মেঘশূন্য আকাশ,পর্ব-৩(সমাপ্ত পর্ব)
আমিনুর রহমান
মেয়েটা কে? আপনার সাথে ওভাবে কথা বলল কেনো? আর আমাকে আপনার গার্লফ্রেন্ড ভাববার কারণ কি?
– আমার ভার্সিটি জীবনের বান্ধবী। অনেক কাছের বান্ধবী ছিলো কিন্তু একদিনে সব শেষ হয়ে গেছে। হয়তো ভেবেছে আপনার সাথে আমার রিলেশন আছে। তাই এমনটা মনে করেছে। সে জন্য আমি দুঃখিত।
– আপনি কেনো সরি বলবেন। সব মানুষই এখন এমন। দুজন সমবয়সী ছেলে মেয়ে একসাথে দেখলে তারা এমন ভেবে নেয়।
রাফিয়ার ইন্টার পরীক্ষার সময় প্রতিদিন আমি তাঁর সাথে যেতাম। সে পরীক্ষা দিতো আর আমি বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। রাফিয়ার সাথে আমার ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে যায়। সে আমার সাথে কেমন করে যেনো কথা বলে। আমার মনে হয় আমার খুব কাছের কোনো মানুষ আমার সাথে কথা বলছে। আমার বড় ভালো লাগে তাঁর সাথে কথা বলতে। কোনো কোনো সময় মনে হয় এই একাকিত্বের পৃথিবীতে এই মেয়েটাই হয়তো আমার সঙ্গহীন জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাবে। আমার বেদনাভরা হৃদয়ে ভালোবাসার সমুদ্র সৃষ্টি করবে। আমি একসময় বুঝতে পারি এই অতি সুন্দরী মেয়েটাকে আমি নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছি। মানুষের জীবনে যেকোনো সময় যে কাউকে ভালো লাগতে পারে। আমি ভেবেছিলাম আর কাউকে হয়তো ওতোটা ভালো লাগবে না যতোটা সাদিয়াকে লেগেছিলো। কিন্তু এটা মিথ্যা হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি কোনো একজন মানুষের সাথে থাকলে তাকে ভালো লাগবে না হয় খারাপ লাগবে। যদি এমনটা না হয় তাহলে বুঝতে হবে তাঁর মাঝে কোনো অনুভূতি নেই। কিন্তু আমি অনুভূতিহীন মানুষ নই। তাই আমার রাফিয়াকে ভালো লাগে।
রাফিয়ার সাথে আমার প্রেম হয়ে যায়। আমি পাঠকদের আমাদের প্রেমের কাহিনিটা জানাতে চাই না। তবে আমাদের দুজনের মাঝে এক অদ্ভুত সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। যেটাকে এই পৃৃথিবীর মানুষ নাম দিয়েছে প্রেম। আমি অনার্স শেষ করে ভালো একটা চাকরি পেয়ে যখন রাফিয়াকে বললাম,
” এখন তো আমি চাকরি পেয়েছি,এখন তোমার বাবা মাকে বলো।”
আমার খুব বিশ্বাস ছিলো রাফিয়ার বাবা মা আমার হাতে তাদের মেয়েটাকে তুলে দিবে। কিন্তু সেটা হলো না। তারা কোনো বংশপরিচয়হীন,ইয়াতিম ছেলের কাছে তাদের মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজী না।
রাফিয়ার বাবা যখন বলেছিল,
” আমরা তোমার কাছে কিভাবে আমাদের মেয়েকে বিয়ে দিবো বলো। বিয়ের পরে যদি কোনো সমস্যা হয়,তুমি যদি আমার মেয়েকে রেখে চলে যাও তখন আমরা কার কাছে যাবো? তোমার বাবা মা থাকলে না হয় তাদের বলতাম তারাও তো নেই। তুমিই বলো, এরকম একজন গার্জিয়ান ছাড়া কোনো ছেলের হাতে কি কোনো বাবা মা তাঁর মেয়েকে তুলে দিতে পারে?”
আমি সেদিন কিছু বলিনি,চুপ করে চলে এসেছিলাম। কারণ কথা গুলোর কোনো জবাব আমার কাছে ছিলো না।
কিছুদিন পর রাফিয়া আমাকে না বলেই আমার কাছে চলে আসে। আমি যখন বললাম,
“কাজটা তুমি একদম ঠিক করোনি। এভাবে তোমার বাবা মাকে ছেড়ে আসা মোটেও উচিত হয়নি। আমি তোমাকে হয়তো অনেক ভালোবাসি। কিন্তু যারা তোমাকে জন্ম দিয়ে এই সুন্দর পৃথিবীতে এনেছেন তাদের থেকে বেশি ভালোবাসার ক্ষমতা বিধাতা আমাকে দেয়নি। তোমার বাবা মায়ের মনে দুঃখ দিয়ে ঠিক করো নি তুমি।”
তখন রাফিয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,
” যে মানুষটা আমার বাবা মায়ের খারাপ লাগা নিয়ে,তারা দুঃখ পাবে বলে এতো চিন্তা করে। সেই মানুষটা আমার দুঃখে কতোটা কাঁদবে,আমার খারাপ লাগার জন্য সে পৃৃথিবীর সব ভালো লাগা আমার কাছে নিয়ে আসবে আমি জানি। এমন একজন মানুষের কাছে আমি সবসময় নিরাপদ। বাবা মাকে না বলে এসে যেমন ভুল করেছি,তোমার কাছে এসেও তেমন আমি কোনো ভুল করিনি আমি জানি।”
আমি রাফিয়াকে বিয়ে করে ফেলি। আমরা দুজন ভেবেছিলাম বিয়ের পর রাফিয়ার পরিবার আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিবে। কিন্তু না,এমনটা হয়নি। বিয়ের দুবছর পাড় হয়ে গেলেও তারা আমাদের সাথে কখনো কথা বলেনি,কখনো দেখা করেনি। আমরাও যাওয়ার সাহস করিনি তাদের কাছে।
দুই বছরে আমি আমার স্ত্রীর কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছি। সে আমাকে অনেক ভালোবাসা দিয়েছে। কখনো কোনোদিন ভুল করেও এমন কিছু করেনি যেটাতে আমার খারাপ লাগবে। এমন কাউকে নিজের জীবনে পেয়ে সত্যিই আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করতাম। কারণ সবার জীবনেই এতো সুন্দর জীবনসাথী জুটে না। আমি যেখানে চাকরি করি সেখানে সাদিয়ার হাসবেন্ডও চাকরি করে। তবে তাঁর হাসবেন্ড আমাকে স্যার ডাকে। আমার থেকে সুন্দরও না। পৃৃথিবীর সব মেয়েরাই কি এমন? প্রেম করার সময় যতোটা সুন্দর সুদর্শন ছেলে খুঁজে,বিয়ে করার সময় ততোটা সুন্দর দেখে না। এরকম আমি অনেক মেয়েকে দেখেছি যাদের বয়ফ্রেন্ড অনেক স্মার্ট, সুন্দর ছিলো অথচ তাদের হাসবেন্ড তাদের থেকে বয়সে অনেক বড়,দেখতেও ভালো না। তবে ভালো চাকরি করে। প্রেমের বাজারে মেয়েরা অনেক দামি হলেও বিয়ের বাজারে তারা দামি না। আবার এমনও দেখা যায় প্রেমের বাজারে যেসব ছেলেদের কোনো দাম নেই বিয়ের বাজারে তাদের অনেক দাম।
রাফিয়াকে নিয়ে আমি হাসপাতালে এসেছি। ডাক্তার বলেছে তাঁর বাঁচার সম্ভাবনা কম। তবে তাঁর পেটের অনাগত সন্তানটাকে বাঁচানো যাবে। আমি কাঁদছি, আমার কান্না থামানোর কেউ নেই,এতোটাই একা আমি। আমার এই একাকি জীবনে একজন ভালোবাসার মানুষ ছিলো, যাকে নিয়েই আমি বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতাম।
রাফিয়া যেদিন আমার বুকে মাথা রেখে অনেক মমতা ভরা ভালোবাসা নিয়ে বলেছিলো,
” ওগো বলো তুমি আমার কাছে কি চাও। এই দুই বছরে আমি তোমার কাছ থেকে অনেক পেয়েছি। কোনো কিছুর অভাব তুমি আমাকে দাওনি। যখন যা চেয়েছি সেটাই পেয়েছি আমি। তুমি আমাকে এতো এতো ভালোবাসা দিয়েছো যে আমি আমার বাবা মাকে ভুলে গিয়েছি। প্রথম প্রথম তাদের কথা মনে করে কাঁদতাম। কিন্তু তুমি তোমার ভালোবাসা দিয়ে সব ভুলিয়ে দিয়েছো। আজ আমিও তোমাকে এমন কিছু উপহার দিতে চাই,যেটা শুনে তুমি পৃৃথিবীর সবকিছু ভুলে যাবে। তুমি বাবা হবে আর আমি মা। আমাদের ছোট্ট টুনাটুনির সংসারে আরও একজন আসবে আমাদের জীবনটাকে আলোয় আলোয় ভরিয়ে দিতে।”
সেদিন আমি রাফিয়াকে জড়িয়ে ধরে অনেক সুখের কান্না কেঁদেছিলাম কিন্তু আজ দুঃখের কান্না। জীবনের মোড় কখন কোনোদিকে যায় আমরা কেউ জানি না।
ওইতো ভাইয়া আর ভাবি আসছে আমার কাছে। তারা হয়তো জেনে গিয়েছে রাফিয়া বাঁচবে না। তবে তাঁর পেটে অনাগত সন্তানটা বাঁচবে। কে জানে সেই সন্তানটার জন্যই হয়তো আমার ভাইয়া আর ভাবি এতোদিন পর আমার কাছে এসেছে। কারণ তাদের বিয়ের দশ বছর পাড় হয়ে গেলেও তারা কোনো সন্তানের মুখ দেখেনি। কতো টাকা,কতো ডাক্তার,কতো চিকিৎসা করেছেন দুজন তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
“চিন্তা করিস না,সব ঠিক হয়ে যাবে তোর সন্তানের কিছুই হবে না।”
ভাইয়া যখন কথা গুলো বলল তখনো আমি কাঁদছি।
“আমার সন্তানের কথা বললে,আমার স্ত্রীর কথা বললে না? আমি তো তোমার মতো না,আমার কোনো সমস্যা নেই। আমার স্ত্রীও তোমার বউ এর মতো না। আমাদের দুজনেরই সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা আছে। সৃষ্টিকর্তা আমাদের সেই ক্ষমতা দিয়েছেন। আমার স্ত্রী বেঁচে থাকলে আমরা আবার সন্তান নিতে পারবো। কিন্তু মারা গেলে কি তাকে আবার ফিরে পাবো? তোমরা বাচ্চাটার জন্যই এসেছো না? তোমরা হয়তো চাইছো আমার স্ত্রী মারা যাক,পরে আমি বাধ্য হয়ে আমার সন্তানকে তোমাদের হাতে তুলে দিবো। কিন্তু এমনটা কখনো হবে না। আমি আমার সন্তান কে তাঁর মায়ের আদর ছাড়াই মানুষ করবো তবুও তোমাদের কাছে দিবো না।”
আমার কথা গুলো শুনে ভাইয়া আর ভাবি চুপ হয়ে গেছে। কোনো কথা বলছে না তারা। এমন সময় ডাক্তার এসে বলল,
” আলহামদুলিল্লাহ্,মা এবং বাচ্চা দুজনেই সুস্থ্য আছেন। আল্লাহকে ডাকুন। আমরা ভাবিনি এমনটা হবে। সবই ওপরওয়ালার কৃপা।”
” তোরা দুজন এখন আমাদের সাথে আমাদের বাসায় থাকবি। সেদিনের কথা ভুলে গিয়ে আমাদের ক্ষমা করে দে। তোর স্ত্রী আর সন্তানকে নিয়ে আমাদের সাথে চল। বড় ভাই মনে করে আমাদের কে ক্ষমা করে দে।”
” কিসের বড় ভাই? যখন তোমাকে দরকার ছিলো তখন তোমাকে আমি পাশে পাইনি। আমি আমার গার্জিয়ান এর জন্য নিজের ভালোবাসার মানুষকে লুকিয়ে বিয়ে করেছি,রাফিয়াকে ওর বাবা মার আদর থেকে বঞ্চিত করেছি। আমি মানুষের বাসায় থেকেছি,মানুষের বাসায় খেয়েছি। আমি অনেক আগেই তোমাদের ভুলিয়ে গিয়েছি। যখন খুব কষ্টে ছিলাম তখনই তোমাদের কাছে যাইনি আর এখন তো। আর আমি আমার সন্তানকে তোমাদের মতো মানুষের সংস্পর্শে বড় করতে চাই না। আমার সামনে থেকে তোমরা চলে গেলে আমি খুশি হবো।”
ভাইয়া আর ভাবি কাঁদতে কাঁদতে চলে যাচ্ছে। আমিও ঠিক এমন করে কাঁদতে কাঁদতে চলে এসেছিলাম। আমার খুব ইচ্ছে করছে তাদেরকে আটকাই,তাদের সাথে আবার নতুন করে জীবন শুরু করি। কিন্তু পরক্ষণেই আমার ভিতরে সেই হৃদয়বিদারক মুহূর্তটা নাড়া দিয়ে উঠে। আমি যখন জলভরা চোখে তাদের সামনে দিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলাম তারা তখন আমাকে আটকায়নি। তাহলে আজ কেনো আমি তাদের আটকাবো? এতোদিন একজন মানুষের ভালোবাসায় আমি বেঁচেছিলাম কিন্তু আজ আমার জীবনে আরও একজন মানুষ এসেছে। আমার বেঁচে থাকার জন্য এই দুজন মানুষই যথেষ্ট। আমার আকাশেও আজ মেঘ জমেছে। আমার আকাশে আজ বৃষ্টি হবে,সুখের বৃষ্টি।
সমাপ্ত