নিস্তব্ধ বিচরণ,পর্ব-২২

0
2445

নিস্তব্ধ বিচরণ,পর্ব-২২
তানজিলা

চোখের ভিরে আটকে গেছে সেই কবেই। হৃদয় গহীনে পুষে থাকা রাগটাও গলতে শুরু করেছে। আগে সেই ভীতু চোখ দেখে নিজেকে সামলাতে পারলেও ইদানিং বদলে যাচ্ছে অনেক কিছুই। রেহানের প্রতি কোন ভয় ইনায়ার চোখে আর নেই। আর না ওর স্পর্শে ছিটকে সরে যাচ্ছে ও। কিন্তু তারপরও কোথাও যেন একটা জড়তা রয়েই গেছে। অদৃশ্য জড়তা। খুব কাছাকাছি থেকেও যেন দূরত্বের পাল্লা ভারী হচ্ছে। হঠাৎ করেই ইনায়ার কম্পিত ওষ্ঠদ্বয়ের দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে রেহান। বৃষ্টি কণার সাথে মিশে যাচ্ছে ইনায়ার চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুবিন্দু। ইনায়াকে চোখ বন্ধ করতে দেখে মৃদু হাসলো রেহান। সেই দিনও চোখ বন্ধ করে বৃষ্টি বিলাশে হারিয়ে যাওয়া এক রূপসী দেখে কিছু সময়ের জন্য নিজেকেও হারিয়েছিলো। বিষয়টা অনিচ্ছাকৃত হলেও সেই মুখটা ওর মস্তিষ্কে প্রচন্ড বাজে ভাবে গেঁথে গেছে। আজ সেই মুখটা যেন সামনে থেকেও নেই। ইচ্ছে করছে আরও কিছু সময় এখানে থাকতে! মন ভরে দেখবে প্রেয়সীকে। ক্ষতি কী! কিন্তু এই মুহুর্তে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করাটা বেশি জরুরি।

-“আমি নিজেকে কখনোই সম্পূর্ণ সেলফলেস মানুষ বলবো না । হয়তো জেলে যেতে হয়নি কিন্তু পুলিশ স্টেশন পর্যন্ত ঠিকই যেতে হয়েছে। যে পাপ আমি করিনি সেই পাপের বোঝা কিছু সময়ের জন্য হলেও আমাকে বহন করতে হয়েছে। এতো সহজে তা ভুলে যেতাম আমি! সবার দেয়া অপবাদ সহ্য করলেও নিজের মায়ের দেয়া অপবাদ কি করে সহ্য করতাম! ইনায়া প্লিজ এই বিষয়গুলো নিজের মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। ভুলে যাও! সাদাফের ব্যাপারেও কোন চিন্তা তোমাকে করতে হবে না!”

-“কোনটা ভুলে যাবো! নিজের বাবার মৃত্যু ভুলে যাবো! নিজের সম্মান হারানো ভুলে যাবো! একটু একটু করে প্রতিনিয়ত নিজেকে হারিয়ে ফেলাকে ভুলে যাবো!”
কঠোর আক্ষেপ জড়িয়ে থাকা কন্ঠে করা প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারলো না রেহান। ইনায়ার গাল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ও। ইনায়া আরও বললো,

-“আমার পক্ষে ভুলে যাওয়া তো এই মুহুর্তে সম্ভব না! সাদাফের মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নেয়ার প্রশান্তি আমার সহ্য হবে না!”
মুখে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে আছে ইনায়ার। যেন কোন উন্মাদনার নেশায় মেতেছে ও! কিন্তু এই উন্মাদনায়ও কোন চাপা ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে। একটু আগ পর্যন্ত গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়লেও এখন মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। একটু পর পর কম বেশি হচ্ছে বৃষ্টির পরিমাণ। রেহান উঠে দাঁড়ালেও ইনায়া জেদ ধরে ওখানেই বসে রইলো।
-“সারারাত এখানে থাকবে?”
শান্ত নিস্তব্ধ পরিবেশে শুধু ঝুমঝুম বৃষ্টির আওয়াজ। ইনায়াও চোখটাও কেমন করে যেন পিটপিট করছে।

গাড়িতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে ইনায়া। এখনও কিছু পথ বাকি। ফোন বের করতেই সময় দেখে নিলো রেহান।রাত বারোটার কাছাকাছি সময়। ইনায়ার গায়ের তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে ইনায়াকে আর ডেকে তুললো না রেহান। কোলে নেয়েই গেটের সামনে যেতেই দেখে ইয়াসমিন আগে থেকেই গেটের সামনে অপেক্ষা করছে। খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে ওকে। ইয়াসমিন আগে থেকেই জানালা দিয়ে বাইরের দিকে লক্ষ্য রাখছিলো।

সেই রাতেই হাড় কাঁপিয়ে জ্বর এলো ইনায়ার। কোনমতে জামাকাপড় বদলেছে। ইয়াসমিন জোর করে ইনায়াকে কিছু খাইয়ে দিল। জ্বরের ঘোরে কী সব উল্টোপাল্টা বকছিলো। বলতে গেলে ইনায়াকে খাওয়াতে গিয়ে রেহান আর ইয়াসমিনকে একপ্রকার যুদ্ধই করতে হলো।

ঔষধ খেয়েই ঘুমে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে ইনায়া। রেহান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখে ইয়াসমিন বিছানার একপাশে বসে আছে অনেকটা ইতস্ততভাবে।
-“রেহান, একটু বাইরে আয়!”
এতটুকু বলেই ইয়াসমিন হনহন করে বেরিয়ে গেল। রেহান একনজর ঘুমন্ত ইনায়াকে দেখে ওর মায়ের পিছু পিছু গেলো।

ইয়াসমিন রেহানের চোখের দিকে পর্যন্ত তাকাচ্ছে না। প্রায় পাঁচ মিনিট নিরবতায় দাঁড়িয়ে থাকার পর রেহান নিজেই বলে উঠলো,
-“কিছু বলবে?”
রেহানের অধৈর্য কন্ঠে টনক নড়লো ইয়াসমিনের।
-“রাতে খেয়েছিস কিছু? যা টেবিলে বস, আমি খাবার আনছি!”

রেহান কিছুক্ষণ ইয়াসমিনের দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকালো। যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। রেহানের এই অবিশ্বাসের চাহনিকে উপেক্ষা করেই ইয়াসমিন নিজের হাতে রেহানকে খাইয়ে দিচ্ছে। আর রেহান চুপচাপ নিজের মায়ের গতিবিধি দেখছে। এমুহূর্তে রেহানকে দেখতে কোন ছোট বাচ্চার থেকে কম লাগছে না।

-“কোন সম্পর্কে কখনও জড়তার জায়গা দিতে নেই! নাহলে ধীরে ধীরে সবচেয়ে প্রিয় সম্পর্কেও মরিচা লাগতে সময় লাগে না! পারলে তোর মাকে ক্ষমা করিস!”
রেহান একদৃষ্টিতে ওর সামনে দাড়িয়েছিল থাকা ক্রন্দনরত মহিলার দিকে তাকিয়ে আছে। রেহানকে কিছু বলতে না দেখে ইয়াসমিন একহাতে চোখ মুছে যেতে নিলেই রেহান হুট করে জড়িয়ে ধরে ওর মাকে। কেউ কোন কথা বলছে না। অনেক দিন পর শুধু মন খুলে কাঁদতে ইচ্ছে করছে!
___________________________

সকালের দিকে জ্বর অনেকটাই কেটে এলো ইনায়ার। জেরিন আজ ড্রইংরুমে এক বস্তা বিস্ময় নিয়ে বসে আছে। ইয়াসমিন নিজের হাতে আজকে রেহানকে খাওয়াচ্ছে। শুধু জেরিন না বাকিদেরও একই অবস্থা!
-“আমি কী দোষ করেছি?”
রেহান ভ্রু কুঁচকে নাজনীনের দিকে তাকালো আর নাজনীন তাকিয়ে আছে ইয়াসমিনের দিকে। এদিকে রিয়াদও ফোন ঘাটতে ঘাটতে খাবার টেবিলে এসে বসলো,
-“কাল রাতে পাশের এলাকায় একটা লাশ পাওয়া গেছে!”
গম্ভীর কন্ঠ কানে এতেই সবার চোখ রিয়াদের দিকে গেলো।
-“তোর পরিচিত কেউ?”
প্রশ্নটা করলো জেরিন। রিয়াদ সচরাচর খাবার টেবিলে দরকার ছাড়া তেমন কথা বলে না। হঠাৎ করেই খানিকটা আশঙ্কা জমে গেলো সবার মনে। শুধুমাত্র ইনায়াই ওর মতো করে নিঃশব্দে খাচ্ছে। রিয়াদ ইনায়ার দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে বলে উঠলো,
-“লাশটা সাদাফের!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here