হতে পারি বৃষ্টি ❤️,পর্বঃ৮
লেখনীতেঃ মৌশ্রী রায়
জানো আব্বু-আম্মু,
আজ না আমার বিয়ে।এই এতগুলো বছর পরে হয়তো আমিও আবার একটা পরিবার পাব,যেখানে আমারও সবাই থাকবে।বাবা,মা,স্বামী। আমার নতুন সংসারের প্রতিটা ধাপে যেন আমি তোমাদের সম্মান রাখতে পারি আব্বু-আম্মু।আমার জন্য যেন তোমাদের কখনো লজ্জিত না হতে হয়।
জানো তো, আমার যার সাথে বিয়ে, তাকে না আমি আজ অবধি দেখিইনি,ওনার বাবা-মাই আমাকে ওনার জন্য পছন্দ করেছেন।কি অদ্ভুত তাইনা?আমার মতো একটা অনাথ মেয়েকে ওনারা নিজেদের বাড়ির বউ,নিজেদের ছেলের স্ত্রী করে নিয়ে যেতে চাইছেন!আমার কাছে কিন্তু পুরো বিষয়টাই একটা স্বপ্নের মতো আব্বু-আম্মু।
তবুও,এই স্বপ্নই আজ পুরণ হতে চলেছে। আমি এতে খুশি।খুব খুশি।তোমরা দেখ,আমি ওনাদের সবাইকে ভালোবাসব।ভীষণ বেশী ভালো।ওনারা আমার ভালোবাসার টানে আমায় ঠিক আপন করে নেবেন! তাইনা?
.
আমি আমার বাসরঘরে বসে আছি আব্বু-আম্মু।কিছুক্ষণ আগে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমিও এখন কারো বিবাহিতা স্ত্রী জানোতো!
এই রাতটা নিয়ে নাকি প্রতিটা মেয়েই অনেক স্বপ্ন সাজায়!
আমার তো ছোট থেকেই স্বপ্ন দেখা বারণ আব্বু-আম্মু। তবুও আমিও তো একটা মেয়ে।তাই স্বপ্ন দেখার লোভটা সামলাতে পারিনি।তাইতো বিয়ে ঠিক হবার পর থেকেই একটু একটু করে ঐ না দেখা মানুষ টাকে নিয়ে আমিও একটা গোটা স্বপ্নের রাজ্য সাজিয়েছিলাম। যে রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন উনি,আমার স্বামী।
তবে হয়তো আমার স্বপ্ন দেখাটা উচিত হয়নি বুঝলে!আমাদের মতো কিছু মানুষের কখনো স্বপ্ন বুনতে নেই।তাতে স্বপ্ন ভেঙে যাবার কষ্টটুকু ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়না।কিচ্ছু না।
এই দেখো না, আমিও তো আর পাঁচটা মেয়ের মতো, এই রাতটা ঘিরে,ঐ মানুষ টাকে নিয়ে কত স্বপ্ন বুনেছিলাম,লাভ কি হল তাতে?
সদ্য গড়া নতুন স্বপ্নের ভাঙা টুকরোয় কেবল আমার মনটা ক্ষত বিক্ষত হলো। আহত হলো।
উনি প্রথম রাতেই আমাকে বলে দিলেন,আমাকে উনি স্ত্রী হিসেবে মানেন না।আমাকে উনি বাধ্য হয়েই বিয়ে করেছেন,ওনার বাবা মায়ের ইচ্ছে রাখতেই নাকি এ বিয়েটাতে নিজেকে জড়ালেন।
কি আশ্চর্য বিষয় দেখ, যাকে নিয়ে আমার মনের মণিকোঠায় হাজারটা রঙিন স্বপ্নের জালপনা আঁকা ছিল তার মনে আমি কেবলই একটা বাধ্যবাধকতা হয়ে রয়ে গেলাম।
কেন বলোতো!আমার জীবনটাতেই কেন এমন হবে?
জানো!আজ এই প্রথমবার আমার মনে হচ্ছে, আল্লাহ যার ভাগ্যে শৈশবের সুখ লেখেন না,তার কপালে কোনকালেই সুখ থাকেনা।
আমার জীবনেও আর সুখ নেই আব্বু-আম্মু।স্বামী সংসার থেকেও আমার কিছুই নেই।
তাইতো প্রথমরাতেই স্বামীর বিছানা থেকে জায়গা পেলাম তার রুমের ব্যালকনিতে।
এমন কপাল কজনের হয় বল?
.
আজ আমার জীবনের আরো একটা নতুন মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি আব্বু-আম্মু।
কাল মাত্র বিয়ে করে যার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে এলাম, আজ জানতে পারলাম, আমি তার জীবনের প্রথম নারী নই।আমার আগেও, মুলত অনেক আগেই তার জীবনে অন্য কেউ ছিল।
রিধি আপু।হ্যাঁ আব্বু-আম্মু, আমি আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী, এটা আমার প্রথম বিয়ে হলেও ওনার দ্বিতীয় বিয়ে।
ওনার মন মস্তিষ্ক সবটা জুড়ে এখনো শুধুই রিধি আপুর বাস।তাতে যদিও আমার কোন কষ্ট নেই।ওনার মনে রিধি আপু চলে যাবার এতগুলো দিন পরেও যে রিধি আপুর প্রতি ওনার ভালোবাসা এতটুকুও কমেনি,তাতে আমার ওনার জন্য গর্ব হয় জানো তো!
কতজন এমন নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসতে পারে বলতো!
আমার স্বামী পারে,এটা তো আমার গৌরবই তাই না?
জানো,রিধি আপু আর ওনার ভালোবাসার একটা চিহ্ন আছে।মিষ্টি চিহ্ন। রায়া।
ওনাদের দুজনের মেয়ে।
সায়াহ্ন না রায়াকে একদমই সহ্য করতে পারে না।তবে উনি যে কারণে রায়ার ওপরে রাগ করে আছেন তা নিতান্তই নিরর্থক।আর এজন্যে নিজের অমন ফুটফুটে মেয়েটার থেকে দুরে সরে আছেন,এটা যে কতটা বোকামো তা উনি বুঝতে পারছেন না।
ওনার চোখে এখন সেই অকারণ রাগের পট্টিই যে বাঁধা।
তোমাদের তো বলাই হয়নি।আমাকে এ বাড়িতে বউ করে নিয়ে আসার মুল কারণ রায়া।ওকে ওর হারানো সব ফিরিয়ে দেয়াই আমার লক্ষ্য।
জানো,মেয়েটা আমাকে এত ভালোবাসে,বলে বোঝাতে পারবনা।
আমি কেউ না হয়েও ওর মা।মা হবার আনন্দটা কি তা আমি ওর থেকেই জেনেছি আব্বু-আম্মু।
তাই ওকে আমি সবটা ফিরিয়ে দেব।যেভাবেই হোক,যত দ্রুত হোক।তাতে আমাকে সবার চোখে যতটাই নিচে নামতে হোক,যতই ঘৃণা কুড়াতে হোক,তবুও আমি গোটা জীবনে যে অভাবটা নিয়ে বেঁচেছি সেই অভাবটা নিয়ে আমি আর আমার রায়াকে বাঁচতে দেব না।
ও ওর জীবনে সব খুশি পাবে।পরিবার,বাবা,মা সবার আদর পাবে।আমি পাইয়ে দেব।দিতেই হবে যে আমায় আব্বু-আম্মু!
তোমরা শুধু আমাকে দোয়া কর।
.
আজ আমি সারাদিন সায়াহ্ন কে প্রচুর জ্বালাতন করেছি গো।এতটা করা ঠিক হয়নি।মানুষ টার ওপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে।
ওনার সাথে অমনটা করা আমার উচিত হয়নি তাই না আব্বু-আম্মু!
আমার ওপরে উনি কি রেগে থাকবেন?আমি মনে মনে অনেকবার ওনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি আব্বু।ইশশশ!যদি উনি আমার মনের ভাষাটা পড়তে পারতেন।
তবে হয়তো আর আমার ওপর রেগে থাকতে পারতেন না।ঠক ক্ষমা করে দিতেন,তাইনা?
.
আমার আজ মরে যেতে ইচ্ছে করছে আব্বু-আম্মু।আমি বেঁচে থেকেও মৃত্যুর মতো যন্ত্রণা অনুভব করছি।কষ্ট হচ্ছে। কাছের কারো অবিশ্বাস বুঝি এতটাই কষ্ট দেয়?
জানো,আজ সায়াহ্ন আমাকে অবিশ্বাস করেছেন।
আমাকে স্বার্থপর,লোভী বলে চরম ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে আমায় দেখেছেন।
ওনার চোখের ঐ ঘৃণা,ঐ অবিশ্বাস দেখে আমার এমন মনে হচ্ছিল যেন কেউ একজন আমার বুকে ছুড়ি চালাচ্ছে।
এত দমবন্ধ আমার কখনো লাগেনি এর আগে।
অবিশ্বাসের কড়াল আঁচে আমি জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছি আব্বু -আম্মু।
তবুও আমি সবটা সহ্য করে নেব গো।ওনার অবিশ্বাস কুড়িয়ে হলেও রায়ার চোখে মুখে,বাবা-মায়ের চোখে মুখে আজ যে আনন্দের ছটা আমি দেখেছি তা যে আমার কাছে অমূল্য গো।
থাকলাম না হয় আমি আমার ভালোবাসার চোখেই ঘৃণার পাত্রী হয়ে।
তবুও আমার মেয়েটা তো সুখে থাকবে।
আর নিজের মেয়ে কে ফিরে পেয়ে সায়াহ্নও খুশিতে থাকবে।আমি জানি।
সবার আনন্দের কাছে আমার এটুকু কষ্ট কিছুই না।
আমার তো আজীবন না পেয়ে,হারিয়ে অভ্যেস আছেই বল।
এবার নাহয় ঘৃণাটাই পেলাম,তবুও ওদের সকলের খুশিতে আমি সব কষ্ট ভুলে থাকতে পারব।ঠিক পারব।
.
আব্বু-আম্মু,
জানো তো,আমাদের রায়া এখন খুব খুশি।সায়াহ্ন ওকে মন থেকে মেনে নিতে পেরেছে।আর ওর খুশিতে আমিও খুব খুশি। মেয়েটা যখন প্রাণখুলে হাসে,ছুটে গিয়ে ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে,আহ্লাদী হয়ে বাবার আদর কুড়ায়,তখন ওর চেহারায় যে উজ্জলতাটা ছড়িয়ে পড়ে তাতেই বোঝা যায় গো,যে ও কত খুশি।
সায়াহ্নও এখন মেয়েকে চোখে হারায়।হারাবেই তো,রক্তের টান যে,তাকে কি আর এড়ানো যায়।
বাবা মেয়ের সম্পর্ক, তাকে তো একনা একদিন ঠিক হতেই হবে বলো,তাই না?
আমার শুধু একটাই চাওয়া আব্বু-আম্মু, ওনার মনে কোথাও আমার জন্য একটুখানি জায়গা হোক।
রিধি আপুর জায়গা আমি কখনোই নিতে চাইনা।বরং,আমি চাই সায়াহ্ন ওনার মনে আজীবন রিধি আপুকে রেখে দিন।উনিই যে ওনার প্রথম ভালোবাসা।আমার মতো নতুন করে জীবনে আসা কারো জন্য সে ভালোবাসার স্থানচ্যুতি ঘটুক তা আমার কাম্য না আব্বু-আম্মু।
আমি শুধু চাই ওনার মনের খানিকটা অংশ নাহয় শুধুই আমার জন্য বরাদ্দ থাক।আমি নিজের জন্য কিছুটা জায়গা কি আদৌ কখনো পাব ওনার মনে?
মেয়েকে তার বাবা ফিরিয়ে দিতে যে ঘৃণার চাদরে নিজেকে আবৃত করেছি আমি,সেই চাদরের আড়াল সরিয়ে উনি কি কখনো আমাকে মেনে নিতে পারবেন?
ঘৃণারুপী মেঘেদের আড়াল থেকে আমার জন্য ভালোবাসার সূর্য কি কখনো উঁকি দেবে ওনার মনে?
কি জানি?
হয়তো না।
তবুও অপেক্ষা করব আমি।জানি এ অপেক্ষার হয়তো কোন শেষ নেই,তবুও শেষ অবধি অপেক্ষা করে যাব।
পরের পাতাগুলো ফাঁকা।আর হয়তো লেখা হয়নি।সায়াহ্নর চোখ ভিজে এসেছে।বরাবরই আসে।ঐশীর এই ডায়রিটা যতবারই পড়ে,ততবারই দৃষ্টি অবধারিত রুপেই সিক্ত হয়ে ওঠে তার।
আজ অষ্টমবারের মতো ঐশীর ডায়রিটা পড়ে দেখলো সায়াহ্ন। প্রতিবারের মতো ঐশীর অনুভুতির আঁচরগুলো তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল।প্রতিটা দৃশ্যমান শব্দ তার বুকে ঘটালো তীক্ষ্ণ রক্তক্ষরণ।
মেয়েটা যে ঠিক কতটা কষ্ট পেয়েছিল,তা যতবারই সায়াহ্নর মনে আসে,ততবারই তার নিজেকে বড্ড দোষী মনে হয়। মনে হয় কেন আরেকটু আগে সে সবটা ঠিক করে নিতে পারলো না।কেন সবটা সাজানোতে তার এতটা দেরী হয়ে গেল।
আরেকটু আগে সবটা বুঝতে পারলে জানতে পারলে হয়তো সবটা অন্যরকম হত।সবটা।
সায়াহ্নর ভেজা চোখের কার্ণিশ বেয়ে জল গড়ালো।সে সাথে সাথে তা মুছে নিল।
তার চোখে যে জল মানায় না।সে যে ঐশীর মতো একটা মেয়ের স্বামী।
যে কিনা জীবনের যে কোন পরিস্থিতিতে অবাধে হাসতে পারে।কোন মতেই যার ভেজা চোখ কেউ দেখেনি।
তার স্বামী হয়ে এভাবে অশ্রু বিসর্জন করা সায়াহ্নর কি সাজে?একদম না।
সায়াহ্নর একটাবার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হল, ঐশীর মনের ইচ্ছে পুরণ হয়েছে। তার অপেক্ষার প্রহর সমাপ্ত হয়েছে,সার্থক হয়েছে তার করা অপেক্ষা। সায়াহ্নর মনে এখন শুধুই ঐশীর জন্য একান্ত কিছু স্থান আছে,রয়েছে একান্ত কিছু অনুভুতি।রিধির প্রতি থাকা সব অনুভূতিকে সম্মান করেই সায়াহ্ন এখন মন থেকে ভালোবাসে ঐশীকে।খুব ভালোবাসে।
তবে এখন যে উপায় নেই।চাইলেও যে ঐশীকে আর সে জানাতে পারবেনা সবটা।
আচ্ছা, কেন হল আজ সবটা এমন।এতটা এলোমেলো হয়ে যাওয়ার কি খুব প্রয়োজন ছিল সবটা?
কে জানে?
সায়াহ্নর ভাবনার মাঝেই তার সামনে এসে দাঁড়ালো নয় বছরের একটি বাচ্চা।পরনে তার সাদা জামা।মাথার চুল খোলা।সায়াহ্ন অদ্ভুত চোখে লক্ষ্য করলো, তার রায়ার চোখে মুখে একদম অবিকল ঐশীর ছোঁয়া।কি আশ্চর্য, ঐশী তাকে পেটে ধরেনি,জন্ম দেয়নি,তবুও রায়াকে দেখলে বোঝাই যায় না যে সে ঐশীর মেয়ে না।
হয়তো আত্মার বন্ধন ঠিক এমনটাই হয়।ঠিক এমনটা।
রায়া চোখ পিটপিট করে হাসি মুখে সায়াহ্নর দিকে চেয়ে বলে উঠল,
“বাবা,আজ তো মায়ের জন্মদিন।তুমি এখনো এখানে বসে আছো কেন?তুমি কি ভুলে গেছ, আজ আমাদের মায়ের অ্যাডাপশন হোমে যাবার কথা।তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও না।প্লিজ!”
সায়াহ্ন হাসলো।মাথা নেড়ে মেয়ের কথায় সম্মতি জানাতেই মেয়ে চলে গেল।সায়াহ্নর বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো একটা দীর্ঘশ্বাস।
সে ধীর পায়ে উঠে রেডি হয়ে নিল।সাদা পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা।
বাড়ি থেকে বেরোনোর পথে চোখে পড়লো,বাগানের কোণায় থাকা কামরাঙা গাছটা।আর তাতে বাঁধা সেই দোলনা।ঐশীর নিজের হাতে বাঁধা এটা।
সায়াহ্ন অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো,ঐশীর ছোয়া লাগা প্রতিটা জিনিস,তার প্রিয় সবকিছু আজো এ বাড়িতে একদম নতুনের মতো আছে।এমনকি সে নিজেও।শুধু সেই মেয়েটাই নেই।
কেন?
খুব কি ক্ষতি হত আজ ঐশী থাকলে?
সায়াহ্ন আর ভাবলো না।রায়ার হাত ধরে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে গেল অনাথ আশ্রমের উদ্দেশ্যে।।
চলবে