দখিনা প্রেম,অতিরিক্ত অংশ
লাবিবা ওয়াহিদ
কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মা নড়ে সদর দরজার দিকে তাকালো। মায়ের নড়াচড়ায় রুয়াবি লাফ দিয়ে উঠে বসলো আর এদিকে সেদিক তাকিয়ে অস্থিরতার সাথে বলতে লাগলো,
—“কী হলো মা? ভাই এসেছে? কোথায় সা’দ?”
বলতেই তার সদর দরজার দিকে নজর গেলো। সা’দকে দেখে রুবাইয়ের যেন প্রাণ ফিরে এলো। সে উঠে দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে সা’দকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। সা’দও পরম আবেশে নিজের বোনকে জড়িয়ে ধরলো। পরিবারের প্রতিটা মানুষ সা’দকে এখনো সেই ছোটবেলার মতো করেই ভালোবাসে।
—“এতো দেরী হলো কেন ভাই? আমি তো অফিস থেকে ফিরে তোকে পেলাম না!”
—“আমি তো ন’টায় রওনা দিয়েছি আপু, তাই দেরী হলো আর কী!”
সা’দের মা দুই ভাইবোনের দিকে এগিয়ে এসে গাল ফুলিয়ে বললো,
—“বোনকে পেয়ে সবাই ভুলে যায় আর আমি যে ১২টা অবধি জেগে আছি সে খবর কেউ রেখেছে?”
মায়ের অভিমানী কথায় সা’দ কিঞ্চিৎ হাসলো। এরপর রুবাইয়ের সাথে নিজের মাকেও জড়িয়ে ধরলো। সা’দ চোখ বুজে মুচকু হেসে বলতে লাগলো,
—“তোমাদের ভুলবো কী করে বলো তোমরা যে আমার দুনিয়া মা! এখন বলো আমার চিন্তায় প্রেশার হাই করে ফেলোনি তো?”
সা’দের কথায় মা সা’দের বুকে হালকা চাপড় দিয়ে বললো,
—“তুই এতো ফাজিল হলি কেন?”
সা’দ দুজনকে ছেড়ে বুজে হাত বুলাতে বুলাতে মুখ গোমড়া করে বলে,
—“কিছু বললেই দোষ!”
—“না রে ভাই! তোর দোষ না মায়ের ব্লাডপ্রেশারের দোষ!” বলতেই লিভিংরুমে একদফা হাসির রোল চললো। কারীবকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সা’দ বললো,
—“এই তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন ভেতরে আসো! আজ ডিনার আমার সাথে করবে প্লাস আজ আমাদের বাড়িতেই থাকবে!”
—“আরে কী বলেন স্যার! তা তো হয় না!”
—“হওয়ার হলে ঠিকই হয়। এখন কোনো কথা না, চুপচাপ গেস্টরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেতে আসো! ইট’স মাই অর্ডার!”
বলেই সা’দ সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো। রুবাই হেসে কারীবকে বললো,
—“বসের অর্ডার না মানলে সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবেন আপনার এই চাকরি ফুঁস করে উড়ে গেছে। তাই বেশি না বলে সা’দ যা বললো তাই করে ফেলুন, আমরা খাবার রেডি করছি!”
বলেই রুবাই তার মায়ের কাজে হাত লাগাতে রান্নাঘরে চলে গেলো। সা’দ উপরে যাওয়ার সময়ই মা কিচেনে ছুটেছিলেন। কারীবও আর কী করবে, কোনো উপায় না পেয়ে গেস্টরুমের দিকে চলে গেলো।
★
—“সেহের! তোরে আমি এতো সহজে ছাড়মু না। আমারও সময় আইবো! আমি কী জিনিস তোরে আমি হারে হারে বুঝায় দিবো। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। সেই সঠিক সময়ে তোকে আমার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না কেউ না! তোর অপমানের শোধ আমি শুধে আসলে নিবো।”
বলেই অচেনা লোকটা হুংকারের সাথে হাতে থাকা স্টিলের গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। রাগে তার সমস্ত শরীর যেন দাউদাউ করে জ্বলছে। প্রচন্ড জ্বলছে!
★
সেহের ব্যস্ত হয়ে পরলো নিজের পরীক্ষা নিয়ে। সারাদিন বইয়ে ডুবে থাকো পরীক্ষা দাও আর রাতে রিমনকে সময় দাও। এ যেন তার প্রতিদিনের রুটিন। জোহরা বা তপা এখনো কোনো ঝামেলা করেনি তবে জোহরা একবার এসেছিলো রিমনকে নিতে কিন্তু রিমন বরাবরই নাকোচ করে দেয় যে সে ওই বাড়িতে ফিরবে না। প্রতিবারের মতোই জোহরা খালি হাতে ফিরে যায়। তবে ফিরে যাওয়ার আগে সেহেরের দিকে ক্রোধের দৃষ্টি একবার হলেও নিক্ষেপ করবেই। সেই দৃষ্টি সেহের বুঝতে পারলেও কিছু বলে না। কবির এখনো জেলে আছে। এদিকে গ্রামের মানুষ নতুন একজন চেয়ারম্যান নিয়েছে। নতুন চেয়ারম্যান হলো রতন চাচা। উনি অত্যন্ত ভালো এবং ঠান্ডা স্বভাবের মানুষ৷ যেমন তার ব্যবহার তেমনই তার কাজের দক্ষতা। গ্রামের মানুষ বেশ খুশি এমন একজন চেয়ারম্যান পেয়ে। সময় যত এগোতে থাকলো সেহেরের পরীক্ষাও শেষ হয়ে আসলো। পরীক্ষার কারণে মানজুর সাথে কলেজ ছাড়া দেখাই হয় না। শেষ পরীক্ষার দিন মানজু আগেই কলেজ থেকে বাসায় চলে গেছে তাই সেহেরের আজ একাই যেতে হচ্ছে। সেহের প্রশ্নের এমসিকিউ দেখতে দেখতে আসছিলো তখনই তার পাশের ক্ষেত থেকে একটা শব্দ পেলো। সেই শব্দে সেহের ভ্রু কুচকে থামলো। ঘাড় ঘুরিয়ে পা উঁচু করে কিছু দেখার চেষ্টা করতেই যা দেখলো তাতে সেহেরের হাত-পা যেন অবশ হয়ে গেলো৷ এ যে তার বাবা কবির! এক ঢোকে মদ গিলছে সে। সেহের ভয়ে শ্বাস আটকে আসছে। মদ খাওয়া শেষে বোতল নামিয়ে কেমন পাগলের মতো কথা বলছে আর চিৎকার চেঁচামেচি করছে যা দেখে সেহেরের ভয় আরও বেড়ে গেলো। সে আর এক মুহূর্ত সেদিকে না দাঁড়িয়ে দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করলো। তার পক্ষে এই মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না। বাসায় ফিরে কাউকে জিজ্ঞাসা করতে চেয়েও কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারলো না। আর আবিদ বা জেঠুও বাসাতে ছিলো না। আবিদ তার ভার্সিটি থেকে এখনো ফিরেনি আর জেঠু তার কাজে গেছে। সেহেরের অস্বস্তি যেন বেড়েই চলছে। কবির জেল থেকে ছাড়া কবে পেলো? আর কীভাবেই বা বের হলো? সে কী আবার সেহেরের কোনো ক্ষতি করবে? এরকম নানান প্রশ্ন সেহেরের মাথায় ঘুরঘুর করছে। চাচী সেহেরকে উঠোনে বসে থাকতে দেখে হাক ছেড়ে বললো,
—“ফুল রান্নায় এসে সাহায্য করতে পারবি? পুকুরে যাইয়া কাপড় ধুইতে হইবো আমার, তুই একটু ভাত টিকা দিস আর মাছ বসিয়েছি নুন লাগলে দেখিস একটু!”
—“আচ্ছা চাচী তুমি যাও, রান্না আমি সামলাচ্ছি!”
চাচীমা মুচকি হেসে রান্নাঘর থেকে ভেতরে চলে গেলো। সেহের নিজের সব চিন্তা পাশে ফেলে রান্নাঘরে চলে গেলো। আজ যেহেতু সেহেরের পরীক্ষা শেষ, সেহেতু সে এখন অবসরেই আছে।
★
পার্টিমুখর পরিবেশ! কিছুক্ষণ পরপর লাল, নীল লাইট বদলে চারপাশ দুই কালারের কলম্বিয়া তৈরি করছে। সাইড স্টেজে একটা ব্যান্ড এবং ফেমাস সিঙ্গার বসেছে। গায়ক কিছুক্ষণ পরপর বিভিন্ন মনভুলানো গান গাইছে। চারপাশে নানান মানুষের আনাগোনা। সকলেই পাবলিক ফিগার অথবা সেলিব্রিটি। এক প্রডিউসার তার নিউ মুভিতে ভালো রেসপন্সের জন্য এই বিশাল পার্টির আয়োজন করেছেন বিভিন্ন বড়ো বড়ো বিজন্যাসমেন এবং ফিল্মইন্ডাস্ট্রির সকল লোকদের। তুষার ড্রিংকস সাইডে হাতে ওয়াইন নিয়ে দুই-তিনজন মডেল মেয়ের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত এমন সময়ই সদর দরজার সামনের থেকে হালকা শোড়গোল শোনা গেলো। তিন মডেল সেদিকেই তাকালো। শুধু এই তিনজন নয় আশেপাশের সবার দৃষ্টি-ই সেদিকে। সকলের মতো তুষারও বিরক্তি নিয়ে সেদিকে তাকালো। প্রডিউসার সাহেব একপ্রকার ছুটে সদর দরজায় গেলেন আর কাউকে ওয়েলকাম ওয়েলকাম করে ভেতরে আসতে বলছেন। কিছু মানুষ সরে যেতেই দেখা গেলো সা’দ আর তার বোন রুবাই পার্টিতে প্রবেশ করছে। সা’দ পুরো ফর্মাল লুকে আর রুবাই একটা শাড়ি আর হিজাব পরেছে। সা’দকে দেখে তুষারের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। মেজাজ গরম হওয়ার মূল কারণ সা’দ কেন তার চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় যার জন্য প্রায় সকল মডেল আর অভিনেত্রী তার দিকে নজর দেয়? কই তুষারের দিকে তো এভাবে তাকায় না? এই বিষয়গুলো পুরো বিরক্তি ধরিয়ে দেয় তুষারকে। অত্যন্ত বিরক্তির সুরে তার পাশে থাকা মেয়েটিকে বললো,
—“এরে নিয়ে এতো মাতামাতির কী আছে ভাই? সে তো সামান্য ডাইরেক্টর। শুধু সাদা হলেই যে ভালো হতে হবে এমন তো নয়! লুক এট মি অর লিভ হিম!”
মেয়েটা তুষারের দিকে না ফিরে কড়া কন্ঠে বললো,
—“সা’দ বিন সাবরানের মতো মানুষকে প্রায় প্রতিটা মেয়েই হাসবেন্ড হিসেবে আশা করে, যে মেয়েদের সাথে মিসবিহেভ করে না, রেসপেক্ট দেয় সাথে একজন ভালো মানুষ। ফেরেশতার মতো মানুষটাকে খারাপ বলার মতো কোনো ওয়ে নেই মিস্টার! বরং আমি এটা বলতে পারি, তোমার স্টার হওয়ার ২ বছরে বেশ অনেকবার ওয়াইন বা ড্রিংকস নিতে দেখেছি কিন্তু সা’দ স্যারকে গত সাড়ে চার বছরে কোনোদিন ড্রিংকস তো দূরে থাক স্মোকিংও করতে দেখিনি!”
বলেই মেয়েটি তার পাশের দুজন মেয়েকে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেলো। তুষার রাগে গ্লাসের পুরোটা ওয়াইন এক দমে শেষ করে মৃদ্যু চিৎকার দিয়ে বললো,
—“সা’দ সা’দ এন্ড সা’দ! এই এক নাম আমার সবকিছু যেন শেষ করে দিচ্ছে। কে এই সা’দ! এ উপরে যা দেখায় তা তো সে একদমই না! এর ভেতরে কুটনৈতিক কাজ কেউ কেন ধরতে পারে না হোয়াই? কেন তার জন্য বারবার নিজেকে অপমান হতে হয়! এরে তো ইচ্ছা করে নিজ হাতে খুন করি একে!”
সা’দ কয়েকজনের সঙ্গে অল্পস্বল্প আলোচনা করছিলো তখনই সে দূর থেকে ফারুক হোসাইনকে দেখতে পেলো। তখনই সে “এক্সকিউজ মি” বলে ফারুক হোসাইনের দিকে এগিয়ে গেলো। এই একটা মানুষকে সা’দের বেশ পছন্দ। ফারুক হোসাইন যেমন রসিক তেমনই ভালো মানুষ। অল্পতেই মানুষের সাথে মিশে যান! সামান্য অহংকারবোধ নেই তার মধ্যে। ফারুক হোসাইন সা’দকে দেখে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
—“আরে ইয়াংম্যান যে কী অবস্থা? তা নতুন কোনো শিডিউল আছে নাকি??”
—” আলহামদুলিল্লাহ আঙ্কেল ভালো আপনার কী অবস্থা? আর এক মাস শান্তিতেই আছি কোনো শিডিউল নেই। থাকলে তো আপনি জানতেনই!” মুচকি হেসে বললো সা’দ। ফারুক হোসাইন হেসে বললো,
—“হ্যাঁ তা তো অবশ্যই। আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তা কিছু খাবে কোলড্রিংকস অর স্নেকস?”
—“না আঙ্কেল ঠিকাছি। আন্টির কী অবস্থা আর আপনার মেয়ের?”
—“সকলেই আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে। আমার মেয়েকে তো এবার নিউইয়র্কে পাঠিয়েছি!”
—“ও আচ্ছা৷ এবার সে কোন ক্লাস?”
—“ইন্টার দিয়েছে, রেজাল্ট আসার পর নানান ঝামেলার পর অবশেষে নিউইয়র্কে পারি জমালো! তা শুনলাম তোমার বোনও নাকি এসেছে? সে কোথায় পরিচয়ই তো হলো না!”
—“ও হ্যাঁ ও ওদিকে আছে৷ চলুন সেদিকে যাই!”
—“হ্যাঁ চলো।
চলবে!!!