অঙ্গারের নেশা,পর্ব-২৯,পর্ব -৩০ (শেষ পর্ব প্রথম অংশ)

0
2840

অঙ্গারের নেশা,পর্ব-২৯,পর্ব -৩০ (শেষ পর্ব প্রথম অংশ)

পর্ব-২৯
সুফিয়ানের কথায় প্রতুত্তর করতে পারলো না প্রানেশা।
এতক্ষণের সকল ক্ষোভ যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। সুফিয়ান যেনো তার দোষ গুলো তার চোখের সামনে তুলে ধরলো ৷ ঠিকই তো বলেছে সুফিয়ান!
না জেনেই হোক রেয়ানের সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিলো সে। প্রানেশা যেমন সত্যি জানতো না তেমন
সুফিয়ানও ধোঁয়াশায় ছিলো। সে হিসেবে দুজনেই বরাবর অপরাধী৷
সুফিয়ান যখন বুঝতে পারলো প্রানেশার মন শান্ত হয়ে এসেছে, তখন নিজের দিকে ফেরালো। প্রানেশার চোখ বেয়ে অশ্রুর সাড়ি। সুফিয়ান মৃদু কন্ঠে বললো-

‘সরি প্রাণ, আমি পুরনো কথা বলতে চাইনি। আই এম সো সরি ‘

প্রানেশা আচমকা সুফিয়ানের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে হুহু করে কেঁদে উঠলো। সুফিয়ান তাল সামলাতে না পেরে খাটে বসে পড়লো। প্রানেশা কেঁদেকেটে নিজের অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। সুফিয়ান অস্থির ভাবে বললো –

‘আহা! আর কাঁদে না প্রানেশ্বরী। অসুস্থ তো তুমি ‘

প্রানেশা হেঁচকি তুলে ফেলেছে । হেঁচকিতে আটকে আটকে বললো –

‘সব আমার দোষ। আমার ওমন করা উচিত হয়নি। কিন্তু বিশ্বাস করুন আপনাকে হঠাৎ ওই অবস্থায় দেখে আমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছিলো৷ পৃথিবীটা অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছিলো। খুব ভালোবাসি আপনাকে।’

সরল স্বীকারোক্তিতে সুফিয়ানের মন ভালো লাগায় ভরে গেলো। সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি তো হবেই। কিন্তু তা নিজেদেরই মিটিয়ে নিতে হবে। একজনের অভিমান হলে আরেকজনের মাথা নত করতে হবে। ইগো বজায় রাখতে গিয়ে অনেক সময় সম্পর্কে ফাটল ধরে। অথচ,সম্পর্কের একটুখানি যত্ন নিলে তা নতুনত্ব বরণ করে নেয়। এখন প্রানেশা যদি অবুঝের মতো নিজের রাগ বজায় রেখে চলে যেতো তাহলে এত দিনের সুন্দর ভালোবাসাময় সম্পর্কটা ভেঙ্গে খানখান হয়ে পড়তো।

সুফিয়ান প্রানেশার কান্নামাখা মুখ আর সহ্য করতে পারলো না। তাই বললো-

‘ প্রাণ, মেয়েগুলোর কারো সঙ্গেই আমার শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয়নি ‘

প্রানেশা কান্নার মাঝেই চমকে তাকালো। সুফিয়ান স্মিত হেসে প্রানেশার চোখ মুছে নিয়ে কপালে গাঢ় চুমু
খেয়ে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো-

‘ইভানান আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করতো যে মেয়ের নেশা মেয়ে দিয়ে কাটবে। প্রথমে আমি রেগে গেছিলাম। কিন্তু বন্ধুর উপর বিশ্বাস করে পরবর্তীতে রাজি হই। মেডিকেলে পড়াশোনা করে, ক্লাবে ড্রিংকস করার পরও যখন তোমাকে না পাওয়ার বিরহে কাতর হয়ে উঠতাম তখন ইভানান সুযোগের সৎ ব্যবহার করে আমার রুমে ক্লাবের একটা ড্যান্সারকে পাঠায়। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের অধিকারী। আমার মনে হয়েছিলো আমি হয়তো তোমার জ্বালানো আগুন নিভাতে সক্ষম হবো ৷ অথচ কাছে আসার পর আগুন যেনো আরও বেশি পুড়াতে শুরু করলো আমাকে। মেয়েটার পর আরও অনেক সুন্দর মেয়েকে আমার রুমে পাঠাতো ইভানান। কিন্তু কোনোভাবেই আমি ওদের খুব কাছে যেতে পারিনি। তোমার ভালোবাসা আমায় যেতে দেয়নি প্রাণ। ‘

প্রানেশার চোখ মুছে সুফিয়ান বললো-
‘বসো, সকালে বমি করে সব ফেলে দিয়েছো। খাবার খেয়ে আবার কেঁদো ‘

বলেই রসাত্মক হেঁসে খাবার আনতে চলে গেলো। প্রানেশা বিস্ময় নজরে তাকিয়ে রইলো। এই মানুষটা কতটা ত্যাগ করেছে তার জন্য। আর সে কিনা টেরও পায়নি। এত আঘাতের পরও তাকে ভালোবেসে যাচ্ছে! সুফিয়ান যে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত তা ঢের ভালো করে জানে প্রানেশা। অথচ , সে যে ক্ষুদার্ত তা বলার আগেই জেনে গেছে সুফিয়ান। এত ভালোবাসা সবার কপালে জোটে না।

__________________

পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রানেশা। আজ তার থার্ড সেমিস্টারের শেষ পরীক্ষা ছিলো।
সুফিয়ানের অক্লান্ত পরিশ্রমে অনেক ভালো প্রস্তুতি নিয়েছিলো। ডক্টর বলেছে আর ১৫ দিন পরই ডেলিভারি ডেট। সবগুলো পরীক্ষার দিনই সুফিয়ান ঘন্টার পর ঘন্টা সব কামধাম ফেলে গেটের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতো। অনেক সময় দেখা গেছে পারমিশন নিয়ে হুটহাট হলের ভিতর ঢুকে পরীক্ষার মাঝে প্রানেশাকে খাইয়ে দিয়ে আসতো। প্রানেশা এত মানুষের ভিতর লজ্জা পেয়ে সুফিয়ানকে আসতে মানা করতো। কিন্তু সুফিয়ান তো সুফিয়ানই! সে প্রানেশাকে কোনোরকম তোয়াক্কা না করে খাবার দাবার নিয়ে হাজির হতো৷
আজও সুফিয়ান সকালে দিয়ে গেছে। শেষ পরীক্ষায়ও সুফিয়ান চেয়েছিলো বাহিরে অপেক্ষা করতে। কিন্তু ইমার্জেন্সি থাকায় প্রানেশা নিজেই জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছিলো৷ গত এক মাস যাবৎ সুফিয়ান প্রানেশাকে দেখাশোনার জন্য হসপিটালের কাজ থেকে বিরতিতে ছিলো।
সুফিয়ান কল করে বলেছে দশ মিনিটের মধ্যেই এসে পড়বে। গার্ড পাঠাতে চেয়েছিলো কিন্তু প্রানেশা বলেছে
তার প্রয়োজন নেই। গ্রীষ্মের ভস্ম করা গরম। উঁচু পেট ঢাকতে প্রানেশার গায়ে বড় শাল জড়ানো। গরমের সময়ে শালটা পড়ে আত্মা বের হওয়ার উপক্রম।
নাহ! আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। মাথা ঘুরে আসছে। প্রানেশা পাশের চায়ের দোকানের ছাউনিতে গিয়ে দাঁড়ালো৷ ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলো পানি খেয়ে মোবাইলটা বের করে সুফিয়ানকে আরেকবার কল করলো৷ হয়তো ব্যস্ত, তাই রিসিভ করছে না৷
আরেকটু অপেক্ষা করতে পাশের বেঞ্চে বসে পড়লো।
বিকেলে বৃষ্টি হবে হয়তো। এদিক ওদিক তাকিয়ে মুখ ঢেকে বসে রইলো। গাড়ি থামার আওয়াজে মুখ তুললো। প্রথমে ভেবেছিলো হয়তো সুফিয়ান৷ কিন্তু নাহ, গাড়ি তো এটা নয়। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো ব্লু কোর্ট পরিহিত সুদর্শন যুবক। নীল চোখের স্বচ্ছ পানির ন্যায় চোখের পুরুষ। সামনের আরেকটা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো ছয়জন মুখোশ পড়া লোক ৷
সুদর্শন যুবকটি প্রানেশার বরাবর এসে দাঁড়ালো। প্রানেশা প্রথমে চিনতে না পারলেও পরবর্তীতে সুফিয়ানের বলা বর্ণনায় মিলে যাওয়ায় বুঝতে পারলো এটা ইভানান। শজারুর কাঁটার ন্যায় চুলগুলো পেছনের দিকে এলিয়ে রাখা৷ চলাচলের ভঙ্গি সুফিয়ানের সঙ্গে কিছুটা মিলে। অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়লো সে৷ প্রানেশা উঠে দাঁড়িয়ে ভীত মনে বললো-

‘কী চাই আপনার? এখানে কেনো এসেছেন? ‘

ইভানান ঠোঁটের কোণে হাঁসি ফুটিয়ে প্রানেশার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো-

‘স্রোতস্বিনীর স্থান শুধু তার নীল পুরুষের বুকে ৷ নীল পুরুষ বেঁচে থাকতে স্রোতস্বিনী অন্য কারো বুকে বাসা কী করে বাঁধে! ‘

চলবে….

“অঙ্গারের নেশা ”
পর্ব -৩০ (শেষ পর্ব)
(প্রথম অংশ)

গমগমিয়ে বৃষ্টির আওয়াজ রোজকার মতো আজ আর স্নিগ্ধ মোহময় হয়ে ধ্বনিত হচ্ছে না। বৃষ্টির ফোঁটা গুলো শোনাচ্ছে কোনো এক কিশোরীর আর্তনাদের ন্যায়। এমনটাই অনুভূত হচ্ছে কাঁচের তৈরি আবদ্ধ কক্ষে।
মাথায় ভারী জিনিস রাখা এমন লাগছে প্রানেশার।
ঘ্রাণ শক্তি লোপ পেয়েছে। নাকি, এখানে ঘ্রাণের কোনো উৎসই অবশিষ্ট নেই! বুঝতে পারছে না প্রানেশার অবচেতন মন৷
চেতনা ফিরেনি এখনো তার। ঘুমঘুম দেহে নরম শরীরটা উঠিয়ে বসালো প্রানেশা। চোখ কচলে নিলো।
চারপাশে হালকা ঝাড়বাতির আলো ৷ চোখ মেলতেই চারপাশের পরিবেশ অচেনা মনে হলো। পুরো রুমের নকশাই আলাদা৷ রুম বললে বোধ হয় ভুল হবে৷ এত বড় রুম হয়! কেমন গা ছমছমে।
ঘুমের ঘোর কাটতেই মনে পড়লো সে তো পরীক্ষার হলের বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিলো। ইভানান হঠাৎ তার মুখে রুমাল চেপে ধরলো। তারপরই সব অন্ধকার। অর্থাৎ,তাকে ইভানান কিডনেপ করে ফেলেছে।
সুফিয়ান নিশ্চয়ই খুঁজছে তাকে! সুফিয়ান কী জানে ইভানানের এই জঘন্য অপরাধের কথা? মনে একের পর প্রশ্ন দলা পাকিয়ে বেরিয়ে এলো। বিছানা থেকে নামতে নিতেই চমকে উঠলো। একি! তার পা অবশ হয়ে আছে। পা পাথরের মতোন লাগছে। অদ্ভুত! কোনো অনুভূতি হচ্ছে না। এটা কী করে হলো!

খট করে দরজা খুলে কেউ ভেতরে ঢুকে পড়লো। হালকা আওয়াজে দরজাও আঁটকে নিলো। প্রানেশা চোখ তুলে চাইতেই সামনের দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠলো ইভানানের চেহারা। আবছা আলোয় কী ভয়ংকর দেখাচ্ছে নীল চোখদ্বয়! প্রানেশা পেটের কাছটা খামচে ধরে রেখেছে। চিনচিনে ব্যথা উঠছে। ছয় মাসের পর থেকেই এমন ব্যথা করে। আজ পরিমাণ বেশী। শরীর নাড়াতে না পেরে ব্যথাটা বেড়ে যাচ্ছে। ইভানান বেডের মাঝ বরাবর টানটান হয়ে শুয়ে পড়লো। প্রানেশার হাত মৃদু কাঁপছে। ইভানান যদি খারাপ কিছু তার সাথে করার চেষ্টা করে, এই রকম শরীর নিয়ে প্রানেশা হয়তো কুলিয়ে উঠতে পারবেনা। এ ভেবেই অন্তরআত্মা কেঁপে উঠলো। ইভানান অদ্ভুত স্বরে বললো –

‘স্রোতস্বিনী! ‘

প্রানেশা ভাবনার দুয়ার থেকে বেরিয়ে গেলো। অস্থির ভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। তারপরও নিজেকে সামলে সাবধানতার সঙ্গে কঠোর গলায় বললো –

‘সমস্যা কী আপনার! সুফিয়ানের কম ক্ষতি তো করেননি আপনি। তারপরও কী চান? ‘

ইভানান হাসলো ৷ ভয়ংকর হাসি। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়ার ন্যায় হাসি। প্রানেশার কাছে এসে কিছুটা ঝুঁকে গালের উপরে পড়ে থাকা চুলগুলো পিছনে সরিয়ে দিলো। হাসিমুখেই প্রানেশার নরম কোলে মাথা রেখে হাত ভাজ করে শুয়ে পড়লো। প্রানেশার গা অস্বস্তিতে গুলিয়ে আসতে শুরু হলো৷ দুই হাতে ধাক্কা দিয়ে মাথাটা নিচে নামিয়ে দিলো। ইভানানের ঘুমন্ত রাগ ডগমগিয়ে উঠলো। তেড়ে এসে প্রানেশার গাল চেপে ধরলো। সাপের মতো ফেনা তুলার ভঙ্গিতে বললো-

‘একদম চুপ! আমাকে রাগান্বিত করবেন না স্রোতস্বিনী
এর ফল ভালো হবে না ‘

কিছুটা সময় পর ছেড়ে দিয়ে পাশে বসলো সে। প্রানেশা ভয়ে অস্ফুটস্বরে গোঙাচ্ছে। শ্বাস প্রশ্বাস ঘন ঘন। ইভানান সেদিকে এক পলক তাকিয়ে হাস্যজ্জ্বল কন্ঠে বললো –

‘স্রোতস্বিনী, আপনি জানেন আমরা এখন কোথায় আছি? ‘
থেমে নিজে নিজেই বললো –
‘নীলগিরি ‘

উচ্ছ্বাসের সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত পদে হেঁটে লম্বা কাঁচে ঘেরা জানালাটা খুলে দিলো। বৃষ্টির বেগ হালকা হয়ে এসেছে। সামনেই ছোট নদীর স্বচ্ছ পানির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আজকের দিনটা ইভানানের অদ্ভুত সুন্দর মনে হচ্ছে। হবেই না বা কেনো! তার স্রোতস্বিনী যে তার কাছে। কত সাধনাই না করেছে সে এই দিনের অপেক্ষায়। প্রানেশার দিকে এগিয়ে আসলো। প্রানেশা ভয়ে কাতর হয়ে গুটিয়ে বসে আছে। ইভানান গম্ভীর গলায় বললো –

‘সুফিয়ানের ক্ষতি আমি কেনো চাই জানতে চান আপনি?’

প্রানেশা স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো। সত্যটা তো সে জানে। তারপরও ইভানানের মুখে শুনতে মুখিয়ে আছে। ইভানান প্রানেশার কাঁধের চুল পেছনে দিয়ে বললো-

‘আমি জানি, সুফিয়ান আপনাকে ইনায়ার কথা বলেছে। ‘

থেমে আবার বললো- ‘কিন্তু, এরপরও কেনো এসব করছি জানেন? ‘

প্রানেশার কোমল গালে দুই হাত রেখে বললো –

‘শুধু মাত্র আপনার জন্য স্রোতস্বিনী!কারণটা আপনি’

প্রানেশা অবাক চোখে বললো-

‘আমি! ‘

‘হ্যা, সেই প্রথম দিন আপনাকে যখন দেখলাম জানিনা কী হয়েছিলো আমার। দুনিয়াটাই উলোট পালোট করে দিয়েছিলো। রাতের নিদ্রাহীন প্রহরের সৃষ্টি করেছিলেন। ইনায়ার মৃত্যুর প্রতিশোধ আমি অন্য ভাবে নিতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম রেয়ান আর ছোট চাচিকে চিরদিনের জন্য ওর থেকে কোনোভাবে দূরে সরিয়ে দিবো। রেয়ানটা তো বোকা ৷ ওকে নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে আসবো। কিন্তু, সুফিয়ান আরও একবার আমার আপনজন কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করলো। আমার স্রোতস্বিনীকে নিজের করার চেষ্টায় উঠেপড়ে লেগেছিলো। অসহ্য লাগতে শুরু করলো আমার। দিনরাত নিজের ভালোবাসার মানুষের কথা অন্য কারো মুখে শুনতে শুনতে হৃদয়ে বিষাক্ততা ছড়িয়ে পড়ছিলো। তারপর হঠাৎ একদিন সুফিয়ানের মুখে শুনলাম আপনিও ওকে ভালোবাসেন। সহ্য করতে পারিনি আর। মনে মনে ভেবে নিলাম, আপনাকেও বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে ওকে একেবারে নিঃশেষ করে দেবো। রেয়ানকে ধীরে ধীরে বোঝালাম সুফিয়ান ওর ভালো চায় না। রেয়ান প্রথমে বিশ্বাস না করলেও আমি বারবার এক কথা স্মরণ করানোতে বাধ্য হয়ে বিশ্বাস করলো। সবই মস্তিষ্কের খেলা। ততদিনে রেয়ান আমার বশে। ফুলপ্রুভ প্ল্যান সাজিয়ে নিলাম। যেদিন সুফিয়ানের কনসার্ট। সেদিন কনসার্টের চেয়ে বেশি আপনার সাথে দেখা করার জন্য উৎফুল্ল ছিলো৷ আমিই ওর এক্সিডেন্ট করিয়ে দিলাম।
আরেকটু সহজ হলো আমার জন্য, ওর গলায় সমস্যা
হয়ে গেলো। আমার উদ্দেশ্য ছিলো ওকে আপনার কাছে পৌঁছাতে আটকানো। যেভাবেই হোক ৷ কিন্তু গলায় আঘাত পাওয়াটা সম্পূর্ণ প্ল্যানের বাহিরে। রেয়ান যে গাইতে পারে এটা আমার প্লাস পয়েন্ট হয়ে দাঁড়ালো৷ আমি ওকেই গানের দুনিয়ায় মগ্ন করে তুললাম। ক্যারিয়ার থেকে ওর নিজের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেলো।
ততদিনে ওকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিলাম। আমি গেলে আপনি হয়তো আমাকে মেনে নিতেন না। কারণ কোনোকিছুই আমার সঙ্গে মিলতো না। কিন্ত, আপন ভাই হওয়ায় রেয়ানের সঙ্গে মিলে যায়। রেয়ান আমার কথায় উঠবে আর বসবে বলেই আমি ওকে আপনার কাছে পাঠালাম। রিলেশনে আপনার সাথে থাকলেও আমরা কথামতো চলতো৷ সুফিয়ানকে ইমোশনাল করে ওর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমালাম। লোকজন লাগিয়ে রাখলাম টাকা দিয়ে যাতে সুফিয়ান বাংলাদেশের কোনো খবর না পায়।
আমার উদ্দেশ্য ছিলো ওকে একটা ধাক্কা খাওয়ানো। যেদিন ওর জন্মদিন সেদিনই তনিমকে মুক্ত করে দিলাম। বোকাটা বোঝেইনি, যে সবই আমার প্ল্যান।
সুফিয়ান কীভাবে যেনো সব ঠিকঠাক করে আপনাকে বিয়ে করে নিলো৷ সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো বটে। ‘

প্রানেশা বিস্ময়ে বিভোর হয়ে গেছে। একজন মানুষ কতটা নিচুস্তরের হতে পারে! ঘৃণায় মুখ কুঁচকে রইলো।
ইভানান অস্থির কন্ঠে বললো-

‘আমার কিচ্ছু চাইনা স্রোতস্বিনী। আপনি আমার হয়ে যান৷ খুব ভালোবাসবো আপনাকে। আর কারো ক্ষতি করবো না ‘

প্রানেশা ধাক্কা দিয়ে গালে রাখা হাতটা সরিয়ে দিলো।
চিৎকার করে বললো –

‘পাগল আপনি। একে ভালোবাসা বলেনা। পাগলামো বলে। যে নিজের আপন বন্ধুর সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করে সে আমাকে কী করে ভালোবাসে! ‘

ইভানান হিংস্র রুপে বললো-

‘হ্যা, পাগল হয়ে গেছি আমি! এই পাগলেরই হতে হবে আপনার। ‘

পরমুহূর্তেই আদুরে কন্ঠে বললো –

‘আপনার সন্তানকেও আমি নিজের সন্তানের চোখে দেখবো। কোনো অবহেলা হবে না। তারপরও বিয়ে করুন, আপনি আমায় ভালোবাসুন ‘

প্রানেশা কোনো কথা না শুনে নামার চেষ্টা করলো৷ কিন্তু পা দুটো নাড়াচাড়া করা যাচ্ছেই না। কী হচ্ছে বুঝতে পারছে না। ইভানান হেঁসে বললো –

‘আপনাকে ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে। আগামী এক ঘন্টায় আপনার পায়ের অবশ ভাব সরবেনা। বৃথা চেষ্টা করে লাভ নেই ‘

প্রানেশা চিল্লাতে চিল্লাতে বললো-

‘কেনো করলেন এমন? ‘

‘এমন না করলে যে আপনি বারবার চলে যাওয়ার চেষ্টা করবেন! আপনাকে বেঁধে রাখতে হবে। কষ্ট হবে আপনার, আর তা আমি কী করে সহ্য করবো বলুন তো!’

প্রানেশা বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লো সে। এখন যে পা নাড়াতে না পেরে আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে। এমনিতেই ছয় মাস হওয়ার পর থেকে এক জায়গায় বেশি সময় বসলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আর এখন তো ইয়াত্তাই নেই। সেই কখন থেকে পা অবশ। নাহ, এই পাগলকে অন্য কায়দায় বোঝাতে হবে। প্রানেশা বুক ফুলিয়ে শ্বাস টেনে বললো-

‘দেখুন, আপনি যা করছেন তা সবার জন্যই ক্ষতিকর। আমি বিবাহিত, কয়েক দিন পর এক বাচ্চার মা হবো৷ আমাকে বিয়ে করে কী লাভ! আমি সুফিয়ানকে ভালোবাসি। ‘

ইভানানের চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো। তেড়েমেড়ে এসে প্রানেশার গলা চেপে ধরলো। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এলো প্রানেশার। মুহূর্তেই চোখ উল্টে আসতে শুরু করলো৷
আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে মৃত্যু অতি সন্নিকট হবে। ইভানান রাগের মাথায় প্রানেশাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিলো ফ্লোরে । প্রাণ সঞ্জিবনী ফুরিয়ে আসলো বোধ হয়। তলপেটের দিকটা ছিড়ে যাওয়ার মতো ব্যাথা অনুভব হচ্ছে।
হঠাৎ সম্বিত ফিরলো ইভানানের। নিচে নেমে উঠাতে যাবে এমন সময় কে যেনো লাথি মেরে দরজা খুলে ফেললো৷ চমকে তাকালো সেদিকে৷ সুফিয়ানের মতো মনে হলেও ধরে ফেললো এটা রেয়ান।
অনেকক্ষণ ধরেই বাহিরে দাঁড়ানো ছিলো সে৷ ইভানানের প্রতিটি কথাই শুনেছে সে৷ মস্তিষ্ক রাগে টগবগ করছে। বিশ্বাসই করতে পারছেনা যে, ভালো মানুষীর মুখোশ পড়ে কত বিচ্ছিরি এক খেলা খেলছিলো। অস্ট্রেলিয়ায় ইভানানের বাড়িতেই ছিলো। ইভানান এক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশে ফিরেছে। রেয়ানের অফিসের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় সেও ফিরে এলো৷ ইভানানের বান্দরবনে আসার কথা বাড়ির কেয়ার টেকারের থেকে শুনলো। নীলগিরিতে কী করছে ভেবে পেলো না সে। কারণ পেইন্টিং এর কাজ এখন সিলেট ছিলো৷ ইভানান হয়তো জানতো না টেক কেয়ার ওর নীলগিরিতে থাকার কথা বলে দেবে। রেয়ান যে সব সত্যি জেনে গেছে এটা বুঝতে পারলো।

রেয়ান দ্রুত পদে এগিয়ে আসলো৷ ইভানানের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না। তুমি এমন জঘন্য মানুষ,ছি! ‘

থেমে উত্তেজিত কন্ঠে বললো-

‘আমি সুফি ভাইকে সব বলবো। এখনই ডেকে আনছি’

প্রানেশার আর্তনাদের পরিমাণ বাড়ছে। প্রানেশার দিকে তাকিয়ে মায়া হলো তার। অজান্তেই সবার অপরাধী হয়ে গেছে সে। নিজেকেই একবার ধিক্কার দিয়ে উঠলো মনে মনে রেয়ান ।

পরমুহূর্তেই দৌড়ে বেড়িয়ে সুফিয়ানকে খবর দিতে নিলেই পেছন থেকে ইভানান পাশের ফুলদানি দিয়ে মাথায় আঘাত করলো৷ দুনিয়া ঘুরে উঠলো রেয়ানের।
ঘাড় বেয়ে নামতে লাগলো লহুর সরু লাইন। ফ্লোরে পড়ে থেকে রেয়ানের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রানেশা। কিছুই যেনো করার নেই৷ সুফিয়ান না আসা পর্যন্ত কিছু করা সম্ভব হবে না। রেয়ান লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে,হালকা জ্ঞান আছে । ইভানান পাগলের মতোন হাসতে হাসতে প্রানেশার দিকে ঝুঁকে বললো-

‘এত দিনের স্বপ্ন কী করে ধুলোয় মিশে যেতে দেই বলুন স্রোতস্বিনী! আপনি যে আমার বহু আকাঙ্খিত নারী। কত কিছু করেছি আমি আপনার জন্য। আপনি বাঁচলে শুধু আপনার নীল পুরুষের জন্য বাঁচবেন। যে আমার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে তাকে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দেবো আমি। ‘

প্রানেশার ব্যাথার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। মুখ নীলচে রঙ ধারণ করছে। সহ্য করতে না পেরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ইভানান বললো-

‘আপনার কষ্ট হচ্ছে স্রোতস্বিনী?আরেকটু কষ্ট সহ্য করুন আমি ডাক্তার ডাকছি৷ ‘

প্রানেশাকে কোলে তুলে নিয়ে বেডে শুইয়ে দিলো। এক ঘন্টার মতো হয়ে এসেছে প্রায়। প্রানেশা পা দাপিয়ে চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছে। ইভানান মোবাইল নিয়ে কল করে পেছনে ফিরতেই কিছু পড়ার আওয়াজ আসলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সুফিয়ান ভেতরে ঢুকে পড়লো। ইভানান চমকে উঠলো। এত কড়া নিরাপত্তা ভেঙে কী করে প্রবেশ করলো বুঝতে পারছে না সে ৷ সুফিয়ানের শরীর ঘামে ভিজে একাকার। সেই সকাল থেকে প্রানেশাকে না পেয়ে কলিজা শুকিয়ে গেছে । কোথায় যেতে পারে ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছিলো না। ফোনটাও রাস্তায় একটা দোকানের সামনে পেলো৷ অনেক খোঁজ খবরের পর নীলগিরিতে আসার খবর পেলো শেষমেষ।

প্রানেশাকে চিৎকার করে কাঁদতে আর রেয়ানকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে সমস্ত রাগ দাউদাউ করে জ্বলজ্বল করে উঠলো৷ বন্ধুত্বের মর্যাদা রেখে এতদিনের সকল অপরাধ ক্ষমা করেছিলো। অথচ, ইভানান এখনো শুধরায়নি। এবার আর কোনো ক্ষমা নেই। সোজা ইভানানের গালে চড় বসিয়ে দিলো। কলার টেনে দুটো ঘুষি মেরে বললো-

‘তোকে এবার আর ক্ষমা করবো না৷ তুই না মরা পর্যন্ত শান্তি হবেনা আমার৷ সব সীমা লঙ্ঘন করে ফেললি ‘

ইভানানের নাক দিয়ে রক্ত ঝড়ছে৷ তারপরও মুখে হাসি। হাসতে হাসতেই বললো-

‘মার, আমিও দেখি ‘

সুফিয়ান একের পর এক ঘুষি মেরে লাথি মারতেই ইভানান পাল্টা আক্রমণ করলো৷ সুফিয়ান দুই কদম পিছিয়ে গেলো। প্রানেশার দিকে তাকাতেই দেখলো প্রায় বেহুশ হয়ে যাচ্ছে। ইভানানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পাশে থাকা পানির গ্লাস নিয়ে রেয়ানের মুখে ছেটালো। রেয়ানের হুঁশ ফিরতেই উঠে বসলো। সুফিয়ান বললো-
‘প্রানেশাকে এখানে থেকে নিয়ে যা। ‘

রেয়ান মাথা নেড়ে প্রানেশাকে ধরে দাঁড় করালো। প্রানেশা হেলে দাঁড়িয়ে আছে। রেয়ান কয়েক কদম আগালো৷ সুফিয়ান আর ইভানানের মাঝে তখনও মারপিট চলছে। ইভানান প্রানেশার যাওয়ার পথের দিকে একবার তাকিয়ে চিৎকার স্বরে বললো-

‘ স্রোতস্বিনী, যদি আপনি আমারই না হন তাহলে আপনার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই! ‘

বলেই সুফিয়ানের প্যান্টের পকেটে গুঁজে রাখা পিস্তলটা ছিনিয়ে প্রানেশার মাথা বরাবর শুট করে দিলো। চারিদিকে আত্মচিৎকারে ভরে উঠলো। সুফিয়ানের চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে টুপ করে পড়লো, অস্ফুটস্বরে বললো -‘আমার প্রাণ ‘

(চলবে..)

শেষ পর্বের ১ম অংশ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here