কাছে_কিবা_দূরে পর্ব-২৪

0
3911

কাছে_কিবা_দূরে
পর্ব-২৪
তানি কিছু সময় ডায়েরি বন্ধ করে কাঁদলো। সিদ্ধান্ত নিলো আর পড়বে না। পড়ার দরকার ও নেই। ওর যা জানার জানা হয়ে গেছে। এতো বড় যন্ত্রণা বুকের ভিতর নিয়ে শুভ্র কিভাবে দিনের পর দিন হাসিখুশি ভাবে কাটিয়েছে! তানি নিজেই এইটুকু পড়ে সহ্য করতে পারছে না। তাহলে শুভ্র কিভাবে সহ্য করেছে। পড়বে না ভাবলেও নিজের কৌতূহল দমন করতে পারলো না। আবারও ডায়েরি খুলে পড়তে শুরু করলো।

অবন্তীর কাছ থেকে ধোকা খাওয়ার পর নিজের মন কে বারবার প্রশ্ন করলাম কেন আমার সাথে এসব হলো? কী দোষ ছিলো আমার? আমার ভালোবাসায় তো কোন কমতি ছিলো না। একসময় উত্তর নিজেই খুঁজে বের করলাম। অবন্তীকে ভালোবেসে আমি নিজের মা’কে কষ্ট দিয়েছি। মায়ের সাথে হওয়া অন্যায় কিংবা বেয়াদবি দেখেও কখনো অবন্তী কে কিছু বলিনি। কিছু বললে অবন্তী ঝগড়াঝাটি করবে, রাগারাগি করবে ভেবে চুপ থেকেছি বারবার। এক পর্যায়ে মা, ভাই বোন কে ছেড়ে আলাদা হয়ে গেছি। আমি আপনজনদের সাথে অনেক টা স্বার্থপর হয়েছিলাম বলেই অবন্তী আমাকে ঠকিয়েছিল। ভেবেছিলাম এ জীবনে আর বিয়েশাদি, সংসার করব না। কাজ, পরিবার এসবে ব্যস্ত থেকে জীবন টা কাটিয়ে দেব। কিন্তু মা তা হতে দিলেন না। একদিন এসে বললেন, তোর জন্য তোর মতো ই একটা ভালো মেয়েকে খুঁজে পেয়েছি। আমি মায়ের উপর ভরসা করলাম। একবার তো নিজের পছন্দ বহাল রেখে সবাইকে ভুগিয়েছি, তাই চাইলাম না আর তোমাকে দেখতে। দেখার পর মনে হলো মা আমার জন্য ঠিক মেয়েকেই পছন্দ করে এনেছে।

তানি আমি প্রথম তোমার প্রেমে কবে পড়েছিলাম জানো?
যেদিন তুমি রান্নাঘরে ঘামে ভিজে আমাদের সবার পছন্দের আইটেম রান্না করেছিলে।

এরপর আরেকটু প্রেমে পড়েছি সেদিন, যেদিন তুমি আনিকার জ্বর হয়েছিল বলে সারারাত জেগে ছিলে।

ইরার জন্য আলাদা করে পায়েশ, পিঠে রেখে দিতে যখন তখনও তোমার প্রেমে পড়েছিলাম একটু।

অভ্র’র সাথে রাত জেগে হেসে হেসে যখন গল্প করো তখন আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম আর ভাবতাম কেন এই মেয়েটার সঙ্গে আমার জীবন টা আগে জুড়ে গেল না!

চোখের পানিতে ডায়েরির পাতাগুলো ভিজে গেল। তানি ব্যকুল হয়ে কাঁদছে। এই প্রথম তানি খুশিতে এতো কাঁদছে। চোখ মুছে তানি আবার পড়তে শুরু করলো।

তানি আমি অবন্তীর প্রেমে পড়েছিলাম ওর রুপ দেখে। তোমাকে এক বিন্দুও মিথ্যে বলব না। অবন্তী আগেও এমন রাগী, বদমেজাজী ছিলো। তবুও আমি সেটা প্রশ্রয় দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে আমি সেই ভুল করতে চাই নি। আমি তোমাকে চিনতে, জানতে চেয়েছি। নিজেকে জানাতে চেয়েছি। তোমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে অনেক সময় অনেক কিছু করেছিও কিন্তু বিশ্বাস করো ওই কথাগুলো বলতে চাইনি। আমার মনে হয়েছিল মানুষ হিসেবে আমি ভালো নই বলেই আমার সাথে বারবার এমন হয়। ভুল মানুষের সাথে দেখা হয়। কিন্তু যখন সত্যিটা জানলাম তখন ভিতরে ভিতরে কতো যে ছটফট করেছি তা তোমাকে বোঝানো সম্ভব নয়। তুমি যখন জ্বরে কাতর হয়ে বিছানায় শুয়েছিলে, আমি তখন দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে মনে মনে শতবার বলতাম তানি শিগগিরই সুস্থ হয়ে যাও। সুস্থ হয়ে আমাকে মারো, রাগারাগি করো কিন্তু আমার জীবন থেকে দূরে সরে যেও না। একটা রাত যেখানে তোমাকে ছাড়া থাকা সম্ভব না সেখানে সারাজীবন কিভাবে থাকব! তুমি দূরে চলে গেলে আমি হয়তো মরেও যেতে পারি।

তানি আমার জীবন টা এই ক’দিনে তুমিময় হয়ে গেছে। তোমাকে ছাড়া কিছুই ভালো লাগে না। খাওয়ার সময় গ্লাসে তুমি পানি না ঢেলে দিলে ভালো লাগে না। ঘুমানোর সময় গা ঘেষে না ঘুমালে কেমন যেন অশান্তি লাগে। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে তোমার এলোমেলো চুল, চোখ বন্ধ করে কপাল কুচকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হওয়া মুখ না দেখলেও ভালো লাগে না।

আমার না জেনে, না বুঝে করা ভুলের জন্য যেটুকু শাস্তি তুমি দিতে চাও তা আমি মাথা পেতে নিতে রাজি আছি, কিন্তু তোমাকে কোনোভাবে হারাতে রাজি নই। তানি আমি একবার জীবনে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছি, দ্বিতীয় বার আর আমাকে এভাবে নিঃস্ব করে দিও না প্লিজ। যদি মুখ ফিরিয়ে থাকতে চাও, কিংবা দূরে থাকতে চাও তাহলে থেকো। তবুও চোখের সামনে তো থাকবে। দিনশেষে আর শুরুতে যেটুকু চোখের দেখা দেখতে পাব তাতেই আমার তৃষ্ণা মিটে যাবে।

তানি ডায়েরির পাতাগুলো যখন পড়া শেষ করলো তখন সন্ধ্যে নেমে গেছে। আকাশে তখন বিকেলের আলো নেই। রাত নামার পায়তারা করছে। কিছু সময় বেলকনিতে বিমূঢ় হয়ে বসে থেকে শুভ্র’কে ফোন করলো। শুভ্র’র ফোন বন্ধ। আরও বারদুয়েক চেষ্টা করেও বন্ধ পেয়ে শেষমেস অভ্র’কে ফোন করলো৷ দু’বার রিং বাজতেই অভ্র ফোন ধরলো। বলল,

“হ্যালো ভাবী?”

তানি কান্নার দমকে কথা বলতে পারছে না। অভ্র ব্যস্ত হয়ে বলল,

“কী হয়েছে ভাবী?”

“তোমার ভাইয়াকে একটু ফোন টা ধরতে বলবে?”

“ভাইয়া তো কিছুক্ষন আগে বেরিয়ে গেছে। ”

তানি আরও জোরে শব্দ করে কাঁদতে শুরু করলো। অভ্র’র খুব খারাপ লাগলো। বলল,
“প্লিজ ভাবী কেঁদো না। কী হয়েছে আমাকে বলো”?

“তোমার ভাইয়াকে আমার এক্ষুনি লাগবে”।

অভ্র’র মুখের হাসি টা চওড়া হলো। বলল,

“ভাইয়া একুশ দিনের জন্য গেছে ভাবী। একুশ দিনের আগে তো তাকে পাওয়া যাবে না।”

তানি কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমাকে নিয়ে চলো প্লিজ। ওনাকে না দেখতে পেলে আমি মরে যাব৷ কেন যে মরতে এখানে থেকে গেলাম!”

অভ্র বলল, ভাবী প্লিজ শান্ত হও। এভাবে অস্থির হইয়ো না।

তানি কোনো কথাই শুনছে না। অভ্র শেষমেস উপায় না পেয়ে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে আমি কাল রাজশাহী এসে তোমাকে নিয়ে ভাইয়ার কাছে যাব। এবার একটু শান্ত হও প্লিজ।

তানি কিছু সময়ের জন্য শান্ত হলো। অভ্র ফোন রাখতেই মাহফুজা চিন্তিত গলায় বলল, তানি কাঁদছিল কেন?

অভ্র হেসে ফেলল। বলল, ভাইয়াকে না দেখতে পেলে মরে যাবে তাই।

মাহফুজা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আলহামদুলিল্লাহ।

অভ্র হেসে ফেলল। খবর পেয়ে আনিকাও ছুটে এলো। বলল, ভাইয়া জানিস আমার না খুশিতে বারবার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। অভ্র হাসলো। উত্তেজনায় ওর মুখ দিয়ে কথাই বের হচ্ছে না। আশ্চর্য তো! ওর ও তো আনিকার মতো চোখে পানি এসে যাচ্ছে।

*****

তানি ম্যাসেঞ্জারে শুভ্র’কে আনব্লক করে অনেকগুলো ম্যাসেজ পাঠালো। অপেক্ষা করেও শুভ্র’র রিপ্লাই না পেয়ে শেষমেস মেইলে লিখলো,

এই যে শুনুন, আপনি কী জানেন আপনি আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ। এতো এতো কথা ডায়েরি তে লিখেছেন! অথচ এগুলো কিন্তু মুখে বললেই পারতেন। কেন আমি কী হিল্লিদিল্লি থাকি! চোখের সামনে ই তো দিনরাত ঘুরঘুর করতাম।

আচ্ছা শুনুন, আমিও অনেক কিছু জমিয়ে রেখেছিলাম যে আপনাকে বলব। কিন্তু আপনি যেহেতু মুখে কিছু আমাকে বলেন নি তাই আমিও বলব না। বরং লিখেই পাঠাই।

এই যে আমি আপনার সাথে কারণে অকারণে রেগে যেতাম। এমন কিন্তু আগে ছিলাম না। রাগা তো বহুদূর কারও মুখের উপর কিছু বলতেই পারতাম না। কিন্তু আপনার সাথে রাগতে পারি, একশ টা খারাপ কথাও শোনাতে পারি। কেন পারি বলেন তো! বলবেন কী করে! আপনি তো বিশ্ব গাধা! আপনি কী আর এসব বুঝবেন।

আপনাকে প্রথম দেখার পর তেমন কিছু ভাবার সুযোগ পাই নি। কিন্তু পরে যখন সেন্সে এলাম তখন মনে হলো ইশ মানুষ টা’র সাথে আর একটা বার আমার দেখা হতো! উপরওয়ালা আমার অনেক কিছু হারানো জীবনে একটা জিনিস ফিরিয়ে দিয়েছে। সেটি হলেন আপনি। শুনুন ড্রেনওয়ালা আপনি সেদিন আমায় হাত ধরে টেনি উঠিয়েছেন ঠিক ই কিন্তু যাওয়ার সময় আমার ছোট্ট মন টা চুরি করে নিয়ে গেছেন। কতো বড় চোর আপনি! ছিঃ! এরজন্য অবশ্যই আপনার শাস্তি হবে, কঠিন শাস্তি।

আপনি জানেন কতগুলো বৃষ্টির দিন আমি আপনাকে নিয়ে ভেবেছি, আর আপনি কী না আমায় নিয়ে হাসাহাসি করেছেন! এরজন্য শাস্তি স্বরুপ আর কখনো আমার হাতের খিচুড়ি আর মাংস ভুনা খেতে পারবেন না।

আর শুনুন, আপনাকে কে বলল যে আমি আপনার জীবন থেকে যাব? ইশ! এতো সহজ সবকিছু! ফের যদি ড্রেনে পড়ে যাই তখন কে তুলবে আমায়? আরেকজন ড্রেনওয়ালা যদি ছুটে না আসে! তখন কী হবে!

তবে আপনাকে আমি কোনোদিনও ক্ষমা করব না বুঝলেন। কারণ আপনি খুব খুব খুব খারাপ একজন লোক। কক্সবাজারে থাকাকালীন সময়ে জলপাই রঙের শাড়ি কিনে ব্যগে ভরে রেখেছেন। আবার ঢাকা অবধি নিয়ে এসে আলমারি ভরে রেখেছেন। কেন শাড়ি টা আমাকে দিলে কী হতো! অন্যান্য সময় তো ঠিকই বেহায়াপনা দেখান আর কাজের সময় ভং ধরে থাকেন? বলতে পারতেন না, তানি একটু ভালো করে সাজুগুজু করো তো, তোমায় নিয়ে সারা শহর ঘুরে বেড়াবো!

এবার কিছু ভালো কথা শুনুন। আপনি যেমন প্রতিদিন একটু একটু করে আমার প্রেমে পড়েছেন তেমন আমিও প্রতিদিন একটু একটু করে আপনার প্রেমে পড়েছি। দ্বিতীয় দর্শনে আপনি যখন বললেন, তানি আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে তখনই তো সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেল।

রিকশায় ঘুরতে যেয়ে যখন হাত ধরে বসেছিলেন তখন আরেকবার নতুন করে প্রেমে পড়েছিলাম। সোডিয়াম লাইটের আলোয় যখন গভীর চোখে তাকিয়ে ছিলেন তখনও একবার প্রেমে পড়েছি।

তবে ভালোবেসেছি কখন জানেন? যেদিন আপনি বলেছিলেন, তানি শরীর ছুঁয়ে দেবার আগে আমি তোমার মন ছুঁতে চাই। আমার জীবনের সবচেয়ে শোনা ভালো দুটো কথার মধ্যে এটি একটা। আরেকটা যেটা আপনি আপনার ডায়েরির শেষ পাতায় লিখে রেখেছেন।

আর কোনোদিন অবন্তীর নাম মুখেও আনবেন না। মুখভরা অবন্তী নাম টা’র চেয়ে তানি নাম টা অনেক বেশী সুন্দর। এরপর থেকে তানি তানি করবেন।

তানি পুরো লেখাটা সেন্ট করে দিলো। এখন খুব শান্তি শান্তি লাগছে। ঘরের সবাই বারবার ডাকতে এসেছিল খেতে যাবার জন্য। কিন্তু তানি যায় নি৷ এখন ক্ষিধে টের পাচ্ছে। খেতে যাবার আগে আরও একবার ডায়েরির শেষ পাতাটা ওল্টালো। যেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, তানি আমি কোনো সাধুপুরুষ না, তাই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। তবে তুমি কিন্তু আমার মন ছুঁয়েই অনেক টা তৃষ্ণা মিটিয়ে দিয়েছ।

চলবে….
(শেষ পর্ব বাকী। পাওয়া যাবে কাল রাত ১২ টায়)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here