এক মুঠো রঙ,পর্ব_৯

1
6297

এক মুঠো রঙ,পর্ব_৯
ফারজানা আফরোজ

ডান পায়ের উপর বাম পা তুলে টিভির রিমোট ডান হাতে রেখে পা নাচিয়ে ‘ওগো জামা’ কার্টুন দেখছে নিবিড়। এক বাটি নুডলস সবটুকু শেষ করে নতুন জামাইয়ের মতো আচরণ করছে সে। বাম হাত পেটের কাছে রেখে টিভির দিকে তাকিয়ে বলল….

—” নেই নেই কোনো সম্মান নেই। দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র মেয়ের একটা মাত্র দেবর আমি। কই একটু যত্ন করবে, আদর আপ্যায়ন করবে, না উনি তা না করে মাত্র এক বাটি নুডলস দিয়ে চলে গিয়েছেন। যাবার আগে এইটুকুও বললেন না, বাবা আরো কিছু লাগলে ফ্রিজ বা রান্না ঘর থেকে খেয়ে নিও। যদি বলে যেতো তাহলে তো খেতে পারতাম তাই না? আমার কি লজ্জা করে না অনুমতি ছাড়া কিছু খেয়ে নিতে।”

সিঁড়ি নামছিলেন সিমরানের আম্মু ও সিমরান। নিবিড়ের কথা শোনে চোখ গুলো বড় বড় করে বললেন…..

—” মা তুই যা আমি রুমে যাচ্ছি। কি পাকা ছেলেরে বাবা।”

সিমরানের মা দৌঁড়ে পালালেন। সিমরান কিছুক্ষণ একা একা হেসে নিবিড়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ভ্রু জোড়া নাচিয়ে ডান চোখে টিপ দিয়ে নিবিড় বলল…..

—” হিহিহিহি, ভাবী এসেছো?”

—” ‘ভাবী’? এই ছেলে শোনো আমি এখনও অবিবাহিত।”

—” আজ অবিবাহিত কিন্তু কে বলতে পারে আগামীকাল অবিবাহিত নামের অ বাদ পড়ে যেতে পারে।”

—” বাহ খুব সেয়ানা দেখছি কে শিখায় এইসব?”

—” আমার ভাইয়া।”

সিমরান ও নিবিড় আড্ডায় মেতে উঠলো। ছোট্ট ছেলেটি সহজেই সবাইকে আপন করতে পারে। দুষ্টু মিষ্টি কথার জালে সবাইকে আটকিয়ে রাখার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে বলে সিমরানের ধারণা।

কলিং বেলের শব্দ পেয়ে সিমরান দরজা খুলে নওশীনকে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরে বলল….

—” তোকেই মিস করে ছিলাম। আমি জানতাম তুই আসবি।”

—-” তোর অসুস্থতার কথা শোনে আমি আসবো না তা কি করে হয় হুম? তুই আমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র কলিজা। তোর কিছু হলে তো আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা।

বন্ধুহীন জীবন হলে লবণ ছাড়া তরকারির মতো। বন্ধুত্ব নিয়ে মানুষের অনেক ধারণা বিশ্বাস রয়েছে । সবচেয়ে বেশি রয়েছে আবেগ । সহজ কথায় সহজ ভাষায় এর সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয় । কেন না বন্ধু হল মানুষের এক হৃদয়ের অনুভূতিমূলক সম্পর্ক । বিভিন্ন মনীষী বন্ধুত্ব বিষয়ে সুন্দর সুন্দর কথা বলে গেছেন । সেগুলি তাদের নিজস্ব অনুভূতির কথা । রক্ত দূরে চলে গেলেও খাঁটি বন্ধু কোনোদিন সরে যায় না ছায়ার মত আশে পাশে থাকে। ‘উইড্রো উইলসন’ বলেছেন ” বন্ধুত্ব একমাত্র সিমেন্ট যা সবসময় পৃথিবীকে একত্র রাখতে পারবে। ” হাজার ঝড়, তুফানে ভেঙ্গে পড়ার আশংকা কম।

নওশীন সিমরানের পিছনে নিবিড়কে দেখে মুখে কিউট মার্কা হাসি দিয়ে বলল…..

—” ওয়াও কি সুইট পুতুল একটা। ইসস গাল দুটো তো একদম রসগোল্লা ইচ্ছা করছে খেয়ে ফেলি। কে রে এই রসগোল্লা।”

নিবিড়ের গাল দুটো টেনে কিস দিয়ে সিমরানকে উদ্দেশ্য করে বলল নওশীন। সিমরান নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে দেখলে নিবিড় রেগে আগুন হয়ে আছে। এক্ষুনি মনে হয় নওশীনের হাতে কামড় দিয়ে ফেলবে। নিবিড়কে শান্ত রাখার জন্য দাঁত বের করে হাসতে লাগলো সিমরান। নওশীন ও নিবিড় সিমরানের হাসির অর্থ না বুঝে তাকিয়ে রইলো। সিমরান হাসতে হাসতে বলল….

—” ও আমার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়। আয় পরিচয় করিয়ে দেই।”

সিমরান পরিচয় করানোর পর রাগী কণ্ঠে কথা বলল নিবিড়। হঠাৎ করেই নওশীনের ডান হাত কামড় দিয়ে বলল….

—” আমার গাল দুটো রসগোল্লা তাই না? এখন এই রসগোল্লার একটু কামড় তো খেতেই পারো মিস দুষ্টু আপু। আমার গাল দুটো শুধু আমার ভাবী আর বউয়ের জন্য বানানো তোমার জন্য না ওকে।”

নওশীন অবাক হওয়ার চরম পর্যায় চলে গেল। সিমরান বেক্কল মার্কা হাসি দিয়ে বলল….

—” তোকে সব পরে বলছি এখন কিছু বলিস না।”

নওশীন আর কথা বাড়ালো না। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে সে চলে গেলো। সিমরানের মা’র সাথেও নিবিড়ের সম্পর্ক বেশ জমে গিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে তারা কত বছর ধরে একে অন্যকে চিনে জানে।

____________________

নীর এইদিকে এলাকার সব জায়গায় নিবিড়কে খুঁজতে ব্যাস্ত। নাহ কোথাও সে নিবিড়কে খুঁজে পাচ্ছে না, চিন্তায় তার পুরো মাথা হ্যাং হয়ে গেছে। বাসায় এ কথা বললে সবাই চিন্তা করবে সেই জন্য বাসায় না জানিয়ে পুলিশকে ইনফর্ম করলো। তার চোখ দুটো রক্ত লাল হয়ে আছে, দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি তার চোখ বেয়ে লাল পানি বের হবে। বার বার ঘড়ির দিকে তাকাতে লাগলো। পুরো শরীর কাঁপছে তার। ভয়ে শিউরে উঠছে গায়ের লোম গুলো।

আজকের সন্ধ্যাটা নীরের জীবনে অশুভ সন্ধ্যা নামে পরিচিত হলো। আজকের দিনটা তার জীবনে খারাপ একটি দিন। হঠাৎ করেই তার মাথায় সিমরানের নামটি মনে হলো। নিবিড়ের চিন্তায় সে সিমরানের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। তার মন একটা কথা বার বার বলছে, জীবনের সব সন্ধ্যাই অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়, তার মধ্যে শুভ সন্ধ্যারও পদার্পণ ঘটে। সিমরানের ফোনে কল দিল কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ ফোন বন্ধ। মনে মনে বকতে লাগলো সিমরানকে হয়তো এখন কাছে ফেলে মেরেও ফেলত। রাগটা কন্ট্রোল করে আবারো ফোন দিল কিন্তু আগের মতই ফোন অফ। সিমরানের বাসায় যেতে সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা খুব জোড়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বাইক নিয়ে রওনা হলো সিমরানের বাসার উদ্দেশ্য……..

এইদিকে সিমরানের ফোনে চার্জ নেই। নিবিড় গেমস খেলে সব চার্জ শেষ করে ফেলেছে। সিমরানের মনে নেই সে যে নিবিড়ের ব্যাপারে নীরকে কিছু বলেনি। আরামসে সে নিবিড়ের সাথে খেলতে ব্যাস্ত। আজ যেন সিমরান আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। ছোট্ট নিবিড়ের সাথে সেও ছোট বাচ্চা হয়ে গিয়েছে। মনের ভিতর জেগে উঠেছে রংধনু। রংধনু যেমন সাত রঙা তেমনি সিমরানের মনে আজ রঙের খেলা ধারণ করেছে। নিবিড় সিমরানের কোলে মাথা রেখে শান্ত বাচ্চাদের মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার দু চোখে যেন অদ্ভুদ এক মায়া সেই মায়ায় বার বার জড়িয়ে যাচ্ছে সিমরান। কি আছে এই ছেলেটির মধ্যে যা তাকে বার বার টানে, খুব আপন মনে হয় তার কাছে।

রাত দশটা, নিবিড় ঘুমে আচ্ছন্ন। সিমরানকে জড়িয়ে ধরে সে ঘুমাচ্ছে। তারও বেশ ঘুম পাচ্ছে। সেও ঘুমিয়ে পড়েছে ছোট্ট নিবিড়কে জড়িয়ে ধরে……

কলিং বেলের শব্দ শোনে সিমরানের মা দরজা খুলে দেখলো তারেই সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন সুদর্শন যুবক। যুবকটির মুখে চিন্তার ভাঁজ, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে, চোখ দুটি লাল বর্ণ ধারণ করেছে।

—” কাকে চাই?”

—” সরি আন্টি রাত করে বিরক্ত করার জন্য। আমার ছোট ভাই নিবিড় কি এইখানে আছে?”

নিবিড়ের নাম শোনে বাসার ভিতরে প্রবেশ করতে বলল নীরকে। সোফায় বসতে বলে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি আনতে গেলেন উনি…..

—” চিন্তা করো না তোমার ভাই আমাদের বাসায় আছে। তোমাকে আমি ঠাণ্ডা পানি দিচ্ছি খেয়ে পরে ভাইয়ের কাছে যাবে।”

মায়েদের কথায় যেনো মধু মিশিয়ে থাকে। নীর কিছু না বলে সেই মিষ্টি কণ্ঠের কথা মনোযোগ সহকারে শুনলো। মাথা এদিক ওদিক হেলিয়ে হ্যাঁ বোধক অর্থ বুঝালো।

দুই ঘণ্টার রাস্তা চার ঘণ্টা লেগেছে নীরের। দুই বার বাইক নষ্ট হয়ে যাওয়া, রাস্তায় প্রচুর জ্যাম সবমিলিয়ে সে আজ ভীষণ বিরক্ত। সিমরানের মায়ের দেওয়া ঠাণ্ডা পানিটুকু এক নিমিষেই শেষ করে বলল….

—” আন্টি নিবিড়?”

—” দু তালার বা দিকের দ্বিতীয় রুমে আছে। তুমি যাও আমি আসছি।”

নীর আর দাঁড়ালো না দ্রুত পা চালিয়ে সে নিবিড়ের উদ্দেশ্য হাঁটা দিল। রুমের দরজা খোলা থাকায় ভিতরে প্রবেশ করে দেখলো, সিমরান ও নিবিড় একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। এই দৃশ্যটা সে ফোনে বন্ধী করতে চায়। দ্রুত গতিতে ফোন বের করে ছবি তুলে আবারো ফোন পকেটে রেখে দিল। এরেই মাঝে আগমন ঘটে সিমরানের মায়ের।

—” দেখো কেমন বাচ্চাদের ঘুমাচ্ছে দুইজন বাচ্চা। আমি তো নিবিড়কে ভেবেছিলাম রেখেই দিবো। কি মিষ্টি ছেলে, যেমন তার কথা তেমন তার বুদ্ধি।”

হাসলো নীর। দশ মিনিট ধরে কথা বলছে নীর ও সিমরানের মা। কথার শব্দে ঘুম ভেংগে যায় সিমরানের। সামনে নীরকে দেখে একবার নিজের দিকে তাকিয়ে কাচুমাচু হয়ে বসে পরে কেননা তার গায়ের ওড়নাটা নিবিড়ের হাত ও পেট পেছানো রয়েছে। সিমরানের মা আবারো কলিং বেলের শব্দ শোনে দৌঁড়ে যেতে লাগলেন। নীরকে উদ্দেশ্য করে বললেন…..

—” সিমুর আব্বু এসেছো, দাঁড়াও ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দিব তোমার।”

চলে গেলেন উনি। নীর এইবার সিমরানের দিকে তাকালো। তার চোখ দুটো এখনও রাগে আগুন হয়ে আছে। হঠাৎ তার খেয়াল হলো সিমরান খুবই অস্বস্তিতে আছে কারণটা বুঝতে পেরে নিবিড়কে কোলে নিয়ে নিল। অন্য দিকে তাকিয়ে বলল…..

—” সমস্যা নেই। আমি এতটাও বাজে ছেলে নই ওকে।”

সিমরান ওরনা নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল…..

—” আপনি এত রাতে এইখানে?”

—” নাটক দেখানোর জন্য আসে নি? ফোন রিসিভ করেছো তুমি?”

রাগী ও ধমকের সুরে বলল কথাটা। সিমরান ভয়ে চুপসে গেল। নীর রাগ দেখিয়ে আবার বলল……

—” আমি তো তোমার বিরক্তির কারণ তাই তো? আজ থেকে আমি বা আমার ভাই তোমার আশে পাশে আর কোনোদিন আসবো না। আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যই কি আমাকে জানাও নি যে , আমার ভাই এইখানে?”

—” আসলে আমার মনে ছিল না।”

—” বাহ অজুহাত ভালো ছিল কিন্তু ভীষণ পুরানো,নতুন কিছু আবিস্কার করতে পারলে না।”

—” সত্যি বলছি।”

—” আমি নিবিড়কে নিয়ে যাচ্ছি। যাবার পথে আন্টি আংকেলের সাথে দেখা করে যাবো কিন্তু তোমার সাথে আমাদের আর ইচ্ছাকৃত ভাবে কোনোদিন দেখা হবে না। ভালো থেকো গুড বায়।”

চলবে……

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here