অভিমানে তুমি,পর্বঃ১
ফারিয়াbআফরিন ঐশী
একের পর এক বেল্টের আঘাত শরীরে যেন জ্বালার সৃষ্টি করছে।চিৎকার করার ও উপায় নেই কারণ মুখ বাধা।আঘাতের কারণে শরীরের কয়েকজায়গা থেকে রক্তও বের হচ্ছে। লাল রক্ত যেন আমার গায়ে জড়ানো লাল বেনারসির সাথে মিলে একাকার হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আঘাত করা ব্যক্তিটি আঘাত থামিয়ে সজোরে বেল্ট খানা মাটিতে ফেলে দিল।তারপর চিল্লিয়ে বললো–“মিটেছে তোর জ্বালা?বিধবা একটা, ২ দিন হয়নি স্বামী মরেছে এর মধ্যে আরেকটা বিয়ে করার জন্য এতো মরিয়া হয়ে উঠলি যে আরেকজনের বিয়ের আসরে তাকে সরিয়ে নিজে বসে পড়লি।।তোর মতো মেয়েদের তো পতিতালয় এ ও জায়গা দেওয়া উচিত না।।”এসব বলে ঘটঘট করে বেরিয়ে গেল ঘর হতে।আমি কোনোমতে উঠে বসে নিজের মুখ হতে কাপড় টা খুললাম।তারপর খুব কষ্টে ওয়াশরুমের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলাম।।ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে আতকে উঠলাম।শাওয়ার ওন করে তার নিচে বসলাম।প্রতিটা পানির ফোঁটা যেন গায়ে আগুনের ফুলকির মতো লাগছে।
অতিত,
আমি মানজিয়া মিথি।বয়স ২৩।দেখতে ফর্সা,রোগাটে আর কোমড় ওবধি ঘন কালোচুল।সবার মতে আমি নাকি একটু বেশি সুন্দরী তবে রোগাটে ভাবের জন্য তা নাকি ঢাকা পড়ে গিয়েছে।পড়াশোনাটা এইচএসসির পর আর করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি।মা-বাবা আর ২ভাই আর আমি মিলে ছিলো আমাদের সংসার।।আমাদের বাড়িটা একদম মধ্য গ্রামে হওয়াতে মেয়েদের বেশি পড়াশোনা করার রীতি নেই।তাইতো ১৮ পেরোতে সবাই বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল।যৌতুক দেওয়ার সামর্থ্য না থাকায় বিয়ের জন্য এগোতেও পারছিল না আমার পরিবার।অবশেষে ২২ এর কোটা পেরোতেই আমার চাচা পাশের গ্রামের একজন লোকের জন্য আমার সম্বন্ধ নিয়ে আসেন।লোকটির প্রায় ৪৫ বয়স, আগের স্ত্রী মারা গিয়েছেন।যথারীতি সময় এ বিয়ে হয় লোকটির সাথে কিন্তুু বিয়ের দিন বিদায়ের পথে গ্রামের মূলসড়কের রাস্তা পার হতে গিয়ে তার এক্সিডেন্ট হয় বাসের সাথে। ঘটনাস্হলেই তার মৃত্যু হয়।তাদের বাড়ির লোকজন আমায় অপয়া বলে বাড়িতেই ফেলে যায়।যার নাম না জেনেই বিয়ে করলাম তার দূর্ঘটনার জন্য আমি দায়ী।। কি আজব ব্যাপার তাইনা!!!
এই ঘটনার ১ মাস পর আমার ফুপি বাড়িতে আসেন।
ফুপিরা ঢাকায় থাকেন।ফুপির ১ মাত্র ছেলে সায়মান আহমেদ সাদি।সাদি ভাইয়া আমার থেকে ৬ বছরের বড়।শুনেছি বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে দেশে এসেছেন।সাদি ভাই দেখতেও খুবই সুন্দর।অনেক ফর্সা না হলেও শ্যামবর্ণ গায়ের রঙের সৌন্দর্যে যেকোনো মেয়েকেও হার মানাবে।ভাইয়া ৬ ফিট লম্বা আর জিম করা বডি তার ওপর ঠোঁটের কোণের অমায়িক হাসিতে যেন যেকোনো মেয়ে তার প্রেমে পড়বে।কয়েকবছর আগে বাবার সাথে ফুপির একটা ঝামেলা হওয়াতে ফুপি বাড়িতে আসা বন্ধ করে দেন।।তবে এবার মা অনেক বলে বাবা আর ফুপির মিল করান।ফুপির বাড়ি আসার আরেকটি কারণ হলো সাদি ভাইয়ের বিয়ে।
সাদি ভাইয়া নাকি কোনো একজন মেয়েকে খুব ভালোবাসেন, তাকে বিয়ে করবেন।তাই ফুপির ইচ্ছে তে তাদের বিয়ে আমাদের বাড়িতে হচ্ছে। ১ম সাদি ভাইকে অনেক আগে দেখেছিলাম।আর এই দেখলাম।তার হবু স্ত্রী ও যেন কোনো এক হুরপরি।কথার মাঝে জানলাম তার হবু স্ত্রী এর নাম তিশা।সাদি ভাই আর তিশা আপুর বিয়ের তারিখ ঠিক হলো।।কিন্তুু কথা চক্রে সাদি ভাই বা তিশা আপুকে আমার সাথে কেউ পরিচয় করালো না।হয়তো অপয়া বলে।।অনেক সময় পর,ফুপি আমায় ডেকে বলেন-“কি রে মিথি,কাছে আসছিস না কেন?”
ফুপির কাছে গিয়ে বসলে ফুপি তিশা আপুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।সাদি ভাইয়ার সাথে পরিচয় হলে তিনি বলেন-আরে,, তুই!! এখন আর আইসক্রিমের জন্য ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদিস নাকি??আমি ঠোঁট চেপে বললাম–মোটেই না,আমি এখন বড় হয়ে গিয়েছি।
তারপর বেশ হাসি তামাশার পর বাবা আর ফুপা মিলে সাদি ভাইয়ের বিয়ের তারিখ ঠিক করেন।সামনের বুধবার গায়ে হলুদ আর তার পরদিন বিয়ে।ফুপিরা ঢাকা থেকে শপিং করে এনেছে তা সবাই মিলে দেখতে বসলাম।।তারপরদিন সাদি ভাই, তিশা আপু আর আমার বড় ২ ভাই(মিহির আর মাহির) গেল গ্রাম ঘুরে দেখতে।।তখন মা আমায় একা ঘরে ডেকে বললেন -“শোন মিথি,সাদির কোনো শুভ অনুষ্ঠানে তুই উপস্হিত থাকবি না।তিশা আর সাদির আশে পাশেও আসবি না বিয়ে না হওয়া অবধি,,বুঝতেই পারছিস””
মাকে থামিয়ে বললাম–“বুঝেছি,আমি বিধবা তাই শুভ অনুষ্ঠানে যেতে নেই,,চিন্তা করো না,আমি থাকবো না””বলে বেরিয়ে পড়লাম ঘর হতে।
আজ সাদি ভাই আর তিশা আপুর গায়ে হলুদ। ফুপি একটা শাড়ি পরিয়ে,সাজিয়ে দিয়েছেন।সাথে করে প্যান্ডেলে নিয়ে যেতে চাচ্ছিল কিন্তুু আমি বাহানা দিয়ে ঘরে চলে আসি।ঘরে বসে জানালা দিয়ে অনুষ্ঠান দেখছি।হঠ্যাৎ চেচামেচির আওয়াজ শুনতে পেলাম কিন্তুু বুঝতে পারলাম না।কিছুক্ষণ পর সাদি ভাইয়া এসে আমার ঘর হতে আমার হাত ধরে প্যান্ডেলে নিয়ে গেলেন।তারপর তিশা আপুর পাশে নিজে বসে আমাকে বললেন হলুদ লাগাতে আমি বেশ অবাক হলাম।দেরি হচ্ছে দেখে ভাইয়া দিলো এক ধমক আমি আতকে উঠলাম।।ভয়ে ভয়ে তাদের হলুদ লাগালাম,তারপর স্টেজ থেকে নিচে নেমে চাচাতো বোন তুশির পাশে দাঁড়ালাম।তুশির বয়স মাত্র ১৫। তবে অনেক চটপটে।প্যান্ডেলে কি হয়েছে ওর কাছে জানতে চাইলে ও যা বললো তাতে আমি হতবাক।আমার কথা ফুপি জিজ্ঞেস করতেই মা বললো ও আসবে না।চাচি গলা খেঁকি দিয়ে বললেন-তুমি তো জানো ননদী,ওর স্বামী মরেছে কয়েকদিন আগে।অপয়া মেয়ে।
ফুপি বেশ রেগে বললেন–কারো মৃত্যু দায় তো আর মিথির না।ফুপি জোড়াজুড়ি করেও যখন পারলেন না,তখন সাদি ভাইয়াকে বললেন। সাদি ভাইয়া তখন বাবা,চাচার সাথে কথা বললেন।কিন্তুু তারা নাকোজ করে দিলেন।গ্রামের বেশ কয়েকজন নিমন্ত্রিত আমার উপস্থিতির কথা শুনে বললেন–আমার মতো অপয়া মেয়ে অনুষ্ঠানে থাকলে তারা থাকবেন না।
সবার কথা শুনে সাদি ভাই রেগে বললেন–এসব কুসংস্কার তিনি মানেন না।বলে আমাকে নিয়ে এলেন ঘর থেকে।সব অনুষ্ঠানের পাট চুকিয়ে আমি ছাদে দাঁড়িয়ে আছি।এরই মধ্যে ছাদে সাদি ভাই আসে।আমাকে কাঁদতে দেখে বলেন–কি রে বুচি,কাঁদছিস কেন?
বললাম–এমনিই।
সাদি ভাইয়া –মন খারাপ করিস না।
এসব কুসংস্কার বিশ্বাস করতে নেই।।কারো মৃত্যুর দায় তোর না।
আমি কোনো উত্তর দিলাম না,আকাশ পানে চেয়ে রইলাম।।ভাইয়ার ফোন আসায় সে নেমে যায়।
আজ সাদি ভাইয়ের বিয়ে,,আমি তৈরি হয়ে বিয়ের আসরে যাব বলে বের হবো তখনি ফুপি কিছু ব্যাগ নিয়ে আমার ঘরে ঢুকলেন।তারপর দরজা বন্ধ করে দিলেন।তারপর আমার হাত ধরে যা বললেন তাতে আমি অবাকের চরম শিখরে পৌঁছে গেলাম।ফুপি আমায় অনুরোধ করছেন যে সাদি ভাইকে বিয়ে করতে কারণ তিশা আপু পালিয়ে গিয়েছেন।।পালিয়ে যাওয়ার সাথে যদিও আরও কারণ ফুপি জেনেছেন তা পরে জানাবেন।আমি বারবার মানা করলাম।।কিন্তুু অবশেষে ফুপি আমার পায়ের সামনে বসে আঁচল তুলে ভিক্ষা চাইছেন তখন একপ্রকার বাধ্য হয়ে তখন তিশা আপুর জামা কাপড় পরে বড় ঘোমটা দিয়ে বিয়ের আসরে গেলাম।কবুল বলার সময় আমার গলার আওয়াজ আটকে যাচ্ছিল ভয়ে।তারপর ফুপি কাঁধে হাত রাখায় বলেই দিলাম।আয়নায় মুখ দেখা পর্বে আমার মুখ দেখে আতকে দাঁড়িয়ে পড়লেন সাদি ভাই।
সে চিল্লিয়ে বলে -এসব কি?তুই এখানে কেন??তিশা কই??
আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না।তখন ফুপি বললেন -সাদি,তিশা পালিয়েছে।
সাদি ভাইয়া বলল-কি!!!হতেই পারে না।
তখন সারাবাড়ি খুঁজে, ফোন করতেই দেখে তিশার ম্যাসেজ।তিশা লিখেছে–আমি যেতে চাইনি সাদি,কারো লোভে বাধ্য হলাম।।
এই ম্যাসেজ পড়ে সাদি ভাইয়া স্বাভাবিকভাবে আমায় ভুল বুঝে। বিয়ের আসর ছেড়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায় তিশাকে খুঁজতে। সাদি ভাই বেরিয়ে যেতেই আমার মা এসে আমায় এক থাপ্পর মারলো।আর যা তা বলতে লাগল।এরপর এক ধাক্কা দিলে আমি বাবার পায়ের কাছে গিয়ে পড়ি।বাবার হাত চেপে ধরতেই আমাকে ছিটকে ফেলে দিয়ে চলে গেল।ফুপি এসে আমায় টেনে তুলল।তারপর বলল –চল মিথি,আমরা এখনি রওনা দিবো।
বিদায় হলো কিন্তুু মা,বাবা কেউ এলো না।কাঁদতে কাঁদতে গাড়িতে উঠলাম।।সারা রাস্তা কান্না করতে করতে এলাম।ফুপি সান্ত্বনা দিলেন অনেক।
অবশেষে ফুপির বাড়িতে পৌঁছালাম।মেইন গেট দিয়ে বাড়ি ঢুকে দেখি এতো বাড়ি নয় প্রাসাদ।চারদিক তাকিয়ে দেখতে লাগলাম।ফুপি কয়েকজন মেইডকে দিয়ে আমাকে সাদি ভাইয়ের ঘরে পাঠালেন ফ্রেস হতে।সাদি ভাইয়ের ঘরে ঢুকে দেখলাম ঘরটা বেশ সাজানো গোছানো।কোনের ১ টা দেওয়ালে সাদি ভাই আর তিশা আপুর অনেক ছবি রয়েছে।তাদের ছবি দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।তারপর ফ্রেস হয়ে ফুপির কাছে গেলাম,ফুপি আমায় খাবার দিলেন।।এতো ঝামেলার মধ্যে ভুলেই গিয়েছিলাম যে খাওয়া হয়নি।।খাওয়ার পর রুমে নিয়ে ফুপি বললেন–সাদিকে একটু মেনেজ করে নিস।।ও একটু রাগি।।তারপর তিশা আপু সম্পর্কে যা বললেন তা শুনে আমি অবাক।কথা শেষ করে রাত ১১ টায় আমায় সাজিয়ে সাদি ভাইয়ের ঘরে পাঠালেন।
ঘরটা আর সাজানো হয়নি।অনেকক্ষণ যাবত বসে আছি।ভয়ে আমার জীবন শেষ।রাত ১.৩০ টার দিকে সাদি ভাই ঘরে আসলেন।দরজা খুলে আমাকে দেখেই রেগে গেলেন।তার দিকে তাকিয়ে দেখি রক্তাক্ত চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে এক থাপ্পর দিলেন আর আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম।তারপর তো জানেনই আপনারা।
দরজায় নক করায় কোনোমতে গা মুছে শাড়ি পেচিয়ে বাইরে এসে দেখি ফুপি।আমার হাত পা,মুখ দেখে ফুপি বুঝতে পেরে মুহূর্তেই রেগে গেলেন।।তারপর সাদি ভাই কে ফোন করলেন ও বাড়িতে আসতে বললেন।
সাদি ভাইয়া আসার পর—–
চলবে