মাস্টারমশাই পর্ব ২০

0
348

মাস্টারমশাই
পর্ব ২০

দু’বারের মতো ফোনের রিংটোন বেজে গেল। কেউ রিসিভ করল না। মাহবুব তৃতীয়বারের মতো দুপুরকে কল করল। সাধারনত দুপুরকে এত ভোরে কেউ কখনো কল করে না। সকাল সকাল তার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দেওয়ায় মনটা খিটখিটে হয়ে গেল। ইচ্ছে করে সে ফোন ধরল না। দুপুর খুব সুশৃংখল ভাবে জীবন যাপন করে। নিজের মধ্যে কখনো বদ অভ্যাস আসতে দেয়নি। সে মনে করে, সকালবেলা সুন্দর ভাবে কাটাতে পারলে সারাদিন সুন্দরভাবে কাটবে।একটা সকাল বলে দেয় সারাটা দিন কেমন কাটবে। ঘুম থেকে উঠে ফোন কিংবা অন্যকোনো অপ্রয়োজনীয় জিনিস হাতে নিলে তা আর ছাড়তে ইচ্ছে করে না। সারাদিন পুরোপুরি বেকার হয়ে যায়। কিছুই আর ভালো লাগে না। সকালবেলা যদি কোনো ভালো কাজ করা যায়, তাহলে সারাদিন অন্যরকম ভাবে কাটে। মানুষের জীবনে সফল হওয়ার জন্য শারীরিক তুলনায় মানসিক প্রস্তুতিরও ভীষণ প্রয়োজন। যা আজ পর্যন্ত করে এসেছে সে। রোজ সকালে বই পড়ায় অভ্যস্ত । নিজের জীবনে কখনো অলসতা আসতে দেয়নি। অলসতা খুব খারাপ। কিন্তু চতুর্থবার ফোন বেজে ওঠায় সে আর অপেক্ষা করল না। ফোনের কাছে উঠে গেল। মাহবুব ফোন করেছে। দুপুরের দৈনন্দিন অভ্যাস সম্বন্ধে মাহবুবের অজানা নয়। তাই সে কখনো দুপুরকে বিরক্ত করে না। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। ফোন রিসিভ করল।
‘তোমাকে বলেছি না সকাল সকাল ফোন করতে না! সারাদিন পুরো বেকার করে দিলে।’
‘এত রাগার কি আছে! একটা কথা বলার ছিল!’ বিপরীত দিক থেকে মাহবুব শান্ত গলায় বলল।
‘একটু বেলা হলে বললে হতো না! এখন বলা কি ভীষন জরুরী?’
‘ভীষণ জরুরি নয়, তবে না বলে থাকতে পারছি না।’
‘হয়েছে!কি বলতে চাও তাড়াতাড়ি বল?’
‘আমি কানাডা একটা কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছি। দু’সপ্তাহের মধ্যে চলে যাব…..।’
মাহবুব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তার প্রিয় মানুষটিকে তার সাফল্যের কথা জানিয়ে দিয়েছে। স্বপ্ন দেখেছিল অনেক বড় হবে। আর সেই বড় হওয়ার প্রথম ধাপ হল, কানাডায় উড়ে যাওয়া। দুপুর নিশ্চয়ই অনেক খুশি হবে। তাই সে বলতে দেরি করেনি। দুপুর বিরক্ত হবে জেনেও সকাল সকাল ফোন করেছিল। কিন্তু দুপুর কোনো আগ্রহ দেখালো না, বরং বিরক্ত বোধ করলো। সে বিব্রত স্বরে বলল,’আমাকে বলে কি হবে? বরং তোমার আব্বুকে গিয়ে বল। তোমার ভালো মন্দ বিচার করার অধিকার কেবল তাদের রয়েছে। আমার তোমার উপর অধিকার ফলানো এখনো জন্মায়নি। বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আমি তোমার উপর কোনো অধিকার চাপাতে চাই না।’
দুপুরের কাছে মাহবুব এমন কথা আশা করেনি। তার আকাঙ্ক্ষা জলাঞ্জলি ঘটে। সে হালকা স্বরে বলল,’কী সব কথাবার্তা বলছো, তুমি?’
‘আমি ঠিক বলছি। তোমার মা তোমাকে জন্ম দিয়েছে। তোমাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। তোমার কাছ থেকে উনারা অনেক কিছু আশা করে আছেন। ওই আশা-আকাঙ্ক্ষা তুমি ভাঙতে পারো না।এই অধিকার তোমাকে কেউ দেয়নি।তোমার একটা বিবেক আছে। বিবেককে প্রশ্ন করে দেখো, তুমি ঠিক করছো কিনা? তুমি যদি মনে করো ঠিক করছো, তাহলে তুমি বিদেশে যেতে পারো। আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে যাওয়ার আগে একবার হলেও, বাবা মার সঙ্গে দেখা করে যাও। তাঁরা অন্তত মনে শান্তি পাবেন।’
দুপুর ফোন কেটে দিল। মাহবুব সোফার উপর বসে পড়ল। অনেকের মুখে শুনেছে, মানুষের খারাপ মুহূর্তে কেউ থাকে না। কিন্তু সে এতটা অসহায়, তার ভাল মুহূর্তেও কেউ নেই। তবে কি তার বাড়িতে ফিরে যাওয়া উচিত? আব্বু আম্মুর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত? কিন্তু সে এই সব কিছুই করলো না। মনে মনে স্থির করলো, যতই বিপদ আসুক সে কানাডা যাবে। জীবনে অনেক বড় বড় চাকরি ছেড়েছে। এমন সুযোগ আর হাতছাড়া করবে না। সে পুরোপুরি নিশ্চিত আব্বু কানাডায় যেতে দিলেও,আম্মু কিছুতেই যেতে দেবে না। তাকে এই পচা দেশে থাকতে হবে। এই দেশে চাকরী করতে হবে। এই দেশের মানুষদের সঙ্গে মিশতে হবে। যারা কথায় কথায় বিরিয়ানির পরিবর্তে, জ্ঞান দেয়। অথচ সেই জ্ঞান কখনো নিজের জীবনে প্রয়োগ করে না। তাছাড়া, তার পক্ষে বাড়ি ফিরে যাওয়া কখনো সম্ভব নয়। তার খারাপ মুহূর্তে তার বাড়ির কোনো সদস্য তার পাশে ছিল না। আজ যে সাফল্য পেয়েছে, সে কেবল নিজের জন্য। নিজে পরিশ্রম করে পেয়েছে। দিনের পর দিন এক অফিস থেকে অন্য অফিস ছুটেছে। কত নিচু কাজ করেছে। তখন কেউ পাশে ছিল না। আজ যখন সে সফল হলো, তখন কেন সে তাদের কাছে ফিরে যাবে? যাবে না। এই সাফল্য কেবল নিজেই সেলিব্রেট করবে। অন্য কেউ নয়।

সকাল সকাল ইয়াসমিন তৈরি হয়ে নিল, বাপের বাড়ি আসার জন্য। আব্বু দুই দিন আগে থেকে বলেছিল, আম্মুর শরীর ভীষণ অসুস্থ। মানুষটাকে একবার দেখে যাওয়ার জন্য। বারবার আমিনা ছেলে মেয়েদের নাম নিচ্ছে। একবার দেখতে চাইছে। কিছু কথা তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চান। ইয়াসমিন বিভিন্ন কারণে আসতে পারেনি। আব্বু আবার ফোন করেছিল, যখন আম্মুকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। বাড়িতে এসে থাকতে বলে কয়েক দিনের জন্য। বাড়িতে কেউ থাকবে না। ইয়াসমিন বলেছিল, সময় পেলে অবশ্যই আসবে।তারপর বাড়ির টেলিফোনে অনেক বার কল করে। কেউ ধরেনি। ইয়াসমিনের শশুর মশাই ভীষণ অসুস্থ। তিনিও হাসপাতালে রয়েছেন। উনার জন্য রোজ খাবার নিয়ে যেতে হয়। খুব সকালে উঠে শশুরের জন্য খাবার তৈরি করে রেখেছে। বেলা হলে রাকিব ওই খাবার হাসপাতালে নিয়ে যাবে। হাসপাতালে শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে শাশুড়িও রয়েছেন। উনার দেখাশোনার জন্য। ইয়াসমিন বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তেই, তার শাশুড়ি বাড়িতে প্রবেশ করলো। হঠাৎ শ্বাশুড়ি বাড়িতে চলে আসায়, ইয়াসমিন ভীষণ রকমের অবাক হয়। দ্রুত শাশুড়ির কাছে এগিয়ে যায়। তারপর বলল,’আপনি চলে আসলেন কেন? বাবাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দিয়েছেন?’
কাজল ইয়াসমিনের কথা শুনেও না শোনার ভান করলেন। তিনি সম্পূর্ণ রকমের প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলেন। বললেন,’হাসপাতালে থাকতে আমার আর ভালো লাগছে না। তিনদিন ধরে রয়েছি। ঠিকমতো খাওয়া নেই। ঘুম নেই। তার উপর রয়েছে মশার কামড়। আমি তো তিনটা দিন থাকলাম। তুমি গিয়ে কয়েকটা দিন থাকো।’
ইয়াসমিনের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে উঠল। নিজের বাবা মার জন্য মনটা কেমন হচ্ছে। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। ছোটবেলায় অসুস্থ হলে আম্মু সব সময় পাশে থাকতো। আজ আম্মু অসুস্থ, কিন্তু সে পাশে নেই। আব্বু কতবার বলেছিল একবার হলেও তাদের বাড়িতে যেতে। পরিস্থিতির কাছে সে হারিয়ে যাচ্ছে। সে এখন কি করবে? নিজের বাবার কথা মনে করার চেষ্টা করলো। বাবা বলতো, যখন তুই যার সঙ্গে থাকবি। তখন সেই মানুষটাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিবি। যদি সে শত্রু হয়, তাও তাকে বেশি গুরুত্ব দিবি। সেই মানুষটা সবচেয়ে বেশি আপন। ইয়াসমিন যখন এই বাড়িতে এসেছিল, তখন বাবা বলেছিল, রাকিবের বাবা মাকে কখনো শ্বশুর-শাশুড়ি ভাববি না। তাঁদেরকে সবসময় নিজের বাবা-মা ভাববি। দিলেই অনেক সুখী হতে পারবি। না হলে কখনো সুখী হবি না। ইয়াসমিন কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে। এই অবস্থায় শ্বশুর শাশুড়িকে ফেলে বাপের বাড়ি যাওয়া কি উচিত হবে? উনারা যদি নিজের বাবা-মা হতো, তাহলে কি এমনটা করতে পারতো? তাঁদেরকে ফেলে কখনোই যেত পারতো না। কিন্তু,নিজের বাবা-মাও অসুস্থ। এখন কি করা উচিত? ভেবে কোনো কূল পেলো না। নিজেকে খারাপ লাগছে।সে শান্ত স্বরে বলল,’আমার মাও অসুস্থ…..।’
ইয়াসমিন আরও কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু তার কথা আটকে কাজল বললেন,’আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি এখন ওই বাড়িতে গিয়ে কি করবে? ওই বাড়িতে তো কেউ নেই। তোমার বাবা মা শহরে গেছেন ডাক্তার দেখাতে। ওরা ফিরে আসুক। তারপর না হয় রাকিবের সঙ্গে পাঁচ দিন গিয়ে ঘুরে আসবে। ঘোরা হলো সঙ্গে বাবা মার সঙ্গে দেখাও হলো।’
ইয়াসমিন শ্বাশুড়ীর কথা বার বার ভাবতে লাগলো। তিনি কোনো মন্দ কথা বলেননি। এখন ওই বাড়িতে গিয়ে লাভ কি? সে বাড়িতে তো কেউ নেই। বাবা মা ফিরে আসুক। তারপর না হয় যাওয়া যাবে। ইয়াসমিন নিজের তৈরি করা খাবার গুলো ব্যাগের মধ্যে নিয়ে নিল। তারপর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।শশুরের কাছে থাকতে হবে। উনার সেবা সুস্থতা করতে হবে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। একসময় ভরা সংসার আজ বিষন্নতায় ভুগছে। সবসময় ঘরের মধ্যে চলা হৈ-হুল্লোড় আজ চারিদিকে নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে। খুব ভোরের দিকে আমিনাকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে যান তানভীর স্যার। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী, আমিনার দাফন সম্পন্ন করা হয়। তাদের বাড়িতে বেশ কয়েক জন গ্রামবাসী এসে উপস্থিত হয়েছিল। কিন্তু কোনো আত্মীয়-স্বজন আসেনি। শুধুমাত্র আমিনার ভাই এসেছিল। বেশ কয়েক ঘণ্টা থেকে সেও ফিরে যায়। অনেকে কান্নাকাটি করে। কিন্তু তানভীর স্যার এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলেননি। তিনি চুপচাপ বসে ছিলেন। বাইরের দৃশ্যগুলি প্রখর করছিলেন। কেউ একজন তানভীর স্যারের কাছে গিয়ে বলেছিল, ছেলেমেয়েকে মায়ের মৃত্যুর সংবাদ দিতে…..। তানভীর স্যার অদ্ভুত রকমের আচরণ করেন। তিনি ভীষণ রকমের রেগে যায়। বলেন, আজ কয়েক মাস ধরে আমিনা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। ছেলে মেয়েকে দেখতে চাইছিল।সবাইকে(মাহবুব বাদে) খবর দেওয়া হয়েছিল।একজনও দেখতে আসেনি। তাহলে মৃত্যুর পর এসে কি করবে? কান্না করে সবাইকে বোঝাবে তারা আমিনাকে কতটা ভালবাসে! মিথ্যে ভালোবাসার কোনো প্রয়োজন নেই। আমার আমিনা সবসময় শান্তিতে থাকতে চাইতো। সে শান্তির জায়গায় আছে। তাকে বিরক্ত করার কোনো প্রয়োজন নেই। মৃত মানুষকে সমবেদনা জানানো অর্থহীন। তারা তাদের ব্যস্ত শহরে ব্যস্ত থাকুক…..
তানভীর স্যারের এরূপ আচরণে দ্বিতীয়বার কেউ উনার সঙ্গে কথা বলার সাহস পায়নি। মানুষটি কেমন তা সবারই জানা। একবার একটা কথা বলেছেন মানে আর ফেরাবেন না। তাঁকে আর রাজি করানো সম্ভব নয়।ছেলেমেয়েদেরকে আর খবর দেওয়া হয়নি।
আমিনাকে দাফন করা সম্পন্ন হয়। তারপর একজন একজন করে নিজেদের বাড়ি ফিরতে থাকে। আর তানভীর স্যারের বাড়ির চারদিকে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। আমিনা কখনো বাড়িতে নিস্তব্ধতা আসতে দিত না। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে তাঁর মুখে সবসময় গান ভেসে বেড়াতো। তানভীর স্যার নিজের রুমের মধ্যে প্রবেশ করলেন। রুম বেশ অগোছালো। সে-ই কবে বিছানা করা হয়েছিল। এখনো তোলা হয়নি। বিছানার পাশে এখনো গরম জলের বাটি পড়ে আছে। আমিনার মাথায় দেওয়া জলপট্টি পড়ে আছে। তানভীর স্যার আর আমিনা যখন শেষ রাতে একসঙ্গে ঘুমিয়ে ছিলেন, সেই রাতে আমিনার পরনে থাকা শাড়ি এখনো বিছানার উপর পড়ে আছে। সবকিছু আগের মতো রয়েছে, শুধু মানুষটা নেই। তাঁর ব্যবহার করা সমস্ত জিনিস, তার প্রতি ভালোবাসা, তার প্রতি অনুভূতি সবকিছু অটুট আছে। তানভীর স্যার পালঙ্কের উপর উঠে বসলেন। আমিনার শাড়িগুলো বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। প্রিয় মানুষগুলো তাঁর প্রিয় মানুষকে বেশি কষ্ট দিতে বেশি পছন্দ করে। আমিনাও তাই করলেন। তাঁর প্রিয় মানুষকে কষ্টে রেখে, তিনি না ফেরার দেশে চলে গেলেন। একবারের জন্যও ভাবলেন না, তানভীর স্যার কি করে থাকবেন?

দিন আরও গড়িয়ে যেতে রইল। সময় বদলে গেল। ইয়াসমিন আর রাকিব অনেক পরে তাদের বাড়িতে এসেছিল। কিন্তু তখন যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। নিজেকে অপরাধী মনে করে ইয়াসমিন। খুব কষ্ট পায়। পাঁচ দিন থাকবে বলে বাপের বাড়ি এসেছিল, কিন্তু এক দিনের বেশি থাকতে পারেনি। বুকটা হাহাকার করছিল। নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি। পরেরদিন সকালেই শশুর বাড়ি ফিরে যায়। তানভীর স্যার নিজেকে একটু একটু করে গুছিয়ে নিতে শুরু করেন। আমিনার অভাব পুড়িয়ে মারছিল। নিজের বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে উঠেছে। তবুও বাঁচতে হবে। না বাঁচার মতো বাঁচতে শুরু করেন। কোনো কাজ আর পছন্দ হয় না। এমন সময় রঘুর বাবা মারা যায়। ছেলেটি কাজের জন্য এ-দিক ও-দিক ঘোরাঘুরির করতে থাকে। তানভীর স্যার তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। রঘু খুব ভালো রান্না করতে পারত। সে প্রথমে তাদের বাড়িতে রান্না করতে শুরু করে। পরপর ওই বাড়ির দায়িত্ব তার উপর চলে আসে। তার বিনিময় তানভীর স্যার তাকে কিছু টাকা দিতে শুরু করেন। তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিজে নিয়ে নেন।আমিনার স্মৃতি মুছে ফেলতে পারেননি। একাকিত্ব ঘিরে ধরে। প্রয়োজনে দু’চারটা কথা বলেন। এত বয়স হবার সত্বেও আমিনার অভাবে, মাঝরাতে কেঁদে ওঠেন। মাঝ রাতে একা একা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।আমিনার কবরের কাছে গিয়ে বসে থাকেন। প্রথম প্রথম এমন দৃশ্য প্রায় দিনই দেখা যেত। তারপর একটু একটু কমতে থাকে। মা মারা যাওয়ার পর, ইয়াসমিনের বাপের বাড়ি আসার ব্যাপকতা বাড়তে থাকে। বাবার যন্ত্রণা সে বুঝতে পারে। বাবাকে এই সময় সময় দেওয়া উচিত। রাকিব ইয়াসমিনকে আটকাতে পারেনি।সে জানে,তানভীর স্যার কতটা কষ্ট পেয়েছেন স্ত্রীকে হারিয়ে। মাঝে মাঝে সেও এসে থেকে যায়।মেয়ে জামাই বাড়িতে আসলে বাড়িতে বসন্তের আগমন ঘটে, আর তারা ফিরে গেলে…… এভাবে দুটো বছর কাটিয়ে ফেলেন।

দু’বছর পর,,,,,,,
আজ মাহবুব টেন্ডার জয়লাভ করেছে। খুশিতে বন্যা বইছে। সেদিন তাকে কেউ আটকাতে পারেনি। কানাডায় চলে যায়। অচেনা শহরকে কিছুতে মানিয়ে নিতে পারছিল না। ধীরে ধীরে সেই অচেনা শহর চেনা হয়ে ওঠে। দুপুর বেশ কয়েকদিন রাগ করে তার ওপর। কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। দুপুরের রাগ ভেঙ্গে যায়। মাহবুবের সঙ্গে আবার কথা বলে। দুপুর প্রায় সময় বলতো, বাবা মাকে ফোন করে ক্ষমা চাও। তাদের কাছে ফিরে যাও। কিন্তু মাহবুব তা করেনি। আজ টেন্ডার হাতে পেয়ে নিজের চোখে জল আটকে রাখতে পারেনি। কেন জানে না, আজ বারবার আব্বুর কথা মনে পড়ছে। খুব অল্প সময়ে সে সফল হতে পেরেছে। এত তাড়াতাড়ি সফল হওয়ার কারণ কি? এর কারণ খুঁজতে খুঁজতে আবিষ্কার করে তার আব্বুকে? এই মানুষটি তার সাফল্যের মূল কারণ। তিনি না থাকলে মাহবুব কখনো এই জায়গায় আসতে পারতো না। তাহলে তার কি বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত? কিন্তু আব্বু তো তাকে ক্ষমা করবে না।সে ক্ষমার অযোগ্য। আজ চারটা বছর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। বাড়ির সদস্যরা কেমন আছে তা জানে না। বোনের নিশ্চয়ই বিয়ে হয়ে গেছে। মা-বাবা একাকীত্বে ভুগছেন। তাকে নিশ্চয়ই খোঁজ করছে। সে বাবাকে কথা দিয়েছিল, বৃদ্ধ অবস্থায় কখনো কষ্ট পেতে দেবে না।বাবা-মা যতটা ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছেন, তার চাইতে শতগুণ বেশি ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবে। কোথায় আজ সেই ভালোবাসা?এই শহর অনেক সুন্দর, অনেক ধনী। কিন্তু এই শহরে শান্তি নেই। শান্তি আছে ময়ূরগঞ্জে। টেন্ডার পেয়ে প্রিয় মানুষ গুলোকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এখানে সেই মানুষ নেই। কাউকে জড়িয়ে ধরে কান্না করলে বলবে, ন্যাকা কান্না থামাও। সবাই হাসাহাসি করবে। বাবা বলতেন, জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে ছেলে মেয়েকে মানুষ করতে না পারা।এর চাইতে পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোনো বড় ব্যর্থতা হতে পারে না। বাবা তার ছেলেকে মানুষ করতে পারেননি। তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।এই ব্যর্থতা মানুষটাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। মাহবুব অদ্ভুত রকমের চিন্তা করছে।সেদিন বাবার সিদ্ধান্তকে সঠিক মনে হচ্ছে। তার সঙ্গে সঙ্গে তার অনেক বন্ধুরাও পড়াশোনা করেছে। তারাও অনেক বড় জায়গায় গেছে। তাদের সঙ্গে মাহবুবের রোজ কথা হয়। অনেক প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু, তাদের সব সময় শুনতে হয়, তারা নিজেদের বাবার জন্য বড় হয়েছে। নিজস্বতা বলে তাদের কিছু নেই। বাবার অনেক টাকা ছিল তাই বড় হয়েছে। এমন ধনি বাবা থাকলে সবাই অনেক বড় জায়গায় যেতে পারবে। বাবার অনেক টাকা না থাকলে,কখনো তারা এত বড়ো জায়গায় যেতে পারত না। তাদের এত বড়ো সাফল্য যেন কোথায়ও একটা ক্ষীন হয়ে যায়। সাফল্যের আড়ালে অন্য কেউ একজন বেশি প্রাধান্য পায়। সাধারণ মানুষের কাছে,ওদেরকে প্রায়ই শুনতে হয়,তারা ঘুষ দিয়ে বড়ো জায়গায় পৌঁছেছে। তাদেরও যদি কেউ ঘুষ দেওয়ার মতো লোক থাকতো,তাহলে তারাও অনেক বড়ো জায়গায় যেতে পারতো। কিন্তু মাহবুবকে এইসব কিছু শুনতে হয় না। তার বাবাও অনেক ধনী ছিল। কই তাকে তো শুনতে হয় না এইসব কথা।তাকে তো কেউ বলে না,তুমি ঘুষ দিয়ে অনেক বড় জায়গায় পৌঁছেছো। বরং, সে শুনতে পায়, মাহবুব নিজের চেষ্টায় অনেক বড়ো জায়গায় গেছে। মাহাবুবের সাফল্য আর তার বন্ধুদের সাফল্যের মধ্যে পার্থক্য অনেক। তাকে নেপোটিজম নিয়ে কেউ কখনো আঘাত করে না। এটা কেবল সম্ভব হয়েছে তার বাবার জন্য। তার সাফল্যের আড়ালে কেউ প্রশংসা পায় না। সে নিজের পরিশ্রমের প্রশংসা নিজে পায়। সেদিন যদি তানভীর স্যার তাকে টাকা দিত, তাহলে আজ তাকে তার বন্ধুদের মতো সম্মান পেত হতো। আলাদা সম্মান সে কখনো পেত না। মাহবুব এখন বাবার জন্য প্রাউড ফিল করছে। গাড়ি করে নিজের রুমে ফিরলো। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, সে খুব শিগ্রই বাড়ি ফিরে যাবে। ক্ষমা চেয়ে নেবে। আজ অন্য রকম একটা অনুভূতি হচ্ছে। খুশির জোয়ার বইছে। এত কিছুর মধ্যেও একটা ক্ষীন ভয় রয়েছে। ছোটবেলায় বাবা একটা গল্প শুনিয়ে ছিল। একটা ছেলে বাবা মার উপর রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। বাবা-মা প্রথমে ভেবেছিলো,ছেলে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। অনেক গুলো বছর কেটে যায়,কিন্তু ছেলে আসলো না। বাবা শেষ পর্যন্ত খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেন -ছেলে ফিরে আসার জন্য। তার মা ভীষণ অসুস্থ। একবার হলেও যেন দেখা করে যায়।ছেলের কিছুটা দৈহিক গঠন, উচ্চতা, বয়স ইত্যাদি বিজ্ঞাপনের নথিভূক্ত করে….. ছেলের নাকের কাছে একটা দাগ রয়েছে। বিজ্ঞাপন পেয়ে অনেকেই(বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত দৈনিক গঠনের অনেকটাই মিল রয়েছে)তার বাড়িতে আসতে থাকে। তারা তার নিজের ছেলের পরিচয় দেয়। আগন্তুক ছেলের সঙ্গে নিজের ছেলের মধ্যে পুরোপুরি মিল খুঁজে পাননি। তাই কাউকে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেননি। আরও কয়েকটা বছর কেটে যায়। একসময় ছেলে নিজের ভুল বুঝতে পারে।সে বাড়িতে ফিরে আসে। কিন্তু তাকে নিজের বাড়িতে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। কারণ, ছেলের বাবা মা জেনে গিয়েছিল তাদের ছেলে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। নিজে হাতে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছে। নিজের ছেলের সঙ্গে ওই ছেলের পুরোপুরি মিল ছিল। ছেলে মারা যাওয়ার পরেও অনেকেই একই বিজ্ঞাপন নিয়ে তাদের বাড়িতে আসে। নিশ্চয়ই,এই ছেলেটাও তাদের মধ্যে একজন। তাই তাকে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। মাহবুবের ক্ষেত্রে এমন ঘটবে না তো? মাহবুব কেঁদে উঠলো। গল্পের ওই ছেলেটার মতো আজ নিজেকে সে অসহায় মনে করছে। সেই ছেলেটার মতো,তাকেও সারা জীবনের মতো নিজের বাড়ি হারাতে হবে নাতো? কেউ একজন বলেছেন, গল্প কখনও গল্প হয় না। মানুষের জীবন থেকেই গল্প তৈরি হয়। আজ সে তা বুঝতে পারছে। সে জানে না,বাড়িতে তার জন্য কি অপেক্ষা করে আছে! তবুও সে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিল।

চলবে

এতদুর গল্প পড়ে আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, সমাজে আর চারটি মানুষের চিন্তা-ধারা এবং মাস্টারমশাইয়ের চিন্তা-ধারা অনেকটা আলাদা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here