বিপদ,পর্ব- ০৫
লেখা: ত্রয়ী আনআমতা
তৃণার মাথায় আকাশ ভেঙে পরল। প্রিয়া এসব কী বলছে! বলল, ‘তুই এগুলি কী কইতাছছ, প্রিয়া? তর মাথা ঠিক আছে? আর তুই কানতাসস ক্যা? কিচ্ছু হয়নাই আমগো বাপ-মার। তুই স্বপ্নে দেখসস। বাসায় গিয়া দেকবি সবাই ঠিক আছে। ‘
‘আমি স্বপ্নে দেহি নাই। তুই ক্যান আমার কথাডা শুনতাসস না!’
বলতে বলতে প্রিয়া আবার কেঁদে দিল। কাঁদতে কাঁদতে তার হেঁচকি উঠে গেছে।
তৃণা প্রিয়ার কথা আর কান্ডের আগামাথা কিছুই ধরতে পারছে না। প্রিয়াটা কী পাগল হয়ে গেল?
‘এইবার আমার মেজাজ খারাপ হইতাছে তুই কান্দন থামা। কী হইছে আমারে দয়া কইরা সব বুঝাইয়া ক।’
প্রিয়া কান্না থামানোর চেষ্টা করল। বলল, ‘ আমগো গ্রামডা ধ্বংস হইয়া যাইতাছে।’
তৃণা ভ্রু কুঁচকালো। ‘ ধ্বংস হইয়া যাইতাছে মানে?’
‘জাফর ভাইয়ে ইন্ডিয়া গেছিল শুনসস?’
তৃণা মাথা নাড়ল। ‘হ শুনছি তো। ওইহান থিকা আহনের পর তো হ্যায় পাগল হইয়া গেছে। যারে পায় তারেই না-কি কা…।’
প্রিয়া কথার মাঝখানে তৃণাকে থামিয়ে দিল। ‘হ্যায় পাগল অয়নাই। হ্যায় মইরা গেছে। মইরা আবার জ্যান্ত হইয়া উঠছে।’
‘এডি কী কস প্রিয়া! মরা মানুষ আবার জ্যান্ত অয় ক্যামনে?’
প্রিয়া কান্না থামিয়ে দিয়েছে। চোখের জল শুকিয়ে তার ফর্সা গালের ওপর রেখা তৈরি করেছে। হাতের উলটো পাশ দিয়ে সে গালের বাম পাশটা মুছে নিল। তাকে শুন্য দৃষ্টিতে তৃণার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তৃণা তাকে মৃদু ধাক্কা দিল। বলল, ‘কী অইল প্রিয়া। চুপ কইরা রইলি ক্যান?’
প্রিয়া অনুভূতিহীন কন্ঠে বলল, ‘হয়। জোম্বি কামড় দিলে মানুষ মইরা যায়। হেরপর আবার জ্যান্ত হইয়া উঠে। জাফর ভাই ইন্ডিয়ায় যেই জায়গায় গেছিল হেই জায়গার নাম কেরালা।’
প্রিয়া তৃণাকে যা বোঝাল তার সারমর্ম এই, জাফর কেরালায় ঘুরতে যাওয়ার কিছুদিন পর সেখানে হঠাৎ করে একটা রোগ ধরা পরে। রোগটা হচ্ছে, রোগী যাকে পায় কামড়ে দেয়। আর সে যাকে কামড়ায় সেই ব্যাক্তিও তার মতো হয়ে যায়। সেও অপরকে কামড়াতে থাকে। কিন্তু সেটা কোনো সাধারণ কামড় নয়। কামড়িয়ে রক্ত মাংস খেয়ে ফেলা। যে পর্যন্ত ভুক্তভোগী মরে না যাচ্ছে সে পর্যন্ত রোগী তাকে কামড়ে খেতে থাকে। ভুক্তভোগী মরে গেলে তৎক্ষনাৎ তাকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদেই মৃত ভুক্তভোগী জ্যান্ত হয়ে উঠে। আর সুস্থ স্বাভাবিক যাকে পায় তাকে কামড়ে মেরে ফেলতে থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন প্রকৃতপক্ষে এটা কোনো রোগ নয়। এটা একটা অভিশাপ। কারণ এই রোগের রোগীরা জীবিত নয় মৃত। তারা আসলে জীবন্ত লাশ। আর মৃত ব্যাক্তিদের প্রাণ কখনোই ফেরানো সম্ভব নয়। এটা অসম্ভব এবং সৃষ্টির বিরোধী। এই সমস্ত নরখাদকদের বিশেষজ্ঞরা নাম দিয়েছেন জোম্বি।
এই অদ্ভুত ব্যাপার ধরা পরার পর কেরালায় বেড়াতে যাওয়া সকল বিদেশী ব্যাক্তিকে নিজেদের দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আর কেরালার মানুষদের ঘরবন্দী করে রাখা হয়। কেরালা থেকে কোনো মানুষ যেন বেরোতে না পারে সে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।
কিন্তু তারপরও আলোর গতিতে এ রোগ ছড়াতে থাকে। পুরো কেরালার অধিকাংশ মানুষই নরখাদক হয়ে গেছে।
সবটা শুনে তৃণা বলল, ‘তুই এতকিছু কেমনে জানলি?’
প্রিয়া জবাব দিল, ‘টেলিভিশনে খবরে দেখছি।’
তৃণা ভুলেই গিয়েছিল প্রিয়ারা তাদের মতো দরিদ্র নয়। সে চেয়ারম্যানের মেয়ে। তাদের একটা নতুন রঙ্গিন টেলিভিশন আছে।
তৃণা জিজ্ঞেস করল, ‘হেরপর?’
প্রিয়া আবার হেঁচকি তুলে কান্না শুরু করল। এদিকে দুঃশ্চিন্তায় তৃণার মাথা ফেটে যাচ্ছে । প্রিয়া যা বলছে তা যদি সত্যিই হয় তাহলে তো! নাহ এসব ভাবতে চায় না সে। তার বাবা-মার কিচ্ছু হয়নি। কিচ্ছু না!
তৃণা ব্যগ্র হয়ে বলল, ‘একটু তাড়াতাড়ি ক না, বান্ধবী! ‘
প্রিয়া কাঁদতে কাঁদতেই উত্তর দিল, ‘জাফর ভাইয়েও মইরা নরখাদক হইয়া গেছে। হের মাধ্যমেই এই এলাকাডা ছড়াইছে। আজকে বিকাল বেলা বাবা কইছিল, এই এলাকায় আর থাকব না। এই এলাকায় বিপদ। তাই ঢাকায় ছোট চাচাগো বাসায় যাওয়ার কথা আছিল। কিন্তু..।’
তৃণা অস্থির হয়ে উঠল। ‘কিন্তু কী?’
‘কিন্তু আমগো রওনা দিতে দিতে সন্ধ্যা হইয়া যায়। বাস স্টেশনে যাওনের লিগা ভ্যানে উঠছিলাম। কিছুদূর যাইতেই হঠাৎ রাস্তায় একদল পাগলের মতো মানুষ দেহি। আমগো দেইক্ষা হেরা আমগো পেছন পেছন আইতে থাকে। ভ্যান’আলা সহ আমরা সবাই ভয় পাইয়া যাই। তাই বাবা’য় ভ্যানওয়ালারে তাড়াতাড়ি ভ্যান চালাইতে কয়। কিন্তু ওই লোকগুলি এত জোড়ে দৌড়াইতাছিল যে ভ্যান ওয়ালাও এত জোড়ে প্যাডেল ঘুরাইতাছিল না। শেষ মেশ পাগলগুলি আমগো লাগুর পাইয়া যায়। ভ্যানওয়ালা ভ্যান ফালাইয়া জংগলের মধ্যে দৌড়াইয়া পলাইতে যায়। আমরাও দৌড়াইতে থাকি পলানের লিগা। কিন্তু আমার বাপ-মা’র বয়স অইছে। হেরা অল্প ইকটু দৌড়াইয়াই হরান অইয়া যায়। আর দৌড়াইতে পারে না। কাছাকাছি আহনের পর বুজতে পারি ওগুলি আসলে পাগল না। ওগুলি জোম্বি আছিল। যেগুলি মইরা আবার জ্যান্ত হইয়া উঠছে। আমার বাবারে হঠাৎ ওগুলি আক্রমণ করে। আমার মা’য় চিল্লাইয়া আমারে পলাইতে কয়।’
প্রিয়া এবার শব্দ করে কাঁদতে শুরু করল। তৃণা ওকে জড়িয়ে ধরল। ওকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্য বলল, ‘কান্দিস না বইন, কান্দিস না। সব ঠিক অইয়া যাইব।’
প্রিয়া এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। চেঁচিয়ে বলে, ‘কিচ্ছু ঠিক অইব না। কোনোদিন ঠিক অইব না। কেমনে ঠিক অইব? মরা মানুষ কেমনে ফিরা আইব? ‘
তৃণা কী বলবে খুঁজে না পেয়ে চুপ করে রইল।
প্রিয়া নিজে থেকেই আবার বলতে শুরু করল, ‘প্রথমে আমি পালাইতে চাই নাই। আমার মা’য় আমারে হাজারবার কইছে পলানের কথা। কিন্তু আমি হুনি নাই। কিন্তু যহন দেকলাম আমার বাপ-মায়ও আমার চোখের সামনে মইরা জোম্বি অইয়া গেল!’
প্রিয়ার আর কিছু বলতে হল না। তৃণা সবকিছু বুঝে নিল।
প্রিয়া আবার বলল, ‘ হেই সন্ধ্যা থিকা পলাইয়াই বাঁইচা আছি। তুই আহনের ইকটু আগেই আমগো বাসায় ফেরত যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। পারি নাই। পুরা গ্রাম জোম্বি দিয়া ভইরা গেছে। রাস্তার ওইপারে যাওয়ার সময় অনেকগুলি জোম্বি আমার পিছু নেয়। আরেকটু হইলেই মইরা হেগো মতো অইয়া যাইতাম। ওই জোম্বি গুলির মদ্যে জাফর ভাই আর তর বাপ-মাও আছিল।’
এবার তৃণার অশ্রুর বাঁধ ভেঙ্গে পরল। এতক্ষণ সে আশায় ছিল শুনবে, তার বাবা-মার কিছু হয়নি। কিন্তু শেষ মেশ কি-না তার বাবা-মাও! একমাত্র বাবা-মা’ই তো ছিল তার এই দুনিয়াতে। তৃণা পাগলের মতো কাঁদতে লাগল। প্রিয়া তাকে থামাল না। কাঁদুক। এ কষ্টের কোনো শেষ নেই। কেঁদেই একটু প্রশমিত করুক। না জানি আর কত কিছু সইতে হবে তাদেরকে!
★
রাত প্রায় বারোটা বাজতে চলল। খিদেটা মরে গেছে। কিন্তু শরীর ভীষণ দুর্বল লাগছে আহাদের। সেই সকালে একটা রুটি খেয়েছিল! তারপর থেকে আর পেটে কিছু পরেনি। পানি পিপাসাও পেয়েছে। তার কাছে বোতলে পানি ছিল। কিন্তু পানির বোতলটা ব্যাগের ভেতর। আর ব্যাগ নিচে তাদের ক্লাসে।
ভয়ে ঘুমুতেও পারছে না সে। ওই পিশাচ লোকগুলো যদি আবার চলে আসে! ইতি-উতি ভাবতে ভাবতে কখন যেন চোখ লেগে এল আহাদের। ধূলো-বালু ভরা মেঝেতেই কাত হয়ে শুয়ে পরল।
যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন সূর্যের আলো ফুটে উঠেছে। চোখ মেলতেই দেখল সে স্কুলের একটা ক্লাসের ময়লা মেঝেতে শুয়ে আছে। তৎক্ষনাৎ লাফিয়ে উঠে বসল। ধাতস্থ হতে কিছুক্ষণ সময় লাগল তার। ধীরে ধীরে মনে পরতে লাগল সে কীভাবে এখানে এসেছে। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। সেই সঙ্গে বুঝতে পারল প্রচন্ড পানি পিপাসা পেয়েছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। যেভাবেই হোক নিচের ক্লাসে যেতে হবে। একমাত্র তাহলেই পানির নাগাল পাবে।
আহাদ ভেতর থেকে কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিল। কিছু দেখতে পেল না। পিশাচ লোকগুলো কী চলে গেছে? নিশ্চিত হবার জন্য দরজা খুলে বাইরের দিকে দৃষ্টি ছুড়ল। কাউকেই দেখতে পেল না। মনে মনে খুশি হল। সন্তর্পণে হেঁটে এগোতে লাগল আহাদ। পাছে তারা টের না পেয়ে যায়। নিরাপদে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে পরল সে। পিশাচ লোকগুলো নেই। কিন্তু একি! ক্লাসের সামনে আসতেই কোত্থেকে এক ঝাঁক পিশাচ এসে দৌড়ে তার দিকে এগোতে লাগল। আহাদও দৌড়াতো লাগল। তাকে বাঁচতে চাইলে ক্লাসের ভেতর ঢুকতে হবেই!
লোকগুলো তার কাছে এসে পৌঁছাবে ঠিক সে মূহুর্তে সে ভেতরে ঢুকে গেল। দরজা লাগাতে ভুলল না। লোকগুলো এসে দরজার উপর হুমড়ি খেয়ে পরল। একপর্যায়ে ধাক্কাতে লাগল দরজা। ভেতর থেকে আহাদ দেখতে পেল ছিটকিনি নড়ছে। এমন ভাবে ধাক্কাতে থাকলে দরজা যেকোনো মুহূর্তে খুলে যাবে। নয়তো ভেঙ্গে পরবে। আহাদ কি করবে ভাবতে লাগল।
শেষ চেষ্টা হিসেবে ক্লাসের টেবিল ও বেঞ্চি গুলো টেনে এনে দরজার পাশে জড়ো করতে লাগল। ক্লাসের প্রায় অর্ধেক টেবিলই দরজায় জড়ো করে ফেলল। এবার ছিটকিনিটা তেমন নড়ছে না। আহাদ মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
তাকে যেন না দেখা যায় তাই সে বেঞ্চি গুলোর আড়ালে লুকিয়ে পরল। ভাবল, হয়তো তাকে দেখতে না পেয়ে পিশাচ গুলো চলে যাবে!
আহাদকে সঠিক প্রমাণ করে আধ ঘন্টা বাদেই লোকগুলো চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর সে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। লোকগুলো নেই।
আহাদ নিজের ব্যাগের দিকে এগিয়ে গেল। দেখল পুরো বোতলটাই ভরা। মুহূর্তেই তার মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। ঢকঢক করে বোতলের অর্ধেক পানি পান করে ফেলল। বোতলের মুখ ভালো ভাবে আটকে বাকি অর্ধেক ব্যাগের ভেতর রেখে দিল। কেননা এই পানি দিয়ে ঠিক কতদিন চলতে হবে তা তার এখনো অজানা।
চলবে…