মাস্টারমশাই পর্ব ১৭

0
263

মাস্টারমশাই
পর্ব ১৭
_____________
সেদিন মাহবুবকে কেউ আটকাতে পারেনি। এ বাড়ি তার কাছে বিরক্ত হয়ে উঠেছে। কারোর কথা গ্রাহ্য না করে ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।আমিনা ছেলেকে অনেক আটকানোর চেষ্টা করেন কিন্তু ছেলে শুনেনি। অনেক মিনতি করে ছিলেন স্বামীকে ছেলেকে আটকানোর জন্য। কিন্তু তানভীর স্যারে কঠোর হৃদয় দোলাতে পারেননি। তানভীর স্যার ছেলেকে আটকানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করেননি। বরং তিনি গম্ভীর স্বরে আমিনাকে জবাব দিয়েছিলেন, ছেলে বড় হয়েছে পাখা গজিয়েছে,তাকে উড়তে দাও। বাবার হোটেলে খাচ্ছে, তাই মনে হচ্ছে পৃথিবীটা খুব সহজ। বাবার হোটেল থেকে বেরিয়ে যাক তারপর বুঝতে পারবে পৃথিবী কতটা কঠিন। এত শাসন, এত ভালোবাসা পাওয়ার পরেও তার চাহিদা পূরণ হলো না। তার আরও অনেক কিছু চাই। খুব সহজে সে অনেক বড় কিছু পেতে চায়। কিন্তু সহজে বড় কিছু কখনোই পাওয়া যায় না।যদি কিছু পাওয়া যায় তাহলে তা ক্ষণিকের জন্য এবং অসম্মানের। আজকাল ছেলেমেয়েরা পরিশ্রম না করেই দামি কিছু পেতে চায়। আজকে যারা ঘুষ দিয়ে চাকরি পাচ্ছে। কিছুদিন পর তাদের একটা করে চুল পাকতে শুরু করবে, তখন তারাই ছোটদের বোঝাবে, সমাজটা শেষ হয়ে যাচ্ছে টাকার কাছে। আজ মেধাবী স্টুডেন্ট হারিয়ে যাচ্ছে। যারা উচ্চ পদে বসে আছে তারা মেধার জোরে নয় টাকার জোরে বসে আছে। কিন্তু তারা কখনোই নিজেকে প্রশ্ন করবে না। নিজে কীভাবে ওই জায়গায় এসেছে? স্বামীর বলা কথাগুলো পছন্দ হলো না আমিনার। একপ্রকার তিনি স্বামীর কথাগুলোকে অগ্রাহ্য করলেন।ছেলে বাড়ি থেকে একটি টাকাও নেয়নি। কি করে বাইরে থাকবে? মাহবুবের পক্ষে বাইরে থাকা সম্ভব নয়। তানভীর স্যার হেসে জবাব দিয়েছিলেন, কয়েকজন বন্ধু পেয়েছে।তাদের দুঃসাহসে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে সে। ওরা তোমার ছেলেকে ঠিক গুছিয়ে রাখবে। কিন্তু বেশি দিনের জন্য নয়। সব কিছু যখন বুঝতে পেরে যাবে তখন ছেলে আপনাআপনি বাড়ি ফিরে আসবে। বুঝতে পেরে যাবে,বাবা মা ছাড়া এই দুনিয়ায় কেউ আপন নয়।

দু-মাস কেটে গেল কিন্তু মাহবুব ফিরলো না। কোনো চিঠিও পাঠাইনি। টেলিফোনও করেনি। আমিনা ভীষণ চিন্তিত। ছেলের চিন্তায় তিনি নিজের অজস্র রোগ বাঁধিয়ে ফেলেছেন। তিনি এমনিতেই রোগাক্রান্ত এক নারী।বছরে প্রায় সময় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। ছেলে চলে যাওয়ার পর খাওয়া-দাওয়া নিজের যত্ন নেওয়া পুরোপুরি ছেড়ে দেন। বিভিন্ন রোগ তাঁকে জাঁকিয়ে ধরে। তারাও সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে থাকে। ইয়াসমিন বাবা-মার প্রতি ভীষন উদাসীন হয়ে ওঠে। তার মন এখন রঙিন আর চঞ্চল।নতুন প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। এখন বাবা মা ছাড়া অন্য কোনো এক ছেলে তার কাছে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। তানভীর স্যারেরও চিন্তার শেষ নেই। স্কুল থেকে বারবার তাঁকে সতর্ক করছেন। উঁচু ক্লাসে স্টুডেন্টরা প্রায় প্রতি সপ্তাহে প্রধান শিক্ষকের কাছে দরখাস্ত জমা দিচ্ছে, তানভীর স্যারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। সমস্ত স্টুডেন্ট এবং কিছু গার্জেনের সই করেও অনেকগুলো দরখাস্ত জমা দিয়েছে। প্রথমের দিকে এগুলো গুরুত্ব না দিলেও পরে এগুলোকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হন। তিনি খুব ভালো করেই জানেন, স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের বয়স ততটা বেশি নয়। তাদের পক্ষে এত কিছু করা কখনোই সম্ভব নয়।কারোর উস্কানিতে তারা এমন করছে। তাঁর বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীরা এবং কিছু সহকর্মী যেভাবে উঠে পড়ে লেগেছেন, তাতে তাঁর চাকরি আর বেশিদিন থাকবে না। তিনি নিশ্চিত।
এখন তানভীর স্যার লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না করেন। কাউকে বুঝতে দেন না। স্ত্রী জানতে পারলে ভীষণ কষ্ট পাবেন। তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের কথা ভাবেন। চাকরি পাওয়ার পরেও তাঁর জীবনে অনেক বড় বড় চাকরির সুযোগ আসে। কলেজের প্রফেসরের সুযোগ আসে। বর্তমানে তিনি স্কুলের সবচেয়ে বয়স্ক শিক্ষক। প্রধান শিক্ষকের জন্য তিনি অনায়াসে এপ্লাই করতে পারেন। কিন্তু তিনি এসবের একটাতে ‘হ্যাঁ’ বলেননি। তিনি এই স্কুল ছেড়ে কখনও যেতে চাননি। স্কুলের সাথে এক দীপ্ত মায়ায় আটকে পড়েছেন। এই মায়ার জাল ছিঁড়ে বের হবার সাধ্য নেই। আর প্রধান শিক্ষক হয়ে উঠলে, উনার দায়িত্ব অনেক বেড়ে যাবে। ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস নেওয়ার সুযোগ থাকবে না। সবার সমস্যার কথা জানা হবে না। তাই তিনি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কে বিসর্জন দিয়েছেন।সেই প্রথম থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের ইংরেজি শিখিয়ে যাচ্ছেন। যখন সেভেন-সিক্সে পড়তো তখন ছাত্রছাত্রীরা ইংরেজিতে কিছুই জানতো না। নিজে হাতে তাদের কে মেরে পিটিয়ে শিখিয়েছেন। আজ তারা সামান্য বড় হতেই,স্যারের অবসরের দাবি জানাচ্ছে। সত্যি ভাবনার বিষয়। আজকাল তিনি একা থাকতে পছন্দ করছেন। বাড়ির ভেতরে বসে শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন সবসময়। যাদের জন্য কঠোর হওয়া… যাদের জন্য ত্যাগ স্বীকার করা… আজ তারাই….
এমন সব দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছিল স্কুল।এই দাবি খানিকটা ভাটা পড়ে স্কুলের বাৎসরিক অনুষ্ঠানের কারণে। স্কুলের অনুষ্ঠান তানভীর স্যারের একদমই পছন্দ নয়। তিনি মনে করেন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য,টাকা খরচ ছাড়া আর অন্য কিছু নয়। তিনি প্রথম প্রথম অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করতেন। প্রধান শিক্ষকের কাছে অনুষ্ঠান না করার দাবি রাখতেন।তবে ইদানিং কয়েক বছর হলো, তাঁকে এমন টা করতে দেখা যায়নি। সবাই যখন মেনে নিয়েছে সেখানে উনার মানতে অসুবিধা কোথায়? ভেতর থেকে না চাইলেও বাইরে থেকে মেনে নিয়েছিলেন। কারণ,স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সময় তিনি লক্ষ্য করেছেন,ছেলেদের মধ্যে এক অদ্ভুত আনন্দ। সবার মুখে একটা প্রফুল্ল হাসি বজায় থাকে।সারাবছর পড়াশোনা করার পর বছরের শুরুতে কিংবা বছরের শেষে যদি একটা সামান্য অনুষ্ঠান হয়, আর সেই অনুষ্ঠান খুশির জোয়ার নিয়ে আসে, তাহলে তো তা খুবই ভালো।
কিন্তু এবারের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তানভীর স্যারের জন্য মোটেও সুখকর ছিল না। তাঁর জীবনে নিয়ে এসেছিল এক ভয়ংকর অঘটন।তিনি যদি আগে থেকে জানতেন তাঁর সঙ্গে এমন টা হবে, তাহলে, হয়তো, কখনো সেই রাতে তিনি স্কুলে থাকতেন না।
স্কুলের অনুষ্ঠানে অনেক দায়িত্ব তানভীর স্যার পেয়েছিলেন। স্কুলের পাশে উনার বাড়ি হওয়ার দরুন উনাকে রাতে স্কুলে থাকার কথা বলা হয়। অনেক জিনিস খোলামেলা পড়ে রয়েছে, জিনিসগুলো পর্যাপ্ত দেখাশোনার দায়িত্ব উনার উপর পড়ে। উনার দুজন সহকর্মী এবং কয়েকজন উঁচু ক্লাসের ছাত্রর সাথে রাতে থাকার দায়িত্ব পান। তিনি অনায়াসে থেকে গিলেন। ছাত্ররা রাতে একসাথে থাকলে একটু বদমায়েশি করবে। এই ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন প্রধান শিক্ষক। তাই তিনি ইচ্ছে করে তানভীর স্যারকে দায়িত্ব দেন। উনার সামনে বদমায়েশি করার স্পর্ধা কারোরই নেই। তানভীর স্যার রাতে স্কুলে থাকছেন -এ কথা শুনে যারা রাতে স্কুলে থাকার জন্য দীর্ঘদিন ধরে প্ল্যান করে রেখেছিল, তারা নিজেদের আসা সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করল। অনেক আশা ছিল রাতে হিন্দি গান বাজিয়ে ডান্স করবে। কিন্তু সে সব আর হচ্ছে না। তাদের মনে একরাশ কুয়াশা জমা হয়। তাদের কাজ ওয়াকিবহাল থাকল কিন্তু আনন্দের মুহূর্ত হারিয়ে গেলো। তানভীর স্যারের উপর তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল।এই সুযোগটাকে কাজে লাগালো কিরণ সঙ্গে আরও কয়েকজন। কিরণ তখন ক্লাস টুয়েলভের ছাত্র। স্যারের প্রতি তার রাগ দীর্ঘদিনের। স্কুলে অনেক বছর ফেল করেছে সে। এই বিষয়টি নিয়ে স্যার তাকে অনেকবার অপমান করেছে। সেদিন অপমান ভুলে গেছিল। স্যারের সুযোগ ছিল তাই তিনি করেছেন। স্যারকে নিজে সুযোগ দিয়েছে তাই সমস্ত দোষ নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে নিয়েছে। কিন্তু সে ভাবে,স্যার তাকে বরাবরই ইচ্ছে করে প্র্যাকটিক্যালে কম নাম্বার দিয়ে এসেছেন। এতদিন কম নাম্বার মেনে নিয়েছে। কিন্তু এখন বোর্ডের পরীক্ষায় কম নাম্বার,এটা মানা যায় না। এমন কি টুয়েলভে বোর্ডের পরীক্ষায় প্র্যাকটিক্যালে যা নাম্বার দিয়েছেন, সে পুরোপুরি নিশ্চিত ফেল করে যাবে। থিওরি পরীক্ষা এখনো হয়নি,তাতে কি করে পাশ করবে জানে না, তার আগে প্র্যাকটিক্যালে ফেল করে বসে আছে। সেখানে থিওরি পরীক্ষা দেওয়া নিতান্ত অর্থহীন। স্যারকে অনেক বার অনুরোধ করেছে, তার সামান্য নাম্বার বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। অন্তত পাস নাম্বার যেন দেয়। পরিশ্রম না করে নম্বর নেবে সেটি হচ্ছে না। তানভীর স্যার স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয় তাকে একটি নাম্বারও বেশি দেবে না। তাকে একটা নাম্বার বেশি দিলে,যারা ভালো করেছে তাদের প্রতি অবমাননা করা হবে। তারা ভালো করে যেই নাম্বার পাবে আর তুমি খারাপ করেও সেই নাম্বার পাবে, সেটি হচ্ছে না। তাহলে তো তাদের পরিশ্রমকে মর্যাদায় দেওয়া হলো না। কিরণ খুব ভালো করে জানে,অন্যান্য শিক্ষক শিক্ষিকারা মুখের উপর না বললেও খাতায় ঠিক নাম্বার দিয়ে দেবেন। কিন্তু তানভীর স্যার করবেন না। উনার মুখ থেকে যে বাক্য বেরিয়ে গেছে সেটাই সঠিক। তিনি আর কখনো ওই বাক্য ফিরিয়ে নেবেন না। তিনি সবসময় ভেবেচিন্তে কথা বলেন। তার কথার খেলাপ হবে না।

রাতের আঁধার কাটেনি, প্রত্যেক দিনের তুলনায় আজ একটু তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেল তানভীর স্যারের। অনেক কাজ পড়ে আছে। ছাত্রদের নিয়ে শেষ করতে হবে। বেলা বাড়তে থাকলে দূরদূরান্ত থেকে অতিথিরা আসতে শুরু করবে। বাইরে বেরিয়ে মুখে জল ঝাপটালেন। নাকের কাছে পোড়া গন্ধ ভেসে আসলো। তিনি এ-দিক ও-দিক ঘুরে দেখলেন। কোথাও কোনো কিছু পুড়তে দেখা গেল না। তবে পোড়া গন্ধ কোথা থেকে আসছে? সামনের দিকে এগোতে রইল। গন্ধ আরও বিকট হয়ে উঠলো। কিছুটা এগিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। চিৎকার করে উঠলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে কয়েকজন ছাত্র আর তার সহকর্মীরা বিছানা থেকে দৌড়ে স্যারের কাছে পৌঁছালো। তারা পুড়ে যাওয়া অংশ নাড়িয়ে চাড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করল। তানভীর স্যার কিছু বলতে পারলেন না শুধু বিলাপ করে গেলেন। প্রধান শিক্ষক কত আশা করে তাঁকে সমস্ত দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আর তিনি কি করলেন? তানভীর স্যার ভাবলেন,এমন কাজ কে করলো? ঠিক সেই সময় কেউ একজন বলে উঠল, আপনার কোনো অনুষ্ঠান ভালো লাগে না, তা বলে স্টেজে আগুন লাগিয়ে দেবেন। তানভীর স্যার ওই মানুষটিকে খুঁজতে চাইল। কিন্তু পারল না। তিনি আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। তাঁর পা দুটো কাঁপছে। তার সঙ্গে কি ঘটতে চলেছে তা অনুমান করতে বাকি রইল না। তিনি সবকিছু স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারছেন। এক মুহূর্তও সেখানে অপেক্ষা করলেন না। বাড়ি ফিরে গেলেন।

গতকাল রাতে কিরণ আর কয়েকজন মিলে স্যারকে ফাঁসানোর প্ল্যান করে। শুধু কিরণ নয়, আরও অনেক স্টুডেন্ট স্যারের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে আছে।গতকাল রাতে তানভীর স্যারকে বারবার অনুরোধ করেছিল, একটু হিন্দি গান বাজবে, একটু নাচানাচি করবে। কিন্তু তানভীর স্যার একটাতেও রাজি হননি। বরং চোখ রাঙ্গিয়ে কথা বলেছিলেন। তাদের রাগ আরও বাড়িয়ে দেয়। কাজ করিয়ে নেবে অথচ আনন্দ করতে দেবে না। এটা কি আদৌ সম্ভব? তবে স্যারের বিরুদ্ধে কিছু করার সাহস পায়নি। সাহস যুগিয়েছিল কিরণ।তারা খুব ভালো করে জানতো তানভীর স্যার খুব ডিসিপ্লিনের মধ্যে চলেন। তিনি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘুমিয়ে যাবেন,এবং তাদের কাজ খুব সুষ্ঠুভাবে শেষ করতে পারবে। উপস্থিত সমস্ত শিক্ষক ঘুমিয়ে পড়ার পর তারা অফিস রুমের মধ্যে প্রবেশ করে। তানভীর স্যার বিশ্বাস করে তাদের হাতে চাবি তুলে দিয়েছিলেন। কারণ, বিভিন্ন কাজের সূত্রে অফিস রুমে বারবার প্রবেশ করতে হতো। তারা একটার পর একটা দরকারী কাগজ পুড়িয়ে দেয়। পুড়িয়ে দেয় ফাইলের মধ্যে থাকা প্র্যাকটিক্যালের উজ্জ্বল নম্বরগুলো। তারপর বাইরে এসে সাজানো-গোছানো স্টেজে আগুন লাগিয়ে দেয়। যদিও স্টেজে সামান্য কিছু পুড়েছে। বেশিরভাগ অংশ ভালোই আছে। আর সমস্ত দায় তানভীর স্যারের উপর অনায়াসে চাপিয়ে দিতে পারলো। কারণ, তাদের কাছে প্রমাণ অনেক আছে। তানভীর স্যারের বিরুদ্ধে অনেক দরখাস্ত স্কুলে জমা দেওয়া হয়েছে। নিজেকে বাঁচাতে কাগজগুলো পোড়াতে পারেন।তাছাড়া ওনার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান একদমই পছন্দ নয়।তিনি কিছুতে চাইবে না সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হোক। আবার তারা সবাই একসঙ্গে রয়েছে। সেখানে তানভীর স্যার একা কি করবেন? উনাকে ফাঁসানো এর চেয়ে দ্বিতীয় কোনো ভালো সুযোগ হতে পারে না। এবং তারা সফলও হলো সকালে।

এত ভোরে স্বামীকে ফিরে আসতে দেখে আশ্চর্য হলেন আমিনা। তিনি বলে গেছিলেন, তাঁর আসতে অনেক বেলা হয়ে যাবে। আমিনা কাজ ফেলে স্বামীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি রীতিমতো ভয়ে কাঁপছেন। আমিনা কখনো স্বামীর এমন ক্রন্দন রূপ দেখেননি।গত কাল বিকেল পর্যন্ত সবকিছু ঠিক ছিল। তাহলে সকালে কেন এমন হচ্ছে?সম্ভবত এই প্রথম তিনি দেখলেন তার স্বামীকে কাঁদতে। অঝোরে কেঁদে যাচ্ছেন। আমিনা দৌড়ে গিয়ে এক গ্লাস জল এনে দিলেন। ঘট ঘট করে জল পান করলেন তানভীর স্যার। এক গ্লাস জলেও আজ তৃষ্ণা মিটলো না। তিনি আরও জল পান করতে চাইলেন। আমিনা উনাকে শান্ত হয়ে বসতে বলেন। কিন্তু তিনি কিছুতেই শান্ত হতে পারছেন না। কত বড় বিপদ হতে চলেছে তিনি জানেন। তাছাড়া তার দীর্ঘদিনের পরিশ্রম সবকিছু শেষ করে দিয়েছে তার ছাত্ররা। কি হয়েছে, আমিনা জানতে চাইলেন। ধীরেসুস্থে স্যার পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন। পুরো ঘটনা শুনে আমিনা মুখের মধ্যে শাড়ির আঁচল লুকিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। দুটো মানুষ কেঁদে চললেন। থামানোর মতো কেউ নেই। থামতে হলে নিজেই নিজেকে ভরসা দিতে হবে।
‘বিশ্বাস করো আমিনা, আমি এমনটা করিনি। আমি কোনো অন্যায় করিনি। কোনো কাগজ পোড়াই নি। তবুও আমাকে শাস্তি দেওয়া হবে।’
স্বামীর কথা শুনে তিনি আরও বেশি কেঁদে উঠলেন। তিনি জানেন তার স্বামী কখনো এমনটা করবেন না। অন্যের ভালোলাগাকে তিনি কখনো নষ্ট করবেন না। তানভীর স্যার কিছুটা থেমে বললেন,’তারা ইংরেজিতে কিছু জানতো না। আমি নিজে হাতে তাদেরকে ধরিয়ে পড়িয়ে একটু একটু করে ইংরেজি শিখিয়েছি। আর তারা একটু বড় হতেই….তারা আমার সামনে ইংরেজিতে বড় বড় বাক্যে আমাকে গালি দিল।’
আমিনা স্বামীকে কি বলে সান্ত্বনা দেবে বুঝে উঠতে পারল না। তবে এটুকু বিশ্বাস করেন স্বামী সম্পূর্ণ নির্দোষ। তিনি একজন সত্তিকারের ভদ্র মানুষ। কিন্তু তিনি নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছেন। আমিনা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,’কেন তুমি বাড়ি পালিয়ে এলে? এতে তো আপনি আপনি প্রমাণ হয়ে যায় সমস্ত ঘটনার জন্য তুমি নিজেই দায়ী।’
‘কি করতাম আমি, বল? নিজের হাতে নিজের সৃষ্টিকে পুড়তে দেখেছি। আমি চাকরির ভয় পাই না। চাকরি যাক তাতে আমার অসুবিধা নেই। কিন্তু একটার পর একটা বছর পরিশ্রম করে যা তৈরি করেছিলাম সেটা শেষ হয়ে গেছে।’
‘সৃষ্টি! কিসের সৃষ্টির কথা বলছো?’ আশ্চর্য হয়ে আমিনা জানতে চাইল। তানভীর স্যার করুন গলায় বললেন,’হ্যাঁ, সৃষ্টি! আমার সৃষ্টি! ইংরেজিতে কত বড় বড় ফর্মুলা আমি খুব সহজ-সরল ভাষায় ছোট্ট করে রেখেছিলাম। আমাদের দেশে ছেলেমেয়েরা ইংরেজি গ্রামারে খুব কাঁচা। তারা ইংরেজি শিখতে চায় কিন্তু ইংরেজি গ্রামার নয়। কিন্তু ইংরেজি গ্রামার ছাড়া ইংরেজি অসম্পূর্ণ। আমি নিজের মতো করে একটা একটা করে ফর্মুলা তৈরি করেছিলাম। নতুন নতুন ইংরেজি শব্দ…. নতুন কিছু নিয়ম…. সেগুলো তারা পুড়িয়ে দিয়েছে।’
তানভীর স্যার আর আমিনার চোখ থেকে টুপটাপ করে জল ঝরে পড়ল। তিনি কিছুটা থেমে আবার বললেন,’জানো আমিনা, একটা ফর্মুলা তৈরি করতে কত সময় লাগে? তুমি একটা ফর্মুলা তৈরি করলে। আর তা সবগুলোতে প্রয়োগ করতে শুরু করলে। পঞ্চাশ পর্যন্ত ওই ফর্মুলা কাজ করলো, কিন্তু একান্নতে ওই ফর্মুলা কাজ করলো না। তাহলে ওই ফর্মুলা সম্পূর্ণ বাদ। আবার ভেবে চিন্তেই নতুন করে একটা ফর্মুলা তৈরি করতে হবে। তাকে আবার সব যায়গায় প্রয়োগ করে দেখতে হবে। প্রায় কুড়ি বছর ধরে আমি ওই গুলোর পেছনে ছুটেছি। নতুন করে অনেক কিছু তৈরি করেছি। নিজের মতো করে ইংরেজির উপর রিসার্চ করে অনেক কিছু সৃষ্টি করেছিলাম। ভেবেছিলাম, ইংরেজি গ্রামার বই লিখব। সারাদেশে আমার বই ছড়িয়ে পড়বে। খুব কম দামে ওই বই বিক্রি হবে।আর খুব সহজে ছাত্র-ছাত্রীরা ইংরেজি শিখতে পারবে। এক পার্সেন্ট হলেও তাদের ইংরেজির প্রতি ভয় কমবে। আর সেটাই হবে আমার সাফল্য। কিন্তু আমার সব রিসার্চ মাটিতে মিশে গেল। এক মুহূর্তের জন্যও ভাবিনি, আমার সঙ্গে এমন টা হবে।’
চারিদিকে নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরলো। ইতিমধ্যে সূর্যিমামার দেখা মিলেছে। একটা নির্মন সকাল শুরু হয়েছে। মানুষ যে যার মতো করে ব্যস্ত হয়ে উঠছে। কিন্তু প্রত্যেক সকালের তুলনায় আজকের সকাল আলম পরিবারে সম্পূর্ণ আলাদা। এক নতুন ঘটনার সাক্ষী থাকলো তারা।
‘সেগুলো না হয় আবার তৈরি করে নেবে।কিন্তু কষ্ট পেয়ো না। তোমার কষ্টে আমার বুকটা জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে।’ আমিনা শান্ত গলায় বললেন।
‘কিছু কিছু জিনিস চাইলেও দ্বিতীয়বার তৈরি হয় না।’
আমিনা স্বামীকে দেখে বুঝতে পারলেন তিনি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছেন। একজন মানুষের কুড়ি বছরের পরিশ্রম, যখন একটা সেকেন্ড লাগে না শেষ করে দিতে,তখন কেবল ওই মানুষটাই বুঝতে পারে তার কষ্টের ব্যাথাটা। আর কেউ কখনো বুঝতে পারে না। আমিনা তাও বললেন,’এমন কাজ তোমার সঙ্গে কে করতে পারে? তোমার তো আবার শত্রুর অভাব নেই।’
‘আমি কিছু জানি না আমিনা। তবে এটুকু বলতে পারি, ছাত্রদের এত সাহস কখনোই হবে না! এর পেছনে অন্য কেউ রয়েছে। হয়তো, তাকে কোনোদিন চিনতেই পারবো না।’

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here