কাছে_কিবা_দূরে পর্ব_১৭

0
3126

কাছে_কিবা_দূরে
পর্ব_১৭
#সাবিকুন_নাহার_নিপা

শুভ্র কক্সবাজার থেকে আসার পর তানিকে এড়িয়ে চলছে। খুব সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করলে সেটা চোখে পড়ে। বাড়ির সবাই হঠাৎ ওদের ফিরে আসায় অবাক হলো। কিন্তু শুভ্র একদম স্বাভাবিক রইলো। জার্নি করে এসে দুটো দিন প্রায় ঘুমিয়ে ই কাটালো। হাতে গোনা কয়েকটা কথা হলো এই দুদিনে। এক বার খাবার সময় তানিকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, ডালের বাটি দিতে। আর ঘুমাতে যাবার সময় বলেছিল, বেড লাইট টা অফ করে দিতে৷ তানি খেয়াল করলো, শুভ্র স্বাভাবিকের তুলনায় কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে। একবার ওর মনে হলো যে হয়তো কোনো কারনে আপসেট হয়ে আছে তাই কথা কম বলছে। আবার মনে হলো হয়তো ওর কোনো আচরনে কষ্ট পেয়েছে। দিন চারেক পর তানি এক রাতে ঘুমাতে যাবার সময় বলল,

“শুনছেন?”
শুভ্র তানির দিকে পিঠ দিয়ে ঘামাচ্ছিল। সেভাবেই বলল, হ্যাঁ বলো।

“একটু আমার দিকে ফিরুন না!”

শুভ্র উঠে বসে লাইট টা জ্বালিয়ে দিয়ে বলল, এখন বলো।

তানিও উঠে বসলো। মুখোমুখি হয়ে বসা দুজনেই। তানি আদুরে গলায় বলল, আপনি কী কোনো কারনে আমার উপর রেগে আছেন?

শুভ্র’র উত্তর দিতে এক সেকেন্ড সময় ও লাগলো না। বলল, না।

“তাহলে কী কোনো কারনে আপসেট? ”

“হ্যাঁ। ”

“আমাকে কী বলা যায়, কী কারনে আপনি আপসেট।”

“না বলা যায় না।”
শুভ্র কাটাকাটা গলায় জবাব দিলো।

তানির খুব খারাপ লাগলো। এতটা রুক্ষভাবে যে শুভ্র কথা বলতে পারে সেটা ওর ধারনায় ছিলো না। চোখে পানিও এসে গেল। এতো অল্পে আগে তানির চোখে পানি আসতো না, কিন্তু আজকাল অল্পেই চোখে পানি এসে যাচ্ছে।

তানি আস্তে করে বলল, ইটস ওকে।

“উঁহু ইটস নট ওকে। তুমি কী তোমার সব কথা আমাকে বলো বা বলেছ! তাহলে আমাকে কেন সব কথা বলতে হবে? ”

তানি বিস্মিত গলায় বলল, মানে?

শুভ্র হঠাৎই নরম হয়ে গেল। বলল, না কিছু না। স্যরি একটু বেশী ই মিসবিহাভ করে ফেলছি। এক্সট্রেমলি স্যরি।

কথাগুলো বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই শুভ্র শুয়ে পড়লো। তানি কিছু বুঝতে না পেরে খানিক সময় বসে থেকে তারপর শুয়ে পড়লো। সেই রাতে তানি দু’চোখের পাতা এক করতে পারে নি। সকাল হতেই যখন রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের পানি চাপালো তখন মাহফুজা বুঝে গেল যে তানি সারারাত ঘুমোয় নি। বারবার জিজ্ঞেস করলো, যে কিছু হয়েছে কি না। তানি প্লাস্টিকের হাসি মুখে ঝুলিয়ে বলল, কিছু হয় নি। মাহফুজা সরল মনে বিশ্বাস করে নিলো।

মাহফুজা সরে যেতেই তানি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কি যে হয়েছে তা তো আমি ই জানি না।

******
কাজের বাহানা দিয়ে কক্সবাজার থেকে ফিরলেও তেমন কোনো কাজ শুভ্র’কে করতে দেখা যায় নি। ভার্সিটি অফ আছে তাই বাইরেও খুব একটা যায় না। বাসায় থেকে বই পড়ছে, মুভি দেখছে, ইন্টারনেট ব্রাউজ করছে। ব্যাপার টা তানির চোখে পড়লেও ও কিছু জিজ্ঞেস করলো না। সেদিন রাতের ঝাঝালো কথাগুলো কানের কাছে এখনো বেজে চলছে।

অভ্র খেয়াল করলো শুভ্র আর তানির ভিতরে কিছু একটা চলছে। দেখা গেল, সবাই মিলে একসাথে আড্ডা দিচ্ছে। শুভ্র’ও হেসে হেসে গল্প করছে। কিন্তু যেই তানি সেখানে উপস্থিত হয় শুভ্র উঠে চলে যায়। ব্যাপার টা একবার দু’বার হলে কাকতালীয় বলে মানা যেত। কিন্তু বার বার হওয়ায় অভ্র তানিকে জিজ্ঞেস করলো,

“ভাবী বলোতো ঘটনাটা কী?”

“কোন ঘটনা?”

“তোমার আর ভাইয়ার মধ্যে কোনো ঝগড়াঝাটি চলছে? তোমরা ফিরে এলে ভাইয়ার আর্জেন্ট কাজ আছে তাই। কিন্তু ভাইয়া তো বিন্দাস খাচ্ছে ঘুমাচ্ছে।”

তানির সেদিন রাতে শুভ্র’র বলা কথাগুলো মনে পরে গেল। অভ্র’কে সব বলে নিজেই কেঁদে ফেলল।

অভ্র অবাক গলায় বলল, ভাইয়া মিসবিহাভ করছে! সত্যি?

তানি নাক টেনে বলল, আমি মিথ্যে বলি না।

অভ্র ভীষণ অবাক হলো। বলল, আচ্ছা কক্সবাজারে কী এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে যে কারনে ভাইয়া রেগে থাকতে পারে?

“না।”

“একটু মনে করে দেখো”।

তানি একটু ভেবে শুভ্র’র বন্ধুর সাথে দেখা হবার ঘটনা খুলে বলল।

সব শুনে অভ্র বলল, ভাইয়ার সেই বন্ধুকে তুমি চেননা কিন্তু সে তোমাকে চেনে তাই তো?

“হ্যাঁ “।

“আচ্ছা সে কী তোমার আগের হাজবেন্ডের পরিচিত কেউ হতে পারে?”
কথাটা জিজ্ঞেস করার সময় অভ্র কিছুটা বিব্রতবোধ করলো।

তানি রীতিমতো ধাক্কা খেল। শুকনো গলায় বলল, হতে পারে।

অভ্র চিন্তিত গলায় বলল, হতে পারে না ভাবী। আমার মনে হয় তাই ই হয়েছে। হয়তো এমন কিছু বলেছে যেটা ভাইয়া মেনে নিতে পারে নি।

“কিন্তু সেটা আমাকে ক্লিয়ার করে বলবে তো!”

“আচ্ছা আমি জিজ্ঞেস করে দেখি ভাইয়া কী বলে।”

“আচ্ছা”।

****
অভ্র শুভ্র’কে সরাসরি জিজ্ঞেস করলে শুভ্র খুব মেজাজ দেখালো। সব ব্যাপারে অভ্র’র ইন্টারফেয়ার নিয়ে এক দফা রাগ ও দেখালো। কিন্তু অভ্র দমে গেল না। বারবার জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে স্পষ্ট করে বলতে। শুভ্র এক পর্যায়ে রেগে গিয়ে টেবিলে রাখা গ্লাস সেট ভেঙে ফেলল। শব্দ পেয়ে মাহফুজা, তানি, আনিকা সবাই ই ছুটে এলো।

মাহফুজা অবাক গলায় বলল, এসব কী হচ্ছে?

শুভ্র তখনও রাগে ফুসছে। চোখ, মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। গমগমে গলায় বলল, নাথিং সিরিয়াস।

“সিরিয়াস কিছু না হলে এভাবে ভাঙচুর কেন করছিস সব? ”

শুভ্র জবাব দিলো না। মাহফুজা অভ্র’র দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে বল তো?

অভ্র নির্লিপ্ত গলায় বলল, মা ভাইয়া কয়েকদিন ধরে ভাবীর সাথে স্বাভাবিক আচরণ করছে না? কিছু একটা গন্ডগোল আছে সেটা জানার চেষ্টা করছি।

শুভ্র রক্তচক্ষু নিয়ে তানির দিকে তাকালো। বলল, আমি তোমার সাথে কী অস্বাভাবিক আচরণ করেছি?

তানি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। কিছু বলার খুঁজে পেল না। অভ্র ঠান্ডা গলায় বলল,

“ভাইয়া মাথা ঠান্ডা করো তো প্লিজ। ”

শুভ্র আচমকাই অভ্র’র নাক বরাবর একটা ঘুষি মেরে বলল, এতো বেশী বুঝিস কেন সবসময়?

তানি আর আনিকা ছুটে গিয়ে অভ্র’কে ধরলো। শুভ্র রাগে কাঁপছে অনবরত। মাহফুজা ছেলের এই রাগের সাথে পরিচিত। সহজে রাগে না ঠিকই, কিন্তু রেগে গেলে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে ফেলে।

মাহফুজা শীতল গলায় ডাকলো, শুভ্র!

শুভ্র মাথা নিচু করে রাখলো।

“কী হয়েছে? ”

অভ্র নাক চেপে ধরে বলল, মা কক্সবাজার ভাইয়ার এক বন্ধুর সাথে তার দেখা হয়েছে। সে নাকি ভাবীর পূর্বপরিচিত। তার সাথে দেখা হবার পর থেকেই ভাইয়া ভাবীকে এড়িয়ে চলছে।

তানি মাথানিচু করে কাঁদতে লাগলো।

মাহফুজা জিজ্ঞেস করলো, কী বলেছে তানির নামে?

শুভ্র তানির দিকে এক পলক তাকালো। সেই দৃষ্টি দেখে তানির অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো।

শুভ্র তীর্যক হেসে বলল, আমার বউ তার আগের হাজবেন্ডের সাথে সুখী ছিলো না তাই প্রেগন্যান্ট অবস্থায় বয়ফ্রেন্ডের সাথে বেরিয়ে এসে বাচ্চা এবোর্শন করিয়েছে। সেটা বলেছে। বিয়ের এতো মাস পর জানলাম যে আমার বউ চরিত্রহীনা।

তানির জগৎ টা দুলে উঠলো। পরে যেতে গেলে অভ্র ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলো।

মাহফুজা আগের মতো ই স্বাভাবিক। বলল, ব্যাস এইটুকুই?

“হ্যাঁ। ”

“আর তাতেই তুই জানোয়ারের মতো আচরণ শুরু করলি?”

“সেটা কী স্বাভাবিক না?”

মাহফুজা উত্তর দিলেন না। সশব্দে শুভ্র’র গালে একটা চড় মেরে বলল, রাস্তার লোকের কথায় বিশ্বাস করে নিজের বউয়ের সাথে অসভ্যতা করার জন্য এই থাপ্পড় টা দিলাম।

শুভ্র মাথানিচু করে ফেলল।

মাহফুজা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, একটা ব্যাপার পুরোটা না জেনেই একজনের ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দিয়ে ফেললি? কেন সত্যি জানতে আমাকে বা ওকে জিজ্ঞেস করতে পারলি না?

শুভ্র চুপ করে রইলো।

মাহফুজা শান্ত গলায় বলল, যদি নিজের অনাগত সন্তান আর নিজের ভালোর জন্য সহপাঠী বন্ধুর সহায়তায় বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসে তানি চরিত্রহীনা হয় তাহলে তোর বাবাকে ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করে যে তোকে জন্ম দিয়েছে সেও চরিত্রহীনা।

চলবে……

(নিয়মিত দেয়ার ইচ্ছে এখন থেকে। যাদের অপেক্ষা করতে সমস্যা তারা গল্প বর্জন করুন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here