সোনালী রোদ্দুর,পর্ব_১

0
5568

সোনালী রোদ্দুর,পর্ব_১
ফারজানা আফরোজ

প্রেগনেন্সির রিপোর্ট হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে আছি। দু-চোখের পানি যেন বন্যা হয়ে নেমেছে। সামনে থাকা লোকটির কোনো সাড়া শব্দ নেই। আমার কান্না যেন তার ভীষণ শান্তি। ডান হাতে ডিভোর্স লেটার বাম হাতে প্রেগনেন্সির রিপোর্ট নিয়ে ফ্লোরে বসে আছি। সামনে থাকা লোকটি হলো আমার হাজব্যান্ড। ও আমার কাছ থেকে প্রেগনেন্সির রিপোর্ট কেড়ে নিয়ে পড়তে লাগলো।

” দুই মাস চলছে। শুনেছি স্ত্রী প্রেগনেন্ট থাকলে ডিভোর্স হয় না। সমস্যা নেই, যেদিন বাচ্চাটা দুনিয়াতে আসবে সেদিন তোমার কাছ থেকে মুক্তি নিবো। আপাতত পেপারটি রেখে দাও। আর একদম আমাকে বিরক্ত করবে না।”

_________

” তোমাকে কতবার বলেছি আমি বিবাহিত তবুও কেন বিরক্ত করছো, আবির?”

ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলো আবির,

” তোমাকে ভালোবাসি সেই-জন্যই তো বিরক্ত করছি। আগে তো তুমিই আমায় বিরক্ত করতে, সব সময় বলতে বিয়ে নাকি আমাকেই করবে তাহলে এখন কেন দূরে সরে যাচ্ছো।”

” দোষটা তোমারই ছিলো। অতীত নিয়ে আমি আর ভাবতে চাই না। লোকে বলে, মহান আল্লাহ তায়ালা যা করেন ভালোর জন্যই করেন। সেদিন তুমি যদি আমায় ফিরিয়ে না দিতে তাহলে নীলাদ্রির মতো কাউকে আমি পেতাম না। ওর মতো একজন হাজবেন্ড পেয়ে সত্যিই আমি ভাগ্যবতী।”

মুখের কোণায় এক চিলতে হাসি দিয়ে বলল রিয়া। কিছুক্ষণ হাসিটার দিকে তাকিয়ে থেকে আকাশ পানে তাকালো আবির। চোখ দুটি বন্ধ করে গম্ভীর স্বরে বলল,

” আগেও তুমি আমার ছিলে আজও থাকবে এমনকি ভবিষ্যতেও থাকবে।”

এক আকাশ বিরক্তি নিয়ে হাঁটা দিল রিয়া। সে চায় না আবারো আবিরের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়তে। যতই ভালোবাসুক কিন্তু সে তো এখন অন্যজনের বিবাহিতা স্ত্রী। নীলাদ্রিকে কিছুতেই সে ঠকাতে পারবে না আবার আবিরের কাছেও দিনদিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। কয়েক কদম হাঁটার পর কারো স্পর্শে দাঁড়িয়ে পড়লো রিয়া। আবির তার হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরেছে। নিজেকে শক্ত করে রাগী কণ্ঠে বলল,

” রাস্তাঘাটে কি ধরনের ফাজলামি হচ্ছে আবির? জানো আমার শ্বশুর বাড়ির কেউ দেখলে কি হতে পারে আমার?”

” তোমাকে আমি বিয়ে করতে চাই।”

” বিয়ে আমার হয়ে গেছে। দয়া করে শান্তিতে সংসার করতে দাও আমাকে প্লিজ। তোমার এই কান্ডগুলো ভীষণ সমস্যা দিচ্ছে আমাকে। আমি মুক্তি চাই।”

” মুক্তি তাও আবার আমার কাছ থেকে? এই জীবনে কোনদিন পাবে আশা করছো?”

চোখ বন্ধ করে আবারো নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো রিয়া। তার বলতে বড্ড ইচ্ছা যে, আবির আমার হাত দুটো তুমি এইভাবে শক্ত করে ধরে রেখো কোথাও যেতে দিও না প্লিজ কিন্তু নীলাদ্রির মায়ায় পরে, সে মুখে কথাগুলো বলতে পারছে না। সে জানে, দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা যায় না তবুও কিছুই করার নেই তার। পাঁচ বছর ধরে যাকে মনে প্রাণে ভালোবেসেছিলো তাকে এত সহজে কি ভুলে যাওয়া সম্ভব? ফোনটা বেজে উঠল রিয়ার। নীলাদ্রির নাম ভেসে আসাতে পুরোনো অতীত ভুলে যাবার নাকোচ অভিনয় করলো আবিরের সামনে,

” আমি আসছি বাবু, একটু ওয়েট করো। কিহহ আমার জন্য সারপ্রাইজ রেডি করেছো। আই অ্যাম সো এক্সাইটেড জান।”

ফোনটা কেটে দিয়ে মুখের কোণায় হাসি রেখে বলল রিয়া,

” আমার হাজবেন্ড আমার জন্য অপেক্ষা করছে। যেতে হবে আমাকে। তুমি নিজের জীবনে কাউকে খুঁজে নিও।”

চলে গেলো রিয়া, আবির রিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে চুপচাপ কাঁদতে লাগলো। রিয়ার কথাগুলো আজ তার বুকে তীরের মতো বেঁধে গিয়েছে। সে জানে, আজ রিয়ার পরিবর্তনের কারণগুলোর জন্য দায়ী সে নিজেই।

হঠাৎ কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে পিছনে ঘুরে মাহিম,রাজু, নিশীতা, তারিনকে দেখতে পেয়ে কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলল,

” তোরা এইখানে?”

রাগী দৃষ্টিতে তাকালো নিশীতা। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,

” কেন নষ্ট করতে চাচ্ছিস রিয়ার সংসার। সে তো ভীষণ সুখে আছে চাস না ও ভালো থাকুক।”

” ওকে ছাড়া আমি ভালো থাকবো না সেইজন্যই তো ওকে আমার হতেই হবে নিশু। নিজের কষ্টের কথা আগে ভাবা উচিৎ পরে না অন্যের কথা ভাববো।”

হতাশ হয়ে রাজু বলল,

” জানিস না আবেগ এইসব পছন্দ করে না। যদি জানে তুই আবারো রিয়াকে বিরক্ত করছিস তাহলে কিন্তু যুদ্ধ লেগে যাবে। ওর রাগ সম্পর্কে তোকে কিছু বলতে হবে না সব কিছুই তো জানিস।”

‘আবেগ’ নামটি শোনে কিছুটা শান্ত হলো আবির। তাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে আবেগ সবার থেকে আলাদা। হাসি খুশি থাকলেও তার রাগটা খুবই বেশী। রাগ উঠলে বন্ধু কি ভাই কিছুই তার মাথায় থাকে না। আবেগ চায় না আবির বারবার রিয়ার কাছে গিয়ে অপমানিত হোক। বন্ধুর অপমান মানে তারও অপমান। রিয়ার হাজবেন্ড একবার আবিরের গায়ে হাত তুলেছিল তার পরের দিনই রিয়ার হাজবেন্ডকে হসপিটালে পাঠিয়ে বলেছিল,

” শুধু মাত্র রিয়ার হাজবেন্ড বলে বেঁচে গেছিস। আবার যদি আমার বন্ধুর গায়ে হাত তোলার সাহস দেখিয়েছিস সেদিন আমি সত্যিই ভুলে যাবো তুই রিয়ার হাজবেন্ড, মাইন্ড ইট।”

তড়িঘড়ি করে তারিন বলে উঠলো,

” তাড়াতাড়ি চল, আবেগ ওয়েট করছে। জানিস না আজ কলেজে ভর্তি পরীক্ষা। শালা একটা বন্ধু পাইছি এই জীবনে, কাজ করাতে করাতে জীবন তেজ পাতা বানিয়ে ফেলতেছে। আগে জানলে আবেগ শালাকে সাবেগ বানিয়ে কলেজ থেকে বিতাড়িত হতাম।”

তারিনের কথা শোনে হেসে দিলো সবাই। পা চালিয়ে কলেজের ভিতরে চলে গেলো। কাজে যদি সমস্যা থাকে তাহলে আবেগ তাদের লবণ মরিচ ছাড়াই চিবিয়ে খাবে।

প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা সেইজন্য প্রচুর কাজ করতে হচ্ছে তাদের। সিট লাগানো থেকে শুরু করে কাগজপত্র সবই দায়িত্ব আবেগের। টপ স্টুডেন্ট ও কলেজ সভাপতির ছেলে হওয়াতে তার সম্মান অনেক উঁচুতে। এক নামেই চিনে জানে সবাই তাকে।

__________

তীব্র রোদের উজ্জ্বল সোনালী তাপে স্পর্শীর ফর্সা শরীর লাল হয়ে গেলো। বিরক্তি নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

” এত রাগ কেন তোমার সূর্য মামা? দেখছো একটা বাচ্চা মেয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে তাহলে তাকে কেন বিরক্ত করছো? একটু ছায়া দিতে পারছো না?”

কল্পনার জগৎ দিয়ে ভাবছে স্পর্শী, সূর্য মামা বলছে তাকে,

” তোমাকে বিরক্ত করতে ভীষণ ভালো লাগে পিচ্চি। যখনি দেখি তোমার কালো সোনালী চুলগুলো চকচক করছে তখন কেন যেন ইচ্ছা করে তোমার গায়ে তীব্র রোদের উজ্জ্বল সোনালী তাপ মেখে দিতে। অন্যদের আমি দেই গরম তাপ আর তোমাকে দেই সোনালী রোদ্দুর।”

অভিমানী সুরে বলল,

” লাগবে না আমার সোনালী রোদ্দুর। জানো আজ আমার পরীক্ষা আর তুমি কি না আমাকে রোদে পুড়িয়ে কয়লা বানিয়ে ফেলছো। যাও আড়ি তোমার সাথে। বাজে মামা।”

কল্পনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে হাত ঘড়ির দিকে তাকালো স্পর্শী। সময় আছে ত্রিশ মিনিট তাই পা চালিয়ে দ্রুত হাঁটতে গিয়ে রাস্তায় পরে থাকা কোকের বোতলে পা লেগে হোচট খেয়ে পরে যেতে গিয়েও পড়লো না সে। নিজেকে কন্ট্রোল করে পা জড়িয়ে ধরে দুম মেরে বসে পড়লো। এক রাজ্যর বিরক্তি নিয়ে বলল,

” আজ কপালটাই খারাপ আমার। না জানি কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠছিলাম। আরেহ আমি তো সকালে আজ আয়নায় নিজের মুখেই দেখেছি।”

কথাগুলো বলে নিজের মুখ নিজেই চেপে ধরলো স্পর্শী। হতাশ মাখা কন্ঠে বলল,

” আমার মুখ দেখে কোথাও গেলে শুনেছি ভালো হয় তাহলে আজ কেন আমার খারাপ হলো? দোষ তো আমার না , দোষ তো সেই লোক যে এই বোতল এইখানে ফেলে গিয়েছে। কোন হতচ্ছাড়া যে এই বোতল এইখানে ফেলে গিয়েছে তাকে সামনে পাইলে বিনা টিকিটে উগান্ডায় পাঠিয়ে দিতাম। ময়লার ঝুড়িতে কি হাত যায়নি শালা উজবুক।”

বকতে বকতে বোতলটা ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিল স্পর্শী। আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলো কলেজের উদ্দেশ্য। আজ যে তার কপালটা ভীষণ খারাপ কলেজে প্রবেশ না করলে হয়তো জানতেই পারতো না। সখ করে সাদা রঙের জামা পরে এসেছে আজ কিন্তু সেই সাদা রঙের জামা যে তার লজ্জা ও অস্বস্তির কারণ হবে কে জানতো?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here