তুমি যদি চাও,পর্ব ৮,৯

0
2619

তুমি যদি চাও,পর্ব ৮,৯
রাজেশ্বরী দাস ( রাজী )
পর্ব ৮

শুক্রবার সকালে সবাই রওনা হল বাবাইদের গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য , শুভ্রাংশুদাদের সাথে অর্ঘ্যদাও যাচ্ছে সেখানে । বেশ কিছুঘন্টা সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রায় দুপুরের দিকে আমরা পৌঁছলাম গ্রামে । গ্রামের বাড়ির সামনে গাড়ি এসে থামতেই আমরা সকলে গাড়ি থেকে নামলাম , বাড়ির সামনে একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা এবং একজন মধ্যবয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে ছিলেন আমরা নামতেই তারা হাঁসি মুখে এদিকে এগিয়ে এলেন । বাবাই আর বাবা তাদের সাথে আমাদের সবার পরিচয় করিয়ে দিলেন । তারা দুজন হচ্ছেন রূপসাকাকিমা এবং দোলনকাকা , তারা দুজন স্বামী-স্ত্রী এই গ্রামেরই বাসিন্দা , তারা দুজনই মূলত এতদিন ধরে এই বাড়ির পরিচর্চা করে এসেছেন । তাদের কথাবার্তা , ব্যবহার , আচার-আচরণ সত্যিই খুব ভালো । কিছু কথা শেষে দোলনকাকা বললেন..

” দাদাবাবু আপনারা এতটা পথ এয়েছেন নিশ্চয় এখন অনেক ক্লান্ত , আপনারা ভেতরে যান গিয়ে একটু বিশ্রাম নিন । আমি আপনাদের ব্যাগপত্রগুলোকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি আর আপনাদের কোন অসুবিধে হলে কোইবেন আমাদের । ”
.
.

আমরা সবাই ভেতরে এলাম রূপসা কাকিমা আমাদের ঘরগুলো দেখিয়ে দিলেন , তাদের আগে থেকেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল আমাদের এখানে আসার কথাটা , তাই তারা আগে থেকেই সবকিছু ঠিকঠাকভাবে গুছিয়ে রেখেছেন যাতে আমাদের সমস্যা না হয় । আমি আর সুরভি এখানে একসাথে একটা ঘরে থাকবো ।

আমি হাত মুখ ধুয়ে ঘরে আসতেই দেখি সুরভি বিছানায় মুখটাকে কেমন যেন বাংলার পাঁচের মত ভেটকে রেখে বসে বসে কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করছে , সেই গ্রামে আসার সময় থেকেই ওকে লক্ষ্য করছি ও আজ সকাল কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে আছে । আমি ওর দিকে কিছুক্ষন সরু চোখে তাকিয়ে থেকে , ওর পাশে গিয়ে বসে জিজ্ঞাসা করলাম… ” কী হয়েছে বল তো ?? ব্যাপার কী ?? সকাল থেকে এত কী ভাবছিস তুই ?? ”

ও মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো তারপর বলল… ” সঙ্গু রে আমি শেষ , মা বাবা তো আমাকে বলির পাঠা বানানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে । ”

আমি ওর কথার কোন আগা মাথা না বুঝে অবাক হয়ে বললাম… ” মানে..!! কী বলছিস এইসব ?? এই মাইয়া তুই বেশি আলতু ফালতু না বকে খোলসা করে বল তো কী হয়েছে ?? আসল ব্যাপারটা কী ?? ”

” বাবা মা আমার বিয়ে ঠিক করছে । ওরা আমার বিয়ে দিবে বলে পাত্র দেখছে , পছন্দ হলেই নাকি বিয়ে দিয়ে দিবে । ”

আমি ভাবলেশহীনভাবে ওকে উত্তর দিলাম…. ” ওহহ তো এটা নিয়ে এত ভাবার কী আছে ?? বিয়ে ঠিক করেছে তো বিয়ে করবি সেটা নিয়ে এত ভাবার কী আছে ?? টুকুস করে গিয়ে ছাদনা তলায় বিয়ের পিড়িতে বসবি , মুকুস করে সিঁদুরদান আর তারপর ঠুকুস করে গিয়ে ফুলসজ্জার ঘরে বসে যাবি ব্যাস আরকি । ”

ও মুখটা কাঁদো কাঁদো করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল…” সঙ্গু তুই কি মজা করছিস ?? ”

এবার ওর চেহারার এমন অবস্থা দেখে আমার একটু খারাপ লাগলো তাই আমি ওর গলা জড়িয়ে ধরে বললাম…” ওরে আমার সুরসুরি সোনা রে , আমার সুভু পেত্নীটা, কলিজার টুকরো বেস্ট ফ্রেন্ড আমার… আরে এখন থেকেই বিয়ের কথা ভেবে মন খারাপ করছিস কেন ?? আঙ্কেল আন্টি তো এখনই তোর বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে না , আর তারা যা করবেন সেট তো তোর ভালোর জন্যই করবেন তাই না ?? আচ্ছা এখন ঘুরতে এসেছিস ওইসব কথা ভেবে মন খারাপ করবি না একদম , কেমন ?? যা হবে দেখা যাবে , এবার হাঁস তো দেখি একটু । ”

ও আমার কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো আর সেটা দেখে আমিও মুচকি হাসলাম ।
.
.
.

সন্ধ্যের দিকে ঘুম ভাঙতেই আমি চোখ ডলতে ডলতে শুয়া থেকে উঠে বসলাম । অতটা পথ জার্নি করে আসার ফলে বেশ ক্লান্ত লাগছিল , তাই দুপুরে সামান্য কিছু খেয়েই ঘুমিয়ে পরেছিলাম আর এখন আমার ঘুম ভাঙলো । আমি পাশে তাকিয়ে দেখলাম সুরভি এখনও পাশবালিস জড়িয়ে ধরে আরাম করে ঘুমিয়ে আছে তাই আমি আর ওকে ডাকলাম না , পাশ থেকে নিজের ওড়নাটা নিয়ে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম , বাকি সকলেও হইতো এখন যে যার ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে । আমি আর বেশি না ভেবে তাই সোজা হেঁটে বাড়ির ছাদের দিকে গেলাম , এই দোতলা বাড়িটা কিছুটা পুরনো হলেও বেশ সুন্দর এবং অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে এটা আর এই বাড়ির মাঝে আবার বড় একটা উঠোনও আছে ।
.
.

আমি ছাদে যেতেই দেখলাম শুভ্রাংশুদা আর অর্ঘ্যদা ছাদে রেলিঙের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন । আমি তাদের দুজনের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম । অর্ঘ্যদা আমাকে খেয়াল করতেই মৃদু হেঁসে বললেন….” আরে সঙ্গীত তুমি এইসময় এখানে..!! ”

আমি মুচকি হেসে উত্তর দিলাম…” আসলে এমনিই ভাবলাম একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি । ”

সেইমুহূর্তে অর্ঘ্যদার ফোন বেজে উঠলো , উনি ফোন হাতে নিয়ে সেটার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে বললেন…” বাবা ফোন করছে , আব… তোমরা দাঁড়াও আমি আসছি এখনই কথা বলে । ”

অর্ঘ্যদা ফোনটা কানে ধরে কথা বলতে বলতে একটু দূরে সরে গিয়ে দাঁড়ালেন । আমি একবার অর্ঘ্যদার দিকে তাকিয়ে তার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শুভ্রাংশুদার দিকে তাকালাম তারপর সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম আর শুভ্রাংশুদার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম । শুভ্রাংশুদা সামনের দিক থেকে চোখ সরিয়ে একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবারও সামনের দিকে তাকালেন আর আমিও সামনের দিকে দৃষ্টিপাত করলাম । আকাশের পশ্চিমকোণে সূর্য মুখ লুকিয়েছে অনেক সময় পূর্বেই এবং চাঁদ উকি দিয়েছে । এইমুহুর্তে চন্দ্রিমার হালকা আলোয় আলোকিত হয়ে রয়েছে চারিপাশ দূরে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট একটা পুকুর তার পাশে কাঁচা মাটির রাস্তা , চারপাশে সবুজ গাছপালায় পরিপূর্ন প্রানবন্ত ও মনোমুগ্ধকর এই পরিবেশ , এইসব দেখেতেই মুহুর্তের মধ্যেই যেন আমার মনটা ভালো হয়ে গেল । এরই মধ্যে শুভ্রাংশুদা বলে উঠলেন….” খুব সুন্দর মনোমুগ্ধকর পরিবেশ তাই না ?? ”

আমি কথাটা শুনে তার দিকে তাকালাম , আর মুচকি হেসে বললাম…” হ্যাঁ ”

উনি হালকা হেসে আবারও সামনের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন । তাকে হাসলে সত্যিই খুব সুন্দর লাগে , ওনার কপালের ওপর পড়ে থাকা সামনে দিকের বড় চুলগুলো মৃদুমন্দ বয়ে চলা বাতাসে এদিক ওদিক দোল খাচ্ছে , চাঁদের আলোয় তার এই ফর্সা মুখ এখন যেন আরো স্নিগ্ধতা এবং শুভ্রতায় পরিপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে , তবে সবথেকে আকর্ষনীয় বিষয় হচ্ছে তার বাম গালের একটু নীচের দিকে এক পাশে ছোট্ট একটা তিল আছে , তিনি যখন হাঁসেন তখন আশ্চর্যজনক ভাবে সেটা যেন আরো ফুটে উঠে যা ওনার সৌন্দর্যকে আরো কিছুগুণ বাড়িয়ে তোলে । আমি মুগ্ধনয়নে চেয়ে রয়েছি ওনার দিকে , এরই মাঝে উনি আবারও আমার দিকে তাকালেন । তার চোখে চোখ পরতেই আমি কিছুটা লজ্জা পেয়ে ওনার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম , উনি সেটা দেখে সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন আর আমি মাথা নীচু করে থেকে জ্বিভ কেটে নিজেকে মনেমনেই বললাম…” উফ..!! কী করছিলাম আমি এটা ?? না না , এই পোলার ওপর ক্রাস খাওয়া যাবেনা , এমনিতেই সুন্দর কত মেয়ের ক্রাস আবার উপর থেকে বাবাই মামনির ছেলেও উনি । আর তাছাড়াও শুভ্রাংশুদা তো একজনকে ভালোবাসেন আর আর ক্রাস খেয়ে কাজ নেই । ”

আমি নিজের মনে এইসব ভাবছিলাম তখনই অর্ঘ্যদা ফোনে কথা বলা শেষ করে এদিকে এগিয়ে এলেন কিন্তু ঠিক সেইমুহূর্তেই শুভ্রাংশুদা সামনে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন… ” আচ্ছা অনেক রাত হচ্ছে এবার নীচে চলো সবাই । ”

অর্ঘ্যদা ওনার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন বললেন….” আচ্ছা ঠিক আছে বলছিস যখন চল তবে আর এমনিতেও কালকে আবার নববর্ষ কত কাজ আছে তাড়াতাড়িও তো উঠতে হবে সবাইকে । আচ্ছা সঙ্গীত চলো তুমিও নীচে । ”

” আচ্ছা চলুন ”

আমি আর অর্ঘ্যদা বেশি কথা না বাড়িয়ে নীচে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম ।

শুভ্রাংশু যেতে গিয়েও থেমে গেল , ওর মনে হচ্ছে কেও ওদেরকে পর্যবেক্ষণ করছে তাই ও আবার ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরের দিকে তাকাল কিন্তু তেমন কাউকে দেখতে পেল না । ও কিছু একটা ভেবে সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে নীচে যাওয়ার জন্য হাঁটা ধরল ।
.
.
.
পরেরদিন সকালে পাখির কিচিরমিচির শব্দে আর মায়ের হালকা ডাকে ঘুম ভাঙলো আমার , ঘুম থেকে উঠতেই আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিলাম । আজকে পহেলা বৈশাখ , বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসারে বছরের প্রথম দিন , সকল বাঙালিদের কাছেই আজকের দিকটা অনেক গুরুত্বপূর্ন একটা দিন ।

আমি আজকে বাসন্তী আর লাল রঙের সংমিশ্রণের একটি শাড়ি পরলাম , হাতে লাল চুড়ি , কানে ছোট্ট একজোড়া ঝুমকো , চোখে গাঢ় করে কাজল আর ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক সাথে কপালে ছোট্ট একটা লাল টিপ । আমি তৈরি হয়ে চুলগুলো হাতখোঁপা করতে করতেই ঘর থেকে বেরোলাম , সুরভি একটু আগেই তৈরি হয়ে বাইরে বাকিদের কাছে গেছে….

চলবে,……

তুমি যদি চাও
রাজেশ্বরী দাস ( রাজী )
পর্ব – ৯

আমি তৈরি হয়ে চুলগুলো হাতখোঁপা করতে করতেই ঘর থেকে বেরোলাম , সুরভি একটু আগেই তৈরি হয়ে বাইরে বাকিদের কাছে গেছে । বাড়ির উঠোনেই সবাই উপস্থিত রয়েছে এখন , আমিও তাই উঠোনের দিকেই যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম । সেখানে পৌঁছে বারান্দা থেকেই উঠোনের দিকে চোখ পরতেই শুভ্রাংশুদাকে দেখে আমি এন সেখানেই থমকে গেলাম , একদৃষ্টে মুগ্ধ নয়নে তার দিকে চেয়ে সেখানেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছু মুহুর্তের জন্য । নীল পাঞ্জাবিটা বেশ সুন্দর মানিয়েছে তাকে , সত্যিই অসম্ভব সুন্দর লাগছে । হটাৎ আমার মনের মাঝে কিছু ভাবনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো , আচ্ছা তাকে দেখে আমার এমন অনুভূতি হয় কেন ?? না এটাকে তো ক্রাস বলা চলে না , তাহলে ?? এমন নয় তো যে আমি ধীরে ধীরে তাকে ভালোবেসে ফেলছি ?? আচ্ছা আর এমন নয় তো যে সুরভি যা বলছিল সেদিন সেটা ঠিক ?? এমনটা হলে কি খুব খারাপ কিছু হবে ??
নিজের এরূপ ভাবনায় নিজেই বিস্মিত হয়ে উঠলাম আমি , এইসব কী ভাবছি আমি আর কেনই বা ভাবছি ?? না যদি তাকে নিয়ে আমার মনে কোন অনুভূতি সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে তো সেটা ঠিক না , উনি মামনি বাবাইয়ের ছেলে আর তাছাড়াও উনি তো অন্য কাউকে ভালোবাসেন আর সেটা আমি কীভাবে হতে পারি ?? ওনার মায়াবতী নিশ্চয় কোন সুন্দরী রমণীই হবে , আমি নই ।

এইসব ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমি পাশে তাকালাম , মা মামনি বাড়ির বাকি সবাই আর গ্রামের কিছুজন মানুষ সেখানে ছিলেন পূজো দেখছিলেন । নববর্ষ উপলক্ষে পূজোর আয়োজন করা হয়েছিল এই বাড়িতে আজ , আমি সেদিকেই হেঁটে গেলাম আর মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম ।

অন্যদিকে , সঙ্গীতার দিকে শুভ্রাংশুর চোখ পড়তেই ও একদৃষ্টে মুগ্ধনয়নে তাকিয়ে রইলো সঙ্গীতার দিকে ।

” কী ব্যাপার শুভ্রাংশুদা ওদিকে আমার কলিজার টুকরো বেস্ট ফ্রেন্ডের দিকে তাকিয়ে কী দেখেন হুম ?? ”

হটাৎ সুরভির বলা এই কথাটা কানে আসাতেই শুভ্রাংশু কিছুটা থতমত খেয়ে সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে পাশে তাকালো , সুরভি সন্ধিহান দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে । শুভ্রাংশু কিছু বলবে তার আগেই সুরভি মুখ টিপে হেসে বলল… ” থাক আর বলতে হবে না আপনাকে , বুঝি বুঝি সবই বুঝি । ”

শুভ্রাংশু একনজর সঙ্গীতার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সুরভির দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল…” যদি তোমার বান্ধবীও এটা বুঝতো…!! ”

সুরভি সেটা শুনে একটু ভেবে বলল…” হুমম , না বুঝলে বুঝান , মায়াবতী যখন আপনার তাহলে বুঝানোর দায়িত্বও তো আপনার । আমি বরং আসি , সঙ্গু…। ”

সুরভি এদিকে আমার পাশে দাঁড়ালো । আমি ওরদিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞাসা করলাম কী হয়েছে ও ইশারায় মাথা নেড়ে জবাব দিল কিছু না ।
.
.

কিছুসময় বাদে পূজোর পর্ব শেষ হল , সকলে একসাথে বসে কিছু খাবার খেল । এই বাড়িটা আমি পুরোপুরি ঠিকঠাকভাবে ঘুরে দেখিনি তাই ভাবলাম এখন একটু পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখবো । সুরভিকে বলাই ও বলল ও পরে ঘুরবে , তাই আমি একাই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম । আমি পিছু ঘুরে এক পা বাড়াতেই ….. ” সঙ্গীত ” ডাকটা কানে আসায় পাশে তাকালাম , অর্ঘ্যদা দাঁড়িয়ে আছেন । উনি আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে মৃদু হাসলেন আর বললেন…. ” তোমাকে শাড়ি পড়লে দেখতে আরো বেশি সুন্দর লাগে , সত্যিই খুব মিষ্টি লাগছে । ”

আমি ওনার কথা শুনে হালকা হেসে বললাম….” আপনাকেও সত্যিই খুব সুন্দর লাগছে অর্ঘ্যদা । ”

উনি আমার কথাটা শুনে মুচকি হাসলেন । ঠিক তখনই পাশ থেকে শুভ্রাংশুদার ডাক কানে আসায় অর্ঘ্যদা সেদিকে চলে গেলেন আর আমিও বেশি না ভেবে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম ।

.
.

আমি ঘুরে ঘুরে পুরো বাড়িটা দেখছিলাম , তখনই দোতলার একটা ফাঁকা ঘরের সামনাসামনি আসতেই হটাৎ কেউ একজন আমার হাত ধরে ঘরের ভেতর টেনে নিয়ে দেওয়ালের সাথে আমার দুই হাত চেপে ধরল । এরূপ ঘটনায় আমি কিছুটা ভয় পেয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে ফেললাম , বুঝতে পারলাম সামনে থাকা ব্যাক্তিটি আমার খুব কাছেই আছে তার নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে আমার মুখের ওপর , আমি চোখ খুলে সামনে তাকাতেই দেখলাম শুভ্রাংশুদা দেওয়ালের সাথে আমার দুই হাত চেপে ধরে আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন । আমাকে চোখ খুলতে দেখে উনি আমার দুই হাত ছেরে দিলেন , তবে আমি সরে যেতে নিলে দেওয়ালের দুই পাশে হাত রেখে আমার পথ আটকালেন এবং ওভাবেই আমার দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রইলেন । আমি সরুচোখে কিছুক্ষন তার দিকে তাঁকিয়ে বললাম….” আপনি…!!! ”

উনি শীতল কন্ঠে উত্তর দিলেন….” অবশ্যই আমি , তাছারা আমার মায়াবতীকে ছোঁয়ার সাহস আর কার থাকতে পারে বলো তো সঙ্গীপাখি ?? ”

ওনার এমন কথা শুনে আমি চোখদুটো বড় বড় করে ওনার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বললাম…” মানে…!! ক..কী বলছেন আপনি এইসব ?? সঙ্গীপাখি…!! আর মায়াবতী তো আপনার…”

বাকিটা বলার আগেই উনি উত্তর দিলেন….” তুমিই জান ”

আমি অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম , কী বলছেন উনি এইসব ?

উনি কিছুসময় চুপ থেকে আমার চোখের নীচের লেপটে যাওয়া কাজল নিজের বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে মুছে ফেলে বললেন….” তুমি কি আমাকে পুরো পাগল বানিয়েই ছাড়বে বলে ঠিক করেই নিয়েছো ?? ”

উনি আমার দিকে আরেকটু ঝুঁকে কানের কাছে এসে অত্যন্ত ধীরকণ্ঠে ফিসফিস করে বললেন….” এত পুড়াও কেন বলো তো তুমি এভাবে আমার মনটাকে সঙ্গীপাখি , মনে রেখো এবার থেকে আমার মনকে পুড়ালে কিন্তু তার ফল তোমাকেই ভোগ করতে হবে । ”

উনি এই কথাটা বলে আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে পকেটে হাত গুজে দাঁড়ালেন তারপর আমার দিকে একনজর তাকিয়ে বাঁকা হেসে চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন । আমি কিছুসময় সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম স্তব্ধ হয়ে তারপর সেই ঘর থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে হাঁটা ধরলাম সামনের দিকে , আমার মাথায় তার বলা কথাগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে । তার সেই মায়াবতী তারমানে আমিই , এই কথাটা ভাবতেই নিজের অজান্তেই মুখে মুচকি হাঁসি ফুটে উঠলো আমার যার কারণ হইতো আমার নিজেরও অজানা ।
.
.
.

ঘরে বসে নিজের ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে গভীর মনোযোগ সহকারে কিছু বিষয় নিয়ে ভাবছে শুভ্রাংশু , ঠিক সেই মুহূর্তে বেজে উঠলো ওর ফোন ও ফোনের স্ক্রিনের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলো…মিস্টার দত্ত….নামটা ভেসে উঠেছে । ও ফোনের সাথে ব্লুটুথটা কানেক্ট করে সেটাকে কানের একপাশে গুঁজে ফোনটাকে পাশে রাখল আর তারপর অপরপাশে থাকা ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো….” ইয়েস স্যার , বলুন । ”

ফোনের ওপাশ থেকে মিস্টার দত্ত বলে উঠলেন…” অফিসার শুভ্রাংশু তোমার কাজ ঠিকঠাক চলছে তো ?? ”

” ইয়েস স্যার , সব ঠিকঠাকই আছে । ”

” তুমি বয়সে আমাদের থেকে ছোট হলেও তোমার বুদ্ধি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ , আর আমরা জানি তুমি এই কেসটাকে খুব সুন্দরভাবেই সামলাতে পারবে তাই তোমাকে আর তোমার টিমকে এই কেসটা দেওয়া হয়েছে । আমার আর ডিপার্টমেন্টের বাকি সবার ভরসা আছে তোমার ওপর । ”

” ধন্যবাদ স্যার , আর আমরা সবাই চেষ্টা করবো এই ভরসা যেন কখনও না ভাঙে । আমাদের টিম নিজেদের সবটুকু দিয়ে ইনভেস্টিগেশন চালিয়ে যাচ্ছে , এর মধ্যে যে নামটা উঠে এসেছে সেটা হল মিস্টার এস.আর. অর্থাৎ এইসমস্ত বাজে কাজ , দেশের বিরুদ্ধে করা এইসব বেআইনি কাজগুলো যাদের দিয়ে করানো হচ্ছে তাদের হেড ও , কিন্তু এই ব্যক্তিটি কে ? কী এর পরিচয় ? পুরো নাম কী কিছুই এখনও জানা যায়নি । তবে চিন্তা করবেন না স্যার সেটাও খুব শীঘ্রই জানতে পারবো আমরা ঠিক , সে আর বেশিদিন আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারবে না । ”

” হুমম , আচ্ছা শুভ্রাংশু একটা কথা বলি । নিজের খেয়াল রেখো সেই ব্যক্তি যেই হোক না কেন সে যে কোন এক সাধারণ ব্যক্তি নয় এটা তো আমরা সবাই খুব ভালোভাবেই জানি , সে অনেক ভয়ংকর তাই বলবো সাবধানে থেকো । ও অবশ্যই বুঝতে পেরেছে যে তুমি এবং তোমার টিম ওকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছো , ও কিন্তু চেষ্টা করতে পারে তোমার ক্ষতি করার । ”

” হুমম ”

মিস্টার দত্ত কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন…” আচ্ছা শুভ্রাংশু এবার ব্যক্তিগত একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো ?? ”

” ইয়েস স্যার বলুন । ”

” আহা.. তোমাকে না কতবার বলেছি দত্ত আঙ্কেল বলেই ডাকবে , স্যার বলার প্রয়োজন নেই । ”

শুভ্রাংশু হালকা হেসে বলল…” আচ্ছা দত্ত আঙ্কেল বলুন । ”

” উম , তোমার টিমমেম্বার সৌম্য আর বাকিদের থেকে কিছু কথা শুনলাম , সঙ্গীতাটা ঠিক কে বলো তো ?? ”

শুভ্রাংশু কথাটা শুনে নিজের মনেই ভাবলো যে টিমের ওই দুইতিনজন সঙ্গীতার বিষয়ে একটু আধটু জানতো । তারমানে সেটা ওরা দত্ত আঙ্কেলকেও বলে দিয়েছে , এদের নিয়ে আর পারা যায়না উফ..!! শুভ্রাংশু এইসব ভেবে গলা ঝেড়ে কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেই বলল….” দত্ত আঙ্কেল সঙ্গীতা মানে আসলে ঐতো…ও আমার পাপার বন্ধুর মেয়ে । ”

মিস্টার দত্ত কিছুটা সন্ধিহান কণ্ঠে বললেন…” শুধুই বাবার বন্ধুর মেয়ে নাকি অন্যকিছুও ?? ”

শুভ্রাংশু হটাৎ এই কথা শুনে বিষম খেল , মিস্টার দত্ত সেটা দেখে বললেন…” তুমি কি ঠিক আছো শুভ্রাংশু ?? ”

শুভ্রাংশু নিজেকে সামলে নিয়ে মেকি হাসার চেষ্টা করে বলল…” হ্যাঁ আমি ঠিক আছি , ওই আসলে… ”

মিস্টার দত্ত হালকা হাসলেন তারপর বললেন….” থাক , বুঝেছি আর বোঝাতে হবেনা তোমাকে । আচ্ছা তুমি তবে নিজের কাজে মন দাও আর বাকিসব দিকেই খেয়াল রাখো এবং আবারও বলবো সাবধান । ”

” ওকে দত্ত আঙ্কেল । ”

শুভ্রাংশু ফোন রেখে দিয়ে ল্যাপটপের দিকে তাকাল , তারপর নিজের মনেই বলল…” মিস্টার এস.আর তোকে তো আমি যেভাবেই হোক খুঁজে বের করবোই , আর তোর কাজের প্রাপ্য শাস্তিও তুই ঠিকই পাবি । ”

.
.
.

রুমের বিছানায় শুয়ে সিলিংফ্যানের দিকে তাকিয়ে আনমনে কিছু কথা ভেবে চলেছি আমি , সুরভির হালকা ধাক্কায় আমার হুশ ফিরল আমার । আমি ওর দিকে তাকিয়ে শুয়া থেকে উঠে পা গুটিয়ে বসলাম । ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে হা করে , সেটা দেখে আমি ওর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললাম… ” কী হল ওভাবে আমার দিকে তাকিয়ে কী দেখছিস তুই ?? ”

” তুই কালকে থেকে এমন অন্যমনস্ক হয়ে থাকছিস আবার মাঝে মাঝে নিজের মনেই মুচকি মুচকি হাসছিস । তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে তুই কারোর প্রেমে পড়েছিস । কী ব্যাপার বল তো ?? ”

আমি ওর কথা শুনে কিছুটা আমতা আমতা করে বললাম…” ম..মোটেও না , এমন কিছুই না । ”

” তাহলে ?? ”

আমি কিছু বলবো তার আগেই হটাৎ বাইরে থেকে হইহুল্লোর আর হালকা কান্নাকাটির শব্দ ভেসে এলো । আমি আর সুরভি সেটা শুনে অবাক হয়ে একবার একে-অপরের দিকে তাকালাম । আমি উঠে গিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকালাম , বুঝলাম আওয়াজটা যথাসম্ভব পাশের বাড়ি থেকে আসছে । সুরভি আমার পাশে এসে দাঁড়াল , ও আমাকে জিজ্ঞাসা করলো…” কী হয়েছে বল তো ?? ”

” বুঝতে পারছি না তো…..

চলবে,……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here