কাছে_কিবা_দূরে
পর্ব-১৪
টেবিলে খেতে বসে তানি একটাও কথা বলে নি। লজ্জায় মাথানিচু করে ছিলো। কোনোরকম নাকেমুখে খাবার গুজে দ্রুত প্রস্থান করলো। তানি যেতেই অভ্র আর আনিকা শব্দ করে হেসে ফেলল। শুভ্র’র লজ্জা শরমের কোনো বালাই নেই। সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে খেয়ে যাচ্ছে। আনিকা পিঞ্চ করে বলল, ভাইয়া কতো রোমান্টিক দেখেছ?
অভ্র চোখ কপালে তুলে বলল, মোটেও না, এইসব আমার বুদ্ধি। ভাইয়ার কম্ম নয়।
শুভ্র খেতে খেতে বলল, হ্যাঁ বস তোমার তো অনেক এক্সপেরিয়েন্স আছে।
“আমার এক্সপেরিয়েন্স কীভাবে থাকবে? আমার তো আর বউ নেই। ”
“পাতানো বউ আছে তো।”
আনিকা লাফ দিয়ে উঠে বলল, জানো বড় ভাইয়া, ছোট ভাইয়া তো বিয়ের প্ল্যান করছে।
অভ্র আনিকার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, তুই ঠিক কার দলে বলবি?
আনিকা দাঁত বের করে বলল, আমি তোমাদের কারোর দলেই না। আমি শুধু ভাবীর দলে।
শুভ্র বলল, প্রতি মাসে আমাদের পকেট হাতিয়ে, এখন বলছিস তুই কী না ভাবীর দলে! বুঝলি অভ্র, ঘরে এর মতো একটা মীর জাফর থাকলে আর কিছু লাগে না। দেখবি যেকোনো সময় সৈন্য সামন্ত এনে পলাশীর যুদ্ধ শুরু করে দিবে। একে দিয়ে এক ফোঁটা বিশ্বাস ও নেই৷
অভ্র সায় দিয়ে বলল, একদম ঠিক বলেছ।
আনিকা অভ্র’র হাতে চিমটি কেটে ফিসফিস করে বলল, এরকম করলে আমি কিন্তু আর কোনো বুদ্ধি দেব না।
শুভ্র স্পষ্ট শুনতে না পেয়ে বলল, ঘষেটি বেগম কী বলছে রে?
অভ্র বোকার মতো হাসতে হাসতে বলল, না মানে বলছে যে ভাইয়া আর ভাবীর প্রেম তো জমে পুরো আইসক্রিম হয়ে গেছে।
শুভ্র হাসলো শুধু কিছু বলল না।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে শুভ্র যখন ঘরে গেল তখন তানি পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছে। শুভ্র ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো তানি ঘুমোয় নি, কিন্তু ঘুমের ভান করে আছে। শুভ্র বুঝতে দিলো না যে ও তানির ভান ধরে ফেলেছে। লাইট অফ করে মোবাইল নিয়ে বসলো। ইমেইল চেক করতে করতে আড়চোখে তানিকে দেখতে লাগলো। তানি আগের মতো ই চোখ বুঝে শুয়ে আছে।
তানি লজ্জায় চোখ বন্ধ করে আছে। ভেবেছিল শুভ্র’র উপরে রেগে থেকে শোধ নেবে। টানা এক সপ্তাহ কোনো কথা বলবে না। কিন্তু শুভ্র কী করলো! একদম বেহায়ার মতো কোলে তুলে নিলো! তাও আবার ছোট ভাই, বোনদের সামনে। ইশ! একটুও লজ্জা, শরম নেই। শুভ্র যখন ওকে কোলে তুলে নিলো তখন ওর কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাথা খারাপ হয়ে গেল। লাজ লজ্জা ভুলে ও তখন গলা জড়িয়ে ধরলো। ছিঃ ছিঃ কী লজ্জার ব্যাপার! ইশ লজ্জায় এক্ষুনি তানির মাটির নিচে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে। শুভ্র না’হয় বেহায়া, তাই বলে ও এরকম বেহায়া হয়ে গেল কীভাবে! ছিঃ ছিঃ।
তানি হঠাৎ হাতের উপর শীতল কিছুর স্পর্শ অনুভব করলো। কিছু সময় বাদে বুঝতে পারলো যে ওটা শুভ্র’র হাত। শীতকাল প্রায় চলে গেছে। এখন বসন্তকাল। দিনের বেলায় ভ্যাপসা গরম আর রাতে হালকা শীত। শেষ রাতে শীত একটু বেশী ই লাগে৷ এই ঘরে মাহফুজা পাতলা কম্বল একটা’ই দিয়েছে। বড় কম্বল বলে একটা দিয়েছে। লজ্জায় তানি আরেকটা কম্বল চাইতে পারে নি। এক কম্বলে দুজন থাকতে গিয়ে কখনো কখনো কাছাকাছি চলে আসে। আজ তাই শুভ্র’র স্পর্শ পেয়ে তানি ভাবলো শুভ্র ঘুমের ঘোরে হাত রেখেছে। তানির ভালো লাগলো। হাত টা’কে আলতো করে চেপে ধরলো। শুভ্র’র কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। আরেকটু নিশ্চিত হবার জন্য তানি পাশ ফিরে শুভ্র’র মুখোমুখি হলো। মোবাইলে টর্চ জ্বালালো। টর্চের আলোটা সাহস করে শুভ্র’র চোখের উপর ফেলল। যদি জেগে থাকে কিংবা জেগে থাকার ভান করে তবে চোখের উপর আলো পড়লে কপাল কুচকে যাবে। সেসব কিছুই হলো না। শুভ্র একদম স্বাভাবিক রইলো। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে লাগলো। তানি এইবার নিশ্চিত হলো যে শুভ্র গভীর ঘুমে মগ্ন। তানির এখন একটু শয়তানি করতে ইচ্ছে করছে। করবে কী করবে না এই নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। শেষমেস সিদ্ধান্ত নিলো যে করবে। তাছাড়া বর টা যেহেতু ওর তাহলে একটু বেহায়া হয়ে ঢং তো করাই যায়।
তানি শুভ্র’র কপালের চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে দিলো। সরিয়ে দিয়েও ক্ষ্যান্ত হলো না। চুলে বিলি কাটতে লাগলো। এতো নরম সিল্কি চুল! এই চুলে সারাদিন বিলি কেটে গেলেও কোনো ক্লান্তি আসবে না।
এরপর শুভ্র’র হাতের আঙুলের ভাজে নিজের আঙুল গুজে দিলো। একা একা লজ্জা পেয়ে নিজেই হাসলো। এতো টা দুঃসাহস শুভ্র জেগে থাকলে জীবনেও পারতো না। এভাবে কিছু সময় কেটে গেল। হঠাৎই আচমকা শুভ্র হাত বাড়িয়ে তানিকে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো। তানির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। শরীরে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেল যেন। তানি কেঁপে কেঁপে উঠছে, সেই সাথে এক অদ্ভুত ভালোলাগার অনুভূতি হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে তানি দু’হাতে শুভ্র’কে জড়িয়ে ধরলো।
তানি যখনই শুভ্র’কে জড়িয়ে ধরেছে তখন ই শুভ্র চোখ খুলল। মটকা মেরে এতক্ষণ যে ঘুমানোর অভিনয় করে গেছে সেটা তানি ঘূনাক্ষরেও টের পায় নি। পাবে কী করে! শুভ্র কী চিজ সেটা কী এখনো ও জানে নাকি!
*****
প্রতিদিন ই তানির ঘুম ভাঙে দেরিতে। কিন্তু আজ শুভ্র এখনো জাগে নি। ঘুম ভাঙতেই তানি নিজেকে আবিষ্কার করলো শুভ্র’র বুকের উপর। গত রাতের কথা মনে পরে গেল। লজ্জা, আর ভালোলাগার মিশ্র অনুভূতি তৈরী হলো। উঠে বসে শুভ্র দিকে তাকালো৷ কী নিঃষ্পাপ লাগছে! কে বলবে যে এই ছেলে জেগে থাকলে সবাই কে উলটা পালটা কথা বলে জ্বালিয়ে মারে। তানি শুভ্র’র চুলে আবারও হাত বুলিয়ে দিলো আর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, এখন থেকে প্রতিদিন শুভ্র’র আগে ঘুম থেকে উঠে ওর মুখ দেখে দিন শুরু করবে।
মাহফুজা ফিরে এসেছে সকালেই। ফিরে আসার পর পর ই অভ্র আর আনিকার কাছে হানিমুন প্ল্যান সম্পর্কে শুনেছে এবং তার ও এই ব্যাপারে সায় আছে। সত্যিই তো বিয়ের পর ওরা একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ ও পায় নি। ছেলে মেয়েদের মাথায় যে ব্যাপার টা এসেছে এই ব্যাপার টা তার মাথায় কেন এলো না। এবং সিদ্ধান্ত নিলো অতি শিগগিরই শুভ্র’র সাথে কথা বলবে।
তানি রান্নাঘরে রান্না করছিলো। মাহফুজা গিয়ে বলল, আমাকে কিছু একটা করতে দে। সব কাজ তো তুই ই করছিস।
তানি মৃদু হেসে বলল, তুমি একটা দিন ছুটি পেয়েছ বিশ্রাম করো।
মাহফুজা হেসে বলল, তুই তো দিন দিন আমার অভ্যাস খারাপ করে দিচ্ছিস।
তানি শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে আবারও কাজে মন দিলো।
মাহফুজার মন টা খুশিতে ভরে উঠলো। এই মেয়েটা এতো লক্ষী! শুভ্র’র জন্য একদম ঠিকঠাক। তার খাটি সোনা চিনতে একটুও অসুবিধা হয় নি৷ এই মেয়েটা সংসারে আসার পর থেকে সংসার যেন একদম কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। মাহফুজা বলল, তোদের বিয়ের তো অনেক দিন হয়ে গেল। কোথাও ঘুরতে টুরতে তো যাওয়া হলো না।
তানি কিছু না বলে শুধু হাসলো।
“শুভ্র’কে বলি কোথাও তোকে নিয়ে ঘুরে আসুক। তোর যেতে আপত্তি নেই তো”?
তানি মাথা নেড়ে না বলল। মাহফুজা বলল, কোথায় যেতে চাস বল তো?
তানি মাথানিচু করে বলল, ওনার যেখানে ইচ্ছে সেখানেই যাব।
মাহফুজা হাসলো। বলল, আচ্ছা তাহলে তোর ওনার সাথে কথা বলি।
তানি লজ্জা পেয়ে হাসলো। মাহফুজার চোখ আনন্দে চকচক করে উঠলো। এতোদিনে তার ছেলের জীবন টা গুছিয়ে আসতে শুরু করেছে। সব কৃতিত্ব এই মেয়েটার।
*****
শুভ্র’র ইউনিভার্সিটিতে সেমিস্টার ফাইনাল চলছে। এরপর ব্রেক পাবে। সেই ব্রেকে দুজন কে ঘুরতে পাঠানোর প্ল্যান করেছে অভ্র, আনিকা আর ইরা। অভ্র ঘোষণা দিয়েছে হানিমুন ট্রিপের সব খরচ সে দেবে। এটাই হবে তানিকে দেয়া তার পক্ষ থেকে বিয়ের উপহার। কিন্তু হিসেব নিকেশ করে দেখলো ওর সেভিংস যা আছে তাতে সব টা ঠিকঠাক হবে না। ভালো রিসোর্ট বুক করতে হবে। হানিমুনে গিয়ে তো আর সস্তা রিসোর্টে থাকা যায় না। ইরা অনলাইনে সব খোঁজ খবর নিচ্ছে। আপাতত সবাই মিলে ঠিক করেছে দুজন কে কক্সবাজার পাঠাবে। যে রিসোর্ট পছন্দ করেছে সেখানের কস্ট টা একটু বেশী হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া আর কোনোটা’ই ইরার পছন্দ হচ্ছে না। অভ্র চিন্তিত গলায় বলল, খরচ টা তো একটু বেশি মনে হচ্ছে।
ইরা বলল, হোক বেশী। আমার জমানো টাকা আছে আমি সেটা দেব।
সেই শুনে আনিকাও তার সিন্ধুক খুলে বসলো। শেষমেস তিনজন মিলে হানিমুন ট্রিপের সব বন্দোবস্ত করে ফেলল। কিন্তু শুভ্র’কে কিছু জানতে দিলো না। তানি একটু একটু জানলেও পুরোটা জানেনা।
শুভ্র আজ খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছে। তানি শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল। অভ্র তানিকে ম্যাসেজ দিলো, ভাবী একটু বাইরে এসো।
তানি তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো। ভেবেছে এতো রাতে ডেকেছে নিশ্চয়ই জরুরী কিছু বলবে। অভ্র’কে পেল রান্নাঘরে। রাত জেগে ফোনে কথা বলতে বলতে মাঝেমধ্যে তার খিদে পেয়ে যায় তাই নুডলস কিংবা পাস্তা বানিয়ে খায়। আজও নুডলসের যোগাড় করছে। তানি ব্যস্ত গলায় বলল,
“কী হয়েছে ভাইয়া?”
অভ্র হেসে বলল, কিছু হয় নি ভাবী। দেখলাম তোমার ঘরের লাইট জ্বলছে তাই ভাবলাম তোমার সাথে একটু গল্প করি।
তানি স্মিত হেসে বলল, তুমি সরো আমি বানিয়ে দেই।
অভ্র সরে গিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বলল, আচ্ছা ভাবী একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
“হ্যাঁ। ”
“সত্যি বলবে কিন্তু। ”
“আচ্ছা। ”
“তুমি কী ভাইয়াকে ভালোবাসো?”
তানি বিস্মিত চোখে অভ্র’র দিকে তাকিয়ে সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেলল। মিথ্যে বলা ওর পক্ষে সম্ভব না। তাই চুপ করে থাকলো।
অভ্র বলল, নীরবতা সম্মতি ভেবে নেব?
তানি লজ্জা পেয়ে বলল, জানিনা।
অভ্র হাসলো। বলল, আচ্ছা ঠিক আছে জানতে হবে না। তবে একটা কথা শোনো, তুমি আর ভাইয়া যে ঘুরতে যাচ্ছ এই সময় টা ভালোভাবে কাটাবে। মোটেও রাগারাগি করবে না।
তানি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, আমার অতো রাগ নেই।
অভ্র ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বলল, রাগ নেই তাতেই নাকের ডগা সবসময় লাল থাকে। রাগ থাকলে না জানি কী হতো!
“আচ্ছা! আর তোমার ভাইয়া যে আমাকে লেগপুলিং করে! ”
অভ্র অনুরোধের সুরে বলল, আর যাই করো দয়া করে ঝগড়াঝাটি করবে না প্লিজ। পারলে এবার ভালোবাসার কথাটা বলে দিও।
তানি চোখ কপালে তুলে বলল, আমি বলব?
“হ্যাঁ। তাতে সমস্যা কী?”
“প্রেম ভালোবাসার কথা মেয়েরা আগে বলে না।”
“মেয়েরা বলে না ঠিক আছে, কিন্তু বউয়েরা বলতে পারে। ভাবী প্লিজ প্লিজ আমাদের এতো কষ্টে জল ঢেলে সব ঘেটে ঘ’ করে দিও না। একটু দয়া করো। কথা দিচ্ছি প্রথম ছেলে, মেয়ের নাম তোমাদের নামে রাখব।”
তানি হেসে ফেলল। বলল, তুমিও তোমার ভাইয়ের চেয়ে কম না। বরং একটু বেশী ই।
চলবে…..