তুমি যদি চাও,পর্ব ৬,৭

0
2569

তুমি যদি চাও,পর্ব ৬,৭
রাজেশ্বরী দাস ( রাজী )
পর্ব ৬

” এইতো অংশু চলে এসেছে । ভাগ্যিস তুই আজকে রাস্তায় ওকে পেয়েছিলি , নাহলে কী যে হত..!! ”

” হ্যাঁ আর ওর জন্যই তো আমরা আবার একে অপরকে খুঁজে পেলাম এতগুলো বছর পরে । ”

উনি বাবার কথা শুনে কিছু বললেন না , মৃদু হাসলেন । তারপর আমার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে আবারও সবার দিকে তাকিয়ে বললেন…” আচ্ছা ওকে তো কালকে সকালে হসপিটাল থেকে রিলিজ করে নিয়ে যাওয়া যাবে । আর এখন তো প্রায় মাঝরাত হতে চলল , তাই বলছি তোমরা এখন না হয় যাও গিয়ে বাড়ি থেকে ফ্রেশ হয়ে আসো । ”

বাবা কিছুটা দ্বিধান্ধিত কণ্ঠে বলে উঠলেন…” কিন্তু ও একা..!! ”

” আমি আছি এখানে এখন তাই চিন্তার কোন বিষয় নেই আমি দেখে রাখবো ওকে আর আমার ওপর এইটুকু ভরসা রাখতেই পারো । ”

বাবা মুচকি হাসলেন এবং শুভ্রাংশুদার কথায় মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেন । তারা সকলে কিছু কথা বলে এক এক করে চলে গেলেন , শুভ্রাংশুদা এবার ধীরে ধীরে এদিকে এগিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে শান্ত দৃষ্টিতেই আমার দিকে তাকালেন । এরই মাঝে একজন নার্স ঘরে এলেন , তিনি আমার কাছে এসে হাতের ক্যালন খুলতে গেলে শুভ্রাংশুদা বাঁধা দিলেন আর নিজেই আমার কাছে এসে অতি সাবধানে ক্যানলটা হাত থেকে খুললেন যেন তেমন ব্যাথা না পাই , সেই ফাঁকে একবার নার্সের দিকে চোখ পড়তেই আমি দেখলাম নার্স ওনার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে । উনি ক্যানলটা খুলে আমার হাত ধরে ঠিকঠাক করে হেলান দিয়ে বসতে আমাকে সাহায্য করলেন আর নার্সের দিকে তাকিয়ে বললেন…” আপনি এখন আসতে পারেন , ওর ওষুধ আর বাকিসবকিছুর খেয়াল আমরা নিজেরাই রাখতে পারবো , আপনি যান । ”

কথাটা বলার পরেও নার্সটি ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে ওনার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে , সেটা দেখে এবার আমি মুখ টিপে হাসলাম আর উনি ভ্রু কুঁচকে নার্সের দিকে তাকিয়ে শেষে বিরক্ত হয়ে হালকা ধমকের সুরেই বললেন….” এইযে শুনতে পাচ্ছেন না কী বলছি..!! যান আপনি ওর বাকি খেয়াল আমিই রাখতে পারবো । ”

ওনার এই হালকা ধমকেই কাজ হল , নার্সটি আর দেরি না করে সেখান থেকে চলে গেল আমি এবার কিছুটা মজার সুর টেনে শুভ্রাংশুদাকে বললাম….” আরে শুভ্রাংশুদা দিলেন তো ধমক , বেচারী কোথায় আপনার ওপর ক্রাস খেয়েছিল আর আপনি কী করলেন ?? ধমক দিয়ে ভাগিয়ে দিলেন তবে হ্যাঁ নার্সরা কিন্তু দেখতে বেশ সুন্দরীই ছিল । ”

উনি কথাটা শুনে মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে তুলে আমার দিকে তাকালেন , তারপর বিড়বিড় করে বললেন…” কপাল আমার..!! যার ক্রাস খাওয়া উচিত সে তো খাই না । ”

” কী বললেন ?? ”

” কিছু নাহ । নাও ওষুধ… ”

উনি ওষুধ আর জলের গ্লাসটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন , আমি ওষুধ খেয়ে নিলে তিনি গ্লাসটা আমার হাত থেকে নিয়ে পাশে রেখে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন বেশ রাগীদৃষ্টিতেই আমি সেটা দেখে সরু চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম….” কী হয়েছে ?? ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন ?? ”

উনি বিছানায় হাত রেখে আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকলেন আর দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন…” তোমাকে কে বলেছিল রাতে সেই ফাঁকা রাস্তা দিয়ে একা একা আসতে ?? কে বলেছিল এত সাহস দেখাতে তোমাকে ?? আজ কিছু হয়ে গেলে কী হত ?? ”

তার এরূপ ধমক শুনে আমি একটু ভরকে গেলাম , আর আমতা আমতা করে উত্তর দিলাম…” ত..তখন তো সন্ধ্যে ছিল আমি ভাবলাম একাই চলে যায় বাড়ি । আর আমি থোড়াই না আগে থেকে জানতাম যে রাস্তায় অমন কিছু হবে..! ”

উনি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন , ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরের দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করলেন অর্ঘ্যদা । শুভ্রাংশুদা ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে অর্ঘ্যদার দিকে তাকালেন আমিও সেদিকে তাকালাম । অর্ঘ্যদা এদিকে এসে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বললেন…” সঙ্গীত এখন শরীর আগের থেকে ভালো লাগছে তো ?? ”

আমি তার দিকে তাঁকিয়ে মুচকি হেঁসে বললাম..” হুমম ” । অর্ঘ্যদার আর কিছু বললেন না ।
.
.

শুভ্রাংশুদা আর অর্ঘ্যদা সামনেই দাঁড়িয়ে কথা বলছে । আর এদিকে আমার মনে হাজারো প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে , মনটা কেমন যেন আকুবাকু করছে উত্তরগুলো জানবার জন্য । আমি শেষে না থাকতে পেরে বলেই ফেললাম…” আব.. আমার কিছু প্রশ্ন আছে । ”

শুভ্রাংশুদা আর অর্ঘ্যদা দুজনই আমাদের দিকে তাকালেন । শুভ্রাংশুদা খুব স্বাভাবিক কণ্ঠেই বললেন…” বলো । ”

” আচ্ছা শুভ্রাংশুদা ওরা এটা কেন বলল আমি অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়েছিলাম আর আপনি আমাকে পেয়েছেন রাস্তায় ?? ”

” কারণ ওদের সেটাই বলেছি , সত্যিটা বললে ওরা চিন্তা করত তাই সত্যিটা তাদের বলিনি । ”

আমি ভেবে দেখলাম কথাটা ঠিক সত্যিটা জানলে তাদের মাথায় চিন্তার পুরো পাহাড় এসে জড়ো হত , আর সেই পাহাড়ের নীচে চাপা পরত এই সঙ্গীতা নামের বাচ্চা মেয়েটাই । কী সাংঘাতিক ব্যাপার..!! না তার চেয়ে বরং এটাই ঠিক আছে । আমি কিছুসময় চুপ থেকে আবারও বললাম…” মামনি বাবাই আর মা বাবা এদের দেখা হল কীভাবে ?? ”

শুভ্রাংশুদা ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন…” অ্যাক্সিডেন্টলি ”

” মানে…!!”

” মানে হল এই যে হাসপাতালে আসার পর অংশু তোমার ফোন থেকে তোমার বাড়ির নম্বর জোগাড় করে ওদের ফোন করে আর এখানে আসতে বলে । তার কিছুক্ষন বাদেই সুব্রত আঙ্কেল অংশুকে ফোন করেন বেশ রাত হচ্ছে আর ওর আজকে তাড়াতাড়ি ফেরার কথা ছিল তাই । অংশু ফোন ধরাই উনি জিজ্ঞাসা করেন অংশু কোথায় আছে ?? অংশু তখন বলে যে আমরা হাসপাতালে আছি , সুব্রত আঙ্কেল সাথে সাথেই কোন হাসপাতালে জিজ্ঞাসা করলে অংশু হাসপাতালের নামটা বলে তবে আর কিছু বলবে তার আগেই কল কেটে যায় । অংশু পরে ফোন করেছিল আবার কিন্তু নেটওয়ার্ক ইস্যুর জন্য ফোন যায়নি । আর তারপর কিছুসময় পরে তোমার বাবা মা দাভাই এখানে আসে তারা তোমাকে দেখে এসে ঘরের সামনেই বারান্দায় অংশুর সাথে কথা বলছিল তখনই সেখানে সুব্রত আঙ্কেল আর আন্টি আসেন । সুব্রত আঙ্কেল আর তোমার বাবা প্রথমে একে-অপরকে দেখেই থমকে যান এবং পরমুহুর্তেই হেসে একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে । ”

” হুমম , আমি যদিও প্রথমে ব্যপারটা বুঝতে পারিনি । আর মা আর মামনিও প্রথমে অবাক হয়েছিল , কিন্তু পরে তারা বিষয়টা বুঝতে পারলেন আর আমরাও জানলাম যে তারা বন্ধু এবং বাকিসবকিছু । ”

আমি বিস্মিত হয়ে কিছুক্ষন চুপ করে তাদের চেয়ে থাকলাম । এমন ঘটনা তো শুধু সিনেমাতে দেখেছি কিন্তু এখন তো দেখছি বাস্তবে হচ্ছে । যদিও বাবা আর বাবাই আবার একে-অপরকে খুঁজে পেয়েছেন এবং তারা এত খুশি সেটা ভেবে ভালোই দেখে আমার । আমি একটু ভেবে ওদের জিজ্ঞাসা করলাম…” আর ওই ছেলেগুলোর কী হল ?? ”

কথাটা শুনতেই অর্ঘ্য মুখটিপে হেসে বিড়বিড় করে বলল…” ওদের অবস্থা তো শোচনীয় , বেচেঁ আছে সেই খুব । ”

শুভ্রাংশু ওর দিকে চোখ গরম করে তাকাতেই অর্ঘ্য বলল….” আসলে ঐতো না মানে তখন শুভ্রাংশু যখন ওদের মারছিল তখন আমি পুলিশদের ফোন করে জানাই এবং আসতে বলি । ওরা কাছাকাছি থাকাই তাড়াতাড়ি পৌঁছেও যায় , আর এখন ওরা ওই আব.. প.পুলিশ কাস্টাডিতেই আছে । ”

আমি শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম…” ওহ ”

” হুমম তবে ভাগ্যিস তখন শুভ্রাংশু ওখানে ছিল , নাহলে…। আচ্ছা ছার , আব.. অংশু তুই তবে থাক আমি বরং এখন আসি কেমন ?? ”

” আচ্ছা ঠিক আছে আয় । ”

অর্ঘ্যদা আমার দিকে একবার তাকিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন । আর শুভ্রাংশুদা এসে সোজা আমার পাশে ফোন হাতে নিয়ে বসে পড়লেন আমি ওনার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলাম তারপর বললাম…” ধন্যবাদ…”

উনি ফোন থেকে চোখ না সরিয়েই উত্তর দিলেন…” তোমার ধন্যবাদ তুমি তোমার কাছেই রাখো , আমার প্রয়োজন নেই । ”

আমি তার কথা শুনে মুখ ভেংচি দিয়ে অন্যদিকে তাকালাম । হটাৎ আমার মনে পড়ল আমার জ্ঞান হারানোর ঠিক আগের মুহূর্তে তার বলা কথাগুলো আমি আড়চোখে একবার ওনার দিকে তাকালাম । উনি তখন ওইসব কী বলছিলেন…!! উনি কি সত্যিই ওইসব বলেছিলেন নাকি আমার মনের ভুল…!! শুভ্রাংশুদাকে কি একবার জিজ্ঞাসা করবো ?? আমি এইসব ভেবে শেষে কিছু বলতে যাব ঠিক সেই মুহূর্তেই উনি হালকা ধমক দিয়ে উঠলেন ।

” সঙ্গীতা বড্ড কথা বলছো কিন্তু তুমি এবার..!! ডক্টর না বলেছে তোমাকে রেস্ট নিতে তাহলে এত কথা বলছো কেন ?? ”

আমি আর কিছু বললাম না মুখ ফুলিয়ে চুপচাপ বসে থেকে মনে মনে তাকে হাজারো গালি দিতে থাকলাম…. ” অসভ্য বাঁদর পোলা কোনহানকার , মুখ দিয়ে শুধু তিতো কথায় বের হয় ঠিকভাবে তো কথাই বলতে পারেনা । বজ্জাত ধলা বিলাই কোনহানকার , হুহ…!! আমারও বয়েই গেছে এর সাথে কথা বলতে , যতসব ফাউল পোলা । ”
.
.
.

নিজের ঘরে বিছানায় বসে আয়েশ করে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছি আমি আর আমার সামনে সুরভি চোখগুলো রসগোল্লার মত গোল গোল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে হাঁ করে । আজকে সকালেই আমি বাড়ি ফিরেছি হাসপাতাল থেকে আর কিছুক্ষণ আগে ও এসেছে আমার সাথে দেখা করতে । আর তারপর ওকে সেই রাস্তার ঘটনা থেকে শুরু করে হাসপাতালের বাবা বাবাই আর শুভ্রাংশুদার পুরো বিষয়টা বলার পর থেকেই এই মেয়ে এভাবেই বসে আছে । দেখে তো মনে সব শুনে শক খেয়েছে । আমি শেষে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম….” ওভাবে হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কেন ?? মুখ বন্ধ কর নাহলে মুখে মশারা তার পুরো পরিবার আর দলবল নিয়ে ঢুকে বসবাস শুরু করে দেবে । ”

আমার কথা শুনে ও সাথে সাথে মুখ বন্ধ করলো আর বলল…..

চলবে,……

তুমি যদি চাও
রাজেশ্বরী দাস ( রাজী )
পর্ব ৭

“ওভাবে হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কেন ?? মুখ বন্ধ কর নাহলে মুখে মশারা তার পুরো পরিবার আর দলবল নিয়ে ঢুকে বসবাস শুরু করে দেবে । ”

আমার কথা শুনে ও সাথে সাথে মুখ বন্ধ করলো আর বলল…..” আরে ওইসব ছার ,শুভ্রাংশুদা তোর বাবার বন্ধুর ছেলে…!!! সত্যিই…?? ”

এই সুরসুরির এমন বোকা বোকা কথা শুনে এবার আমি বেশ অনেকটা বিরক্তি নিয়েই ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম….” হ্যাঁ রে বাবা…। ”

” আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছেনা , এটা কোন স্বপ্ন না তো..!! এই সঙ্গু একটা চিমটি কাট তো..!! ”

আমি ওর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে দিলাম ওর হাতে জোরে একটা চিমটি কেটে । ও সাথে সাথে হাত ডলতে ডলতে মুখ কালো করে আমার দিকে তাঁকিয়ে বলল…” চিমটি কাটতে বললাম বলে এত জোরে চিমটি কাটলি…!! ধ্যাত…!! ”

” এবার বিশ্বাস হয়েছে এটা বাস্তব ?? নাকি আরেকটা দিবো ?? ”

” না থাক বুঝে গেছি এটা বাস্তব । তবে সঙ্গু একটা কথা কিন্তু মানতেই হবে কালকে কিন্তু শুভ্রাংশুদা ঠিক সময়ে সেখানে না পৌঁছলে অনেক কিছু হয়ে যেতে পারতো । ইশ…!! একদম হিরোর মত ঠিক সময়ে এন্ট্রি নিয়েছে এই নাহলে আমাদের শুভ্রাংশুদা । ”

আমি সুরভির কথা শুনে ভ্রু কুচকে সরু চোখে ওর দিকে তাকালাম ।

” এই সুরসুরির বাচ্চা আবার তুই শুভ্রাংশুদার প্রশংসার পুরো ভান্ডার খুলে বসলি..!! শুভ্রাংশুদার চামচা কোথাকার । হ্যাঁ এটা ঠিক যে উনি কালকে আমাকে বাঁচিয়েছেন তবে ওই ঘাড়ত্যাড়া ছেলে জীবনে শুধরাবে না কখনও , অসভ্য বাঁদর ছেলে কোনহানকার । খাটাস একটা । হুহ…!! ”

.
.
.
.

সকালে বেশ আরাম করেই ঘুমিয়ে ছিলাম কিন্তু সেই আরামের ঘুম আর দীর্ঘস্থায়ী হলো না । আমার মা ঘরে এসে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তাড়া দিয়ে বললেন যেন তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নিই । কারণ জিজ্ঞাসা করাই মা বলল আমাদের নাকি মামনি বাবাইদের বাড়ি যেতে হবে একটু পরেই । ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও তাই শেষে মায়ের কথায় একপ্রকার বাধ্য হয়েই নিজের জামাকাপড় , টাওয়েল আর বাকি সব জরুরি জিনিসপত্র নিয়ে আমি গেলাম ওয়াশরুমে ।
.
.
.
.

আমরা ওই বাড়ি পৌঁছতেই দেখি বাবাই আর মামনি বাড়ির বাইরেই দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন । আমরা যেতেই তারা আমাদেরকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন , তাদের বাড়িটা বেশ সুন্দর আর বেশ বড় এবং গোছালো ।

বড়রা সবাই ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলছে আর তাদের মাঝে আমি একা ছোট একটা মেয়ে বসে চুপচাপ ওদের কথা শুনছি । যদিও তাদের কথাগুলো শুনতে আমার বেশ ভালোই লাগছে , তাদের কথার বিষয়বস্তু হল বাবা আর বাবাই তারা ছোটবেলায় গ্রামে একসাথে ঠিক কতটা দুষ্টুমি করেছে , মজা করেছে , কলেজলাইফের কিছু মজার ঘটনা ইত্যাদি এইসব । কথার মাঝেই মামনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন…” সঙ্গু বড়দের মাঝে এভাবে বসে থাকতে তো তোর একঘেয়েমি লাগবে রে মা , আচ্ছা একটা কাজ কর তুই বরং গিয়ে বাড়িটা একটু ঘুরে ঘুরে দেখ কেমন ?? ”

আমি ভেবে দেখলাম কথাটা মামনি মন্দ বলেনি , সেটাই বরং ভালো হবে এই মুহূর্তে তাই আমি….” ঠিক আছে ” বলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম । মামনি আবারও বললেন….” একা একা কোন সমস্যা হবে না তো ?? ” আমি ছোট্ট করে…” না ” বলে সামনের সিড়ির দিকে পা বাড়ালাম ।

আমি দোতলার বারান্দাটা একটু ঘুরে দেখে সিড়ি বেয়ে গেলাম ওপরে বাড়ির ছাদের দিকে , ছাদটাও বেশ সুন্দর । আমি ছাদে গিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম আর ছাদের রেলিঙের গা ঘেষে দাঁড়ালাম । কিছুসময় ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পরে হঠাৎই আমার মনে হলো কেও হইতো আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে , আমি আশেপাশে চোখ বুলালাম কিন্তু তেমন কাউকে দেখতে পেলাম না । তবে যেইনা আমি পিছু ঘুরতে গেলাম অমনি হটাৎ শুভ্রাংশুদাকে দেখে চমকে উঠলাম । উনি আমার সামনেই পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছেন । উনি আমার দিকে কিছুক্ষন সরুচোখে তাকিয়ে থেকে আমাকে পাশ কাটিয়ে রেলিঙের গা ঘেঁষে দাঁড়ালেন , আর আমি বুকে ফুঁ দিয়ে ওনার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম….” আপনি..!! আপনি এভাবে ভূতের মত দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন ?? আর একটু হলেই তো এই নিষ্পাপ বাচ্চা মানুষটার হার্ট ফেইল হত । ”

উনি আমার দিকে ঘুরে তাকালেন আর বললেন…” কে নিষ্পাপ বাচ্চা মানুষ ?? ”

” অবশ্যই আমি ”

” তুমি বাচ্চা…!! আজ বিয়ে দিলে দুই দিন পর যে কিনা দুই বাচ্চার মা হয়ে যাবে সে আবার বলছে সে নাকি নিষ্পাপ বাচ্চা । ”

আমি তার কথাটা শুনে ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকিয়ে বললাম….” কী বললেন আপনি ?? ”

উনি আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে ফোন হাতে নিয়ে সেটার দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন…” কিছু নাহ । ”

আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম , জানি না হটাৎ কী মনে হল আমি আনমনেই তাকে জিজ্ঞাসা করে ফেললাম….” আচ্ছা শুভ্রাংশুদা আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে ?? ”

উনি কথাটা শুনে ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে ভ্রু কুচকে সরু চোখে আমার দিকে তাকালেন আর বললেন….” হটাৎ এই প্রশ্ন ?? ”

” না এমনিই মাথায় এলো তাই , বলুন না.. ”

উনি হালকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুব শীতল কণ্ঠেই উত্তর দিলেন….” গার্লফ্রেন্ড ঠিক না হইতো তবে একটা মায়াবতী আছে , যার সেই মিষ্টি মায়াভরা মুখ খুব টানে আমায় । বারবার মন চাই ছুটে যায় তার কাছে । প্রথম দেখাতেই নিজের অজান্তেই তার মায়ায় আটকা পড়েছি আমি আর ধীরে ধীরে দিনের পর দিন সেই মায়া গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে , সেই মায়া কেটে বেরোনো হইতো আমার কাছে অসম্ভব । কিন্তু সে খুব অবুঝ , কিছুই বোঝে না । ”

আমি কথাটা শুনে অবাক হয়ে হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে আছি , এই পোলা তো দেখি কারোর প্রেমে পুরো হাবুডুবু খাচ্ছে । আমি একটু চুপ থেকে আবারও ওনাকে বললাম…” আচ্ছা কে সে ?? কলেজের কেও নাকি আপনার অফিসের কেও আর নাকি অন্যকেও ?? ”

” যদি বলি তোমাদের কলেজেরই কেও একজন । ”

আমি চোখগুলো রসগোল্লার মত গোল গোল করে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম…” কী..!! আচ্ছা তাকে কি আমি চিনি ?? ”

” খুব ভালোভাবেই চিনো। ”

” কে সে ?? ”

উনি হালকা হাসলেন তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন…” কী ব্যাপার বলো তো আমার মায়াবতীকে নিয়ে তোমার এত কৌতূহল কীসের ?? ”

” আরে দেখুন আমি তো চাইলে তাকে গিয়ে বোঝাতেও পারি নাকি ?? আপনি সেইদিন আমাকে বাঁচিয়ে আমার এত বড় একটা উপকার করেছেন সেখানে আমি তো এইটুকু করতেই পারি আপনার জন্য । ”

উনি আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন….” থাক তোমার আর উপকার করা লাগবে না । ”

সেই মুহূর্তে নীচ থেমে ভেসে এলো মামনির হালকা কণ্ঠস্বর , মামনি ডাকছেন আমাদের তাই আমরা আর কথা না বাড়িয়ে নীচে ছাদ যাওয়ার জন্য অগ্রসর হলাম ।
.
.
.

নীচে আসতেই আমরা জানতে পারলাম , মা বাবা মামনি বাবাই তারা সবাই মিলে ঠিক করেছেন যে সামনে শুক্রবার অর্থাৎ আজ থেকে তিনদিন পর আমরা সবাই একসাথে বাবাইদের গ্রামের বাড়ি যাবো অর্থাৎ সেই গ্রাম যেখানে বাবাই আর বাবা তাদের ছোটবেলাটা কাটিয়েছেন । এবারের নববর্ষটা আমরা সবাই ওখানেই একসাথে কাটাবো । গ্রামে ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে আবার বেশ আনন্দই হল , আমি জীবনে এই প্রথম সেখানে যাবো । সেই গ্রামেই নাকি যদিও নাকি আমার বাবারও আগের বাড়ি রয়েছে কিন্তু আমরা সবাই যাবো বাবাইদের গ্রামের বাড়িতে । সেখানে অনেক বছর যাবৎ তারা কেও যায়নি এবং পরিবারেরও কেও সেখানে থাকেন না শুধুমাত্র দুইজন সেই বাড়িতে থাকেন যাদের রাখা হয়েছে সেই বাড়ির পরিচর্চা করার জন্য ।
.
.
.

কলেজের মাঠে থাকা অনেকদিনের পুরোনো এক কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে আমি আর সুরভি বসে আছি । আমার মাথায় এখনও সেই কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে যে কে হতে পারে শুভ্রাংশুদার সেই মায়াবতী , শুভ্রাংশুদা তো বলেছে এই কলেজেরই কেও একজন । তবে কে সে ?? আমি এইসব ভেবে সুরভির দিকে তাকিয়ে বেশ চিন্তিতভাবেই বললাম …” কে বলতো সে ?? ”

সুরভি একটু ভেবে বলল…” আমিও তো সেটাই ভাবছি আচ্ছা একটা কথা বলবো ?? সেই মায়াবতীটা তুই না তো আবার ?? ”

আমি কথাটা শুনে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে ওর মাথায় একটা গাট্টা মেরে বললাম…” এই সুরসুরি এত ফালতু কথা মাথায় আসে কেমনে বল তো তোর ?? ”

” যাহ বাবা..!! ভুল কী বললাম ?? হতেই তো পারে , না হওয়ার কী আছে ?? শুভ্রাংশুদা যেভাবে মাঝেমাঝে তোর দিকে তাকাই…”

” চুপ থাক তো তুই এমন কিছুই না । তুই আসলেই বেশি ভাবিস । তোকে আর ভাবা লাগবে না থাক আমিই খুঁজে নেবো না হয় । আচ্ছা সেসব না হয় বাদ দে এখন শোন তুই কিন্তু আমাদের সাথে গ্রামের বাড়ি যাবি মনে আছে তো ?? আন্টিকে তো মা ঠিক মানিয়েই নিয়েছে । ”

” হ্যাঁ অবশ্যই মনে আছে । আমি তো জামাকাপড় আর বাকি জরুরি সব জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়েও ফেলেছি এর মধ্যে । ইশ…!! যা মজা হবে না..!! ”

” হুমম আচ্ছা চল এখন আমরা ভেতরে যায় একটু পরেই আমাদের ক্লাস আছে । ”

” হ্যাঁ ঠিক আছে চল । ”

চলবে,….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here