কথা। কিন্তু হঠাৎ সংস্কৃত ভাষার প্রতি এতো টান কেন?”

হালকা হেসে, “আরে না, কী যে বলো না তুমি মা? এসন টান ফান কিছুই না। একটা প্রবন্ধ পড়েছিলাম, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাঙ্গালা ভাষা’। এই প্রবন্ধেই লেখাটা ছিল। আমার এখন ক্ষিধে পেয়েছে আর লেখাটাও মনে পড়লো। তাই ভাবলাম একটু সংস্কৃত ভাষার চর্চা হয়ে যাক।”

“বাঁদর মেয়ে, তোর এসব সংস্কৃত ভাষার চর্চা অন্য কারোর সাথে করিস। আমার সামনে যদি দেখি আবার এইসব চাং চুং ভাষা বলেছিস তাহলে খবর আছে বলে দিলাম।”

মা’র কথা শুনে আমি হালকা হেসে মাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “মা, তোমার সাথে ভাষা চর্চার করতে যেই ভালো লাগে, সেটা অন্য কারোর সাথে পাওয়া যায় না। তাই তো আমার মিষ্টি মায়ের সাথে মিষ্টি দুষ্টুমি করি।”

মা জোরেশোরে হেসে বলল, “পাগল মেয়ে, যা গিয়ে বস টেবিলে আমি খাবার নিয়ে আসছি।”

মাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, “যথা আজ্ঞা মাতা।”

১৩.

“কথামনি, উঠ মা। অনেক বেলা হয়ে গেছে। তোর বাবা এসে দেখলে ভীষণ রাগ করবেন।… আরে উঠ না।… উফ, এটা মেয়ে না ঘোড়া? ঘুম ছাড়া কিছু বুঝে না। কথামনি?”

এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে মায়ের বকবকানি চলছে। আর আমি শীতকালের এই হিম হিম সকালে, লেপের উষ্ণতা পেয়ে, আয়েশ করে বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছি। এতো কথা শোনার পরও উঠছি না দেখে মা আমার গা থেকে লেপ সরিয়ে জোরে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলতে লাগলো, “এই, তুই কি উঠবি নাকি তোর গায়ে পানি ঢেলে দিবো?”

এখনও আমি ঘুম আঁকড়ে বিছানায় পড়ে আছি। মা’র ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে লাগলো। অসহ্য হয়ে বলল, “এমন বেহায়া মেয়ে যে আমার কপালে কেন এলো কে জানে? এতো কথা শোনার পরও গরু আর ঘোড়ার মতো ঘুমাচ্ছে।”

একটু থেমে মা আবার ডাকতে লাগলো, “এই কথামনি, কথামনি? ওঠ না।”

সাধের ঘুমের বারোটা তো অনেক আগেই বেজে গেছে। তাই মা’র কথার কোনো জবাব না দিলেও শোয়া থেকে উঠে বসলাম। বিছানায় বসে মাথা চুলকচ্ছি আর চোখ বুঁজে এখনও ঘুম ঘুম ভাবটা ধরে রেখেছি। তবে মাথায় ছোট্ট একটা গবেষণা চলছে, “মানুষ হয়ে জন্ম নেওয়া আমি একসাথে কীভাবে ঘোড়া আর গরু হলাম?”

ঘুমের ঘোরে এইসব অদ্ভুত চিন্তা আমার মাথায় সবসময়ই আসে। আমার দায়সারা অবস্থা দেখে মা আরো ক্ষেপে গিয়ে বললো, “কিরে? তোর কি কান দিয়ে কথা ঢুকছে না? সকাল থেকে এই পর্যন্ত না হলেও দু’শ বার ডেকেছি। গলা তো ব্যথা হয়ে গেল আমার।”

মা রেগে বললেও আমি ঘুমঘুম চোখে শান্ত গলায় বললাম,

“আজ-ই প্রভাতে,
জেগে উঠেছি মা তোমার ডাকে।
শীতের আমেজ যে জানান দিলো,
আমি এসে গেছি পাতা ঝরাতে।”

শীতের সময় চলছে আর কার একটা পোস্টে মন্তব্য করেছিলাম লেখাটুকুন। এখন সেটাই মা’র উপর কবিতার মতো আবৃত্তি করে মাকে খুশিতে করতে ব্যর্থ চেষ্টা করে আবারও শোয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই চড় দেওয়ার ভঙ্গিতে ডান হাত উঁচিয়ে মা বলে উঠল, “এখন কিন্তু মারবো বলে দিলাম তোকে। আর এই, তোকে না বলেছি, তোর এইসব কাব্য আমাকে শোনাতে আসবি না।”

লেপ টেনে শুয়ে শুয়ে মাকে বলতে লাগলাম, “এটা তুমি কোনো কথা বললে মা? তুমি হলে কথা চৌধুরীর একমাত্র মা। তোমাকে কাব্য শোনাবো না তো কাকে শোনাবো? আর শোনো, পেইজে কিন্তু আমার ২০০০+ ফলোয়ার আর গ্রুপে হলো ২০০+ সদস্য। তো একটু ভাব না নিলে কী চলে?”

আমি বেশ রাজকীয় ভাব নিয়ে কথা গুলো বলে মা’র দিকে তাকিয়ে আছি। আর মা আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন, আমি সদ্য চুরি করে বাসায় ফিরেছি তাও গণপিটুনি খেয়ে। মিনিট দুয়েক আমাকে পর্যবেক্ষণ করে মা নিরস গলায় বললো, “তোর ভাব দেখে মনে হচ্ছে তোর পেইজের ফলোয়ার ২০০০০+ আর গ্রুপে সদস্য ২০০০+”

নিজের মা’র মুখে এমন কথা শুনে আমার রাজকীয় ভাব এখন চাকরানীর ভাবে রূপান্তরিত হয়েছে। ঠোঁট উল্টে মা’কে জিজ্ঞেস করলাম, “এভাবে কেন বলছো মা? আমি কি খুব বেশি খারাপ লিখি?”

“দেখ, রান্নাঘরে একগাদা থালাবাসন ফেলে রেখে তোকে ডাকতে এসেছি। জলদি হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা খেয়ে নেয় নয়ত ফল ভালো হবে না বলে দিলাম।”

একটুখানি রাগী ভাব নিয়ে বললাম, “ঠিক আছে, যাচ্ছি।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here