মাস্টারমশাই,পর্ব ৪

0
420

মাস্টারমশাই,পর্ব ৪
শুভজিৎ জানা
__________________
সবুজ শস্য শ্যামলায় পরিপূর্ণ গ্রাম, কিছুটা আধুনিক হতে শুরু করেছে। কয়েক মাস আগেই গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। বিদ্যুৎ আসা না আসা দুটোই সমান। কারণ, অধিকাংশ সময়ে বিদ্যুৎ থাকে না। প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রয়োজনীয় সময় বেশি থাকে। স্কুলে এখনো বিদ্যুতের ব্যবস্থা হয়নি।তীব্র গরম শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রীদের সহ্য করতে হচ্ছে। গরম আরও বেশি অনুভব করছে দশম শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীরা। তাদের সামনে বসে রয়েছেন তানভীর আলম। এক বান্ডিল খাতা নিয়ে এসেছেন। তাদের আজ ইংরেজি খাতা দেবেন।যারা কম নাম্বার পেয়েছে তাদের কপালে কি লেখা আছে,একমাত্র ঈশ্বর জানেন। একবার বেত ধরলে ওটা ভাঙ্গা না পর্যন্ত ছাড়বেন না। তিনি এত কঠোর কেন? নির্মমভাবে ছাত্রছাত্রীদের ওপর অত্যাচার করে কি লাভ পান? তা সবারই অজানা।স্কুলের সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা কঠোর কিন্তু তানভীর স্যার সমস্ত স্যারের তুলনায় কঠোর থেকে কঠোরতর। তিনি হয়তো জানেন না গাধাকে পিটিয়ে কখনো ঘোড়া তৈরি করা যায় না। অথবা তিনি বুঝেও না বোঝার ভান করেন। কিন্তু তানভীর স্যার খাতা দিলেন না।তিনি এক এক জনকে দাঁড় করিয়ে আগের দিনের পড়া জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন। পড়া না করলে পিঠে মার পড়বে অনিবার্য। এমনকি যে সমস্ত স্টুডেন্ট প্রত্যেকদিন পড়া করে,তারা যদি একদিন পড়া না করে তার জন্যও ছাড় নেই। তাদেরকেও একই শাস্তি পেতে হবে। তার জন্য রয়েছে অদ্ভুত যুক্তি, আমরা প্রত্যেকদিন নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট খাবার খাই। তাহলে কেন আমরা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কাজ করবো না?

উনি পড়া জিজ্ঞেস করতে করতে একসময় নিজের মেয়ের কাছে আসলেন। ইয়াসমিনকে পরপর পাঁচটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু ইয়াসমিন দুটোর বেশি উত্তর দিতে পারল না।বাবার প্রতি ইয়াসমিনের আদৌ ভয় নেই। তার দৃঢ় বিশ্বাস বাবা তাকে কিছু বলবে না। সে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে উঠলো। কিন্তু সে তানভীর স্যারের পড়া করেনি। তানভীর স্যারের পড়া না করে ছাড় পাবে, কল্পনা করাও অসম্ভব। তিনি সব সময় উনার কর্তব্য এবং দায়িত্বের প্রতি সচেতন। কখনোই নিজের কর্তব্য থেকে একচুলও সরে আসেন না। তিনি ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে যথাবিধি শাস্তির ব্যবস্থা নিলেন। তাকে ক্লাস থেকে বাইরে বের করে দিলেন। রোদে নিলডাউন হয়ে বসতে বললেন। সমস্ত ছাত্রছাত্রীর মধ্যে একটা উদগ্রীব তৈরি হলো। তারা কখনো ভাবতে পারেনি তানভীর স্যার নিজের মেয়ের এত বড় একটা শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। যেখানে রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে সবাই হাঁপিয়ে উঠছে, সেখানে তাকে নীলডাউন হয়ে বসে থাকতে হবে। ইয়াসমিন বাইরে যেতে অনীহা প্রকাশ করল। কিন্তু তানভীর স্যারের রাগান্বিত চোখ,গম্ভীর কণ্ঠস্বর তাকে বাধ্য করল বাইরে যেতে। মুহুর্তের মধ্যে চোখ থেকে জল গড়িয়ে এলো ইয়াসমিনের। আজ কেন জানি না তারও মনে হচ্ছে, এই পৃথিবীতে তার সবচাইতে অপছন্দের মানুষ নিজের বাবা। তিনি নিষ্ঠুর। তিনি অমায়িক মানুষ। উনার হৃদয় নেই। তিনি একের পর এক সবার পড়া ধরতে শুরু করলেন।যে পড়া পারল না তার জন্য ইয়াসমিনের মতো শাস্তি হলো। তারপর তিনি দ্রুত গতিতে চক ডাস্টার নিয়ে উঠলেন। খুব দ্রুত গতিতে হিজিবিজি পড়িয়ে গেলেন। তিনি যেন ইংলিশে সবকিছু জানেন। সবকিছুই তাঁর মুখস্ত। সমস্ত স্যারের থেকে উনার একটা আলাদা ট্যালেন্ট রয়েছে।সেই ট্যালেন্টের বহিঃপ্রকাশ করলেন। পড়ানোর সময় তিনি একবারের জন্যও বইয়ের দিকে তাকান না। একটা মানুষ কি করে এত কিছু মনে রেখেছেন -কেউই জানে না। তানভীর স্যারের এই ট্যালেন্ট অনেকেই ভূয়সী প্রশংসা করেন। অনেকে আবার মনে করেন তিনি মাস্টার রুপি দেবদূত। তিনি সবকিছুই জানেন। এই পৃথিবীতে তার যেন সব কিছুই জানা। সবকিছুই তাঁর আয়ত্তের মধ্যে।

ক্লাস সময় গড়িয়ে যেতে থাকে কিন্তু ইয়াসমিন তার চোখের জল থামাতে পারলো না। কঠিন যন্ত্রণার চাইতেও তার বেশি কষ্ট লাগছে আত্মসম্মানে। এতগুলো বছর সে ক্লাসে প্রথম হয়ে এসেছে। কোনো স্যার তাকে চড় মারার তো দূরের কথা, চোখ রাঙিয়ে কথা বলার দুঃসাহস পায়নি। খুব নিষ্ঠা এবং সততার সঙ্গে বড় হয়েছে। যদিও এই শিক্ষা তার বাবার কাছ থেকে পিয়েছে। প্রত্যেক দিনের পড়া প্রত্যেকদিন করে আনে। আর তার বাবা আজ তাকে ক্লাস থেকে বের করে দিল। যন্ত্রনার কোনো প্রতিধ্বনি নেই। প্রতিধ্বনি হলে হয়তো তিনি জানতে পারতেন যন্ত্রণার যন্ত্রণাটা কতটা কষ্টের। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লাস শেষ হয়ে গেল, কিন্তু তানভীর স্যার বের হলেন না। এখন টিফিনের সময়। তিনি আরও কিছুক্ষণ ধরে পড়াবেন।টিফিন হতে সমস্ত ক্লাসের ছাত্র ছাত্রীরা বাইরে বেরিয়ে আসলো। তাদেরকে বাইরে নিল ডাউন হয়ে বসে থাকতে দেখে হাসাহাসি করলো। বাচ্চারা তাদের দেখে কি শিখবে? আত্মগ্লানিতে ইয়াসমিনের মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। আত্ম সম্মান হারানোর ভয়ে দগ্ধ হতে থাকলো।

বিলে জমে থাকা অল্প জলে শালুকের লুকোচুরি। নীল আকাশে পাখির উড়াউড়ি। শেষ বিকেলের সূর্য রশ্মি চিনিয়ে দেয় অপরূপ ময়ূরগঞ্জকে।বিলের মধ্যে খুব অযত্নে ফুটে থাকা কচুরিপানার সৌন্দর্যের প্রাচুর্যতা গ্রামকে ভরিয়ে দেয়।
রাস্তার খুব কাছাকাছি গ্রামের ছোট ছোট মেঠো বাড়ি রয়েছে।গ্রামের কৃষকদের কঠোর শ্রম তবে দিনের শেষে ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি; আগামীর স্বপ্ন। গ্রামে রয়েছে বড় বড় পুকুর। কেউ আবার মাছ ধরছে ছিপ ফেলে। গাছের তলায় বয়স্কদের আড্ডা। বিশ্বকর্মা আর দুর্গা প্রতিমার কাজ চলছে। গ্রামের শিশুদের ভাবনাহীন বৈচিত্র্য বড্ড আপন। পাশাপাশি দুটো গাছে শাড়ি বেঁধে দিয়ে দোলনা তৈরি করেছে শিশুরা। আর শাড়ির মাঝখানে একজন বসে রয়েছে।আর একজন দোলাচ্ছে এবং দোলানোর হিসাব রাখছে। পরেরবার তাকে ঠিক ততোবারই দোলাতে হবে। বড্ড বিচিত্র এই শিশু সমাজ!গরুর বিশাল পাল নিয়ে রাখাল ছুটে চলেছে। বড্ড বিরক্ত রাখাল। গরু গুলো বারবার এ-দিক ও-দিক ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে। গরু গুলো বাড়ি ফিরতে চাইছে না। আরও কিছুক্ষণ মাঠে থাকতে চাইছে।বাংলা গ্রামে রয়েছে নিজস্ব ঢং। বাড়ির উঠোনে বসে বাড়ির নারীরা উকুন দেখছে। কেউ বা কাজে ব্যস্ত, কেউ আবার বাড়ির সামনে মাদুর পেতে পড়তে বসেছে। ঝুঁকে ঝুঁকে পড়া মুখস্ত করছে সে। মানুষগুলো যেন একে অপরের পরম আত্মীয়। এদিকে কাবেরী আর শুভজিৎ একে অপরের হাত ধরে দিঘির পাড়ে যাচ্ছে। তারাও শেষ বিকেলে খেলাধুলায় মেতে উঠতে চায়। রোজ বিকেলে তারা দুজন খেলতে বের হয়। গ্রামে এ-দিক ও-দিক ঘুরে বেড়ায়। কাদামাখা শরীর শুভজিৎ এর। তাকে দেখে একটু বিরক্ত হচ্ছে কাবেরী। কাবেরী কত সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো গোছানো। কিন্তু শুভজিৎ পুরো ভিন্ন। নিজের যত্ন কখনো নিজে নেয় না। নাকে একগাদা সর্দি বেরিয়ে রয়েছে। তাকে দেখে খিলখিল করে হাসলো কাবেরী। তার হাসি দেখে শুভজিৎ বলল,’এই,তুমি হাসছো কেন?’
‘তাহলে কি করব,বল? তোর নাকটা দেখেছিস একবারও? কতবার বলেছি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকবি সব সময়। তুই একটা কথাও আমার শুনিস না। এইতো কদিন আগে জ্বর সারিয়ে উঠলি। আবার জ্বরে পড়তে ইচ্ছে করছে বুঝি! পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না থাকলে জ্বর হবে বারবার।’
শুভজিৎ কিছু বলল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। আবার জ্বর হতে পারে শুনে ভয় পেয়ে গেল। জ্বর হলেই সে কিছু করতে পারে না। খেলতে পারে না, ঘুরতে পারে না। সবসময় বাড়িতে শুয়ে থাকতে হয়, তার উপর থাকে নিলেশ বাবুর খিটখিটে কথাবার্তা। কাবেরী শুভজিৎ এর হাত টানতে টানতে দিঘির ঘাটের কাছে নিয়ে গেল। কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলো। জল দিয়ে তার মুখ বেশ ভালোভাবে পরিস্কার করে দিল। তারপর হাসতে হাসতে বলল,’দেখেছিস এবার তোকে পুরো রাজপুত্রের মতো দেখাচ্ছে। কত সুন্দর দেখতে। আর তুই সব সময় অগোছালো থাকিস।’ রাজপুত্র কথাটি শুনে শুভজিৎ হাসলো। অদ্ভুত ছেলে। কথায় কথায় শুধু হাসে। হাসির কথা না থাকলেও হাসতে থাকে। তার এত হাসি কোথা থেকে আসে কাবেরী জানে না। যদিও তাকে হাসলে বড্ড সুন্দর লাগে। কিন্তু সব সময় হাসি একদম পছন্দ করে না কাবেরী। কাবেরী কিছু একটা বলতে চাইছিল তখনই শুভজিৎ দূরে হাত বাড়িয়ে কিছু একটা দেখানোর চেষ্টা করল। কাবেরী বুঝতে পারল, সে ঠিক কি দেখাতে চাইছে। দিঘির পাড়ে প্যান্ডেল হচ্ছে। কয়েকদিন বাদে গ্রামে বারোয়ারি পুজো আছে। বেশ কয়েকদিন ধরে যাত্রা হবে। কাবেরী বলল,’পরশুদিন থেকে গ্রামে বারোয়ারি পুজো হবে। যাত্রাও হবে। রোজ আসবো কিন্তু।’
‘এখনই যাই চলো।’ কাবেরী মৃদু হাসলো। তারপর তারা দুজন দৌড় দিল প্যান্ডেলের প্রাঙ্গণে। সেখানে পৌঁছেই সবকিছু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলো। একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির মতো পর্যবেক্ষণ করলো শুভজিৎ। যেন সে এই প্যান্ডেলের মালিক।সে এ-দিক ও-দিক হাত নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে এটা করলে ভালো হতো,ওটা করলে ভালো হতো।এখানে এটা রাখা ঠিক হয়নি,ওখানে সেটা রাখা ঠিক হয়নি।তার হাত ঘুরিয়ে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলতে দেখে প্যান্ডেলের লোক গুলো হাসলো, সাথে কাবেরীও। কাবেরী হাসতে হাসতে বলল,’কিরে তুই? আজ এত বছর ধরে উনারা প্যান্ডেল করছেন, কোথায় কি রাখতে হবে তারা জানে না! তুই ওদেরকে শিখাছিস।’ শুভজিৎ দাঁত কেলিয়ে হাসলো। হাসতে হাসতে বলল,’না, তবে আমি যা বলছি তা করলে মন্দ হয় না। আরও সুন্দর দেখাবে।’
‘হ্যাঁ, তুইতো একদম জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি হয়ে গেছিস।’
দুজনে হাসলো। কাবেরী শুভজিৎ এর মাথায় উস্কোখুস্কো চুল গুলো ঠিক করলো আর খুব ভালোভাবে মানুষ গুলোর কাজ দেখলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে কাবেরী লোকগুলোর উদ্দেশ্য করে বলল,’আচ্ছা, এখানে কতদিন যাত্রা হবে?’ প্যান্ডেল ওয়ালাদের মধ্যে একজন বলল ‘পাঁচ দিন’। পাঁচদিন কথাটি শুনে বেশ খুশী হলো কাবেরী। তাহলে পাঁচ দিন তার পড়াশোনা বন্ধ। বেশ মজা হবে। সে আবার জিজ্ঞেস করল, যাত্রা গুলো দেখার জন্য কোনো টাকা লাগবে কি না? লোকটি স্বাভাবিক কন্ঠে জবাব দিল। যাত্রা দেখার জন্য কোনো টাকা লাগবে না। শুধুমাত্র শেষের দু-দিন উড়িয়া যাত্রা হবে, ওই দুটো যাত্রা দেখার জন্য টাকা লাগবে।কুড়ি টাকা করে টিকিট। কাবেরীর আনন্দ-উচ্ছ্বাস ভরা মন মুহূর্তের মধ্যে ভেঙ্গে গেল। যাত্রা দেখার জন্য তার বাবা কিছুতেই টাকা দেবে না, খুব ভালো করে জানে। তাই পাঁচ দিনের আশা ত্যাগ করতে হলো। তিন দিন নিয়ে খুশি থাকা যাক। লোকগুলোর সঙ্গে কথা বলার পর যখন কাবেরী মুখ ফিরিয়ে দেখল, তখন শুভজিৎ তার কাছে নেই। চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখল শুভজিৎ পাশে লাগানো যাত্রার পোস্টারগুলো দিকে বারবার করে তাকিয়ে কি যেন দেখছে। কাবেরী ছুটে সেখানে গেল। শুভজিৎ পোস্টারগুলো মধ্যে কিছু খুঁজে বেড়াছে। কী খুঁজছে তা জানার উপায় নেই। একটা সময় সে ‘পেয়ে গেছি’ ‘পেয়ে গেছি’ বলে চিৎকার করে উঠল। কাবেরী ভীষণ অবাক হয়। এই পোস্টটার গুলোর মধ্যে সে আবার কি খুঁজে পেল? কৌতুহলবশে জিজ্ঞেস করল,’ওইভাবে চিৎকার করছিস কেন?পোস্টারটি তো আর চারটি পোস্টারের মতো সাধারন।এতে এত উত্তেজিত হওয়ার কি আছে?’ শুভজিৎ আবার দাঁত কেলিয়ে হাসলো। তারপর দাঁত দেখিয়ে বলল,’এটা মোটেও সাধারণ পোস্টার নয়। কোনো পোস্টারে পুলিশ নেই। শুধুমাত্র এই পোস্টারে পুলিশ রয়েছে। আমি এই যাত্রা অবশ্যই দেখবো।’
‘ ও এই ব্যাপার! তোর পুলিশকে ভালো লাগে বুঝি?”
‘হ্যাঁ, অনেক অনেক ভালো লাগে।’
শুভজিৎ যাত্রার নামটি পড়তে লাগলো। একটা একটা অক্ষর জোড়া লাগিয়ে উচ্চারণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করল। একটা সময় সে হাল ছেড়ে দিল। বুঝে গেছে কিছুতেই পারবে না। বেকায়দায় পড়ে কাবেরীকে যাত্রার নাম পড়েতে বলল। কাবেরী খুব ভালো করে জানে শুভজিৎ পড়তে পারে না। অনেক অক্ষর তার এখনও অজানা। সে মৃদু স্বরে পড়লো। যাত্রার নাম “সুখের খোঁজে শান্তির লাশ।” যাত্রার নাম জানতে পারলেও তার মানে উদ্ধার করতে পারলো না শুভজিৎ। সে আবার জিজ্ঞেস করলো,’এর অর্থ কি?’ কাবেরী যেটুকু বুঝেছে তাই বলল, সম্ভবত যাত্রার মূল চরিত্র সুখ খুঁজতে গিয়ে নিজের শান্তিতে কাটানো জীবন শেষ করে ফেলবে।তাই বলা হয়েছে সুখের খোঁজে শান্তির লাশ। যাত্রার নামের পাশে আরও একটি কবিতা লেখা রয়েছে। শুভজিৎ কাবেরীকে কবিতাটি পড়তে বলল। কাবেরী কবিতাটি পড়লো…
“উড়ছে টাকা ছুটছে মানুষ।
করছে নিজের সর্বনাশ।
ভোর হতেই জোর খবর।
সুখের খোঁজে শান্তির লাশ।”
কাবেরী পড়া শেষ হতেই শুভজিৎ সেই লাইন গুলো মনে রাখার চেষ্টা করল। কিন্তু প্রথম লাইন মনে রাখতে না রাখতেই দ্বিতীয় লাইন ঠিক ভুলে গেল। কাবেরী তাকে আবার লাইনটি বলল, আর সে আবার ভুলে গেল।

স্কুল শেষ করার পর সোজা বাড়ি ফিরলেন না তানভীর আলম। পোস্ট অফিসে কিছু একটা কাজের জন্য ওইখানে গেলেন। বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বাড়ি ফিরে তিনি একটি অদ্ভুত দৃশ্য লক্ষ্য করলেন। বাড়িতে থমথমে পরিবেশ। কোথাও যেন কিছু একটা হয়েছে। বাড়িতে বেশির ভাগ সময়ই মাহবুব হইচই করে থাকে। তার মন ভালো নেই। তাই হয়তো চুপচাপ। কিন্তু বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে দ্বিতীয়বারের মতো অবাক হলেন। প্রতিদিন তিনি বাড়ি ফিরলে তাঁর স্ত্রী জল নিয়ে আসেন। কিন্তু আজ আসলেন না। নিজে থেকে জল গড়িয়ে পান করলেন। সুট বুট খুলে এ-দিক ও-দিক ঘুরতে লাগলেন। কোথাও কেউ নেই। নিজের রুমে গিয়েও হতাশ হলেন। আমিনা রুমের মধ্যেও নেই। স্বামী ছাড়া সে কখনো বাইরে ঘুরতে যায় না। তাছাড়া সন্ধ্যে হতে যায়। নামাজের সময় অন্তত সে কোথাও যাবে না। গুটি গুটি পায়ে মেয়ের রুমের দিকে গেলেন।ইয়াসমিন বিছানায় শুয়ে রয়েছে আর মাথার কাছে বসে রয়েছে আমিনা। তাদের দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তারপর রুমের মধ্যে প্রবেশ করলেন। তিনি রুমের মধ্যে প্রবেশ করতেই আমিনা বিমূঢ় স্বরে বললেন,’তোমার আক্কেল জ্ঞান কবে হবে,শুনি?এই বুড়ো বয়সে তোমার ভীমরতি ধরেছে?’ আমিনা ভীষণ রেগে রয়েছে। ইয়াসমিন নিশ্চয়ই তার শাস্তির কথা মাকে বলে দিয়েছে। আজকালকার ছেলে মেয়েরা পারেও বটে। নিজেরা স্কুলে মার খাবে, আবার বাড়িতে ফিরে গর্বের সঙ্গে তা বলবে। লজ্জাও লাগে না তাদের। তিনি হাসলেন। উনাকে হাসতে দেখে আমিনা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,’তোমার লজ্জা করছে না? এইভাবে কাউকে শাস্তি দেয়? তোমার কি মনে হয় শাস্তি দিলে সবাই ভালো মানুষ হয়ে যাবে। আমি রাস্তায় শান্তিতে বের হতে পারি না। সবাই তোমার নামে কত কটু কথা বলে। তোমাকে কত ঘেন্না করে।যখন কোনো মানুষ তোমাকে ঘেন্না করে কথা বলে,তখন আমার কতটা কষ্ট হয় তা কখনো বুঝেছো?’
আমিনা অল্পতেই কেঁদে ফেললেন। কখনো স্বামীর ওপর জোর গলায় কথা বলেননি। আজ বলতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি আর এই সব সহ্য করতে পারছেন না। উনার কঠোরতা মানতে পারছেন না। তিনি কান্না মাখা স্বরে বললেন,’তুমিতো জানতে তোমার মেয়ে রোদে এক মুহূর্ত থাকতে পারে না। তার মাথায় ছোটবেলা থেকে সমস্যা আছে। কোথাও কিছু একটা হয়ে গেলে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারতে? আর তাকেই বাইরে বের করে দিলে। একবারের জন্যও বুক কাঁপলো না! দেখো,জ্বরে কিভাবে কাঁপছে? ভালো লাগছে না তোমার!’
তানভীর স্যার গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি এখনো মনে করলেন তিনি যা করেছেন ঠিক করেছেন। নিজের ভুল খুঁজে পেলেন না। যদিও পৃথিবীতে বেশিরভাগ মানুষ নিজের ভুল নিজে কখনো বের করতে পারে না। তিনি মেয়ের কাছে গিয়ে বসলেন। আমিনাকে জলের পট্টি চেঞ্জ করতে বললেন। আমিনা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রুম থেকে বেরিয়ে আসলেন। তানভীর স্যার মেয়ের চোখের দিকে তাকালেন। ইয়াসমিনের চোখ থেকে জল ঝরে পড়ছে। চোখ দুটো টকটকে লাল হয় গেছে।গাল বেশ খানিকটা ফুলে রয়েছে। নিজের হাত মেয়ের কপালে রাখলেন। কিন্তু ইয়াসমিন এখানে এক অদ্ভুত আচরণ করল। তার বাবার হাত ছুঁড়ে ফেলল। মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিল, তিনি যেন তার কপালে হাত না দেন। তিনি চুপ হয়ে গেলেন। কোনো কথা বলতে পারলেন না। তার শেষ ভরসা মেয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁকেই ভুল বুঝল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here