মাস্টারমশাই পর্ব ১৯

0
309

মাস্টারমশাই
পর্ব ১৯
____________
রাত প্রায় এগারোটার কাছাকাছি। বেশ গরম পড়েছে।আবার কারেন্ট নেই। তানভীর স্যার গরমে হাঁসফাঁস করছেন। পাশে স্ত্রী শুয়ে আছেন। সম্ভবত তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু তানভীর স্যার ঘুমোতে পারছেন না। বারবার চেষ্টা করছেন ঘুমানোর, কিন্তু পারছেন না।পাস ঘুরলেন। স্ত্রীর মখমলে মুখটি তাঁর সামনে ভেসে উঠলো। গভীর ঘুমে মগ্ন আমিনা। তিনি গরম অনুভব করলেও, আমিনা শীতে কাঁপছে। তাঁকে কম্বল ঘুড়িয়ে দিলেন। স্ত্রীর শরীর এখনও বেগতিক। গ্রামে প্রায় সকল ডাক্তার আমিনাকে দেখে নিয়েছেন, কিন্তু আমিনার রোগ ধরতে পারেননি। তিনি প্রচুর চিন্তা করেন। চিন্তার কারণে তাঁর বর্তমান অবস্থা। ডিপ্রেশনের কোনো ওষুধ হয় না। ডিপ্রেশনের যদি কোনো ওষুধ থাকে,তা হলো নিজেই। কেবল নিজে চাইলেই ডিপ্রেশন থেকে মুক্ত পাওয়া যায়। না হলে কখনো মুক্ত পাওয়া সম্ভব নয়। তানভীর স্যার স্ত্রীকে অনেক বুঝিয়েছেন, পুরনো কথা কল্পনা করতে বারণ করেছেন। অতীত নিয়ে পড়ে থাকা ভালো নয়। আমিনা বলেন,অতীতের কথা মনে করবেন না। কিন্তু তা তো ক্ষণিকের জন্য। আপনা-আপনি ওই কথাগুলো মাথার মধ্যে চলে আসে। ওই কথাগুলো দূর করতে চাইলে মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়। নিজেকে সামলানোর সবকটা উপায় যেন শেষ হয়ে গেছে। তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি স্ত্রীর পুরোপুরি গা ঘেঁষে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন। সম্ভবত মিনিট পাঁচেক চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল, তখনই আমিনা বিলাপ করতে শুরু করেন। হুরমুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়েন তানভীর স্যার। লক্ষ করেন, আমিনা পেটে হাত দিয়ে চিল্লাচিল্লি করছেন। অসহ্য যন্ত্রণা তাঁকে সহ্য করতে হচ্ছে।অন্ধকারের মধ্যে তিনি স্ত্রীর মুখ ভালোভাবে দেখতে পেলেন না। তাড়াতাড়ি ল্যাম্প জ্বালালেন। ল্যাম্পের আলোতে, আমিনার মুখখানা পুরোপুরি লাল দেখাচ্ছে। এক ছোট্ট পরিপাটি মুখখানি, এই মুখশ্রী দেখলে কোনো সাধারণ ব্যক্তি বলতে পারবে না -এর আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে অজস্র যন্ত্রণার স্মৃতি।চোখ দুটো থেকে অশ্রু ঝরে পড়ছে। বারবার স্বামীকে বললেন, কষ্ট সহ্য করতে পারছেন না। তাকে কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে।পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। মাথা বনবন করে ঘুরছে। তানভীর স্যার আমিনার মাথায় হাত দিয়ে দেখলেন, জ্বর বিকালের থেকে এখন অনেক বেড়ে গেছে। তিনি হালকা গরম জল নিয়ে এসে স্ত্রীকে খাওয়ালেন। কিন্তু কিছুতেই স্ত্রীর পেটের ব্যথা কমাতে পারলেন না। ভীষণ চিন্তায় পড়লেন তানভীর স্যার। এখন তিনি কী করবেন? স্ত্রী যন্ত্রণায় ছটফট করছে, আর তিনি বসে বসে দেখবেন।তা কখনোই হতে পারে না। আমিনাকে কিছুক্ষণ যন্ত্রণা সহ্য করতে বলেন। খুব শীঘ্রই ডাক্তার নিয়ে আসবেন, আশ্বাস দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। সামনে পূর্ণিমা,তাই আকাশে বড় চাঁদ উঠেছে। চারিদিকে নক্ষত্রেরা মিটমিট করে জ্বলছে। তানভীর স্যারের হাতে টর্চ লাইট রয়েছে।ওটা জ্বালানোর প্রয়োজন হলো না। চারিদিকে আলোয় ঝলমল করছে। দ্রুত পায়ে ডাক্তারের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।গ্রামের বেশ কয়েকজন হাতুড়ে ডাক্তার রয়েছে। তবে তানভীর স্যার গ্রামের কোনো ডাক্তারের কাছে গেলেন না। পাশের গ্রামে একজন ডাক্তার রয়েছেন। তিনি সবসময় তাদের বাড়ির ছেলে মেয়ে থেকে শুরু করে আমিনার চিকিৎসা করেন। তিনি ভালো করে বুঝতে পারবেন, আমিনার কষ্টের কারণ কি? বেশি দূরে নয় পনেরো মিনিট মতো হেঁটে যেতে হবে। তিনি গেলে, ডাক্তার কিছুতেই না এসে থাকতে পারবেন না। অবশ্যই আসবেন। গ্রামের রাস্তা। রাত দশটার মধ্যে গ্রামের মানুষগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে।রাস্তায় কেউ নেই। রাস্তা যেখানে সেখানে কয়েকটা কুকুরের দল আর ষাঁড় ছাড়া কারোর দেখা পেলেন না। মাঝেমধ্যে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা গেল। কুকুরের দল স্যারকে দেখামাত্র ঘেউ ঘেউ করে ওঠল। বড্ড বিরক্ত হলেন স্যার। মানুষটির কিছুই ভালো লাগছে না। প্রিয় মানুষের অসুস্থতা তাঁকে পুড়িয়ে মারছে। তিনি কখনও এত রাতে বাড়ির বাইরে বের হন না। আজ বেরিয়েছেন। একটা ভয়ও অনুভব করছেন। গা ঝিমঝিম করছে। কিন্তু তিনি কোনো বাধা মানলেন না। তাঁর প্রিয় মানুষটি যে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। তার চাইতে বড় ভয় আর কোনো কিছু তে হতে পারে না। ডাক্তারবাবুর বাড়িতে পৌঁছে বাইরে থেকে জোরে হাঁক ছাড়লেন। বেশ কয়েকবার হাঁক ছাড়ার পরেও কেউ বেরিয়ে আসলো না। তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। আবার জোরে জোরে হাঁক ছাড়লেন। কয়েকবার হাঁক ছাড়ার পর বাড়ির ভেতরে আলো জ্বলে উঠলো। জ্বলে ওঠা আলো দেখে তানভীর স্যার একটা জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তারপর একটা খটখট শব্দ কানে ভেসে আসলো। দরজা খোলার শব্দ। অনেক পুরনো দরজা তাই এমন বিকট শব্দ। তানভীর স্যার লক্ষ্য করলেন, একজন মানুষ লন্ঠন হাতে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছেন। মানুষটিকে চিনতে একদম অসুবিধা হলো না। তিনি নবারুণ চট্টোপাধ্যায়। সবাই মানুষটিকে চাটুজ্জে ডাক্তার বলে ডাকেন। বয়স প্রায় সত্তরের গোড়ায়। একসময় তিনি বড় ডাক্তার ছিলেন। তারপর বয়স বাড়তে থাকে আর ডাক্তারিও ছেড়ে দিলেন। এখন তেমন কোনো কাজ করেন না। গ্রামের দু’চারজন রোগী দেখেন। মানুষটির সঙ্গে তানভীর স্যারের খুব ভালো একটা সম্পর্ক রয়েছে।যদিও মনের দিক দিয়ে দুজন সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ।এত রাতে তানভীর স্যারকে দেখে তিনি অবাক হলেন। তিনি খুব দ্রুত তানভীর স্যারের কাছ থেকে সব কিছু জানলেন। তিনি কিছু না বলে বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন তারপর একটা বাক্স নিয়ে বেরিয়ে আসলেন। পরনে ধুতি আর সাদা রঙের একটা ফতুয়া। তাঁর পেছনে পেছনে একজন মহিলা আসলেন। তানভীর স্যার সেদিকে মনোযোগ দিলেন। মহিলাটি প্রখর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। তাকেও চিনতে অসুবিধা হয়নি তানভীর স্যারের। তিনি চাটুজ্জে ডাক্তারের স্ত্রী। তানভীর স্যার আর চাটুজ্জে ডাক্তার পথ ধরে হাঁটতে থাকলেন।আর মহিলাটি বাড়ির উঠোনে লন্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তানভীর স্যারের চোখে মুখে খুশির জোয়ার।তিনি জানতেন, চাটুজ্জে ডাক্তার কিছুতেই না বলবেন না। এত রাতেও তিনি ছুটে আসবেন। কিন্তু গ্রামের ডাক্তারদের মধ্যে কোনো একজনকে বললে, তারা কখনোই আসতো না। নানা ধরনের অজুহাত দেখাতো।‌ তাইতো তিনি গভীর রাতে এতদূর ছুটে এসেছেন।

বাড়ি এসে দুজন দেখলেন, আমিনা তখনও যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে চাটুজ্জে ডাক্তার আমিনার চিকিৎসা করলেন। কিন্তু কিছুতেই আমিনার যন্ত্রণা বন্ধ করতে পারলেন না।এমন যন্ত্রণার কারণ কি সেটাও বার করতে পারলেন না। বড় ধরনের কিছু হয়েছে নিশ্চিত। সেটা তিনি তানভীর স্যারকে বললেন না। বলে দিলে, মানুষটি ভেঙ্গে পড়বেন। তিনি হতাশা মুখে তানভীর স্যারের দিকে তাকালেন। তানভীর স্যার বুঝতে পারলেন, তিনি কি বলতে চাইছেন। একটু থেমে থেমে বললেন,’এখন উপায় কি চাটুজ্জে ডাক্তার?’
‘স্ত্রীকে শহরে নিয়ে যাও। বড় ডাক্তার দেখাও।তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে তোমার স্ত্রীর পেটের যন্ত্রণার আসল কারণ কি?’
‘আমি অনেকবার শহরের ডাক্তারকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে আমিনার চিকিৎসা করিয়েছি। কিন্তু আমিনার রোগ ধরতে পারেনি।’
‘আমি বুঝতে পারছি তানভীর। তবে আবার একবার দেখিয়ে আনো, অন্য কোনো ভালো ডাক্তারকে।’
তানভীর স্যার আর কিছু বললেন না। তিনি টেলিফোনে কাউকে কল করতে থাকলেন। কিন্তু বিপরীত মানুষটি কল ধরলো না তিনি আবার অন্য কাউকে কল করতে লাগলেন। বারবার ব্যর্থ হলেন। তানভীর স্যার একসময় কেঁদে ফেললেন। বড্ড অসহায় দেখাচ্ছে মানুষটিকে। চোখ দুটো পাংশুবর্ণ হয়ে গেছে। মুখের উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে গেছে। মানুষটিকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো আজ কেউ নেই। পুরো পৃথিবীটাই তাঁর কাছে শূন্য মনে হচ্ছে। কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই। কোনো বন্ধু বান্ধব নেই। তিনি ভীষন একা। কেউ সাহায্য করার মতো পাশে নেই। এখন আমিনার বলা কথাগুলো মনে পড়ছে। আমিনা বলতো, সমাজ খারাপ হলেও সমাজের সঙ্গে মিলেমিশে চলতে হবে। খারাপকে মেনে নিতে হবে।না হলে, সমাজে টিকে থাকা যাবে না। এখন তিনি তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। নিজের আইনের কাছে নিজেই হেরে যাচ্ছেন। তাঁর বলি হচ্ছে আমিনা। তাঁর ভালোবাসার মানুষ। চাটুজ্জে ডাক্তার উঠে দাঁড়ালেন। তিনি তানভীর স্যারের কাঁধে হাত চাপড়ে বললেন,’শান্ত হও তানভীর। তোমার বয়স হয়েছে একটু বোঝার চেষ্টা করো। তোমার মনের পরিস্থিতির কথা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু কিছু করার নেই। এত রাতে তুমি কোনো গাড়ি পাবে না। তাছাড়া অ্যাম্বুলেন্সকে ফোন করলে শহর থেকে এখানে আসতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাছাড়া গ্রামের সরু পথে এম্বুলেন্সের প্রবেশ করা কখনো সম্ভব নয়। স্ত্রীকে নিয়ে বটতলায় যেতে হবে। তার চাইতে আমি একটা পরামর্শ দিচ্ছি ওটা মেনে চলো। আমি কয়েকটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি ওইগুলো দোকান থেকে নিয়ে আসো।আশা করছি ওষুধ গুলো খাইয়ে দিলে পেটের যন্ত্রণা কমে যাবে। সকালে গ্রামের কোনো এক যুবক ছেলেকে বলো, বাইকে করে স্ত্রীকে বটতলায় পৌঁছে দিতে।বাইক থাকলে ভালো না থাকলে দোলনার ব্যবস্থা করো। সেখান থেকে কোনো গাড়ি বুকিং করে কলকাতায় চলে যাও।কলকাতা থেকে স্ত্রীর চিকিৎসা করে আনো। আমিনা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে।’
চাটুজ্জে ডাক্তারের কথা ভাবতে থাকলেন তানভীর স্যার। তিনি কথাটা মন্দ বলেননি। কিন্তু এত রাতে ওষুধ দোকান তো খোলা থাকবে না। তানভীরের মনের কথা যেন চাটুজ্জে ডাক্তার পড়ে নিলেন। তিনি স্বাভাবিক গলায় বললেন,’ময়ূরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে হয়তো দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু আমি পুরোপুরি নিশ্চিত বটতলায় দোকান খোলা আছে। ওষুধ দোকান তো অবশ্যই খোলা থাকার কথা। তুমি সাইকেল নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যাও।’
তানভীর স্যার পোশাক বদলালেন না। শুধু ড্রয়ার থেকে কয়েকটা টাকার নোট তুলে নিলেন। তারপর দ্রুত পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। বেরিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল করলেন স্ত্রী এখানে একা থাকবে। বড়তলা থেকে ফিরতে যথেষ্ট সময় লাগবে। এতক্ষণ স্ত্রীকে একা রাখা কি ঠিক হবে? তিনি আবার ফিরে আসলেন। চাটুজ্জে ডাক্তার তখন নিজের বাক্স গোছাচ্ছেন। তাকে ফিরে আসতে দেখে চাটুজ্জে ডাক্তার বললেন,’কি হলো? ফিরে আসলে কেন?’
‘ডাক্তার বাবু আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?’
‘বল?’
‘কিছুক্ষণ আমার স্ত্রীর কাছে থাকুন। আমি ফিরে আসলে আপনি চলে যাবেন। প্লিস ডাক্তারবাবু না বলবেন না।’
চাটুজ্জে ডাক্তার মৃদু হাসলেন। তিনি হাসিমুখে বললেন,’স্ত্রীকে এত ভালোবাসো!এই বয়সেও প্রেম।’
‘এই মানুষটা ছাড়া আমার যে আর কেউ নেই। একটা বড় গাছ ছিল। গাছে কত পাখি বাসা বানিয়ে ছিল। কাঠবেড়ালিরা সারাদিন ওঠানামা করত। পাখিরা গান করত। ফুল ফুটত। কিন্তু এক সময় গাছে বসন্ত আসা বন্ধ হয়ে গেল। তারপর পাখি কাঠবেড়ালি সবাই চলে গেল। গাছে আর ফুল ফুটে না। কিন্তু গাছটা তো আছে। এখনো এই গাছ আমাকে ছায়া দেয়। ওই গাছটা আমার জীবনের থেকেও অনেক দামী।’
চাটুজ্জে ডাক্তার আবার হাসলেন। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা দেখে অবাক হলেন। এই বয়সে একটুও প্রেম কমেনি। বরং প্রেম বেড়েছে। তিনি তানভীর স্যারকে আশ্বস্ত করলেন,তার ফিরে না আসা পর্যন্ত তিনি তাদের বাড়িতে অপেক্ষা করবেন। তানভীর স্যার আশ্বস্ত হয়। মানুষটিকে অনায়াসে বিশ্বাস করা যায়। তানভীর স্যার একটু হেসে বললেন,’শুধু কি আমি আমার স্ত্রীকে ভালোবাসি! আপনি ভালোবাসেন না? আমি খুব ভালো করে লক্ষ্য করেছি,আমরা দুজন যখন বেরিয়ে আসছিলাম তখন আপনার স্ত্রী বাড়ির উঠোনে লন্ঠন নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। হয়তো,আপনার বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত তিনি ওইখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন। অপেক্ষা করবেন।’
চাটুজ্জে ডাক্তার তানভীর স্যারের দিকে তাকালেন। দুজন একে অপরকে তাকিয়ে হাসি বিনিময় করলেন। তারপর বললেন,’আসলে মেয়ে মানুষ গুলো এমনই।আমরা পুরুষেরা অনেক ত্যাগ স্বীকার করি অনেক যন্ত্রণা সহ্য করি। কিন্তু নারীদের মতো কখনো ত্যাগ স্বীকার কিংবা যন্ত্রণা সহ্য করতে পারবো না। তাদের অদ্ভুত এক ধরনের যন্ত্রণা কিংবা ত্যাগ স্বীকার করার ক্ষমতা রয়েছে। আমাদের অপছন্দের মানুষগুলো খুব সহজে পছন্দ হয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন। অপছন্দের মানুষটা খুব তাড়াতাড়ি পছন্দের হয়ে ওঠে। অপছন্দের মানুষটাকে ভালোবেসে ফেলে। তাকে ছাড়া নিজেকে শূন্য মনে করে। একটু খেয়াল করে দেখবে, বাড়িতে নারীর তুলনায় পুরুষরাই একটু বেশি সুযোগ সুবিধা পায়। কিন্তু ভালো করে লক্ষ্য করবে,সেই নারীরা নারীদের তুলনায় পুরুষদের বেশি ভালোবাসি। অদ্ভুত এই নারী জাতি!’

হসপিটালে বেডের উপর শুয়ে আছেন আমিনা। তিনি নিশ্চিত, এই পৃথিবীতে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার অতিথি।যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। মৃত্যুর ঘন্টা বেজে উঠেছে। ওষুধ দিয়েছে কিন্তু কাজে আসেনি। রিপোর্ট আসতে অনেক দেরি আছে। পাশে বসে আছেন তানভীর স্যার।গতকাল থেকে খাওয়া আর ঘুম নেই। সারারাত বসে স্ত্রীর সেবা সুস্থতা করেছেন। তিনিও বুঝতে পারছেন, স্ত্রী আর বেশিক্ষণ বেঁচে থাকবে না। গতকাল রাত থেকে কোনো কথা বলেনি। ঠিকমতো হাত-পাও নাড়েননি। বিবর্ণ চোখ থেকে মাঝে মধ্যে জলের রেখা বয়ে যেতে দেখেছেন। তিনি ভীষণ ক্লান্ত। চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। উস্কোখুস্কো চুল। হসপিটালে প্রবেশ করা থেকে তিনি বারবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন আমিনার সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু আমিনা কিছু বলতে পারেনি। শুধু মাথা নড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ বলে গেছেন। দুজন কেঁদেছেন। ভীষণ রকমের কান্না। কিন্তু দুজনের মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হয়নি। শুধু চোখের জলে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তাদের ব্যথার কথা। আমিনা কিছুতেই স্বামীকে ছেড়ে যেতে চাইছেন না। তিনি চলে গেলে, স্বামী বড্ড একা হয়ে যাবে। স্বামীকে কেউ কখনো বোঝেনি,তিনি ছাড়া। কিন্তু বিধাতা তা শুনবে না। তাঁকে নিয়ে যাবে। তানভীর স্যারকে একা দাঁড় করিয়ে দেবে। তাঁকে আরও জীবনের মানে বোঝাবে। বুকটা বার বার হাহাকারে ভরে উঠছে। মৃত্যুর আগে যেন তিনি কিছু কথা স্বামীকে বলে যেতে চান। কিন্তু তাও সম্ভব নয়। তিনি ঠোঁট নাড়াচাড়ার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেছেন। এই জিনিসটা তাঁকে যেন আরও বেশি ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। আর একই সঙ্গে থাকা হবে না।একই সঙ্গে গল্প করা হবে না। জড়িয়ে ধরে দুজন ঘুমোতে পারবে না। একে অপরকে খাইয়ে দিতে পারবে না। ছেলে মেয়েদের নিয়ে ভবিষ্যতে চিন্তা থাকবে না। তিনি আরও বেশি কষ্ট পাচ্ছেন, শেষে মুহূর্তে ছেলেমেয়েদেরকে না দেখতে পেয়ে। যাদেরকে নিজে হাতে বড় করেছিলেন।তাদের জন্য নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ সময় গুলো নষ্ট করে ফেলেছিলেন। আজ তারা এখানে নেই। তারা ব্যস্ত শহর আর টাকার কাছে হারিয়ে গেছে। তাদের কাছে বাবা-মা মূল্যহীন। ইয়াসমিনকে সকালে টেলিফোন করে বলা হয়েছিল, মা ভীষণ অসুস্থ সে যেন একবার এসে দেখা করে যায়। কিন্তু সে আসেনি। বলেছে, আগামীকাল সকালে আসবে। শশুর মশাইও ভীষণ অসুস্থ। উনাকে ফেলে এখানে আসা সম্ভব নয়। আর ছেলের কোনো দেখা সাক্ষাত নেই।
আমিনা হঠাৎ করে অদ্ভুত এক ধরনের আচরণ করলেন। তিনি এতক্ষণ ধরে তানভীর স্যারের একটা হাত ধরে রেখেছিলেন। এবার সেই হাতকে আরও জোরে শক্ত করে ধরলেন। তারপর স্বামীর দিকে তাকালেন। চোখ থেকে জল ঝরে পড়ছে। তিনি ইশারা করে স্বামীকে কান্না করতে বারণ করলেন। নিজের খেয়াল রাখতে বললেন।প্রত্যেক মানুষেরই মৃত্যু হয়। কেউ আগে মারা যায় কেউ পরে। এটাই বিধাতার নিয়ম। হঠাৎ করে আমিনা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করলেন। তারপর থমকে যায় তার দেহ। তানভীর স্যার এমন দৃশ্য কখনো দেখেননি। অনেক মানুষের মৃতদেহ দেখেছেন। কিন্তু কখনো কোনো মানুষকে মারা যেতে দেখেননি। এই প্রথম তিনি দেখলেন, আবার নিজের স্ত্রীর মৃত্যু। বড্ড ভয়ঙ্কর এই মৃত্যু।

অনেকক্ষণ ধরে মৃতদেহের পাশে বসেছিলেন তানভীর স্যার। অনেক কেঁদেছেন। জোরে জোরে চিৎকার করে কেঁদেছেন। তাঁর কান্নার শব্দে নার্স আর ডাক্তার ছুটে আসে। তারপর মানুষটিকে বাইরে বের করে দেন। হাসপাতালের নিজস্ব কিছু গাইডলাইনস রয়েছে। সেগুলো অবশ্যই পালন করতে হবে। ডাক্তার আর নার্স সেগুলোই করতে শুরু করলেন।বাইরে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে তানভীর স্যার বসে রইলেন। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। জীবনের সবচাইতে প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে ফেলেছেন। চাইলেও আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। তিনি কত নিয়মের মধ্যে চলতেন। কিন্তু আজ কোথায় সেই সব নিয়ম?তিনি গতকাল রাত থেকে কিছু খাননি। এখন আবার একটা রাত হয়ে গেছে। হয়তো, আরও অনেকগুলো রাত এমন কেটে যাবে। বিভিন্ন স্মৃতি উনার মাথায় জেগে উঠল। আমিনার সঙ্গে প্রথম রাত থেকে শেষ রাত পর্যন্ত কাটানো মুহূর্তগুলো। তিনি মনে করার চেষ্টা করলেন, আমিনার সঙ্গে শেষবারে ঠিক কোন বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলেন? বেশ কয়েকদিন আমিনার সঙ্গে তেমন কথা হয়নি। কাল রাতে তো একটাও কথা বলেননি। আজ শহরে আসার সময় একবার বলেছিলেন। দুরন্ত গাড়ি যখন গ্রামকে পেছনে ফেলে প্রায় শহরের মধ্যে ঢুকে গেছে। তখনই আমিনা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমরা কি হাওড়া ব্রিজের উপর দিয়ে যাব?’তানভীর স্যার তীক্ষ্ণ চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি গতকাল রাতে এবং ভোরে অনেকবার চেষ্টা করছিলেন,আমিনার সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু আমিনা কিছু বলেননি। আর এখন নিজে থেকে কথা বলার চেষ্টা করছে। তানভীর স্যার হাসিমুখে বলেছিলেন, ‘আমরা হাওড়া ব্রিজের উপর দিয়ে যাচ্ছি না। ওই পথ দিয়ে হাসপাতালে যেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তুমি ভীষণ অসুস্থ। সুস্থ হয়ে নাও তারপর ওই পথ দিয়ে যাব।’ আমিনা আবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাহলে তারা কোন পথ দিয়ে যাচ্ছে?
তানভীর স্যার হাসিমুখে দ্বিতীয়বার উত্তর দিয়েছিলেন, তারা দ্বিতীয় হুগলি সেতুর ওপর দিয়ে যাচ্ছে। যদিও ওই দিক দিয়ে হাওড়া ব্রিজ দেখা যায়। তবে আমিনার পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। তাছাড়া তারা অনেক আগে দ্বিতীয় হুগলি সেতু পেরিয়ে এসেছেন। আমিনা আর কিছু বলেননি। তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তানভীর স্যার কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। আমিনার শেষ ইচ্ছের কথা মনে পড়তেই তানভীর স্যার আরও বেশি ভেঙে পড়লেন। নিজেকে আরও বেশি অপরাধী মনে হল। তিনি স্ত্রীর শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে পারলেন না।নিজেকে বারবার প্রশ্ন করলেন, কেন তিনি এমনটা করলেন? আমিনা কতবার বলেছিলেন হাওড়া ব্রিজ দেখবে। একবার এসে ঘুরিয়ে নিয়ে গেলে……।
হাসপাতালে সমস্ত গাইডলাইনস আর কাগজপত্র ঠিক করে উঠতে রাত প্রায় এগারোটা পেরিয়ে গেল। গতকালের রাত এগারোটা আজকে রাত এগারোটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মৃতদেহ নিয়ে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। রাস্তায় যানবাহন অনেক কমে গেছে। হাতে গোনা কয়েকটা গাড়ি দ্রুত ছুটছে। মৃতদেহের একপাশে বসে রয়েছেন তানভীর স্যার। কোনো কথা বলছেন না। শুধু আলোকোজ্জ্বল শহরের দিকে তাকিয়ে থাকলেন…….
অনেকক্ষণ ধরে গাড়ি চলল। হাওড়া ব্রিজের কাছাকাছি আসতেই তানভীর স্যার ড্রাইভারকে বললেন,কিছুক্ষণের জন্য গাড়ি থামাতে। কিন্তু ড্রাইভার কিছুতেই রাজি হলো না। শহরে যেখানে সেখানে গাড়ি থামানো যায় না। আবার হাওড়া ব্রিজের উপর -তা সম্ভব নয়। কিন্তু তানভীর স্যার বারবার অনুরোধ করতে লাগলেন। ড্রাইভার বড্ড বিপদে পড়লো। একদিকে আইন অন্যদিকে তানভীর স্যারের কাকুতি মিনতি। এখানে কি করা উচিত সে জানে না? একজনের কথা রাখলে অন্যজনের সর্বনাশ। তবে একটা জিনিস খেয়াল করলো। রাত অনেক হওয়ায় শহরের জমজমাট কিছুটা হলেও কম। আবার সে মনে করলো, কিছু কিছু জায়গায় আইন ভাঙলে অন্যায় নয়। এখানে আইন না ভাঙলে একজনের সারা জীবনের আক্ষেপ থেকেই যাবে। এক মৃত মানুষের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।ড্রাইভার গাড়ি থামাল। মাত্র দু মিনিটের জন্য। তানভীর স্যার বাইরে বেরিয়ে আসলেন। গাড়ির মধ্যে ড্রাইভার আর মৃতদেহ রইল। গরমের মধ্যেও একটা শীতল হাওয়া তাঁর গায়ে আঘাত আনছে। জোস্না উজ্জ্বল এক রাত্রি। যদিও শহরের জোস্না বোঝা যায় না। বোঝা গেলেও কম। শহরের আলোর কাছে জোস্না হারিয়ে যায়। ব্রিজের কাছে গিয়ে তিনি দাঁড়ালেন। আমিনার স্বপ্ন অদ্ভুত ভাবে পূরণ হলো। তিনি ব্রিজের উপর দিয়ে হাঁটতে চাইছিলেন। ব্রিজের উপর কিছুক্ষণ বসতে চাইছিলেন। আজ সেই স্বপ্ন পূরণ হলো। ব্রিজের উপর মানুষটি শুয়ে(গাড়ির ভেতর) আছে, তবে মৃত অবস্থায়। রক্তে-মাংসে গড়া দেহটা আছে,কিন্তু ভেতরের আত্মা নেই। তানভীর স্যারের চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে,স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য কেবল তিনি নিজেই দায়ী। হ্যাঁ তিনি নিজেই দায়ী। তিনি যদি নিজের জন্য আইন তৈরি করতেন না, তাহলে তাঁর স্ত্রী কখনোই মারা যেত না। তিনি যদি সমাজের সঙ্গে মেনে চলতেন,তাহলে কখনোই এমনটা হতো না। সবকিছু ঠিক থাকলে তিনি কখনো স্কুল থেকে রিটায়ার্ড হতেন না। মাহবুব কখনো বাড়ি ছেড়ে চলে যেত না। আর আমিনা অসুস্থ হতো না। আমিনার সমস্ত স্বপ্ন পূরণ হতো। তাদের ভরা সংসার থাকতো। শুধুমাত্র নিজের জন্য, নিজের আইনের জন্য, নিজের অহংকারের জন্য, নিজের জেদের জন্য, আজ তিনি একা।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here