নিস্তব্ধ বিচরণ,পর্ব -১২

0
2282

নিস্তব্ধ বিচরণ,পর্ব -১২
তানজিলা

ধীর কন্ঠে নিজের সম্মতি জানিয়ে পুনরায় জানালার বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ইনায়া। এই মুহুর্তে যেন আর কিছুই ওর মনোযোগে ঠাই পাচ্ছে না। জট পাকানো বৈদ্যুতিক তারগুলোতে একটু পর পর পাখিরা এসে বসছে। যেন অনেক দিন পর নিজের প্রিয় বন্ধুদের দেখা পেয়েছে। মন ভরে গল্প করে আবারও হয়তো উড়ে যাবে নিজ ঠিকানায় পাখা মেলে। খুব মনোযোগ দিয়ে সেই দৃশ্য দেখছে ইনায়া। আচ্ছা, ওর ঠিকানা কোনটা!

ইনায়া এতো সহজে হ্যাঁ বলবে সেটা ভাবতে পারেনি ইনায়ার চাচা। তবে না বললে যে জোর করে বিয়ে দিত এমনটাও না! এতোটাও গর্হিত কাজ সে কখনোই করতো না। দিনে দিনে মেয়েটা তার স্ত্রীর চোখের বিষ হয়ে যাচ্ছে। অথচ মা মরা মেয়েটাকে কতটাই না আদর করে সে-ই নিয়ে এসেছিল। তখন তাদের কোন সন্তান ছিল না। ইনায়ার বাবারও মেয়েকে নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা ছিল। স্ত্রীর শোকে যেন পাগল হয়ে গেছিলো। বেশিরভাগ সময় কাজ নিয়েই পড়ে থাকতো।

পাড়া প্রতিবেশি একেক জনের একেক কথা। ঘরটা যেন তিক্ততায় ভরে গেছে। ইনায়া এমনিও প্রচন্ড ভেঙে পড়েছে। ওকে এখান থেকে দূরে রাখাটাই ভালো মনে হচ্ছে ইনায়ার চাচার।
আজ অনেক দিন পর ইনায়ার চাচী ইনায়ার ঘরে এসে ইনায়াকে জড়িয়ে ধরে অস্রুবিসর্জন করতে লাগলো। ইনায়ার মধ্যে এর কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। সে তার মতো করে এক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। যেন এক অনুভূতিহীন অস্তিত্ব!

-“চাচী, আমার ব্যাপারে জানে ওরা?”
-“হ্যাঁ জানে। তোমারে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না! আল্লাহর রহমতে বিয়েটা একবার হইলেই আমি বাঁচি।”

ইনায়ার মাথায় কয়েকবার হাত বুলিয়ে সে-ও চলে গেল। ইনায়া আবারও তার গতানুগতিক কাজে মন দিল। সবাই ওর থেকে মুক্তি চায়! যেন কোন ভয়ানক আসামি সে! জানে না নতুন কোন পরিবারে যাচ্ছে ও। তারাও কি ওর থেকে মুক্তির পথ খুঁজবে!

পরেরদিন বিকেলেই বিয়ে সম্পন্ন হলো। বিয়েতে ইনায়ার মামাও এসেছিল সাথে মামাতো বোন প্রিয়া।

-“আপু, তুমি সত্যি বিয়েতে রাজি ছিলে তো?”
-“হুম।”
নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দেয় ইনায়া। ভারী শাড়ি আর গয়নাগুলো শরীরে কাঁটার মতো বিঁধে যাচ্ছে। এসব একদম ভালো লাগছে না ইনায়ার।
-“বিয়ের জন্য হ্যাঁ তো বলে দিলাম কিন্তু এখন কী করে সবকিছু সামলাবো আমি! আমি না-কি পাগল! দুই দিন পরই না-কি আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারে!”
কথাটা বলেই মৃদু হেসে উঠলো ইনায়া। প্রিয়া ইনায়ার হাত ধরে বললো,
-“মানুষের কথা কেন শুনছো তুমি? এদের খেয়ে দেয়ে কোন কাজ নেই মানুষের বাসায় এসে এসব বলে বেড়ায়!”
ইনায়ার চোখটা হঠাৎ নরম হয়ে গেল। যেন এতক্ষণ সবার সামনে নিজেকে শক্ত হিসেবে ধরে রাখার চেষ্টা করছিলো। আচমকা প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরলো,
-“কিভাবে সংসার করবো আমি! কিভাবে সহ্য করবো তাকে! কিচ্ছু জানি না আমি!”
ইনায়ার পিঠে হাত বুলিয়ে শান্তনা দেয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না প্রিয়া। পুরুষ মানুষ দেখলেই যে ইনায়া আতঙ্কিত হয়ে পড়ে তা ভালো করেই জানে প্রিয়া। এখনো হয়তো ট্রমা থেকে বের হতে পারেনি ও!
ইনায়ার মনে হলো দরজার সাইড থেকে আকস্মিক ভাবে কে যেন সরে গেল। যদিও সেটা নিয়ে আর মাথা ঘামালো না ইনায়া।

ইনায়ার শ্বাশুড়ি ইয়াসমিন ওকে রেহানের ঘরে বসিয়ে চলে গেল। বিয়ের আগে শুধু নামটাই জেনেছিল ইনায়া। রেহানের ব্যাপারে আর তেমন কিছুই জানা হয়নি ওর। শ্বশুরবাড়ি থেকে শুধু ইয়াসমিন আর ওর দাদী শ্বাশুড়ি জেরিনকেই দেখলো ও।

খাটের এককোনায় চুপচাপ বসে আছে ইনায়া। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজে কিঞ্চিৎ সতর্ক হয়ে বসলো। রেহান এক পলক বিছানায় বসা ভিত মুখটা দেখে বালিশ নিয়ে ফ্লোরেই শুয়ে পড়লো। পুরো ব্যাপারটাই বিস্ময় নিয়ে দেখে গেল ইনায়া। লোকটা হয়তো ওকে মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। একবার নিজের হাতে লক্ষ্য করে দেখে অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে ও।

নিজেকে স্বাভাবিক ভাবেই সবার সামনে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা করেছিল কয়েকদিন। কখনো পেরেছে কখনোবা পারেনি। তবে ইয়াসমিন আর জেরিন সবকিছুই যেন স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিয়েছে।
ইয়াসমিনের রেহানকে উপেক্ষা করে চলাটাও ইনায়ার দৃষ্টিগোচর হয়নি।

বর্তমান
___________

রেহান শান্ত চোখে কিছুক্ষণ ইনায়ার দিকে তাকিয়ে বিছানায় বসে পড়লো। একদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে রেহানের মুখে আরেকদিকে অশান্ত মনে একঝাঁক প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইনায়া। একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো রেহানের মুখ থেকে। হয়তো আজ এড়িয়ে যেতে পারবে না!

-“তোমার বাবা আমাদের আসিফের এমপ্লয়ি ছিলেন।”
-“শুধুমাত্র এই কারণেই তো কারও পারসোনাল ইনফরমেশন কারও পারসোনাল ডায়েরিতে লেখা থাকবে না!”
ইনায়ার কন্ঠ আজ বেশ তিক্ত মনে হচ্ছে রেহানের কাছে।
-“এক বছর আগে অসিফে একজন মহিলা এমপ্লয়ি খুন হয় যার চাক্ষুষ সাক্ষী ছিলেন তোমার বাবা। সন্দেহের কাটা সর্বপ্রথম ঘুরেফিরে আমার কাঁধেই আসে। সিসিটিভি ফুটেজও ডিলিট করে রেখেছিলো কেউ।”

এসবের কিছুই ইনায়া জানতো না। ওর বাবা কোন মার্ডার কেসের সাক্ষী ছিলো! এই কারণেই ওর বাবাকে কেউ…!

-“খুনী কি আসলেই আপনি ছিলেন?”
রেহান নিজের দৃষ্টি ইনায়ার থেকে সরিয়ে শান্ত গলায় বললো,
-“সেই এমপ্লয়ি সবার সামনে আমার গালে চড় মেরেছিলো।সহ্য হয়নি আমার এতো অপমান। রাগের মাথায় অনেক কিছুই বলে ফেলেছি যা আমার উচিত হয়নি। ফলস্বরূপ সবার সন্দেহের লিস্টে আমিই প্রথম ছিলাম। তবে তোমার বাবা পরে সাক্ষ্য দেয় অন্য কারও বিপক্ষে। আর তাকে গ্রেফতার করা হয়।”

-“তাহলে আপনি আমার বাবাকে কেন খুঁজছিলেন?
কাঁপা কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করে ইনায়া।

-“আসল খুনি ধরা পড়েনি ইনায়া। তোমার বাবা মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছিলো!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here