মাস্টারমশাই পর্ব ২২

0
320

মাস্টারমশাই
পর্ব ২২
______________
শহরের বাইরে বেরোলে ধরা পড়ে পৌষমাসের শীতের তীব্রতা। বিকেল হতে না হতেই সূর্য যায় পশ্চিম দিগন্তে। লাল আভায় ভরিয়ে দেয় সোনালী পৃথিবীকে।পনেরো বছরের আগে গ্রামের সরু রাস্তা আজ আর সরু নেই। পাকা রাস্তা ঝকঝক করছে।কয়েক বছরের আগে এই রাস্তায় একটা মোটরসাইকেল দেখতে পেলে গ্রামের সব বাচ্চারা ছুটে আসতো। আজ সেই সব বাচ্চারা মোটরসাইকেল দেখে বিদ্রূপ করে বলে, আমরা সবাই বড় হয়ে গেছে। আমরা চাইলে একসঙ্গে অনেকগুলো মোটরসাইকেল কিনে নিতে পারি। মোটরসাইকেল না দেখলেও চলবে। এটাই গ্রামের ঢং। সময়ের সাথে সাথে বদলে গেছে ময়ূরগঞ্জ। বদলে গেছে মানুষের জীবন যাপন। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। কাবেরী গ্রামের রাস্তা হয়ে নিজের বাড়ি ফিরছে। আসার সময় এতটা তাড়াহুড়ো ছিল, গ্রামে বদলে যাওয়া দৃশ্যে চোখে পড়েনি। এখন বেশ ভালোভাবে চোখে পড়ছে। সবুজ অরণ্যে ঢেকে থাকা গ্রামটা নগরায়নের আগ্রাসনে আত্মসমর্পণ করেছে। পারেনি নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে। শীতকালে বেশিরভাগ গাছ গুলো পাতা ঝরিয়ে ফেলেছে।পাতা ঝরে পড়া গাছগুলো দাঁড়িয়ে যেন বিদ্রুপ করছে,
তোমরা সভ্য মানুষ
তোমরা সভ্য হয়েছো
আমাদেরকে নগ্ন করে।
তোমরা সাফল্য পেয়েছো
আমাদেরকে ধ্বংস করে।
কিন্তু যাকে করছো ধ্বংস
তারা কি করেছে কখনো প্রতিবাদ?
করেনি। তারা দিয়েছে,
তাদের উদারতার পরিচয়।
তোমরা আজ আমাদের দেখে হাসছো।
ভাবছো, আমরা অপায়া।
তোমরা ভুল,তোমরা ভুল।
আমরা যদি উঠি একবার গর্জে,
তোমাদের কি থাকবে,
শত বছর ধরে সাজানো সাম্রাজ্যে?
তোমাদের সোনালী সাম্রাজ্য
আমরা শেষ করে দিতে পারি মুহূর্তে।
কিন্তু,আমরা নিষ্ঠুর নই তোমাদের মতো।
তবুও ধৈর্যের একটা ধৈর্য আছে।
তাইতো আমরা কয়েকজন মিলে,
মাঝেমধ্যে গর্জে উঠি।
সাবধান করাই তোমাদের।
অনেক হয়েছে আর নয়।
থামায় তোমাদের এই সাম্রাজ্য,
ফিরিয়ে দাও আমাদের অভয়ারণ্য।
ঝরে পড়া হলুদ পাতার উপর পা মাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে কাবেরী। মনটা খুব প্রফুল্ল। অনেক দিনের পর গ্রামের বাড়িতে আসায়, মনটা ভীষণ চঞ্চল হয়ে উঠেছে। চঞ্চলাকিত মন বারবার নেচে উঠছে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। পুরো গ্রাম ঘুরে একবার দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সম্ভব নয়। সূর্যি মামা বলছে, বাড়ি ফিরে যাও কিছুক্ষণের মধ্যে সন্ধে নামবে। মাঠের সোনালী ফসল বাড়িতে উঠে গেছে। আবার কিছু কিছু জমিতে এখনো সোনালী ফসল রয়েছে। কাবেরী আরও কিছুটা এগিয়ে যায়। একটা ছেলে বাইক নিয়ে তার সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। দূর থেকে ছেলেটাকে খুব ভালো করে চিনতে পারল না। ছেলেটা কাছে আসতেই অনুমান করতে পারলো। সম্ভবত ছেলেটা কিশলয় হবে। তবে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারল না। কিশলয়ও কাবেরীকে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। সে বাইক থামিয়ে কাবেরীকে দেখতে লাগলো। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো, দুজনেই জোরে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। দুজনের নিঃশ্বাসে একটা বোঝাপড়া হয়ে যায়। একে অপরকে চিনতে পারে।
‘কি হয়েছে তোর অবস্থা? চুলগুলো এমন করে কেটেছিস কেন?’ কাবেরী কিশলয়কে প্রশ্ন করল।
ন্যাড়া হওয়ার পর মাথায় চুল বেরোলে যেমন দেখায়, কিশলয় ঠিক ওই ভাবে চুল কেটেছে। কিশলয় এমনিতে অনেক রোগা তার উপর তার চুলের কাটিং, খুব বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে ।
কিশলয় বড় একটা হা করে অনেকখানি বাতাস মুখের মধ্যে পুরে নিল। তারপর বলল,’আর বলিস না। মাথার চুল গুলো বড্ড বিরক্তকর। তারপর বল, তুই এতদিন পর গ্রামে কি ভেবে।’
‘কেন?আমি আমার গ্রামে আসতে পারি না!’
‘তেমনটা নয়। এতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। একবারও আসিসনি। তাই বললাম।’
‘ভালো লাগেনি তাই আসিনি।’
‘এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলার কি আছে। সোজা বলতে পারিস, গ্রামের ঘৃণ্য পরিবেশে আসতে মন চায় না।শহরের উজ্জ্বল জীবনযাত্রা ছেড়ে কেনই বা গ্রামে আসবি!’
কাবেরী মৃদু হাসলো। তারপর হাসতে হাসতে বলল,’আচ্ছা ওই সব বাদ দে। তুই কেমন আছিস বল?’
‘মোটামুটি দিনকাল চলে যাচ্ছে । কিন্তু তুই এদিকে কোথায় গিয়েছিলিস?’
‘তানভীর স্যারের সঙ্গে দেখা করতে।’
‘মানুষটা বড্ড একা হয়ে গেছে। এই মানুষটাকে দেখলে আগে হাত-পা কেঁপে উঠতো। এখন কেউ ভয় পায় না। আসলে অহংকার জিনিসটা খুব খারাপ। তানভীর স্যারের মধ্যে এই জিনিসটা প্রচুর ছিল। এখনো রয়েছে। নিজের পাপের শাস্তি নিজেই পাচ্ছে। এটাতো বিধাতার নিয়ম। কেউ খন্ডাতে পারে না। সব সময় সবাইকে হেয় করেছেন। কারোর কথা কখনো গুরুত্ব দেননি। নিজেই সব কিছু। আজ এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেছেন। এত মানুষকে হারিয়েছেন। জীবনটা কষ্টে ভরে উঠেছে। তবুও মানুষটা বদলাইনি। বরং আরও বেশি অহংকারী হয়ে উঠেছেন।’
কিশলয় একটু থেমে আবার বলল,’জানিস তো, কয়েকদিন আগেকার ঘটনা।সামান্য ব্যাপারে সবার সামনে আমার উপর হাত তুলতে উদ্যত হলেন। আমি দ্রুত সরে এসেছিলাম,না হলে সেদিন আমার সব মান সম্মান শেষ হয়ে যেত। মানছি দোষটা আমার তা বলে গায়ে হাত তুলতে উদ্যত হবে। আমি তানভীর স্যারকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি, আমি শিক্ষিত ভদ্র মানুষ তাই সেদিন কিছু বলিনি। না হলে ঠাস করে গালে একটা চড় লাগিয়ে দিতাম। বুঝিয়ে দিতাম সবাই আপনাকে ভয় পেতে পারে কিন্তু কিশলয় নয়। পাগলামির একটা সীমা থাকে। তিনি সীমা ছাড়িয়ে গেছেন। কেউ তো সম্মান দেয় না। নিজের ছেলেমেয়েদের কাছেও পর হয়ে গেছেন। এমন জ্ঞানহীন মানুষ সমাজে না থাকাটাই বেটার।’
কিশলয় দীর্ঘ বক্তব্য রেখে জোরে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। চোখেমুখে তানভীর স্যারের প্রতি ঘৃণার আর আক্রোশ স্পষ্ট। কাবেরী তীক্ষ্ণ চোখে কিশলয়কে প্রখর করল। কাবেরী ভাবছে, এই মুহূর্তে কিশলয় যদি তানভীর স্যারকে সামনে পেত, তাহলে হয়তো স্যারের গালে চড় লাগিয়ে দিতে দ্বিধা বোধ করতো না। কিশলয় তানভীর স্যারকে শ্রদ্ধা করে তাই সে সেদিন স্যারকে চড় মারেনি। কিন্তু মনে মনে চড় মারার জন্য প্রস্তুত ছিল। আসলেই কি এটা তানভীর স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ? চড় না মেরেও যেন সে চড় মেরে দিয়েছে। কাবেরী থেমে থেমে বলল,’কি সব বলছিস তুই? যতই নিষ্ঠুর কিংবা অমানবিক হোক, তিনি আমাদের ছোটবেলার মাস্টারমশাই।’
‘সেই জন্য তো আমি মানুষটাকে এখনো শ্রদ্ধা করি। তুই গ্রামে থাকিস না তাই মানুষটার কীর্তিকলাপ কিছুই জানিস না। তুই তো ভালো করে জানিস আমাদের গ্রামে একটা বারোয়ারি মেলা বসতো। যাত্রা, ফাংশন হতো। ইয়াং ছেলেরা একটু জোরে বক্স বাজিয়ে নাচানাচি করছিল। গত বছর এই নিয়ে তিনি কত ঝামেলা করলেন। সামান্য বক্স পর্যন্ত বাজাতে দিলেন না, পুলিশকে ফোন করে বন্ধ করে দিলেন। রাতে ফাংশন ছিল, বাইরে ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসে নাচানো হয়েছিল। ব্যাস সেটা নিয়েও ঝামেলা করতে ছাড়েননি। এগুলো তিনি পছন্দ করেন না। এগুলো গ্রামের সৌন্দর্য নষ্ট করে।ভাই, তোমার পছন্দ হয় না ঠিক আছে। তুমি বাড়িতে বসে থাকো। কে বলেছে তোমাকে ফাংশন দেখতে যেতে?এগুলো আমারও ভালো লাগে না। কই আমি তো কিছু বলিনি। চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকি। কোন বিষয় ভালো না লাগলে ইগনোর করা উচিত।’
কাবেরী কিশলয়ের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো। তার কথা যতই শুনছে সে ততই অবাক হচ্ছে। এখানে কার দোষ সে জানে না। তবে এটুকু অনুমান করতে পারল, সম্পূর্ণ দোষ গ্রামবাসীদের নয় কিছু দোষ তানভীর স্যারেও। তবে এই সমস্ত গৌণ বিষয়ে বেশি মাথা ঘামানো উচিত নয়। সে এই গ্রামে থাকতে আসেনি। বাড়ি বিক্রি করে চলে যাবে। এরপর যা ঘটবে ঘটুক। তাতে তার কি? সে প্রসঙ্গ পাল্টে গেল। কিশলয়ের বাইকে উঠে বসলো। তাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে বলে। কিশলয় ধীরে ধীরে বাইক চালাতে শুরু করে।কিছু দুর এগোতে কাবেরী কিশলয়ের কাঁধে হাত রাখে। তারপর নরম গলায় বলল,’তোর দিদি কই? সে এখন কি করে?’
দিদির কথা শুনে বিস্মৃত হলো কিশলয়। স্কুলে পড়াকালীন কাবেরী কখনো তার দিদির সম্বন্ধে জানতে চায়নি। তাহলে আজ.. ।যদিও কিশলয় পরবর্তী মুহূর্তে কথাটিকে স্বাভাবিক নিল। নরম স্বরে বলল,’ওই আছে…. ।’
অনেকগুলো বছর হলো শিউলির বিয়ে চলে গেছে। বিয়ের পরেও ভাই বোনের ভালোবাসা অটুট থেকে গেছে। শুধু মাঝখানে বেড়ে গেছে দূরত্ব। তারপর দিন বাড়তে থাকে শিউলি তার সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল, আর কিশলয় নিজের কাজে। এখন আর দিদির খোঁজ নেওয়া হয় না। তবে এটুকু জানে, দিদি অনেক সুখে আছে। ঈশ্বর কখনো কারোর জন্য সারা জীবন কষ্ট লিখে যান না। দুঃখ-কষ্ট মিলেমিশে লিখে দিয়ে যান। শিউলি বিয়ের আগে অনেক কষ্ট পেয়েছে, তবুও কখনো অসৎ পথ বেছে নেয়নি। কষ্টময় সৎ পথে এগিয়ে গেছে। তাইতো সে এখন এতটা সুখে জীবনযাপন করছে। বিয়ের পর জামাই বাবু শিউলিকে কখনো কষ্ট পেতে দেয়নি। শুধু ভালবাসায় ভরিয়ে রেখেছে। জামাইবাবুর ভালোবাসা পুরো খাঁটি। মোটরসাইকেল ধীরগতিতে চলছে, কাবেরী আর কিশলয় নিজেদের সম্বন্ধে একে অপরকে জানাচ্ছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে কাবেরী জানতে পারে, কিশলয় এখন ইংরেজী পত্রিকায় লেখালেখি করে। স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে রয়েছে। এটাই তার বর্তমান পেশা। কিন্তু কাবেরী এতকিছুর মধ্যেও অন্য কাউকে খুঁজছে। তার মনের চিন্তা ধারা বিশাল। এই সমস্ত কৃতিত্ব যেন মাস্টারমশাইয়ের পাওয়ার কথা। সে নিজে একজন স্কুল টিচার। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের ইংরেজি পড়ায়। কিন্তু তার ছোটবেলায় সবচাইতে কঠিন সাবজেক্ট ছিল ইংরেজি। অথচ আজ সেই সাবজেক্ট সবচাইতে প্রিয়। এই সাবজেক্টে শিক্ষকতা করে সে। এর পুরো প্রশংসাযোগ্য তানভীর স্যার। উনার তৈরি করা সহজ সরল,ছোট ছোট ইংরেজি ফর্মুলা, ধৈর্য সহকারে দিনের পর দিন একই বিষয় নিয়ে আলোচনা করা, তাঁর তীব্র শাসন, তাঁর প্রতি ভয়, আড়ালে অসীম ভালোবাসা তাকে আজ এত দূর পৌছে দিয়েছে।তিনি একজন শিক্ষকের পাশাপাশি, তিনি ছিলেন একজন আদর্শ বাবা। নিজের ছাত্র-ছাত্রীদের সন্তানের মতো দেখতেন। নিজের সন্তানের মতো ছাত্র-ছাত্রীদের শাসন করেছেন। ভালোবেসেছেন কিন্তু এই ভালোবাসাটা ছিল আড়াল। যেটা কেউ কখনো বুঝতে পারেনি। তাইতো তিনি এত প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তার ছাত্রছাত্রীরা সত্যি যদি মাস্টারমশাইকে ভালোবাসতো, তাহলে মাস্টারমশাই কখনো প্রতারণার শিকার হতেন না। একটা বৃহৎ গাছ সবসময় ফল দেয়, ফুল দেয়, অক্সিজেন দেয়, মানুষকে আশ্রয় দেয়। কিন্তু সেই বৃহৎ গাছকে উঁচু হয়ে দাঁড়াতে সবসময় ভরসা যোগায় মাটি। মাটি যদি নরম হয় তাহলে সেই গাছ কখনো উঁচু হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। উপড়ে পড়ে যাবে। এমনই, একজন শিক্ষকের ভরসা তার ছাত্র ছাত্রী। আর ছাত্রছাত্রীরা যদি উদাসীন হয় কিংবা তারা প্রতারণার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। তাহলে সেই শিক্ষক কি করে সোজা হয়ে দাঁড়াবেন? কি করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন?
‘তানভীর স্যারের সেই পাথরের মতো হাতের চাপড় আজও মনে পড়ে। সেদিনের চাপড় গুলো পিঠে আর গালে পড়ে ছিল বলে আজ আমি মানুষ হয়েছি। না হলে মানুষের বেশে অমানুষ থেকে যেতাম।’ কাবেরী কিশলয়ের কথা মন দিয়ে শোনল। আড়চোখে তাকে দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করল। কাবেরী এক গাল হেসে বলল,’সবচাইতে বেশি মার আমি খেয়েছি। তুই তো একবারো মার খাস নি! তুই বড্ড চালাক।’
‘অনেকগুলো বছর স্যারের হাতে মার খেয়েছিলাম না। ভেবেছিলাম কোনদিন খাবও না। কিন্তু ইলেভেন টুয়েলভে কি হল কি জানি! প্রতিদিন মার খেয়েছি। এখনো ওই সব কথা ভাবলে গা হাত শিরশির করে ওঠে। এখনো মনে হয় ব্যথা পাচ্ছি।’
দুজনে হা হা করে হেসে উঠলো। বেশ খানিকক্ষণ তারা হাসতে থাকল। কাবেরীকে নিজের বাড়িতে পৌঁছে দিলো। কাবেরী বাইক থেকে নামতেই কিশলয় আবার বলল,’যতই হোক,আমি আজ যেখানে পৌঁছেছি,তার পেছনে দুজন মানুষের অবদান অপরিসীম। তাদের মধ্যে একজন আমার নিজের দিদি আর তানভীর স্যার।তারা না থাকলে কখনো আমি বড় হতে পারতাম না।’
বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে দুজন।তারপর দুজনে একে অপরকে একটা প্রসন্ন হাসি দিয়ে বিদায় জানালো। কাবেরী নিজের বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে, আর কিশলয় নিজের বাড়ির দিকে রওনা দেয়।

রাত প্রায় সাড়ে দশটার কাছাকাছি। কাবেরী খাটের ওপর তানভীর স্যারের দেওয়া উপন্যাস বইটি খুলে বসলো। বইটি পুরোপুরি নতুন। চকচক করছে। এই বইয়ের প্রতি এত আগ্রহ কেন? সে সত্যি জানে না। আজ পর্যন্ত কোন উপন্যাসের প্রতি এত আগ্রহ প্রকাশ করেনি। মাঝেমধ্যে বাবা গ্রামের বাড়িতে আসতো। বাড়িটা পরিষ্কার করে যেত। তাই বাড়ি ততটা নোংরা হয়ে ছিল না। সামান্য ঝাঁট দিতেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। খুব দ্রুত নিজের কাজ সম্পন্ন করে। আলু মাখা আর ভাত বানায়। ভাত খেয়ে সোজা চলে আসে নিজের রুমে। গ্রামে আসার আগে,অনেক ইচ্ছে ছিল পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখবে, ছাদে গিয়ে একটু বসবে, সন্ধ্যার সময় গ্রামের উদ্দেশ্যে বের হবে, একটু মন্দিরে যাবে,কিন্তু বইটি হাতে পাওয়ার পর অন্য কিছু করতে ইচ্ছে হলো না। শুধু বই পড়ার ইচ্ছাটা জেগে থাকলো। বই পড়ার ইচ্ছার কাছে আজ সব ইচ্ছাই মৃত। ধীরে ধীরে সে বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠা খুলল। বইয়ের একদম প্রথমে লেখা রয়েছে ‘সূচনা কথা’।
” ‘মাস্টারমশাই’ এই উপন্যাস আমার লেখা তৃতীয় বৃহৎ উপন্যাস। আমার অন্যান্য লেখা উপন্যাসের সঙ্গে এই উপন্যাসে স্পষ্টতা সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ অন্যান্য উপন্যাসের সমস্ত চরিত্র ছিল কাল্পনিক। এই উপন্যাসে একটা চরিত্রও কাল্পনিক নয়। আমার জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা এই উপন্যাসে আমি তুলে ধরেছি। এই উপন্যাসে কিশলয় মানে আমি নিজেও একটা চরিত্র। আমার ছোটবেলার একজন শিক্ষক (শেখ তানভীর আলম) ওই মানুষটিকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাসটি রচিত। মাস্টারমশাইয়ের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং সেই সিদ্ধান্তের সত্যতা নিয়ে উপন্যাসটি রচিত। আপনি হয়তো এই উপন্যাসটি পড়ার সময় কখনো বোরিং বোধ করবে না। কারন সত্য ঘটনায় কখনো কাল্পনিকতা মিশিয়ে ঘটনাটিকে টানটান করা সম্ভব হয় না। আশা করি সবাই ধৈর্য সহকারে পড়বেন।”
ধন্যবাদান্তে,
কিশলয় কুমার দাস
‘সূচনা কথা’ পড়ে কাবেরী উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। বেশ দারুন লিখেছে। এই ঘটনা তাহলে পুরোপুরি তানভীর স্যারের জীবনী নিয়ে লেখা। এবং গল্পে তানভীর স্যারের নামও উল্লেখ করা আছে। তাহলে তানভীর স্যার এই উপন্যাস পড়ে কান্না করছিলেন কেন? উপন্যাসের প্রতি আরও আগ্রহ বাড়তে থাকে। আসলেই কি এটা উপন্যাস নাকি প্রবন্ধ? একটার পর একটা পৃষ্ঠা খুলে সে পড়তে শুরু করে। প্রথমের দিকে বেশ ভালই লাগছিল। এমনকি এই গল্পের মধ্যে সে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে।যদিও তার নাম উল্লেখ করা নেই তবে অনুমান করতে পেরেছে ওই নারী চরিত্রটি সে নিজে। লেখকের অপরিচিত মানুষেরা বুঝতে না পারলেও পরিচিত মানুষেরা ঠিক বুঝতে পারবে ঘটনাটি কোন অংশেকে কেন্দ্র করে রচিত।বেশ কিছু অংশে কমেডি রয়েছে। কিন্তু উপন্যাসটি অর্ধেকের পর সম্পূর্ণ বদলে যায়। রাত তিনটার দিকে কাবেরী উপন্যাস পড়ে শেষ করে। দুটো চোখ জলে ভিজে গেছে। দুটো হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে। এমন কান্না সে কবে করেছে? তার সঠিক মনে নেই। মনে হচ্ছে উপন্যাসটা এমন না হলেও পারতো। একটু আলাদা হলে ভালো হতো। এই উপন্যাসটা স্যাড এন্ডিং নয়। এই উপন্যাস হ্যাপি এন্ডিং। তবে কেন এই উপন্যাস পড়ে সে কান্না করছে? কেন তার চোখ ভিজে গেছে? শুধু তাই নয়, প্রতিটা পৃষ্ঠায় কারোর চোখের জল লুকিয়ে রয়েছে। বইয়ের পৃষ্ঠায় এক ফোঁটা জল পড়লে ওই অংশটা পাতলা হয়ে যায়। আর চারিদিকে ভাঁজ পড়ে যায়। কাবেরী উপন্যাসটি পড়তে পড়তে অনেক অংশে লক্ষ্য করেছে, উপন্যাসের প্রায় প্রতিটি পাতায় কিছু পাতলা আর ভাঁজযুক্ত অংশ। এই বইটি প্রথমে কাবেরী পড়েনি। প্রথম তো তানভীর স্যার পড়েছিলেন। তাহলে, এই চোখের জল নিশ্চয়ই তানভীর স্যারের। তিনিও এই উপন্যাস পড়ে কান্না করেছেন। নিজের জীবনী পড়ে নিজেই কান্না করেছেন। বড্ড অদ্ভুত! এই উপন্যাস কালি দিয়ে নয়, উপন্যাস যেনো লেখা হয়েছে ছোট্ট বেলার মাস্টারমশাইয়ের চোখের জল দিয়ে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here