তুমি কে?,পর্বঃ ০১
লেখকঃ আবির খান
রাত প্রায় ২ টা নাগাদ বাজে। রোহান ওর নিজের ব্ল্যাক কালারের নিসান জিটি আর গাড়িটা নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছে। আজ ওর মনটা একদম খারাপ। অনেক বড়ো একটা প্রোজেক্ট হাত ছাড়া হয়েছে। খুব রাগ হচ্ছে নিজের উপর। ৩০০ কোটি টাকা মুনাফা করতে পারতো ওর কোম্পানি যদি প্রোজেক্টটা ওরা পেত। কিন্তু ওর বিপক্ষদল আহসান কোম্পানি অফ ইন্ডাস্ট্রিজ প্রোজেক্টটা নিয়ে নেয় অসৎ ভাবে। রোহান আসলে বুঝতে পারছে না যে ওর কি হয়েছে। কেন ও পারলো না? খুব বিরক্ত লাগছিল ওর। তাই নিজেকে একটু ঠিক করতেই এই রাত্রি ভ্রমণ। রোহান সো করে গাড়ি টান দিতেই ওর মনে হলো রাস্তার পিছনে আইলাইনারের উপর কেউ একজন বসা ছিল। ও গাড়িটা একটু স্লো করে লুকিং গ্লাসে আবছা দেখে খুব সম্ভবত একটা মেয়ে। কিন্তু এত রাতে! এভাবে রাস্তায় বসে আছে কেন? রোহানের বিষয়টা খটকা লাগে। ও দ্রুত রিভার্স গিয়ারে দিয়ে গাড়ি নিয়ে পিছনে এসে সাইড মিররে দেখে, হ্যাঁ সত্যিই একটা মেয়ে ফুটপাতে দু’গালে হাত দিয়ে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে। রোহান গাড়ি থেকে নামার আগে ভালো করে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কোথাও কেউ আছে কিনা৷ বলা তো যায় না এটা কোন ট্রাপও হতে পারে। তাই রোহান ওর গাড়িতে রাখা সেল্ফ ডিফেন্স এর জন্য যে পিস্তলটা ছিল সেটা ওর পিছনে নিয়ে গাড়ি থেকে আস্তে আস্তে নেমে মেয়েটার কাছে যায়।
রোহান এখন মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু মেয়েটার সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। সে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে। রোহানের কাছে বিষয়টা অদ্ভুত লাগে। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে ভদ্র ঘরের মেয়ে। তাহলে এই রাতে রাস্তায় কেন? ওর মনের মধ্যে একের পর এক প্রশ্নের আবির্ভাব হচ্ছে তো হচ্ছেই। সেগুলোর উত্তর শুধু মেয়েটাই দিতে পারবে। তাই রোহান আর দেরি না করে বলে ওঠে,
— এই যে হ্যালো, এত রাতে আপনি এখানে এভাবে বসে আছেন কেন? কি হয়েছে?
~…….
কোন উত্তর নেই। মেয়েটা সেই আগের ন্যায় চুপচাপ বসেই আছে৷ রোহান এবার হাতে চুটকি বাজিয়ে জোর দিয়ে বলে,
— কি ব্যাপার আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না কেন? নাকি পুলিশকে কল করবো?
এবার মেয়েটা দ্রুত মাথা তুলে রোহানের দিকে তাকায়। রোহান এই প্রথম মেয়েটাকে দেখলো। ও দেখে মেয়েটার অসম্ভব সুন্দর নয়নজোড়ায় অশ্রুতে ভরে আছে। মায়াবী মুখখানায় সেই অশ্রু গড়িয়ে গড়িয়ে গাল বেয়ে পড়ছে। ও এই অপরূপার করুণ অবস্থা দেখে ব্যথিত হয় এবং সাথে সাথে জিজ্ঞেস করে,
— একি আপনি কাঁদছেন কেন? কি হয়েছে প্লিজ বলুন তো?
মেয়েটা কান্নাসিক্ত কণ্ঠে এই প্রথম একটি বাক্য বলে,
~ আমার অনেক ক্ষুধা লেগেছে।
রোহান মুহূর্তেই বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। এবং ওর মনটাও খারাপ হয়ে যায় মেয়েটার এভাবে বলা দেখে। মেয়েটার মুখটাও শুকনো মনে হচ্ছে। হয়তো অনেকক্ষণ না খাওয়া। রোহান বলে উঠে,
— তাহলে না খেয়ে এখানে বসে আছেন কেন?
মেয়েটা আবার আগের মতো মাথা নিচু করে কান্নাসিক্ত কণ্ঠে বলে,
~ আমার কাছে কোন টাকা নেই। সেই সকাল থেকে না খাওয়া। শরীরে একটুও শক্তি পাচ্ছি না৷ (খুব দুর্বল কণ্ঠে বলল)
মেয়েটার কথাগুলো রোহানের বুকে এসে তীরের মতো লাগলো। ও আর কিছু না ভেবে বলে,
— আচ্ছা বুঝেছি। আপনি আমার গাড়িতে উঠুন।
মেয়েটা মাথা তুলে রোহানের দিকে ভ্রুকুচকে তাকিয়ে বলে,
~ কেন?
— আপনাকে খাওয়াবো তাই।
~ সত্যি খাওয়াবেন নাকি আবার খারাপ কিছু করার চিন্তা করছেন? যদি করে থাকেন তাহলে আমি যাবো না। এখানেই চুপচাপ বসে থাকবো। আপনি চলে যান। আমি যাবো না।
মেয়েটার কথা শুনে রোহান অজান্তেই হেসে দেয়। দীর্ঘ একটি মাস পর ও আজ হাসি দিয়েছে। আর কদিন গেলে হয়তো ও হাসিই ভুলে যেত। রোহান মুচকি হেসে ভাবে, এত বড়ো মেয়ে তাও বাচ্চাদের মতো কথা বলছে। ও হাসতে হাসতে বলে,
— আচ্ছা আমাকে দেখে কি খারাপ ছেলেদের মতো মনে হচ্ছে?
মেয়েটা রোহানকে ভালো করে দেখে সাথে ওর গাড়িটাও দেখে আবার মাথা নিচু করে ইশারায় না না করে। রোহান হেসে বলে,
— তাহলে এই অপরিচিত ছেলেটাকে একটু বিশ্বাস করে আসুন আমার সাথে। ভয় নেই, আমি আপনার কোন ক্ষতি করবো না। শুধু আপনার ক্ষুধাটা নিবারন করতে চাই।
মেয়েটা রোহানের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে বলে,
~ সত্যি বলছেন তো?
— জি সত্যি।
~ আচ্ছা চলুন।
— আসুন তবে।
রোহান মেয়েটাকে সামনে ওর পাশের সিটে বসিয়ে নিজেও এসে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ে। ও মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখে, মেয়েটা পেটে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে আছে মাথা নিচু করে। নিশ্চয়ই প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। রোহান গাড়ি স্টার্ট না নিয়ে ভাবছে, এত রাতে একে নিয়ে কোন রেস্টুরেন্টে গেলে নির্ঘাত সবাই ভুল বুঝবে৷ তার উপর ওর মতো বিজনেসম্যানের সাথে দেখলে তো আরও বিপদ। তাই রোহান শেষমেশ ঠিক করে ওর বাসায়ই নিয়ে যাবে এই মেয়েকে। যেই ভাবা সেই কাজ। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গুলশান মানে ওর বাসার দিকে রওনা হয় ওরা। গাড়ি চালাতে চালাতে রোহান আড় চোখে মেয়েটা দেখছিল। খুব সুন্দর পরিপাটি মেয়েটা। কিন্তু এরকম একটা মেয়ে বাসা রেখে রাস্তায় কেন আসলো? রোহান আরো ভাবে, এই মেয়েকে তো বাসায় নিচ্ছে। আবার কোন সমস্যায় পড়তে হবে নাতো ওকে? চিন্তায় ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আসে। এরপর আধা ঘণ্টার মধ্যে রোহান ওর বাসার সামনে চলে আসে। একটা হর্ণ দিতেই দারোয়ান দ্রুত দরজা খুলে দেয়। তারপর বাসার ভিতরে গাড়ি নিয়ে ঢুকে পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করে রোহান মেয়েটাকে আস্তে করে বলে,
— এই যে মিস আমরা চলে এসেছি। এবার মাথাটা তুলে একটু দেখুন।
মেয়েটা আস্তে আস্তে মাথা তুলে প্রথমে রোহানের দিকে এক নজর তাকিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে, বিশাল বড়ো একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি। সামনে বাগান৷ অসম্ভব সুন্দর একটা জায়গা। একটা সার্ভেন্ট কখন থেকে ওর জন্য গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে,সেদিকে মেয়েটার খেয়ালই নেই। খুব দুর্বল লাগছিল মেয়েটার। রোহান আবার বলে,
— গাড়ি থেকে নামবেন নাকি এখানেই খাওয়া দাওয়ার প্ল্যান করেছেন?
মেয়েটা লজ্জা পেয়ে আস্তে আস্তে গাড়ি থেকে নামে। ততক্ষণে রোহানও নেমে মেয়েটার কাছে চলে আসে। মেয়েটা গাড়ি থেকে বের হলে রোহান বলে,
— আমার সাথে আসুন৷
~ জি।
এরপর রোহানের পিছু পিছু মেয়েটা যেতে থাকে। যেতে আশপাশটা ভালো করে দেখতে থাকে। তারপর বিশাল বড়ো একটা গেইটের সামনে আসতেই সেটা খুলে যায়। বেশ দামী কারুকার্য করা দরজাটা। রোহানের সাথে মেয়েটা বাসার ভিতরে ঢুকতেই মেয়েটা পুরো থ। এত সুন্দর আর এত বড়ো বাসা সে আগে কখনো দেখে নি। আধুনিক ডিজাইন আর দামী দামী আসবাবপত্র। রোহান যে কতটা ধনী ব্যক্তি মেয়েটা তা আচ করতে পারছে। রোহান মেয়েটাকে নিয়ে হল রুমে এসে একজনকে ডাক দেয়।
— নিলু..এই নিলু…
~ জি ভাইয়া বলেন।(দৌড়ে এসে)
— এই আপুর জন্য দ্রুত খাবার রেডি কর। দেরি হয় না যেন।
নিলু অবাক হয়ে মেয়েটাকে দেখে আস্তে করে বলে,
~ জি ভাইয়া এখনি করছি।
নিলু হলো রোহানের বাসার রাঁধুনি। খুব মজা করে রান্না করে মেয়েটা। এবার রোহান মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলে,
— আসুন আমার সাথে।
মেয়েটাকে নিয়ে ডাইনিং রুমে গিয়ে একটা কমন ওয়াশরুম দেখিয়ে ও বলে,
— এতক্ষণ বাহিরে ছিলেন। যান ফ্রেশ হয়ে আসুন৷
~ জি ধন্যবাদ।
মেয়েটা দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসে। তারপর রোহান ওকে খাবার টেবিলে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পড়ে। আসলে ও রাতের খাবার এখনো খায় নি। নিলু একে একে অনেক খাবার নিয়ে আসে। এনে জিজ্ঞেস করে,
~ ভাইয়া আপনিও তো খান নি। আপনাকেও দি?
— হুম দেও।
তারপর নিলু ওদের দুজনকেই খাবার বেরে দেয়। মেয়েটা এত ক্ষুধার্ত ছিল যে নিলু খাবার দেওয়ার সাথে সাথেই সে খাওয়া শুরু করে। রোহান খাবার মুখে দিতে গিয়েও থেমে যায় মেয়েটার খাওয়া দেখে। নিলুও বেশ অবাক হয়ে দেখছিল। রোহানের দিকে তাকালে ও ইশারায় কিছু বলতে না করে। রোহান একটু খাবার মুখে দিয়ে খেতে খেতে বলে,
— যত ইচ্ছা খান৷ কোন সংকোচ করবেন না৷ একদম পেট মন সব ভরে খান।
মেয়েটা খেয়েই যাচ্ছে। রোহানের কথার কোন পাত্তাই দেয় নি। ও পুরো বোকা হয়ে যায়৷ নিলু মিটমিট করে হাসছে। মেয়েটা খেতে খেতে নিলুর দিকে তাকিয়ে বলে,
~ আরেকটা রোস্ট দিবে খুব মজা হয়েছে।
নিলু যেন মেয়েটার কথা আর মুখখানা দেখে আবেগি হয়ে যায়৷ ওর এত্তো এত্তো ভালো লাগে যে চোখে পানি চলে আসে। ও বলে উঠে,
~ আপুমনি একটা কেন দুটো নিন৷
~ না না একটা দিলেই হবে৷ খুব মজা হয়েছে সত্যিই।
মেয়েটা একদম গলা পর্যন্ত খায়৷ রোহান আর নিলু অবাক হয়ে তা দেখে। এক পর্যায় মেয়েটার খাওয়া শেষ হলে সে রোহানের দিকে তাকায়। রোহানকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে খুব লজ্জা পায়। মাথা নিচু করে আস্তে করে বলে,
~ সরি, আসলে খুব ক্ষুধা লেগেছিল। আর রান্নাটাও অসম্ভব মজা হয়েছে। তাই নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি।
— আরে কি বলছেন! কোন সমস্যা নেই। আপনি লাগলে আরো খান। কেউ কিছু বলবে না।
~ না না আর খাওয়ার জায়গা নেই।
— হাহা আচ্ছা আচ্ছা।
~ ভাইয়া এবার আপনি তো খাওয়া শেষ করেন।
— হ্যাঁ করছি করছি।
~ আপুমনি আমার সাথে আসেন হাত ধুবেন।
নিলু মেয়েটাকে নিয়ে হাত ধুইয়ে দিতে নিয়ে যায়৷ আর রোহান মুচকি হাসতে থাকে খেতে খেতে। সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হলে রোহান মেয়েটাকে নিয়ে হল রুমে বসে। মেয়েটা চুপচাপ বসে আছে। কিছু বলছে না। রোহানও ভাবছে কোথা থেকে শুরু করবে৷ মেয়েটা একবার আড় চোখে ওর দিকে তাকায়। ওদের চোখাচোখি হলে ওরা দুজনেই চোখ সরিয়ে ফেলে। রোহান আর সময় নষ্ট না করে জিজ্ঞেস করে,
— এবার বলুন তো আপনার নাম কি?
মেয়েটা আস্তে করে বলে,
~ তুবা রহমান।
— বাহ! সুন্দর নাম। এবার আসল কথায় আসা যাক। আপনি এত রাতে রাস্তায় কি করছিলেন? আর আপনার বাসা কই?
~ আপনি আমার অনেক বড়ো। তাই তুমি করে বললেই ভালো হয়।
— ওহ! আচ্ছা। এই এই তুমি কথা ঘুরাচ্ছো। আমাকে উত্তর দেও আগে৷
তুবা চুপ করে মাথা নিচু করে বসে থাকে। কোন কিছুই বলে না৷ রোহান আরো একবার জিজ্ঞেস করে। কিন্তু তুবা সেই মাথা নিচু করে বসে থাকে। নিলুও সেখানে ছিল। রোহান ইশারা করে ওকে। নিলু মাথা নাড়িয়ে আচ্ছা বলে তুবার কাছে গিয়ে বসে বলে,
~ আপুমনি ভয় নাই। আপনি বলেন। রোহান ভাইয়া অনেক ভালো। আপনাকে সাহায্য করবে৷
তুবা নিলুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আস্তে করে রোহানকে বলে,
~ আসলে আমি…
চলবে..?