সোনালী রোদ্দুর,পর্ব_২
ফারজানা আফরোজ
স্পর্শী যখন গেট দিয়ে কলেজে প্রবেশ করছিল তখন পাশ থেকে কেউ একজন তার গায়ে পানি ঢেলে দিয়েছে। সাদা রঙের জামা ভিজে একদম বাজে রকমের পরিস্থিতির মধ্য পড়লো স্পর্শী। পাতলা সাদা ওড়না দিয়ে শরীর ঢাকার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো। চার পাশের লোকজন চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে দেখে প্রায় কান্না করে দিচ্ছে সে। এই কাজটা কে করেছে বুঝার জন্য যে পাশ থেকে পানি এসেছিল সেখানে তাকিয়ে দেখলো একটি ছেলের হাতে পানির বোতল। ছেলেটি বোতল ঝাঁকাচ্ছে আর কিসব বলে হাসছে। ছেলেটির সাথে দুইজন মেয়ে, তিনজন ছেলে। এই অবস্থায় ওদের সামনে যাওয়া মানে নিজেকে আরো ছোট করা তাই সেখান থেকে দ্রুত পা চালিয়ে বারান্দায় যেতে লাগলো স্পর্শী। গ্রীলের ধারে দাঁড়িয়ে ভাবছে ক্লাসে ঢুকবে কিনা। একবার শরীরের দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠলো। ডান পাশটা একদম ভিজে গিয়েছে তার উপর সাদা জামা। হঠাৎ একজন ছেলে এসে সূতির ওড়না এগিয়ে দিয়ে বলল,
” মানুষ দেখছে, ওড়নাটা জড়িয়ে নেও।”
ছেলেটি কে? কেন সাহায্য করছে? কি করতে এসেছে তখন স্পর্শীর মাথায় এইসব নেই। সে হাত থেকে ওড়নাটা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে ধরে মিষ্টি হেসে বলল,
” থ্যাংক ইউ।”
ছেলেটি হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” আমি উল্লাস। ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছি।”
” আমি স্পর্শী। আমিও ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছি।”
” বাহ। তাহলে দেখছি সেম এজ আমাদের। ”
কথা বলতে বলতে তারা ক্লাসের উদ্দেশ্য হাঁটা দিল। ক্লাসে গিয়ে দেখলো উল্লাস স্পর্শীর পিছনের সিটে পড়েছে। আবারো হেসে উঠলো দুইজন। ভ্রু জোড়া কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো স্পর্শী,
” তুমি ওড়না নিয়ে কি করছিলে? হাফ লেডিস?”
জিভে কামড় দিয়ে বলল উল্লাস,
” ছিঃ কি বলছো এইসব? ওড়না আম্মুর জন্য কিনে ছিলাম। আসার পথে আম্মু বলে দিয়েছিল তার জন্য বাসন্তী রঙের ওড়না নিয়ে যেতে। ভাবলাম পরীক্ষার আগেই কিনে নিয়ে যাই যদি পরীক্ষা খারাপ হয় তাহলে কিনতে ভুলে যাবো। একদিকে ভালোই হলো কি বলো?”
” হ্যাঁ। আমার উপকারে আসলো।”
তাদের দুজনের কথার মাঝে উপস্থিত হলো একজন মেয়ে। গায়ে নীল জামা, চোখের মণি নীল। স্পর্শীর কাছে মনে হলো জীবন্ত এক নীল পুতুল। বড় বড় চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল,
” কি হয়েছে তোমার?”
কষ্ট মাখা কণ্ঠে বলল মেয়েটি,
” আম্মুকে বলেছি পড়তে ভালো লাগে না বিয়ে-টিয়ে দিয়ে দাও তবুও সে আমাকে পড়াতে চায়। এত পড়ে কি করবো আমি?”
মেয়েটির কথা শোনে ভীষণ বিরক্তবোধ করলো উল্লাস। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” একটা প্রেম করে পালিয়ে যাও সমস্যা শেষ।”
” ধ্যাত! পালিয়ে বিয়ে করলে মজা হয় না। আমার ভীষণ ইচ্ছা আমার বিয়েতে আমি ‘ আমার সাইয়া সুপার স্টার’ এই গানে ড্যান্স করবো।”
উল্লাস কিছু না বলে স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
” পাগলা গারদ থেকে পালিয়ে এসেছে এই মেয়ে।”
স্পর্শী হেসে দিয়ে বলল,
” কি যে বলো, আমি তো ভীষণ খুশি। আমার মত কাউকে যে প্রথম দিনই খুঁজে পেয়ে যাবো আমি তো ভাবীই নি।”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো উল্লাস। আমতা আমতা করে বলল,
” মানে?”
” আমারও তো পড়তে ইচ্ছে করে না শুধু আব্বু আম্মু জোর করছে বলেই পড়ছি।”
” বাহ ভালো যাও নিজের মতো সঙ্গিনীর সাথে বসে একটু আলাপ আলোচনা করো কিভাবে পড়ালেখা বাদ দিয়ে বিয়ে করা যায়।”
উল্লাসের কথা শোনে তাকালো মেয়েটির দিকে। মেয়েটি হাতের নখ কামড়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। স্পর্শী বলল,
” কি হলো তোমার তাছাড়া নাম কি?”
” নীলিমা। জানো আমি কিছু পড়িনি কিন্তু আব্বু বলেছে যদি চান্স না পাই তাহলে মাছ ব্যাবসায়ীর সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে। আমি মাছের গন্ধ নিতে পারি না।”
” চিন্তা করিস না। যেটা পারবি না বিড়বিড় করে বলবি বলে দিবো। তুই করে বলার জন্য অবাক হচ্ছিস তো আসলে তুই যে আমার কার্বন কপি এই জন্যই তো তুই করে বলছি।”
নীলিমা জড়িয়ে ধরে বলল,
” লাভ ইউ নিউ কার্বন কপি দোস্ত।”
উল্লাস ওদের দুইজনের দিকে তাকিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে পড়তে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। নীলিমা মুখ ভেংচি কেটে সামনের সিটে বসে পড়লো।
নীলিমা বসেছে সামনে তারপর স্পর্শী আর তার পিছনে উল্লাস। ভালোভাবেই পরীক্ষা দিতে লাগলো তারা।
______________
আবেগ সেই কখন থেকে রেগে আছে। রাগের কারন হলো, কেন রিয়ার সাথে দেখা করলো আবির। আজ থেকে ছয় মাস আগে রিয়া একটু ভালোবাসার জন্য পায়ে ধরেছিল আবিরের কিন্তু সেদিন আবির হেসে হেসে বলেছিল,
” তোমার জন্য আমার মনে কোনো ফিলিংস নেই। ভালোবাসার ক্ষেত্রে ফিলিংস থাকা জরুরি যেহেতু নেই সেহেতু বিয়ে করে মুক্তি দাও আমাকে।”
রিয়া দিয়েছিল সেদিন মুক্তি কিন্তু আবির রিয়ার বিয়ের পর বুঝতে পারে সে রিয়াকে ভালোবাসে। এতদিন যে ফিলিংস এর অভাবে রিয়াকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল সেই ফিলিংস এখন রিয়ার জন্য ভরপুর হয়ে উঠেছে। কিন্তু এখন কিছুই করার ছিল। রিয়া এখন বিবাহিত।
আবির আবেগের কাঁধে হাত রেখে বলল,
” কোনোদিন প্রেমে পড়েছিস যে বুঝবি ভালোবাসার মানুষকে না পেলে কতখানি কষ্ট?”
” শোন তোর মত বিবাহিত মেয়ের প্রেমে পড়বো না আমি। আমি যাকে বিয়ে করবো সে হবে আমার উপযোগী। ”
তারিন চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
” দোস্ত তোর আর এই জীবনে বিয়ে হবে না আর আমরাও তোর বউ দেখতে পারবো না। তোর মত রোবটের কাছে কেউ মেয়ে বিয়ে দিবে না।”
মাথা ঝাঁকিয়ে হাসলো আবেগ। কথা এড়িয়ে বলল,
” পরীক্ষা কি শেষ?”
নিশীতা বলল,
” হুম, প্রায় শেষের পথে। পুলাপান সব বেরিয়ে পড়ছে পরীক্ষা দিয়ে।”
পুলাপান শব্দটি শোনে সবাই হেসে দিলো।
______________
উল্লাস আর স্পর্শী পরীক্ষা শেষ করে ক্লাস থেকে একসাথে বের হলো। এই কয়েক ঘণ্টায় ওরা তুমি থেকে তুই এ পরিণীত হলো। স্পর্শী বুঝলো উল্লাস ভালো একজন ছাত্র। পড়ালেখা ছাড়া মাথায় তার কিছুই নেই। দুইজন কিছুক্ষণ হাঁটার পর তাদের সাথে যোগ হলো নীলিমা। নীলিমাকে দেখে এক রাশ বিরক্তি প্রকাশ করলো উল্লাস। মনে মনে বলল,
” এসে গেছে নীল চোখা। দেখলেই তো ভুত ভুত মনে হয়। আমি এখন একলা থাকলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতাম।”
স্পর্শী আর নীলিমা কথা বলছে উল্লাস শুধু শুনছে। হঠাৎ স্পর্শীর চোখ মাঠের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা কিছু ছেলে মেয়ের উপরে পরে সাথে সাথে রাগ যেনো তার আকাশ ছোঁয়া ধারণ করে। হাতের ফাইল উল্লাসের হাতে দিয়ে নীলিমার পানির বোতলটা কেড়ে নিয়ে জোরে হাঁটতে থাকে। ওইখানে পৌঁছে যে ছেলের হাতে পানির বোতল দেখেছিল তার গায়ে পানি ঢালতে লাগল।
আচমকা আবেগের গায়ে পানি আসাতে সে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো স্পর্শীর উপর। এক রাজ্যর বিরক্তি ও রাগ নিয়ে কটমট করে বলল,
” এই মেয়ে সমস্যা কি? পানি ঢাললে কেন?”
” সকালে আপনি আমাকে ভিজিয়েছেন এখন আমি ভিজিয়ে দিলাম শোধ বোধ হয়ে গিয়েছে।”
” সাহস তো দেখছি খুব বেশি? জানো আমি কে?”
” কেন আপনি জানেন না আপনি কে? দাঁড়ান মাইকিং করে বলছি আপনি কে?”
উল্লাস আগে থেকেই চিনতো আবেগকে। ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলে স্পর্শীর হাত টেনে বলতে লাগলো,
” পানিতে থেকে কুমিরের সাথে লাগতে এসেছিস জানিস উনি কে? উনি চাইলে এক্ষুনি তোকে কলেজ থেকে বের করে দিবে।”
ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল স্পর্শী,
” ওকে বের করে দিক। আমি অন্য কলেজে গিয়ে ভর্তি হবো তবুও ভয় পাবো না।”
উল্লাস স্পর্শীর কথা শোনে তাকালো আবেগের মুখের দিকে। সে যে রেগে আগুন হয়েছে ভালোই বুঝা যাচ্ছে। নীলিমা স্পর্শীর কানে বিড়বিড় করে বলল,
” চলে আয় তা-নাহলে খুন হয়ে যাবি।”
স্পর্শী তাকালো আবেগের চোখের দিকে। এইবার সত্যিই সে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো। কখনো এমন রাগী চোখ সে দেখেনি তবুও সাহস জুগিয়ে বলল,
” ওকে যান আজকের জন্য ক্ষমা করে দিলাম। অন্য কোনোদিন যদি দেখি আমার গায়ে পানি ঢেলেছেন তাহলে আপনাকে উচিৎ শিক্ষা দিবো।”
সেদিনের মতো ভালোভাবেই বাসায় ফিরে স্পর্শী। আবেগ যে তাকে কিছু বলেনি সেই বিষয়ে ভীষণ চিন্তিত সে। নীলিমা ও উল্লাসের মুখ থেকে শুনেছিল ছেলেটি ভীষণ জেদি , কেউ যদি তাকে কিছু বলে তাহলে তাকে খুন করলেও তার হাত কাঁপে না। কিন্তু তাকে কেন কিছু বলেনি সেই চিন্তায় রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেলো তার।
চলে গেলো অনেকগুলো দিন। রেজাল্টের দিন চলে আসলো। ভাগ্য ভালো থাকায় উল্লাস, নিলীমা এবং স্পর্শী একই বিভাগে চান্স পেয়েছে।
ভর্তির পর কলেজে প্রথম দিন খুব সুন্দর করে সেজে গেলো স্পর্শী। এত বড় কলেজে চান্স পাওয়া যে সে কথা নয় তবুও সে চান্স পেয়েছে যাকে বলে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া। হেঁটে হেঁটে যখন যাচ্ছিল তখনি চারজন ছেলে তার পথ আটকালো। চারজন ছেলে আর কেউ নয় তারা হলো, আবেগ,আবির, রাজু, মাহিম। ভয়ে ভয়ে সালাম দিলো স্পর্শী,
” আসসালামু আলাইকুম ভাইয়ারা কেমন আছেন?”
রাজু তখন এক পলক পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
” সেদিনের বাঘিনী আজ বিড়ালনি হয়ে গেলো। আমি ভাবছিলাম আজ সে বাঘিনীর চেয়েও কিছু হবে।”
স্পর্শী বুঝলো এইবার তাকে ক্ষমা চাইতে হবে কারণ এদের সাথে লাগলে কপাল তার নিজেরই পুড়বে তাই ইনোসেন্ট মার্কা মুখ করে বলল,
” সরি সেদিনের ব্যাবহারের জন্য। প্লিজ ক্ষমা করে দিন। ছোট বোন হিসেবে তো এইটুকু ভুল করতেই পারি তাই না?”
আবেগ কিছু বলল না, আবিরকে ইশারা করার
সাথে সাথেই আবির সেখান থেকে চলে গেল। রাজু আর মাহিম তখন ডেভিল হাসি দিয়ে বলল,
” মামা মেয়েটা কিন্তু হেব্বি জোস।”
আবেগ তখন বলল,
” আজ এই জোস মেয়েকেই আমি জুস বানিয়ে ফেলবো। সাহস কত সেদিন পুরো কলেজের সামনে আমায় শাসিয়ে গিয়েছিল। এতদিন কিছু বলিনি এর মানে এই না আমি ভুলে গিয়েছি। আজ থেকে শাস্তি হবে ওর। কলেজে আসলে শাস্তি, না আসলেও শাস্তি, হাঁটতে গেলেও শাস্তি। আজকের পর থেকে এই মেয়ের কপালে সুখ বলে আর কিছু থাকবে না। প্রতিদিন কাঁদতে হবে ওকে।”
এরই মধ্যে আগমন ঘটে আবিরের। শিস বাজিয়ে চিল্লিয়ে বলল,
” মাম্মা রেডি!”
চলবে,