নিস্তব্ধ বিচরণ,পর্ব -১৩
তানজিলা
-“তোমার বাবা টাকার বিনিময়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছিলো। সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত মা আমার সাথে ঠিকমতো কথাও বলেনি। রাগের মাথায় যাই করতাম আমার বাবা আর না হয় দাদু আমাকে কখনও দোষারোপ করতেন না। মাকেও শাসন করতে দিতেন না। একসময় মায়ের থেকে আমার দুরত্ব বাড়তেই থাকে। মা মনে করছে আমি খুন করেছি। আর টাকা দিয়ে তোমার বাবার মুখ বন্ধ করেছি।মানছি আমি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। কিন্তু কারও খুন আমি কখনও করবো না। আমি তো তোমার বাবাকে খুঁজছিলাম শুধুমাত্র তাকে মায়ের সামনে এনে সব সত্যি তার মুখ থেকে মাকে জানাতে। মা তো আমাকে বিশ্বাস করে না! আর না তুমি বিশ্বাস করো!”
-“আমার বাবা টাকার বিনিময়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার মতো মানুষ না!”
-“কতটুকু জানো তুমি মানুষটাকে! মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমার খোঁজ নিয়েছিলো একবার? সবাই সবকিছুর জন্য আমাকে দোষারোপ করছে। খুন না করেও মায়ের ঘৃণা বয়ে বেড়াচ্ছি। কেন? কারণ তোমার বাবা মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে চলে গেছে। যাওয়ার আগে আমার মাকে বলে গেছে সে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে টাকার বিনিময়ে। যেই পাপ আমি করি নি সেই পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরছি আমি! আর কত!”
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেছিলো কিছু সময়ের জন্য ইনায়া। রেহানকে এই মুহুর্তে কোন উন্মাদের চেয়ে কম মনে হচ্ছে না। দুই হাতে নিজের মাথায় চেপে ধরে বসে আসে।
-“ইনায়া নিজের ঘরে যাও!”
ইনায়ার পা যেন সেদিকেই আঁটকে আছে। ইনায়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রেহান ইনায়ার দিকে তাকালো। স্পষ্ট ভয়ের ছাপ সে চোখে৷ ইনায়া ওকে ভয় পাচ্ছে! ইনায়াকে আর কিছু বললো না রেহান। নিজেই উঠে বারান্দায় চলে গেল।
ইনায়া সেখানেই ধপাস করে বসে পড়লো। মৃত বাবার বিরুদ্ধে কেউ এতবড় কথা বললে কেউই তা সহজে মেনে নিতে পারে না। হাঁটু গেড়ে বসে আছে ইনায়া। চোখ বন্ধ করে আছে। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর মনে খানিকটা সাহস জুগিয়ে উঠে দাঁড়ালো ইনায়া। ধীর গতিতে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল ও।
রোডসাইডের ল্যাম্পপোস্টের আলো পুরো বারান্দা ছুড়ে। এক সাইডে রাখা রকিং চেয়ারে বসে গভীর কোন চিন্তায় তলিয়ে আছে রেহান। আগের থেকে এখন বেশ শান্ত মনে হচ্ছে।
-” আমার বাবা কাকে খুনি বলে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন? পুলিশও আমার বাবার মৃত্যুকে কার এক্সিডেন্ট বলে ধামাচাপা দেয়। যেখানে কেউ তাকে খুন করার জন্য পাগলের মতো ঘুরে বেরাচ্ছিল।”
রেহানের কানে ইনায়ার প্রশ্ন গেলেও রেহান কিছু বললো না।
-“আপনি অর্ধেক কথা বলে এখানে চলে আসলে তো হবে না। শুধু আপনার কথা শুনে আমি আমার বাবাকে অবিশ্বাস করবো না। ঠিকাছে, আপনাকে কিছু বলতে হবে না। যা করার হয়তো আমাকেই করতে হবে। ভয় পেয়ে সারাজীবন তো আর ঝিমিয়ে থাকা যায় না!”
রেহানের শান্ত দৃষ্টি গিয়ে পড়লো ইনায়ার ওপর। কি যেন একটা মনে করে মৃদু হেসে আবারও চোখ সরিয়ে নিল। আচমকা চেয়ার থেকে উঠে ইনায়াকে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। ইনায়া নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়েও ব্যার্থ হলো।
-“ভয় পাচ্ছো!”
অস্রুশিক্ত চোখে রেহানের দিকে তাকালো ইনায়া। সবচেয়ে বড় যুদ্ধ তো ওকে নিজের সাথেই করতে হচ্ছে। কারও দয়া, কারও তাচ্ছিল্য, কারও ঘৃণা দেখতে দেখতে ক্লান্ত সে। যতই চাক নিজেকে দূর্বল হিসেবে রেহানের সামনে তুলে ধরবে না। পারছে না ও! তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে মস্তিষ্কে। গলা ধরে আসছে । ক্রমাগত কাঁপছে পুরো শরীর।
রেহানের চোখে ক্রোধের কোন চিহ্নও নেই। ধীর শান্ত এক চাহনি যা আরও ভয়ংকর মনে হচ্ছে ইনায়ার কাছে।
-“কিচ্ছু করবে না তুমি। আমার খারাপ রূপ এখনো দেখোনি ইনায়া। ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট!”
কণ্ঠে নির্লিপ্ত ভাব। একহাত দিয়ে ইনায়ার চোখ মুছে ওর গাল আলতোভাবে চেপে ধরে রেহান।
শরীরের সর্বোচ্চ দিয়ে রেহানকে ধাক্কা দিল ইনায়া। দৌড়ে নিজের ঘরে এসে দরজা আটকে বিছানায় নিজের শরীরটা ছেড়ে দিল। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। ড্রেসিং টেবিলের ওপরই একটা ওষুধের পাতা রাখা ছিল। সেটা খেয়েই চোখ বন্ধ করলো ও। রেহানের কথা মানার কোন ইচ্ছে নেই ইনায়ার। অনেক চুপ থেকেছে। আর না!
বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে আছে রেহান খাবার টেবিলে।চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। সারা রাত যেন ঘুম হয়নি। ইনায়াকে ব্যাগ গুছাতে দেখে মাথায় রক্ত চড়ে বসলেও মুখে কিছু বললো না রেহান।সকাল সকাল ইনায়ার চাচাকে দেখেই ধারণা করেছিলো ও। বাঁধা দেয়নি ইনায়াকে। ইনায়া যাওয়ার আগে রেহানকে শুধু একটা কথাই বলে গেল।
-“আমি এতো সহজেই হার মানছি না!”
চলবে…