এক মুঠো রঙ,পর্ব_৮
ফারজানা আফরোজ
বিছানায় শুয়ে পেটে বালিশ চেপে কান্না করছে সিমরান।। অসম্ভব যন্ত্রণাতে বার বার কেঁদে উঠছে সে। পেটের নাড়িভুড়ি বেরিয়ে আসার উপক্রম প্রায়। নাহ কিছুতেই সহ্য করা যায় না এই ব্যাথা। মৃত্যু যেন খুব কাছেই তার। সিমরানের মা গ্লাস ভর্তি গরম পানিতে আদার রস আর বোতলে করে গরম পানি নিয়ে আসলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বোতলটি এগিয়ে দিয়ে বললেন…..
—” একজন মা কতখানি কষ্ট করতে হয় দেখেছিস? প্রতি মাসে তীব্র যন্ত্রণা, প্রসব বেদনা সহ্য করার পরেই শুনতে পায় সন্তানের মুখের সেই মিষ্টি ডাক। ‘মা’ ডাকটি শুনতে হলে প্রচুর কষ্ট সহ্য করতে হয় রে মা। একজন মা বলতে পারবে সন্তান পৃথিবীতে আনার কষ্ট কেমন। গরম পানি এনেছি দেখবি খুব তাড়াতাড়ি ব্যাথা কমে যাবে।”
সিমরানকে উঠিয়ে জোর করে গরম আদার পানি খাইয়ে দিলেন। বেচারি কান্না করে চোখ লাল করে ফেলেছে। প্রতি মাসের দুইটা দিন তাকে এই কষ্ট সহ্য করতে হয়। সিমরানকে বসিয়ে রেখে ওর মা আবারও রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।
ফোন আসলো সিমরানের ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ফোন রিসিভ করে বলল….
—” হ্যালো।”
সিমরানের কণ্ঠস্বর অস্বাভাবিক মনে হলো নীরের কাছে। গলায় কাটা আটকে যাবার মত কন্ঠ।
—” কি হয়েছে তোমার?”
—” তেমন কিছু না। চকলেটের জন্য ফোন দিয়েছেন?”
—” উহু। ফোন দিয়েছিলাম তোমার সাথে কথা বলার জন্য কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি অসুস্থ। কি হয়েছে?”
—” হুম, অসুস্থ আমি পরে কথা বলছি।”
ফোন কেটে দিলো সিমরান। মা ও চাচীর গলা শোনে তাকালো দরজার দিকে। মায়ের হাতে একটা ডিম, মাছ ভাজি দেখে প্রশ্ন করছেন আইরিনের মা।
উনার মতে, এই সময় নিরামিষ খেতে হবে, আমিষ জাতীয় খাবার শরীরের জন্য ঠিক না পরে সমস্যা হতে পারে, মেয়েকে আদরে আদরে ব্রয়লার মুরগি বানিয়ে ফেলেছেন একটু অসুখ হলেই বিছানা নিয়ে ফেলে। এই সমস্যা মনে হয় আর কারো হয় না।
সিমরানের মা খাবার গুলো টেবিলের উপরে রাখলেন। আইরিনের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন…..
—” মেন্সট্রুয়াল চলাকালে মেয়েদের শারীরিক পুষ্টির চাহিদায় পরিবর্তন আসে। এর কারণ শুধুই হরমোন নয়, এই সময় মেয়েদের দেহে অনেক প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ হারায়। তাই দেহের পুষ্টি উপাদান ঠিক রাখতে এই সময়ে আমাদের অর্থাৎ মেয়েদের ডায়েট চার্ট মেনে চলা উচিত। তাহলে শরীরের যে ক্লান্তিকর সময় বা খাবারের প্রতি অনীহার, দুর্বলতা ঠিক হয়ে যায়।
এই সময়ে দেহ যে খনিজ সবচেয়ে বেশি পরিমাণে হারায় তা হলো আয়রণ। ব্রোকোলিতে প্রচুর পরিমানে আয়রন থাকে, এছাড়াও আছে ফাইবার, ম্যাগনেসিয়ার এবং পটাসিয়াম। এই সময় এসব উপাদান শরীরের শক্তি যোগাতে সাহায্য করবে। কলা একটি সুষম খাদ্য। কলা নারী দেহে প্রয়োজনীয় পুষ্টি যোগাতে সাহায্য করে।ডার্ক চকলেট প্রচুর পরিমানে আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, এন্টি অক্সিডেন্ট এ ভরপুর থাকে। এছাড়াও ডার্ক চকলেট রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। আদা পানি বা রস সাহায্য করে তলপেটের ব্যথা কমাতে। তলপেটের এই অসম্ভব ব্যাথা কমাতে আদা অনেক গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। এই সময়ে যত বেশি ফল খাওয়া যাবে তা স্বাস্থ্যের জন্য ততবেশি উপকারে আসবে। কমলা ও লেবু বিশেষ করে। প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে, ভিটামিন জাতীয় খাবার খেতে হবে, দৈনিক সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। তাহলে শরীর ও মন ভালো থাকবে।
আর তুমি এখনও পুরনো যুগে পরে আছো। একজন মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও মেয়ের কষ্ট বুঝার চেষ্টা করছো না তুমি। জানো মেন্সট্রুয়াল কোনো লজ্জার বিষয় নয় বরং একজন মেয়ের অহংকার। তার মাতৃত্ব অর্জনের সফল।”
কথাগুলো বলতে বলতে উনি সিমরানকে খাবার খাইয়ে দিলেন। আইরিনের মা চুপচাপ কথাগুলো শোনে উঠে পড়লেন। এতদিন কত ভুল কাজেই না করেছেন মেয়ের প্রতি তা ভাবতেই তার চোখ গুলো ভিজে উঠলো। এখন ভীষণ অনুতাপ করছেন মনে মনে।
______________
সোনালী বিকালের মিষ্টি বাতাস বইতে শুরু করেছে সিমরানের বাসার ছাদে। গায়ে হলুদ জামা, বড় বড় চুল গুলো ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে ছাদের মাঝ বরাবর। বাতাস মনে হয় মনে মনে ঠিক করেছে আজ বিরক্ত করবে সিমরানকে, শুধু কি বিরক্ত উহু ভীষণ বিরক্ত। এই জন্যই তো খোলা চুল গুলো বার বার এদিক ওদিক উড়িয়ে দিতে লাগলো। হাতে এক মগ গ্রীন টি নিয়ে সে দাঁড়িয়েছে কিছুটা সোনালী রোদের ছায়া পাওয়ার আশায়। সোনালী আলো তার মুখটাকে আরো সোনালী করে তুলেছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই অগোছালো খোলা চুলের হলুদিয়া পাখিকে দেখতে ব্যাস্ত নীর। মনের ভিতর আজ তার ধম ধম ঢোল পিটানোর শব্দ শুনতে পাচ্ছে। ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি আদো কি কোনো মেয়ে নাকি জান্নাতী হুর? যার দিকে তাকিয়ে চোখ এড়ানো দায়। নীরের বড্ড ইচ্ছা করছে নিজের হাতে সিমরানের এলো মেলো চুল গুলো সরিয়ে দেওয়ার জন্য। বার বার বলছে, ইসসসসসস সময়টা যদি এইখানেই থেমে থাকতো তাহলে আরো অনেক সময় ধরে সে এই অপরূপা সুন্দরী তরুণীকে দেখতে পারতো। নিবিড়ের বিয়ে করা রোগটা এইবার নীরের মনে গেঁথে বসলো।
ভালোবাসা হলো সাদা নরম তোলার মত আবেগ অনুভূতি দিয়ে মুড়ানো, ,ভাষায় প্রকাশ না করতে পারা স্পর্শকাতর এক তীব্র ও কঠিনতম অনুভূতির জন্ম। ভালোবাসার রঙে রাঙা হোক পৃথিবী। নীর সিমরানকে উদ্দেশ্য করে বিড়বিড় করে বলল…..
—” আমার ভালোবাসা দিয়ে তোমাকে করিব পূর্ণ, আমার ভালোবাসা দিয়ে তোমার সৌন্দর্যকে রাঙিয়ে তুলবো। তোমাকে ভালোবেসে করিনি তো ভুল তাই তো সারাজীবন বেসে যাবো ভালো। যতদিন থাকবে আমার নিঃশ্বাস ততদিন তোমাকে মন থেকে অনেক অনেক ভালোবেসে যাবো, সমু।”
সিমরান অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছে কেউ একজন রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকায় লোকটির মুখ সে দেখতে পাচ্ছে না। হঠাৎ করেই সিমরানের আম্মু ভয়ার্ত কন্ঠে এসে বললেন…..
—” সিমু, আট নয় বছরের একটি বাচ্চা এসে জিজ্ঞাসা করছে এই বাড়িতে নাকি ওর ভাবী থাকে। আমি অনেক বার বলেছি এই বাড়িতে কোনো ভাবী নেই তবুও বাচ্চাটি শুনছে না। আমাকে ব্ল্যাক মেইল করে বলছে, যদি ওর ভাবীকে না ডাকি তাহলে নাকি এলাকা থেকে গুন্ডা ভাড়া করে আনবে। দেখ মা এইটুকু বয়সে কিসব বলছে। এখন এই ছেলেটিকে আমার ভীষন ভয় করছে প্লিজ নিচে আয়।”
মায়ের বিবরণ শোনে সিমরান বুঝলো এই বাচ্চা যে নিবিড় তাই চোখ দুটি বড় বড় করে বলল…..
—” ছিঃ আম্মু ছিঃ, শেষমেশ আট বছরের এক ছেলেকে তুমি ভয় পাচ্ছো এখন যদি বাচ্চা ছেলেটির বড় ভাই এসে বলে, উনার বউ এই বাড়িতে তখন তো তুমি হার্ট অ্যাটাক করে ফেলবে।”
—” বাজে না বকে তাড়াতাড়ি আয়। আমি এক বাটি নুডলস দিয়ে এসেছি গপাগপ খেয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে নিজের শশুর বাড়িতে এসে খাচ্ছে।”
হাসলো সিমরান। তার এখন ভীষণ জোরে হাসি পাচ্ছে কিন্তু মায়ের সামনে হাসলে সন্দেহ করবে সেই জন্য মুচকি হেসে গাছের আড়ালে একবার তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকা করে কামড় দিয়ে বলল….
—” চলো তাড়াতাড়ি, গিয়ে দেখবো এই ছেলে সব খেয়ে সাবাড় করে ফেলেছে।”
সিমরান চলে যেতেই নীরের হুস ফিরে আসলো। মন খারাপ নিয়ে নিবিড়কে উদ্দেশ্য করে বলল…..
—” দেখেছিস কি বজ্জাত মেয়ে আমাকে একা রেখে চলে গিয়েছে।”
পিছনে ফিরতেই দেখলো নিবিড় উধাও। আশ পাশটা ভালো করে লক্ষ্য করলো , নাহ নিবিড় কোথাও নেই। মনে মনে ভাবছে কেউ কিডন্যাপ করে ফেলল নাকি।
—” এই ছেলে যে জাতের বিচ্ছু ওকে কেউ কিডন্যাপ করতে পারবে না। মনে হচ্ছে নিজেই একা একা কিডন্যাপ হতে চলে গিয়েছে। ভাই রে ভাই একা একা কিডন্যাপ হবি ভালো কথা যাবার আগে তো আমাকে বলতে পারতি তাহলে কিডন্যাপারকে তোর ব্যাপারে সচেতন করতে পারতাম। আল্লাহ জানে বেচারা কিংবা বেচারি কিডন্যাপের কি অবস্থা।”
সিমরান ও তার মা ড্রয়িং রুমের কাছে আসতেই তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো কেননা নিবিড়……..
চলবে……