তুমি যদি চাও,পর্ব ১৪,১৫
#রাজেশ্বরী দাস ( রাজী )
পর্ব ১৪
জ্ঞান ফিরতেই আমি অনুভব করলাম আমি বিছানার ওপর শুয়ে আছি , পরমুহুর্তেই আমার মনে পড়লো জ্ঞান হারানোর আগের ঘটনাগুলোর কথা আমি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালাম আর শুয়া থেকে উঠে বসলাম , মাথাটাও কেমন যেন ভার হয়ে আছে আমার । আশেপাশে চোখ বুলাতেই আমি অবাক হলাম , আমি একটা ঘরে শুয়ে আছি ঘরটা প্রায় অন্ধকার তবে অন্ধকারের মাঝেও যতটুকু বুঝলাম নাহ এটা তো আমার ঘর না । এই জায়গাটা তো আমার কাছে বড্ড অচেনা । ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না । আমি আমার গলায় থাকা লকেটটা হাত দিয়ে চেপে ধরলাম এবং কিছুটা ভীতির সহিত আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে দাড়ালাম ।
” সঙ্গীপাখি ”
হটাৎ সেই অতীব চেনা কণ্ঠস্বরের এই ডাক কানে আসায় আমি পাশে সেই ঘরের ব্যালকনির দিকে তাকালাম , ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম ব্যালকনির দিকে । আমি যতই সেইদিকে এগিয়ে যাচ্ছি ততই আমার হৃদয়ের ধুকপুকানি যেন বেড়েই চলেছে । ব্যালকনির কিছুটা কাছাকাছি যেতেই আমি বুঝতে পারলাম একজন ব্যক্তি ব্যালকনিতে উল্টোদিকে মুখ ফিরে দাড়িয়ে আছেন । আমি তার দিকে আরো দু পা এগিয়ে যেতেই সে আমার দিকে ঘুরে তাকালো , চাঁদের এই হালকা জ্যোৎস্নার আলোয় তার মুখ দৃশ্যমান হতেই আমি সেখানেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পরলাম , মনের মাঝে কেমন যেন একটা করে উঠলো আমার , চোখের মাঝে জড়ো হলো জলরাশি , ধীরে ধীরে তা বাঁধ ভেঙে গড়িয়ে পরলো গাল বেয়ে । আমি সেখানেই হাঁটু মুড়ে বসে পরলাম এবং কম্পিত কণ্ঠে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলাম….” অংশু…” আমি কথাটা বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলাম । উনি আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার সামনে অনেক কষ্টে দুই হাঁটু ভাঁজ করে বসলেন এবং আমার দুই গালে হাত রাখলেন ।
” এই জান প্লীজ আর কেঁদো না , আমি আছি তো কিছু হয়নি তো আমার । আমি তো আছি তোমার সাথে । মায়াবতী…সঙ্গীপাখি…প্লীজ…”
আমি কাঁদতে কাঁদতেই বলে উঠলাম….” আপনি এমন কেন করেন বলুন তো আমার সাথে সবসময় ?? এভাবে কষ্ট কেন দেন আপনি আমাকে ?? আপনি জানেন আমার অবস্থা কী হয়েছিল ?? আরেকটু হলে হইতো আমি মরেই….”
বাকিটা বলতে না দিয়ে উনি আমার মুখ চেপে ধরলেন আর ধমকের সুরে বললেন….” শার্ট আপ..!! কী বলছো তুমি এইসব ?? স্বার্থপরের মত এমনটা বলতে পারলে তুমি ?? তোমার কিছু হলে আমার কী হবে জান ?? ”
আমি ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলাম । উনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন , আমার কান্নার গতি কমার পরিবর্তে আরো যেন বেড়ে গেল । অনেক কথা বলতে চেয়েও বলতে পারছি না আমি , গলার কাছে এসে সব কথাগুলো যেন কুণ্ডলী পাকিয়ে আটকে যাচ্ছে । উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন….” আচ্ছা বাবা চুপ , চুপ.. আরে চুপ করো জান শান্ত হও প্লীজ , এভাবে কেঁদো না প্লীজ..”
উনি আমার মুখ তুলে তার সামনে এনে নিজের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে আমার দুই চোখের জল মুছে দিলেন তারপর চোখের পাঁপড়ি জোড়াই নিজের নরম ওষ্ঠের উষ্ণ ছোঁয়া দিয়ে দুই গালে হাত দিয়ে আমার কপালে নিজের কপাল ঠেকালেন এবং কিছুক্ষন ওভাবেই চুপ করে থাকলেন তারপর শীতল কণ্ঠে বললেন….” জান…”
আমি মুখ উচুঁ করে ওনার দিকে তাকালাম ভালোভাবে , উনি করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন । তার মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে আছে , চোখে মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে ক্লান্তির ছাপ , চুলগুলোও কেমন যেন এলোমেলো হয়ে রয়েছে , কপালে ব্যান্ডেজ ঠোঁটের একপাশে কেটে যাওয়ার দাগ হালকা এই হালকা আলো-আঁধারের মাঝেও বোঝা যাচ্ছে । তার মুখের দিকে তাকাতেই আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো আমার , আমি ওনার দুই গালে হাত রাখলাম, নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে বললাম….” আপনি…আপনার এই অবস্থা কেন ?? আর কোথায় ছিলেন আপনি ?? ওরা সবাই যে বলছিল আপনি নাকি সেদিন ও..ওখানে…..”
আমি আবারও ফুফিয়ে উঠলাম , উনি আমার দুই গালে হাত রেখে বললেন….” বলবো জান সবটা বলবো , শুধু তুমি আগে শান্ত হয়ে বসো । প্লীজ… ওয়েট…”
উনি উঠে দাড়ালেন , আর তারপর ঝুঁকে আমাকে কোলে তুলে নিলেন । উনি এগিয়ে গিয়ে আমাকে বিছানায় বসিয়ে দিলেন তারপর ঘরের লাইটটা জ্বালালেন , উনি আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন । আমি কিছু বলবো তার আগেই দরজা ঠেলে অর্ঘ্যদা আর একজন মধ্যবয়স্ক লোক ঘরে প্রবেশ করলেন । ওনারা এদিকে এগিয়ে এসে আমার সামনে দাড়াতেই আমি বললাম….” অর্ঘ্যদা আপনি..!! আপনি তারমানে জানতেন তাও আপনি…….”
অর্ঘ্যদা ব্যস্ত ভঙ্গীতে বলে উঠেলন…” আরে আরে এই না না , আমি আগে জানতাম না এইসব কিন্তু এখন জানি । ”
আমি সেই মধ্যবয়স্ক লোকটার দিকে তাকালে উনি ( শুভ্রাংশু ) তাকে উদ্দেশ্য করে আমাকে বললেন….” উনি দত্ত আঙ্কেল । ”
আমি ওদের সবার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে অবাক নয়নে চেয়ে রইলাম অংশুর দিকে , উনি হইতো আমার দৃষ্টির অর্থ বুঝলেন তাই আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন….” এটা আমারই একটা ফ্ল্যাট জান আর কিছুদিন আমরা এখানেই থাকবো ”
উনি কিছুক্ষন থেমে আবারও বললেন….” আর তুমি জানতে চাও তাই তো যে সেদিন ঠিক কী হয়েছিল , এটা কোথায় আর বাকিসব ?? ”
আমি হালকা সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম , উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন….” অনেক দিন থেকে আমরা একটা কেস নিয়ে কাজ করছিলেন , সেটার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমাকে আর আমার টিমকে । আমরা একজনকে ধরার চেষ্টা করছিলাম মিস্টার এস.আর , অর্থাৎ মিস্টার সমীর রয় । আন্ডার ওয়াল্ডের অনেক বড় মাফিয়া , দেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বেআইনি কাজ করে ও । আমরা ওকে খোঁজার জন্যই ইনভেস্টিগেশন করছিলাম , এভাবে চলতে চলতে আমরা খবর পাই যে সেইদিন নদীর ধারের যে বড় গোডাউনটা আছে সেখান থেকে বেশ কিছু বেআইনি জিনিস পাচার করা হবে আর ওখানে সেদিন মিস্টার এস.আর উপস্থিত থাকবে এবং তার বেশিজন লোক সেখানে হইতো সেদিন থাকবে না । আমরা ঠিক করি যে সেইদিনই ওকে আমরা ধরবো , বাট ওটাই ছিল আমাদের ভুল । কারণ ওটা ওই মিস্টার এস.আর. এর প্ল্যান ছিল , ও আমাদের জন্য জাল বিছিয়েছিল আর সেই জালে আমরা পা দিয়েছি । সেইদিন আমি অ্যান্ড আমার টিমের রীতু আকাশ আর রাসেল , আমরা চারজন প্ল্যানমতই সেখানে যায় , আমরা সেখানে প্ল্যান মত নিজেদের পজিশনে আড়ালে লুকিয়ে থাকি , পাশে থাকা একটা ট্রাককে দেখে আমার সন্দেহ হয় কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল । মিস্টার এস.আর এবং ওর কিছু লোক সেখানে আসে , ওরা কথা বলছিল ঠিক সেই মুহূর্তে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আকাশের পা স্লিপ করে অ্যান্ড ও ওদের সামনে গিয়ে পরে তাই আমরাও সেই মুহূর্তেই ওদের সামনে বেরিয়ে আসি । মিস্টার এস.আর -এর সাথে থাকা ওই চার পাঁচজন লোকগুলোকে তো আমরা সামলে নিই । তবে তারপর ট্রাক থেকে বেশ কিছুজন লোক বাইরে বেরিয়ে আসে আর হটাৎ আমাদের ওপর আক্রমণ করে । ওই মিস্টার এস.আর আমার চোখের সামনে আমার টিমের সবাইকে সুট করে মেরে ফ্যালে তবে মিস্টার এস.আর চেয়েছিল আমি যেন ওর সাথে হাত মিলায় কিন্তু না সেটা কখনও সম্ভব ছিল না । আমি না করাই ওরা আমাকে মারতে চেয়েছিল ঠিকই কিন্তু সৌভাগ্যবশত আমি বেচেঁ যায় , ওরা আমাকে আধমরা অবস্থায় সেখানেই ফেলে চলে যায় আর গোডাউনে আগুন লাগিয়ে দেয় , কিন্তু অনেক কষ্টে উঠে আমি নদীর পাশে গোডাউনের যে জানালাটা ছিল সেটা দিয়ে ঝাঁপ মারি । আমি নদীতে গিয়ে পরি , এক সময় ভাসতে ভাসতে কিনারায় আসি আর পরে দত্ত আঙ্কেলরা আমাকে পান । আর সকলের কাছে আমি মৃত হয়ে থেকেছি শুধুমাত্র ওই এস.আর -এর জন্য , ও যদি জানতো তবে আমার জ্ঞান ফেরার আগেই ও আমাকে মারার চেষ্টা করতো তাই দত্ত আঙ্কেল এমন করেছিলেন অ্যান্ড জ্ঞান ফেরার পর আমি ভেবেছিলাম এভাবে গোপনে থেকেই ওকে ধরার জন্য কিছু না কিছু উপায় বের করবো । কিন্তু ওই এস.আর হইতো কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে তাই তো আমাদের অ্যান্ড তোমাদের বাড়ির আশেপাশে ওর লোকেরা ঘুরে বেড়াচ্ছিল , আর সেই জন্যই তো আজকে এত কৌশল করে তোমাকে অজ্ঞান করে আনতে হল যাতে কেও টের না পাই । জানো সেদিন চেয়েও আমি আমার টিমের কাউকে বাঁচাতে পারিনি , কাউকে না , তবে হ্যাঁ ওই এস.আর এর প্রাপ্য শাস্তি আমি ওকে দেবোই , সেটা যেভাবেই হোক। ”
অন্যদিকে মুখ ফিরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো শুভ্রাংশু । দত্ত আঙ্কেল কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে উঠলেন….” শুভ্রাংশু সেদিন সৌভাগ্যবশত তুমি বেচেঁ গেছিলে , কিন্তু এবার তো ও তোমায় ছাড়বে না । ”
” দেশের জন্য আমি সব করতে পারি , ওর জন্য কত নিষ্পাপ মানুষ প্রান হারিয়েছে । ওকে আমি শাস্তি দেবোই স্যার । ”
মিস্টার দত্ত শুভ্রাংশুর দিকে তাকিয়ে শুভ্রাংশুর কাধে হাত রেখে বললেন…” ঠিক আছে , তবে আবারও বলবো সাবধান ও কিন্তু যথেষ্ট ভয়ংকর সেটা তুমি আশা করি খুব ভালোভাবেই জানো । ”
মিস্টার দত্ত আর কিছু না বলে চলে গেল , অর্ঘ্যদা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন….” আমি বা আমরা কেউই জানতাম না এইসব , আমরাও আজকেই জেনেছি । ”
আমি ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম….” বাড়ির বাকিরা । ”
শুভ্রাংশু মুচকি হেঁসে বলল….” ওরা সবাই একদম ঠিক আছে , আর ওদের যথেষ্ট পরিমাণে সিকিউরিটি দেওয়া হয়েছে চিন্তা কোরো না অ্যান্ড ওরা সবটা জানে এখন । ”
অর্ঘ্য….” ওয়েট “….. বলে কাউকে একটা যেন ফোন দিল , তারপর ফোনটা আমাদের সামনে এসে ধরলো । ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই বুঝলাম উনি বাড়ির সবাইকে কল দিয়েছেন হইতো । ফোনের ওপাশ থেকে সকলের হালকা কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো , মামনি বলল….” মা রে শোন আর চিন্তা করিস না বেশি দেখ ও তো ঠিক আছে , আর আমরা সবাই একদম ঠিক আছে । আর ছেলেটা সত্যিই খুব পাজী হয়েছে ”
আমি ওদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম , উনি ফোনটা নিজের হাতে নিয়ে বললেন….” এটা ঠিক না বৌমার জন্য নিজের ছেলেকে ভুলে গেছো তুমি মাম্মা ? আমাকে এমন বলতে পারলে তুমি ? ”
ফোনের অপরপাশ থেকে মামনি আবারও বললেন…” অবশ্যই পারলাম , তোর তো কান মুলে দিতে ইচ্ছে করছে আমার । সঙ্গীতা শোন আমার হয়ে তুই মুলে দিস তো ওর কান । ”
উনি কথাটা শুনে হাসলেন , ওপাশ থেকে আমার মা বলে উঠলেন…” অংশু বাবা নিজেদের খেয়াল রাখিস কেমন ??
” হুম রাখবো , তোমরা চিন্তা কোরো না । ”
সেই মুহূর্তে ডক্টর আদিত্য রয় ঘরে এলেন । আমি আদি দার দিকে তাকালাম অংশু…” আচ্ছা পরে কথা বলছি তোমাদের সাথে ” বলে ফোনটা কেটে অর্ঘ্যদাকে দিলেন ।
আমি আদি দার দিকে তাকিয়ে বললাম….” আপনি…!! ”
আদি দা উত্তর দিলেন….” আমিই ওর ট্রিটমেন্ট করছি সঙ্গীতা । ”
আদিত্য কিছুক্ষন থেমে আবারও বলল….” তুমি সত্যিই ভাগ্যবতী সঙ্গীতা , শুভ্রাংশু তোমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে তাই তো দুই দিন পর ওর যখন জ্ঞান ফিরল ও সবার প্রথমে তোমার খোঁজ করেছিল , ও ওই অবস্থাতেও ছুটে গিয়েছিল তোমাকে শুধু এক নজর দেখার জন্য , যেখানে অন্য কেউ হলে হইতো উঠে দাড়াতেও পারতো কিনা সন্দেহ আছে । ” অংশুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি চুপচাপ দাড়িয়ে আছেন আদি দা আবারও বললেন….” শুভ্রাংশু নিজের খেয়াল রাখো তুমি এখনও সুস্থ্য নও , গুলিটা তোমার হাতে লেগেছিল ঠিকই কিন্তু ওরা যেভাবে তোমার ওপর অত্যাচার করেছে…”
আদিত্য বাকিটা বলতে গেলে শুভ্রাংশু ইশারায় থেমে যেতে বলল , আদিত্য বুঝলো । ও আর কিছু বলল না , ও সঙ্গীতার দিকে তাকিয়ে বলল….” সঙ্গীতা বোন আমি জানি তুমি ওর খেয়াল রাখবে তাও বলছি ওর একটু খেয়াল রেখো আর মেডিসিন আর বাকিসব কিছু ও জানে ওর থেকে জেনে নিও কিছু প্রবলেম হলে আমাকে কল কোরো । ”
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম । আদি দা আর কিছু না বলে চলে গেলেন অর্ঘ্যদাও…” আমিও তবে এখন আসি । ” বলে ঘর থেকে চলে গেলেন ।
আমি মাথা নীচু করে বসে রইলাম সেখানেই , উনি আমার সামনে এসে বসলেন । উনি কিছু বলবেন তার আগেই আমি বলে উঠলাম….” আপনি খুব খারাপ , আপনি জানেন আমি ঠিক কতটা কষ্ট পেয়েছি এই দিনগুলোতে । আপনি আমাকে আগে বলেননি কেন ?? আপনি খুব খারাপ খুব । যান আপনি….”
বলে আমি উঠে দাঁড়িয়ে দুই পা এগিয়ে যেতেই উনি এসে আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন আর বললেন….” আরে রাগ করছো কেন জান , তোমার সেফটির জন্যই তো এমনটা করা , তবে শেষে দেখলাম না তোমার থেকে দূরে থাকলে চলবে না , তুমি হইতো আমার কাছেই বেশি সেইফ থাকবে আর এমনিতেও তুমি যা করছিলে তাতে তো… হাহ…!! কিন্তু হ্যাঁ দূরে থাকলেও আমি কিন্তু সবসময় তোমার কাছেই ছিলাম তোমাকে দেখতে পারছিলাম তোমার সব কথা শুনতেও পারছিলাম । ”
আমি ঘুরে অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকালাম………..
চলবে,……
তুমি যদি চাও
রাজেশ্বরী দাস ( রাজী )
পর্ব – ১৫
আমি উঠে দাঁড়িয়ে দুই পা এগিয়ে যেতেই উনি এসে আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন আর বললেন….” আরে রাগ করছো কেন জান , তোমার সেফটির জন্যই তো এমনটা করা , তবে শেষে দেখলাম না তোমার থেকে দূরে থাকলে চলবে না , তুমি হইতো আমার কাছেই বেশি সেইফ থাকবে আর এমনিতেও তুমি যা করছিলে তাতে তো… হাহ…!! কিন্তু হ্যাঁ দূরে থাকলেও আমি কিন্তু সবসময় তোমার কাছেই ছিলাম তোমাকে দেখতে পারছিলাম তোমার সব কথা শুনতেও পারছিলাম । ”
আমি ঘুরে অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকালাম ,…
” ম..মানে ?? আপনি আমাকে সবসময় দেখতেন আবার , আমার কথা শুনতে পেতেন…!! কিন্তু কীভাবে ?? ”
উনি কথাটা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন তারপর বললেন…” তোমার ঘরের কিছু কিছু জায়গায় খুবই ছোট ছোট হিডেন ক্যামেরা ফিট করা আছে , সেটা আমিই করেছিলাম অবশ্য কিন্তু তুমি টেরই পাওনি । মিশনে যাওয়ার আগে আমি রাতে চুপিচুপি তোমার ঘরে এসেছিলাম ব্যালকনি দিয়ে তুমি বুঝতেই পারোনি তুমি তো তখন ঘুমিয়ে ছিলে , আর বাকি রইলো তোমার কথা শোনার কথা তো… ঐযে ( আমার গলার দিকে ইশারা করে )….. তোমার গলায় যে লকেটটা দেখছো সেটার মধ্যে খুবই ক্ষুদ্র একটা মাইক্রোফোন লাগানো আছে । আর সেটা কানেক্ট করা আছে আমার ফোনের সাথে সো আমি তোমার আর তোমার আশেপাশের সকলের সব কথায় শুনতে পারছিলাম । আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম যে এমনকিছু হওয়ার সম্ভবনা আছে , তাই তোমার সেফটির জন্যই এমনটা করা । ”
আমি বিস্ফোরিত চোখ নিয়ে হাঁ করে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি , আমি বলে উঠলাম….” আপনি সবসময় আমাকে দেখতেন ?? ”
উনি কথাটা শুনে সরুকোখে আমার দিকে তাকালেন , তারপর বাঁকা হেসে বললেন…” হ্যাঁ অবশ্যই আমি আমার বউকে সবসময় দেখতাম , আর এতে ক্ষতি কী আছে ?? আমি আমার বউকে দেখতেই পারি যখন ইচ্ছে তখনই । তাই না বউ ? ”
বলে উনি শব্দ করে হেসে উঠলেন আর আমি লজ্জায় মাথা নোয়ালাম , উনি আমার দুই কাধে হাত রেখে বললেন….” কী হল মিসেস চ্যাটার্জী আপনি লজ্জা পাচ্ছেন নাকি ? ইশ…!! বউ এত লজ্জা পেও না নিজেকে সামলে রাখা তো দায় হয়ে পরছে এখন তোমার এই লজ্জারাঙা চেহারা দেখে , তোমাকে তো এখন পুরো রসগোল্লার মত কিউট লাগছে , ইচ্ছে তো করছে…”
বাকিটা বলার আগেই আমি…” ধ্যাত..!! ” বলে ওনার বুকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ওনাকে কিছুটা দূরে সরিয়ে দিলাম , আর সাথে সাথে উনি হটাৎ…” আহ..!! “…. বলে ব্যথায় চোখ মুখ কুচকে ফেললেন । আমি সেটা দেখে ভীত চোখে ওনার দিকে তাকালাম , তাড়াতাড়ি ওনার কাছে গিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলাম…” কী হলো ?? আপনি…আপনি ঠিক আছেন ?? ব্যথা পেয়েছেন খুব ?? ”
উনি মুখে হাঁসি টানার চেষ্টা করে বললেন….” আরে না আমি তো একদম ঠিক আছি , কিছু হয়নি তো । ”
আমি ওনার মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলাম , আদি দার বলা ওনার হাতে গুলি লেগেছে আর ওনার ওপর অত্যাচার করা হয়েছে কথাগুলো আমার মাথায় এলো । আমি সেটা ভেবে ওনার শার্টের বোতামের দিকে হাত বাড়াতে গেলেই উনি আমার হাত ধরে বাঁধা দিয়ে বললেন…” আরে আরে কী করছো তুমি এটা ? শার্টের বোতাম কেন ?? ”
আমি ওনার চোখের দিকে তাকালাম , আর বললাম…” আমি আপনার স্ত্রী অংশু , আমার জানার অধিকার রয়েছে । ”
উনি শান্তদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে তবে আর কিছু বললেন না উনি আমার হাতটা ছেড়ে দিলেন এবং আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন । আমি ওনার মুখের দিক থেকে চোখ সরিয়ে শার্টের বোতামগুলো এক এক করে খুলতেই ওনার ফর্সা বুকে লম্বালম্বিভাবে ফুটে ওঠা লালচে দাগগুলো স্পষ্ট দৃশ্যমান হলো , ক্ষতগুলো এখনও শুকোয়নি , সেগুলো দেখে আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো । আমি ছলছল চোখে ওনার দিকে তাকালাম , উনি আমাকে নিজ বাহুডোরে আবদ্ধ করে বললেন….” সঙ্গীপাখি প্লীজ কেঁদো না ”
আমি কোন উত্তর দিলাম না , নিঃশব্দে তার বুকে মাথা রেখে ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম । উনি কিছুসময় নিশ্চুপ থেকে মাদক হাসলেন এবং আমাকে তার বাহুডোরে আবদ্ধ রেখেই মৃদু স্বরে বলে উঠলেন….” সঙ্গীপাখি….”
আমি ওভাবে তার বুকে মাথা রেখেই ধীরকন্ঠে বললাম….” আপনার কিছু হলে আমি মরে যেতাম অংশু , প্লীজ কখনও আমাকে ছেড়ে যাবেন না অংশু , প্লীজ । ”
শুভ্রাংশু কিছু বলল না , ও কিছুসময় চুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল…” ভালোবাসা এমন কেন বলতো সঙ্গীপাখি কখনও হাঁসায় কখনও বা কাদায় । ওপর জনের কষ্টে হৃদয়কে তীব্রভাবে ব্যথিত করে , আবার তেমনই অপরজনের খুশিতে হৃদয় সুখ খুঁজে পাই । আর জানো তো সবথেকে বড় কথা হচ্ছে , তুমি সামনের মানুষটাকে কখন কীভাবে এতটা গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলো তুমি নিজেও বুঝতে পারো না । ”
আমি এবার মুখ তুলে ওনার দিকে তাকালাম তারপর ওনাকে ছেড়ে সরে গিয়ে সোজাভাবে দাঁড়ালাম , উনি আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললেন….” আচ্ছা তুমি এবার যাও আগে গিয়ে চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে আসো , আর এই জামাকাপড় তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করো নাহলে তোমাকে এমন পোশাক পরে থাকতে দেখে আমার নিজেকে এখন….”
আমি নিজের দিকে খেয়াল করলাম , আমি সাদা রঙের একটা থ্রি পিস পরেছিলাম । উনি পাশে কাবার্ডের দিকে ইশারা করে আমাকে বললেন…” কাবার্ডের বাম পাশে তোমার জামাকাপড় , টাওয়েল আর বাকি প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র আছে । ”
আমি আর কথা না বাড়িয়ে কাবার্ডের কাছে গিয়ে কাবার্ড থেকে একটা হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি , টাওয়েল আর বাকি জরুরি জিনিসপত্র নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম ।
ফ্রেস হয়ে সেই শাড়িটা পড়ে ওয়াশরুম বেরোতেই দেখলাম উনি খাবারের প্লেট এনে বিছানার পাশে থাকা টেবিলের ওপর রাখছেন । আমি ঘরে আসতেই উনি ঘুরে আমার দিকে তাকালেন , কিছু মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন , তারপর ঘাড়ের এক পাশে হাত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাঁসলেন । উনি তারপর এদিকে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে আমাকে বিছানায় বসালেন । তারপর খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে আমার সামনে বসলেন , এবং এক লোকমা খাবার আমার মুখের সামনে ধরে বললেন….” খাওয়া দাওয়া তো প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলে এই কদিন , এবার তাড়াতাড়ি হাঁ করো , নাও…”
” না , আগে আপনি খান তারপর আমি…”
” আমি ঠিক খেয়ে নেবো পরে , তুমি এখন আগে হাঁ করো বলছি তো । ”
আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম আর না-সূচক মাথা নাড়িয়ে বললাম…” উহু না , তাহলে আমি খাবো না । ”
উনি কিছুক্ষন আমার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে শেষে উপায় না পেয়ে এক লোকমা খাবার নিজের মুখে তুলে নিলেন তারপর আরেক লোকমা খাবার নিয়ে আমার মুখের সামনে ধরলেন আমি আর কথা বাড়ালাম না , চুপচাপ খেয়ে নিলাম । উনি আমাকে কিছুটা খাবার খাইয়ে দিলেন এবং নিজে কিছুটা খেলেন , তারপর আমাকে রেস্ট নিতে বলে প্লেটটা নিয়ে চলে গেলেন । আমি চুপচাপ সেখানেই গালে হাত দিয়ে বসে রইলাম ।
কিছুসময় পরে উনি ফিরে এলেন , উনি মেডিসিন বক্স থেকে একটা ওয়েন্টমেন্ট বের করে হাতে নিলেন । আমি সেটা দেখে বিছানা থেকে নেমে ওনার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম….” শুনুন আপনি বসুন আর ওটা আমাকে দিন , আমি লাগিয়ে দিচ্ছি । ”
” আরে তার কী প্রয়োজন , আমি তো নিজেই….”
বাকি কথাটা বলার আগেই আমি ওনার কথার মাঝে বাঁধ সাধলাম এবং বললাম….” জ্বি না , আপনি নিজে পারবেন না । বেশি কথা না বলে তাই , আপনি শার্টটা খুলে রেখে বসুন চুপচাপ…”
উনি….” ঠিক আছে , অ্যাস ইওর উইশ ” বলে আমার হাতে মলমটা ধরিয়ে দিয়ে নিজের শার্টটা ধীরে ধীরে খুলে পাশে রেখে বিছানায় বসলেন । আমি ওনার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম , ওনার ফর্সা বুক ও পিঠে ক্ষতের দাগগুলো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে , ওনার ডান বাহুতেও ব্যান্ডেজ করা রয়েছে , হইতো গুলিটা সেখানেই লেগেছিল । আমি মলমটা নিয়ে কিঞ্চিৎ কাঁপা কাঁপা হাতে ওনার ক্ষততে মলম লাগিয়ে নিলাম , উনি চোখ বুজে দাঁতে দাঁত চেপে নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলেন । ওনার ক্ষতগুলো দেখে আমার চোখ থেকে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো , ঠিক কতটা কষ্ট পাচ্ছেন উনি কিন্তু তাও মুখ বুজে চুপচাপ সব কষ্টটুকু সহ্য করছেন । আমি ওয়েন্টমেন্ট লাগানো শেষ করতেই উনি পাশ থেকে শার্টটা নিয়ে সেটা পরে নিলেন , আমি হাতের তালুর উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে সরে যেতে নিলে উনি আমার এক হাত ধরে আমাকে বাঁধা দিলেন এবং আমাকে তার কাছে টেনে নিলেন । উনি বললেন…” আমার এখন খুব ঘুম পাচ্ছে সো আমি এখন ঘুমোবো আর তুমি আমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকবে । ”
” কিন্তু আপনি তো ব্যথা পাবেন । ”
” উহু..!! কোন ব্যথা পাব না তুমি শুয়ে থাকবে চুপ করে । ”
উনি শুয়ে পড়লেন , আমি অতি সাবধানে ওনার বুকের বা পাশে মাথা রাখলাম । উনি হালকাভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন , ওনার হার্ট বিটের শব্দ কানে আসছে আমার , আমি চুপটি করে শুনছি । এরই মাঝে উনি বলে উঠলেন….” সারাজীবন তোমার সাথে থাকতে চাই , তোমার পাশে থাকতে চাই #তুমি যদি চাও । জীবনের বাকি পথটুকু একসাথে চলতে চাই #তুমি যদি চাও । আর এভাবেই তোমাকে ভালোবেসে যেতে চাই তুমি চাও বা না চাও । ”
আমি কিছু বললাম না , তার কথায় নিঃশব্দে মুচকি হাসলাম । উনি সেটা ঠিকই বুঝতে পারলেন এবং পরম আবেশে আমাকে আরো শক্তভাবে জড়িয়ে ধরলেন । ওভাবে থাকতে থাকতে ঠিক কখন আমরা দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লাম আমরা টেরই পেলাম না ।
সকালে……
চলবে ,……