তুমিময়_অসুখ ২ পর্ব-৪
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
৭.
রাতেরবেলা বাসা পুরো খালি। আছি শুধু আমি আর দিদা। অভ্র ভাইয়া ছাদে সবকিছু রেডি করে ওনার ফ্রেন্ডদের নিচে রিসিভ করতে গিয়েছেন। আমি রুমে বসে বোর হচ্ছিলাম। ভাবলাম দিদার রুমে গিয়ে বসে থাকি। কিন্তু কয়েক পা এগুতেই শুরু হলো হালকা পেটব্যথা! আমি ততোটা পাত্তা না দিয়ে দিদার রুমে চলে গেলাম। গিয়ে গল্প করতে লাগলাম।
দিদা বললো, ‘অভ্রে’র বন্ধুরা এসে গিয়েছে?’
‘ হুম!’
‘ দেখলাম না তো!’
‘ ওনি নিচে রিসিভ করতে গিয়েছেন। এক্ষুনি আসবে!’
‘ সব কি ছাদে আয়োজন?’
‘ হুম!’
‘ ভালোই হলো।’
‘ কেন?’
‘ বাসায় করলে মনে কর, বাসা ওদের চিল্লাচিল্লিতে ফেটে যায়। ছাদে করেছে সব আপদ ওখানেই থাকুক!’
আমি হেসে ফেললাম। একটু পরে অভ্র ভাই এলেন। ব্যস্ত ভঙ্গিতে আমাকে খোঁজাখুঁজি করে দিদার রুমে এসে পেলেন। বললেন, ‘সবাই এসে গিয়েছে। তুই আয়।’
দিদা অবাক হয়ে বললেন, ‘কেন?’
‘ সবাই-ই তো ইরুকেই দেখতে আসছে।’
‘ তোমার বউকে বন্ধুদের মাঝে নিয়ে যাওয়া কি ঠিক হবে?’
‘ বন্ধু কম, বান্ধবীরাই সব।’
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কিরে আসতে বলছিনা? আয়!’
আমি ওঠে দাঁড়ালাম। ওনার এসব কাজকর্ম আমার একদম ভালো লাগছেনা। আবার বড়মুখ করে বলছেন যে, বান্ধবীরা এসেছে। সবকটা যে বদের হাড্ডি সেটা কি আর মানুষ জানেনা? আমাকে বোকা পেয়েই এসব করার সাহস পাচ্ছে। রিডিকিউলাস ইরাম, তোর মরে যাওয়া উচিৎ!
অভ্র ভাইয়া ভাবনার মাঝপথে বলে উঠলেন, ‘ফলো মি!’
আমি ওনার পিছুপিছু ছাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠছি। এসে দেখি কি সুন্দর ডেকোরেশন করা, ছাদের গাছগুলোতে লাইটিং করা। একপাশে বারবিকিউ করা হচ্ছে, অন্যপাশে অনেকগুলো কাচের রঙিন বোতল। বুঝলাম না কিসের বোতল এসব। যাইহোক, আমাকে দেখতে পেয়েই ওনার সব ফ্রেন্ডরা হইহই করে উঠলেন। আমি সবার দিকে নজর দিলাম। দেখলাম, চারটা মেয়ে আর তিনটা ছেলে। অভ্র ভাইয়া সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং বললেন, ‘আমাকে যাতে সবাই ভাবি ডাকে!’
তাসিফ ভাই বললেন, ‘কেমন আছেন ভাবি?’
আমি ‘ভাবি’ ডাকটাতে অস্বস্তিবোধ করছিলাম। হাসিমুখে বললাম, ‘জ্বি, ভালো ভাইয়া!’
পাশ থেকে সাইমা নামের একটা আপু বললো, ‘আসো! আমাদের সাথে পার্টি এনজয় করো।’
আমিও আস্তেধীরে ভয়ানক অস্বস্তি নিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা।’
চেয়ার-টেবিল থাকা স্বত্ত্বেও ছাদের ফ্লোরে মাদুর পাতা হয়েছে। সবাই ওখানেই বসা। আমিও ওদের পাশে গিয়ে বসলাম। সবাই হাসিঠাট্টা করছে। প্রচন্ড জোরে গান বাজছে। বারবিকিউ’র দারুণ স্মেল আসছিলো। সবাই আইসক্রিমের সাথে চিপসের প্যাকেট নিয়ে মেতে রইলো। আর আমি কাবাব মে হাড্ডির মতো একদল এলিয়েনের মাঝে বসে রইলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা গুনছিলাম মনে মনে। মেঘ ভেঙে আকাশে জেগে ওঠেছে শুক্লাদ্বাদশীর চাঁদ! আমার পাশে অভ্র ভাই বসে সবার সাথে আড্ডা দিচ্ছিলেন। হঠাৎ একটা ঠান্ডা বাতাস বইলো। আমার খোলা চুলগুলো বাতাসের সাথে সাথে আছড়ে পড়লো অভ্র ভাইয়ের মুখচোখে!
অমনি সবাই চুপ করে গেলো। কিছুসময় পর সবাই সিঁটি বাজিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়লো। একজন তো বলেই বসলো, ‘কি রোমান্টিক মোমেন্ট!’
আমি লজ্জ্বায় কাঠ হয়ে রইলাম। অভ্র ভাই চুলগুলো সরিয়ে আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘বেঁধে রাখতে পারিস না? যত্তসব আজাইরা।’ তারপর ওনার ফ্রেন্ডদেরকেও ধমক দিলো আর সবাই নিষ্পাপ মুখ করে বসে রইলো।
আমি মুখ কালো করে বসে রইলাম। উঠে আসতেও পারছিলাম না। অভ্র ভাইয়ের একটা মেয়ে বান্ধবী আমার দিকে রাগী চোখে তাকাচ্ছে আমি বুঝলাম। বোধহয় জ্বলছে আমাকে অভ্র ভাই বিয়ে করেছেন বলে। আমি মনেমনে ফুড়ুৎফুড়ুৎ উড়ছি! ওয়ানপিস অভ্র’ই ছিলো যেটাকে আমি নিয়ে গিয়েছি। প্রাউড অফ মি, প্রাউড অফ ইরু!
৮.
সবাই খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত। আমি কোনোমতে একটু চিকেনের টুকরো চিবুচ্ছি! আর সবাই যেভাবে খাচ্ছে দেখে মনে হচ্ছে কতদিনের অভুক্ত। আমি অবাক চোখে সবাইকে দেখছি। কি হাসাহাসি – ঠাট্টা, মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। অভ্র ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কি? খাস না কেন?’
‘ খাচ্ছি তো।’
‘ হুম।’
তারপর ওনি ওঠে ছোট্ট টেবিলটাতে রাখা একটা রঙিন বোতল নিয়ে এলেন। সবাই আরও একবার হৈহৈ করে উঠে বললো, ‘গ্রেট!’
তারপর একজন বললো, ‘আজ শ্যাম্পেইন খেয়ে মাতাল হয়ে যাবো!’
পাশেরজন ফোড়ন কেটে বললো,
‘ মাতাল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো!’
‘ পুলিশে দেখলে প্যাদানি দিবে!’
‘ তোরে কইসে! আজাইরা কথা কস কেন।’
অভ্র ভাই ওদেরকে চুপ করতে বললেন। তারপর গ্লাসে ঢেলে সবাইকে খেতে দিলেন। আমাকে দিয়ে নিজেও বোতল নিয়ে বসলেন। কিন্তু আমি বুঝলাম না ‘শ্যাম্পেইন’ জিনিসটা কি, ভাবলাম হয়তো ‘কোল ড্রিংকস’ টাইপ কিছু। তাই আস্তেধীরে খেতে লাগলাম। অভ্র ভাইয়া একটু একটু করে খাচ্ছে আর আমার দিকে তাকাচ্ছে। বোধহয় আমার এক্সপ্রেশন দেখার চেষ্টা করছেন। আমি দু চুমুক খেতেই কিছু একটা ভেবে আমার হাত থেকে গ্লাসটা কেড়ে নিয়ে রেখে দিলো, বাকিদের দিকে তাকিয়ে দেখি ওরা খুব আয়েশ করে খাচ্ছে। যেন কোনো ছোট বাচ্চাদের দলকে ‘হরলিক্স’ খেতে দেওয়া হয়েছে। আমি কিছুক্ষণ ‘থ’ হয়ে বসে রইলাম। আর আমি অভুক্ত!
৯.
আমাকে অপমান করা হলো কিনা বুঝতে পারছি না। ঠিক এমন সময় পেটব্যথা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। প্রচন্ড ব্যথা করছে, আমি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। অতঃপর উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে চলে এলাম রুমে। পেটব্যথায় মনে হচ্ছে আমি মরে যাচ্ছি, ওইসময় ততোটা পাত্তা দিইনি। এখন মনে হচ্ছে পাত্তা দেওয়া উচিৎ ছিলো। কোনোকিছুকে ছোট করে দেখা ঠিকনা। কিন্তু এখন আমি কি করবো? দিদার রুমে গিয়ে দেখি দিদা ঘুমিয়ে কাদা, আমি আর জাগালাম না। অভ্র ভাইয়া তো বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত। এমনিতে হলেও বলতে পারতাম না। কিন্তু এখন? এখন আমি কি করবো!! বিছানায় বালিশ চেপে ধরে পড়ে রইলাম, কান্না করছি!
আধঘন্টা পর অভ্র ভাই রুমে এলেন। আমাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে?’
আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললাম, ‘পেটব্যথা!’
‘ আর তুই এতক্ষণে বললি! কোন সময় ধরে হচ্ছে?’
‘ ছাদে যাওয়ার সময়ই, তখন কম ছিলো। আপনার কোল্ড ড্রিংকস খাওয়ার পরেই ব্যথা শুরু হলো।’
অভ্র ভাইয়া একটু গিলটি ফিল করলেন বলে মনে হলো। সাথে সাথে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। বন্ধুদের তৎক্ষনাৎ বিদায় দিয়ে রুমে এসে বললেন, ‘বেশি ব্যথা?’
‘ জ্বি!’
তারপর ওনি কাকে যেন ফোন দিলেন। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে বাসায় আসতে বললেন। একটুপর, বাসার কলিংবেল বেজে উঠলো। অভ্র ভাইয়া তাড়াহুড়ো করে চলে গেলেন দরজা খুলতে। আর রুমে ঢুকলেন ডাক্তার নিয়ে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, এই রাত এগারোটায় ওনি কোথা থেকে ডাক্তার আনলেন আমি বুঝতেই পারলাম না। যাইহোক, এটা ওনার ব্যাপার।
ডাক্তার এসে আমাকে দেখলো, চেকাপ করলো। অভ্র ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন, ‘এরকম হবার কারণ?’
ডাক্তার বললেন, ‘ভুলভাল কিছু খেলে তো এরকম হবেই!’
অভ্র ভাইয়া আরকিছুই বললেন না। তারপর ডাক্তার বললেন, ‘দেখি! আপনার হাতটা দেন।’
আমি বললাম, ‘কেন?’
ডাক্তার সিরিঞ্জ বের করতে করতে বললেন, ‘ইনজেকশন দিতে হবে, নইলে ব্যথা কমবেনা।’
ইনজেকশনের কথা শুনেই আমি লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। ডাক্তার আর অভ্র ভাই চমকে তাকালো। আমি মুখটা হাসিহাসি করার চেষ্টা করে বললাম, ‘আমার ব্যথা নেই। ভালো হয়ে গিয়েছে। ইনজেকশন দিতে হবেনা।’
ডাক্তার বললেন, ‘দিতে হবে!’
‘ দেবোনা।’
অভ্র ভাইয়া রেগে বললেন, ‘দিতে হবে যখন বলেছে দিতে হবে। গভীর রাতে আবার ব্যথা উঠলে আমি তখন ডাক্তার আনবো কোথা থেকে? তোর কি মনে হয়, আমি বাংলা সিনেমার হিরোর মতো তোকে কোলে করে হসপিটালে নিয়ে যাবো!’
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘আমার ভয় করে, আমি ইনজেকশন নেবোনা।’
ডাক্তার বললেন, ‘না নিলে ব্যথা ভালো হবেনা। বুঝছেন না কেন?’
‘ বুঝতে হবেনা। আমি দিবোনা।’
বলেই আমি আরো দূরে সরে গেলাম, ব্যথা কিন্তু আছেই।
অভ্র ভাই রেগে বললেন, ‘দিতে হবে মানে দিতে হবে।’
বলতে বলতে আমার কাছে এসে আমার হাত চেপে ধরলেন, আমি আর নাড়াতেই পারছিনা। কান্না করে দিলাম। ওনি বললেন, ‘কুইক! আমি ধরেছি আপনি ইনজেকশন দিয়ে দিন।’
আমি বললাম, ‘না না, প্লিজ এমন করবেন না!’
‘ চুপ। তুই বুঝবিই না ইনজেকশন দিচ্ছে কি দিচ্ছেনা।’
আমি টের পেলাম হাতে সূঁচ ঢোকানো হচ্ছে। আমি ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে বলতে লাগলাম, ‘লা-ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালেমিন, লা-ইলাহা ইল্লা আন্তা…..!!’
অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো রুম। চোখ খুলে দেখি অভ্র ভাই ‘হা’ ‘হা’ করে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছেন আর পাশেই ডাক্তার লোকটাও হাসছে। ওনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘ইরু! তুই-ই এত ভয় পাস? খোদা…!’
হাসার চোটে ওনার গলা দিয়ে আওয়াজই বেরুচ্ছেনা। আর আমি মুখ কালো করে বসে রইলাম। পেটব্যথা বাবাজি সঙ্গে সঙ্গে পালালো, নইলে অভ্র ভাইয়ের জোকার মার্কা হাসি দেখে নির্ঘাত হার্টফেল করতো!!
?”হয়ত আপনি ৫ বছর আগে নিয়মিত নামাজ পড়তেন না, এখন পড়ছেন।
হয়ত ২ বছর আগে আপনি কোরআন পড়তে জানতেন না, এখন জানেন।
জীবনের কোনো একটি ঘটনা হয়ত আপনাকে গভীরভাবে ভাবতে শিখিয়েছে, আশেপাশের মানুষকে চিনতে শিখিয়েছে, কবর চিনিয়েছে, জান্নাত-জাহান্নাম চিনিয়েছে, আল্লাহ তায়ালাকে চিনিয়েছে। আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের এই পরিবর্তনকে কবুল করুক। আমিন!”
(সংগৃহীত)
?‘দুআ কবুল হবে—এই বিশ্বাস রেখে আল্লাহর কাছে দুআ করো। কেননা, আল্লাহ্ কোনো উদাসীন অন্তরের দু’আ কবুল করেন না।’
~ [তিরমিযি:৩৪৭৯]
চলবে…..ইনশাআল্লাহ!