দখিনা প্রেম,পর্ব ১৬,১৭

0
1390

দখিনা প্রেম,পর্ব ১৬,১৭
লাবিবা ওয়াহিদ
পর্ব ১৬

—“ও তাহলে এই ব্যাপার! এই মেয়েই তোর বউ! ও মাই গড ব্রো! আই জাস্ট কান্ট বিলিভ ইট। মেয়েটা আসলেই মাহশাল্লাহ।”

—“রুবাই শুনলে কিন্তু তোমার কপালে দুঃখ আছে ব্রো! তাই ভুল করেও ওসব বলিও না!”

সা’দ এবং তানজীল কথা বলতে বলতে হাঁটছিলো তখন দেখলো আবিদ এদিকেই আসছে। আবিদকে দেখে সা’দ হেসে ওকে সামনে আসতে ইশারা করলো। আবিদও মুচকি হেসে সা’দের দিকে গেলো।

—“এতো সাতসকালে তোমরা বাইরে যে?”

—“ও কিছু না, মর্নিং ওয়ার্কে বেরিয়েছিলাম তা তুমি কোথায় গিয়েছিলে?”

—“আর কোথায় বন্ধুদের সাথে টঙে বসে চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তো এখন চলো নাস্তার সময় হয়ে গেছে তো!”

—“হ্যাঁ চলো!”

আবিদ, সা’দ এবং তানজীল তিনজন মিলে সেহেরদের বাড়িতে চলে এলো। বাড়িতে এসে কবিরকে দেখে সা’দ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। ওনাকে সে চিনে কিন্তু এই চেয়ারম্যান এখানে কী করছে বুঝতে পারছে না সা’দ। তখনই আসিয়া সা’দের কাছে এসে সা’দকে দেখিয়ে বললো,

—“এইযে কবির ভাই ও আমার ছোট ছেলে সা’দ। আর পাশে যাকে দেখছেন, ও হলো আমার মেয়েজামাই তানজীল। আর সা’দ ও হলো তোমার ছোট চাচা!”

একথা শুনে সা’দ আরেকবার টাস্কি খেলো। তখনই সকালের দাদীমার বলা ঘটনাগুলো সা’দের মনে পরলো৷ সা’দ এবার স্বাভাবিক হলো এই ভেবে যে এই লোককে দ্বারা সব সম্ভব। কিন্তু এমন নিকৃষ্ট একজন মানুষ তার ছোট চাচা হবে সেটা সা’দ কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। সা’দ কবিরকে চিনতে পারলেও কবির সা’দকে চিনতে পারেনি কারণ, সেদিন সা’দ মাস্ক আর রোদের তাপ থেকে বাঁচকে চোখে সানগ্লাস পরা ছিলো। কবির হাসিমুখে কথা বলতে এলে সা’দ কবিরের সাথে কোনো কথাই বললো না। সে কবিরের পাশ কাটিয়ে পাটিতে খাওয়ার জন্য বসলো। সা’দ কোনোদিন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে চলেনি এবং আজও তার ব্যতিক্রম নয়। সা’দের আচরণে কবির মুখটা গোমড়া করে রইলো আর বোঝার চেষ্টা করলো যে সা’দ তার সাথে এমন কেন করলো। বাকিরা নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে কেউ এই ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। তবে আবিদ, তানজীল এবং আসিয়া ব্যাপারটা খেয়াল করেছে কিন্তু কেউ কিছু বলেনি। আসিয়া বুঝতে পেরেছে ছেলের এরূপ আচরণ কিন্তু তারও যে কিছুই করার নেই। ভেবেই চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যদিকে চলে গেলেন। এদিকে আবিদ বেশ খুশি হলো সা’দ কবিরকে এড়িয়ে গেছে বলে। সা’দ খেতে বসলে রুবাই সা’দের পাশে বসলো আর খেতে খেতে ফুসুরফুসুর করে বলে,

—“সেহের তোর আশেপাশে ছিলো বলে জোহরা আর তার ওই মেয়ে তপা নাকি ধোপা কী যেন নাম, ওরা বেশ মিসবিহেভ করেছে। এও বলেছে তারা নাকি তোর গলায় ওই তপাকে ঝুলিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছে তাই যেন সেহের তোর আশেপাশে না ঘেঁষে। সাহস কতো দেখেছিস?”

সা’দের মুহূর্তেই রেগে উঠলো। চামচটাকে এতো শক্ত করে ধরলো যে সেটা বাঁকা হয়ে গেলো। সা’দ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

—“ওরা বলেছে না সেহের আমার আশেপাশে ঘেঁষলে ওরা সেহেরকে ছেড়ে কথা বলবে না। ওকে ডান চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্টেড! সেহের না ঘেঁষলেও আমি সারাক্ষণ ওর সাথে আঠার মতো লেগে থাকবো, দেখি কার কেমন ব্যথা হয়।”

—“ধুর বাদ দে তো। শুধু শুধু ঝামেলায় জড়ানো উচিত হবে না!”

—“ঝামেলা? তুই বলছিস এই ঝামেলার কথা? ওদের সমস্যা কী সেহেরকে নিয়ে? পাইসে টা কী ওরা সেহেরকে? হাতের পুতুল নাকি শোপিজ যে যা ইচ্ছা সেভাবে ইউস করবে অত্যাচার করবে? একটারে যদি আমি শায়েস্তা না করতে পারি তাহলে আমার নামও সা’দ বিন সাবরান না মনে রাখিস!”

—“ভাই কোথায় যেন পুড়তাসে! এর মানে আমি যা ভাবছি তাই ঠিক হলো?” ভ্রু কুচকে কিছুটা খুঁচিয়ে প্রশ্নটা করলো রুবাই। রুবাইয়ের কথার মানে বুঝতে পেরে সা’দ আমতা আমতা করে কথা ঘুরিয়ে ফেললো। কথা ঘুরানোর আগেই রুবাই বলে উঠলো,

—“এবার আমি পুরোপুরি শিওর তোর আর সেহেরের মধ্যে কিছু একটা চলছে। একে তো তখন আমি ওভাবে বলায় এইরকম রিয়েক্ট করেছিস আবার এখন কথা ঘুরিয়েছিস। ভাই এতোটাও বোকা ভেবো না, বোকা হয়ে এতো বড় অফিস সামলাই না। তবে যাই বলো ভাবী মানতে আমার আপত্তি নেই। ক্যারি অন ব্রো, সবরকম হেল্প করতে প্রস্তুত আছি।” হেসে উত্তর দিলো রুবাই। সা’দও হাসলো। এর মাঝে তানজীল বলে উঠলো,

—“কী ব্যাপার দুই ভাইবোন মিলে কী এতো বলছো?”

—“আর কী ভাইয়ের প্রেমকাহিনী শুনি!”

—“ওহ রিয়েলি? কিরে সা’দ তোর আর সেহেরের বিয়ের কথাটা বলে দিলি?”

এবার সা’দ পরলো মহা মুশকিলে! রুবাই চোখ বড়ো বড়ো করে বললো,

—“বিয়ে মানে? ওদের বিয়ে হয়ে গেছে আর আমি জানি না? কীভাবে কী হলো?”

সা’দ এবার কপট রেগে তানজীলের দিকে তাকালো। সআ’দ চাইছিলো না রুবাই তাদের বিয়ের বিষয়টা জানুক কিন্তু শেষমেষ ফাঁস হয়েই গেলো! রুবাই তো এখন পুরো জ্বালিয়ে খাবে। সা’দ কপট রেগে বললো,

—“মুখটা না খুললে বেশি ভালো হতো!”

—“আমি কী জানতাম নাকি তুই বিয়ের কথা বলিস নি!”

—“এই তোমরা থামো আগে আমাকে সব হিস্ট্রি খুলে বলো। আর ভাই তুই কিনা বোনকে বাদ দিয়ে শেষমেষ এর সাথে সব শেয়ার করলি আর বোনটাকে পর করে দিলি?”

—“দেখ আপু যা জানিস না তা নিয়ে একদম কথা বলবি না!”

এরমাঝে আসিয়া ধমক দিয়ে বলে,”খাওয়া ছেড়ে কিসের এতো কথা বলিস তোরা? চুপচাপ খা!”

এবার কারো মাঝে কোনো কথা হলো না সকলে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। তপা তো বারবার সা’দের কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করছে। সা’দ বরাবরই তাকে এড়িয়ে চলছে। তপা খুবই উশৃংখল ভাবে চলাফেরা করে যা একদমই দৃষ্টি কটু। সা’দ তো ভাবছে রাগের মাথায় কখন কী বলে ফেলে। খাওয়ার পরপরই সা’দ রুবাইকে সবটা সুন্দরভাবে খুলে বলতেই রুবাই সা’দকে আশ্বাস দেয় সেহেরকে দ্রুত তারা এই নরক থেকে মুক্ত করবে। এদিকে সেহেরকে সা’দ একবারের জন্যেও রুম থেকে বের হতে দেখলো না। এতে সা’দের মনটা খারাপ হয়ে রইলো। উপায় না পেয়ে সা’দ রুবাইকে বলতেই রুবাই সা’দকে নিয়ে সেহেরের রুমে চলে গেলো। সেহের তখন একটা উপন্যাসের বই পড়ার চেষ্টা করছিলো কিন্তু কিছু কঠিন শব্দ তাকে বারংবার বিচলিত করে ফেলছিলো। কারো আসার উপস্থিতি টের পেতেই সেহের বই থেকে চোখ সরিয়ে রুবাইয়ের দিকে তাকায়। রুয়াবিয়ের পাশে থাকা মানুষটাকে দেখে সেহের অজানা কারণে শিউরে উঠলো। সেহের চটজলদি মাথা ওড়না পেঁচিয়ে পরিপাটি হয়ে বসলো। কোনো ছেলেমানুষ দেখে একটা মেয়ের এভাবে তাড়াহুড়ো করে মাথায় ঘোমটা পরার দৃশ্যটা সত্যিই মনোমুগ্ধকর যা সা’দকেও সমানভাবে মুগ্ধ করে ফেললো। সা’দ আপনমনে এলোমেলো ভাবে একটা ছন্দ বললো,

-“এই মায়াবীনি, আর কতো ভাসবো
তোমার ওই কাজল ভেলার আঁখিতে,
আর কতো মুগ্ধ হবো
তোমার মলিন হাসির রূপকথায়?”

রুবাই মুচকি হেসে বললো,
—“সামনে তো ইদ তাই আমরা আজ সকলে মিলে শপিং করতে শহরে যাবো! জলদি রেডি হয়ে নাও!”

—“আপনারা যান না আপু আমি যাবো না!”

সেহেরের জবাবে সা’দ মুহূর্তেই রেগে বললো,
—“কেন যাবে না?” সা’দের কন্ঠে রাগ স্পষ্ট। সা’দের এমন রূপে সেহের কিছুটা ভয় পেলো। সেহের আমতা আমতা করে বললো,

—“আসলে আমি বেশিদূর জার্নি করতে পারি না, আর আমি এমনিতেও অসু….”

সেহেরকে কিছু বলতে না দিয়ে সা’দ রুবাইয়ের উদ্দেশ্যে বললো,

—“আপু তুমি রুমের বাহিরে যাও আমি ওকে রাজি করাচ্ছি। আমিও দেখে ছাড়বো ওর এইসব এক্সকিউজ কই থেকে আসে।”

—“মামামানে? আপু কোথায় যাবে? আপু কোথাও যাবে না প্লিজ!”

কিন্তু আফসোস! সেহেরের কথাগুলো শোনার আগেই রুবাই বাইরে এসে দাঁড়িয়ে থাকলো। বাকিরা সবাই শপিং করার জন্য রেডি হচ্ছে তাই জোহরা বা তপার এদিকে আসার কোনো চান্স নেই। সা’দ পিছে তাকিয়ে বিছানায় হাত রেখে সেহেরের দিকে ঝুকতেই সেহের জলদি কিছুটা পিছে সরে গেলো। সেহেরের চোখেমুখে আতঙ্ক স্পষ্ট!

—“দে..দেখুন! আপনার মধ্যে উল্টো পাল্টা ভাবনা থাকলে আগেই বলে রাখছি এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন নয়তো…”

—“বাব্বাহ! এই তেঁজটা আমাকে না দেখিয়ে তোমার ওই বাপ সৎমা আর ছ্যাঁচড়া বোনটাকে দেখালে তো বেশি উপকার হতো!”

—“আমি যাকে ইচ্ছা তাকে তেঁজ দেখাবো আপনার কী?”

—“আমার অনেক কিছু বিকজ ইসলামের রীতিতে তোমায় আমি বিয়ে করেছি। সো নাও আই এম ইওর হাসবেন্ড কোনো পরপুরুষ না। তাই তোমার উপর আমার সম্পূর্ণ রাইট আছে।”

—“তো রাইট আছে দেখে কী যা ইচ্ছা তাই করবেন?”

—“ইয়েস! আমি সা’দ বিন সাবরান নিজের ইচ্ছাকে বেশি প্রায়োরিটি দেই৷ এখন থেকে যদি তোমার ওই বোন বা মা তোমাকে কিছু বলতে আসে, তুমি যদি তাদের কথা প্রতিবাদ না করো তাহলে,”

—“তাহলে কী?”

—“ব্যাখ্যা জানতে চেয়ো না! নিজেই ঝামেলায় ফাঁসবা। এখন যা বললাম তা করো, জলদি রেডি হও নয়তো…”

বলেই সা’দ সেহেরের দিলে আরও এগিয়ে গেলো। সেহের ভয়ে আরও পিছে গিয়ে অস্ফুট সুরে বললো,

—“আমি যাবো এখন আপনি ঘর থেকে বের হোন!”

সা’দ সোজা হয়ে দাঁড়ালো আর সেহের যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সা’দ সেহেরের দিকে তাকিয়ে একটা চোখ টিপ মেরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। এই সা’দ যে কী জিনিস সেহের আজ হারে হারে টের পেয়েছে। কিন্তু এখন সেহের নিজেই অবাক হলো। কই আজ অবধি তো মানজু ছাড়া কারো সাথে সে এভাবে কথা বলেনি। সা’দের সাথে কী করে এমন স্বাভাবিকভাবে কথা বললো সেহের বুঝতে পারলো না। সা’দ সেহেরের স্বামী বলে নাকি সা’দকে আলাদা ভরসা করে বলে। কিন্তু তাদের বিয়েটা তো অস্বাভাবিকভাবে হয়েছিলো তাহলে সা’দ কী করে সবটা মেনে নিলো? সেহের তো ভেবেছিলো সা’দ তাকে ডিভোর্স দেয়ার কথা বলতে এসেছে কিন্তু এখন তো সা’দের কর্মকান্ডে তার সব ধারণা বদলে গেলো। নাহ সা’দ আসলেই এই বিয়ে মেনে নিয়েছে কি না তা সেহেরের জানতে হবে। সেহের সা’দকে তা জিজ্ঞেস করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেডি হওয়া শুরু করলো। অবশেষে সকলে একসাথে বেরিয়ে রিকশায় চড়লো। গ্রামের ভেতর অটোরিকশা ছাড়া আর কিছুই চলে না। বাজারে এসেই ওরা রিকশা থেকে নেমে হেঁটে রাস্তার মোড়ের দিকে রওনা হলো। দাদীমা আর চাচী বাড়িতে থেকে গেছেন কারণ তাদের দুজনের একজনও জার্নি করতে পারে না আর দাদীমার পক্ষেও সম্ভব না এই শরীর নিয়ে জার্নি করার। রাস্তার মোড়ে আসতেই একটা বড় মাইক্রো দেখতে পেলো সবাই। সকলে যে যার সিটে বসতেই তপা একজায়গায় বসে পরলো সা’দের জন্য জায়গা খালি রেখে। কিন্তু সা’দ তপার পাশে না বসে একবারে পেছনে সেহেরের পাশে গিয়ে সেহেরের গাঁ ঘেঁষে বসলো। রিমন আবিদের ফোনে গেম খেলছিলো আর সেহের তা-ই দেখছিলো। পাশে কেউ গাঁ ঘেঁষে বসায় সেহের কিছুটা নয় বরং অনেকটা শিউরে উঠেই তার বামপাশে তাকালো। সা’দ এমন ভাব ধরে সামনে তাকিয়ে আছে যেন কিছুই জানে না। সেহের কিছু বলতে পারলো না কারণ তপা তাদের দিকেই অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। সেহের সা’দকে কী বলে সরাবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না সে। সেহেরের অস্বস্তিতে অবস্থা খারাপ৷ কে জানতো সা’দ এমন একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলবে। সেহের আগে জানলে সে জানালার পাশে বসতো, রিমনকে বসাতো না। কিছুক্ষণের মাঝেই গাড়ি স্টার্ট দিলো। সা’দ সিটের সাথে হেলান দিয়ে একমনে ফোন টিপছে আর সেহের মূর্তির মতো বক্সে আছে।

চলবে!!!

দখিনা_প্রেম
লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ১৭ ||

সেহের বারবার খোচাচ্ছে সা’দকে সরানোর জন্য। এদিকে রিমন গেম খেলতে খেলতে সেহেরের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। বাকিরা যে যার মতো আছে। সা’দ এবার বিরক্তি নিয়ে সেহেরের দিকে তাকালো এবং বললো,

—“কী সমস্যা!”

সেহের ফিসফিস করে বললো,
—“আমার থেকে সরে বসুন, আমার অস্বস্তি হচ্ছে!”

সা’দ হেসে সেহেরের সাথে আরও লেগে বসলো। এবার সেহের নিজের চোখগুলোকে দ্বিগুণ বড় করে ফেলে। সা’দ আবারও মুচকি হেসে বলে,

—“এমন ভাবে চোখ বড়ো করেছো যেন চোখ খুলে হাতে চলে আসবে!”

এবার সেহের সা’দকে ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু সা’দ এক চুল পরিমাণও সরলো না। সেহের এবার অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। সা’দ তো মুচকি মুচকি হেসেই চলেছে। সেহেরকে জ্বালাতে তার ভিষণ ভালো লাগছে।

—“প্লিজ বুঝুন!”

—“কী বুঝবো?”

—“আমার সত্যিই অস্বস্তি লাগছে!”

—“তো আমি কী করতে পারি?”

—“সরে বসুন!”

—“নো ওয়ে।” বলে সা’দ আবার ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলো। সেহের কী মনে করে রিমনকে আলগা করে মাঝে বসিয়ে দিয়ে জানালার পাশে চলে গেলো। রিমন ঘুমের ঘোরে কিছুটা নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে গেলো। সা’দ এটা দেখে অবাক হয়ে তাকালো। সেহেরের পেটে পেটে এই ছিলো ভাবতেই সা’দের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো আর কিছু না বলেই গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। সেহের তাকিয়ে দেখলো রাগে সা’দের ফর্সা চেহারা লাল হয়ে আছে। এ দেখে কেন জানি না সেহেরের বেশ হাসি পেলো। সা’দ হঠাৎ তার সাথে এমন করে চিপকালো কেন? এই বিদেশির মতলব কী? আচ্ছা কোনোভাবে কী সা’দ এই বিয়েটা মেনে নিয়েছে? মেনে না নিলে এমন অধিকার তো দেখাতো না। ভাবতেই সেহেরের মনে শীতল হাওয়া বয়ে গেলো। পরক্ষণে আবার ভাবলো সা’দ তো একবারও মেনে নিয়েছে বলে স্বীকার করেনি! যদি তার ভাবনা ভুল হয় তো? আর সেহেরের জীবনটারই যে কোনো গ্যারান্টি নেই, তার মতো মেয়েকে সা’দ কেন মেনে নিবে? সেহেরের জীবন কাহীনি শুনে করুণা দেখাচ্ছে? নাহ সেহের আর ভাবতে চায় না তাকে নিয়ে। ভেবেই সেহের চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

প্রায় ৫০ মিনিট পর সকলে নরসিংদীর একটা শপিংমলে আসলো। রুবাই আর আসিয়া তো ধুমসে শপিং করছে, এদিক দিয়ে তপা আর জোহরাও কম না। তপা ওয়েস্টার্ন ড্রেস নিতে গেলে কবির বাঁধা দিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠলো,

—“এইসব ছিঁড়া জামাকাপড় আমার টাকায় নিতে পারবি না ভিখারিনীর বাচ্চা!!”

কবিরের কথায় তপা মেজাজ দেখাতে গিয়েও পারলো না কারণ, কিছুটা সামনে সা’দ দাঁড়িয়ে এদিকে সেদিক তাকাচ্ছিলো। তপা সা’দকে দেখে কবিরের পাশ কাটিয়ে সরে এসে সা’দের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সা’দ সানগ্লাসের ভেতর দিয়ে তপাকে একবার দেখে অন্যদিকে সেহেরের দিকে তাকালো। সে আপাতত এক কোণায় রিমনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তপা নিজে থেকে বলা শুরু করলো,

—“সা’দ দেখো আমার এই ড্রেসটা পছন্দ হিয়েছে প্লিজ কিনে দাও না।”

সা’দের মন চাচ্ছে তপাকে কয়েক ঘাঁ চড় মারতে। তার উপর কিসব ড্রেস দেখাচ্ছে যা সা’দের একদম অপছন্দ। সা’দ নিজের রাগ দমিয়ে বললো,

—“তোমার বাবা অথবা মাকে বলো!”

—“আরে বাবা তো কিনেই দিচ্ছে না তাইতো তোমাকে বললাম, প্লিজ সা’দ আমায় এটা কিনে দাও!”

—“কাউকে কিছু বলার আগে ম্যানারলেসটা শিখো! আমি তোমার থেকে প্রায় অনেক বড় তাও এইটুকুন একটা মেয়ে হয়ে আমার নাম ধরে ডাকছো তো ডাকছোই আবার ‘তুমি’ সম্বোধন করছো! লাজ-লজ্জা কী নেই নাকি তোমার মা বড়দের সম্মান কীভাবে দিতে হয় সেটা শিখায়নি! লজ্জা-শরম থাকলে এখুনি তোমার এই ডিজগাস্টিং ড্রেস থেকে সরে যাও নয়তো এই সা’দ কী জিনিস হারে হারে বুঝায় দিবো, ইডিয়েট!”

সা’দের ধমক তপা এই প্রথম শুনলো। সে ভয় পেয়ে অন্যদিকে চলে গেলো আর মনে মনে সেহেরকে গালি-গালাজ করতে লাগলো। সেহেরের আশেপাশে থাকলে কিছু না আবার সে কাছে গেলেই দোষ! এদিকে তপাকে দেখে সা’দের চ্যালেঞ্জের কথা মনে পরে গেলো। সে দ্রুত পায়ে হেঁটে সেহেরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো এবং সেহেরের হাত ধরে সেহেরকে থ্রি-পিস দেখাতে লাগলো৷ জেঠু আর কবির বাইরে আছে তাই তারা সা’দের এহেম কান্ড দেখতে পারেনি। কিন্তু এখানে উপস্থিত সকলেই সা’দের কর্মকান্ড অবাক হয়ে দেখছে একমাত্র তানজীল বাদে। রুবাই তো ভাবতেই পারেনি তার ভাই এতো চালু হবে। জুবায়ের আসিয়ার সামনে এসে ফিসফিস করে বলতে লাগলো,

—“তোমার ছেলের কী হলো বলো তো? তুমি এতো করেও ওরে কোনো মেয়ের সাথে লাইন করিয়ে দিতে পারলা না আর এই ছেলে কি না সেহেরের হাত ধরেছে?”

—“বিষয়টা আমিও বুঝতে পারছি না গো। মনে হচ্ছে যেন স্বপ্ন দেখছি!” সা’দের দিকে তাকিয়ে বললো আসিয়া!

—“বাস্তবে ফিরে আসো এটা কোনো স্বপ্ন নয়৷ তোমার ছেলের পেটে পেটে কী চলছে দেখো গিয়ে আমার তো সুগার বেড়ে যাচ্ছে!”

—“আরে ধুর। হয়তো সেহেরের সম্পর্কে জানতে পেরেছে তাই হয়তো এমন করছে। চিন্তা করো না সব ঠিক আছে।”

ওদিকে তানজীল হেসে রুবাইকে বললো,

—“জান অবাক হলে?”

—“অনেকটা!” সা’দের দিকে তাকিয়েই বললো। এদিকে জোহরা আর তপা রেগে আগুন হয়ে আছে।

—“সকলে দেখছে হাত ছাড়ুন! এ কেমন অসভ্যতামি!”

সা’দ থ্রি-পিস দেখতে দেখতে বললো,
—“আমার ইচ্ছা আমি আমার বউয়ের হাত ধরেছি তাতে তোমার কী! চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো আর আমায় ড্রেস দেখতে দাও!”

সেহের নানানভাবে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু সা’দের শক্তির সাথে কিছুতেই পেরে উঠছে না। প্রতি রোজার ইদেই সেহেরের নতুন জামা কিনে দিতো কবির কিন্তু এবার কোরবানি ইদে একটা না দুইটা না একেবারে ৫টা দামী দামী থ্রি-পিস কিনে দিলো সা’দ। যদিও সা’দ গোপনে পেমেন্ট করেছে কিন্তু সকলে জানে রুবাই সেহেরকে এগুলো উপহার দিয়েছে। পাঁচটাই সা’দ নিজে পছন্দ করে দিয়েছে। নিজের পছন্দে প্রিয়জনকে উপহার দেয়াটা সত্যিই অনেক সুখ দেয়। যেমনটা সা’দ পাচ্ছে। সেহের একদমই নিতে চায়নি কিন্তু আসিয়া এবং জুবায়েরের জোরাজুরিতে সেহের এগুলা নিতে বাধ্য হলো। কিছুক্ষণ পর জেঠু এবং কবির আসলেন। তারা আসতেই সকলে বেরিয়ে গেলো। এতক্ষণ জোহরা এবং তপা সেহেরকে নিয়ে সকলের দরদ চুপচাপ দেখেছে আর লুচির মতো ফুলেছে। ভদ্রতার খাতিরে না কিছু বলতে পেরেছে আর না সহ্য করতে পেরেছে। তপার তো সেহেরকে একদম খুন করে দিতে ইচ্ছা করছিলো। যাওয়ার সময়ও সেহেরের গাঁ ঘেঁষেই সা’দ বসলো। এবার রিমন সেহেরের পাশে নেই। সে সামনে আবিদ ভাইয়ের সাথে বসেছে। এবার সেহের পরেছে বিপাকে। সেহের যতো সরে এসেছে ততোই সা’দ সেহেরের দিকে ঘেঁষে বসেছে। চাপতে চাপতে একসময় গাড়ির জানালার সাথে আটকে গেলো সেহের। পেছন সিটে সেহের এবং সা’দ ছাড়া কেউ নেই তাইতো সা’দের সাহস বেড়েছে। সেহের ফিসফিসিয়ে সা’দকে সরতে বললেই সা’দ বলে উঠে,

—“তুমি যতো তোমার থেকে সরতে বলবা আমি ততো তোমার কাছে চলে আসবো! এখনো তো দেখনি সা’দের খেল আস্তে আস্ত এসব বুঝবা!”

সেহের এবারও করুণ চোখে তাকালো সা’দের দিকে। সা’দ সেহেরের দৃষ্টি পাত্তা না দিয়ে ফোনের দিকে মনোযোগী হলো। সেহের বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে একসময় ঘুমিয়ে গেলো। সেহেরকে ঘুমোতে দেখে সা’স ফোন রেখে সেহেরের মাথাটা নিজের কাঁধে রেখে সামনে ফিরলো। গ্রামে ফিরতে ফিরতে মাগরিবের আযানও শেষ হয়ে গেলো। গ্রামে ফিরে রিকশা করে বাসাতে চলে আসলো।

—“দেখো এই সেহেরটারে আমার একদম সইয্য হইতাসে না। এই মাইয়া সবসময় ওই সা’দের লগে চিপকায় থাকে, আপনি জলদি ওরে কিছু করেন!”

—“এই মা*** চুপ করবি? এমনেই মন মেজাজ ভালা না আর তুই আসছোস আজাইরা কথা দিয়া কানের মাথা খাইতে! কয়বার কমু এইসব বালের কথা নিয়া আমার সামনে আসবি না! ওই মাইয়া জাহান্নামে যাক আমার কী! আমার এক লাখ পাইলেই হইলো! আর এই জোহইররা! আরেকবার যদি তুই বালের প্যানপ্যান করোস তইলে তোরেও ওই মাইয়ার ফকিন্নি মায়ের মতো মাইরা জবাই দিমু! আমারে চিনোস!”

বলেই হনহন করে কবির বাহিরে চলে গেলো আর জোহরা সেখানেই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো।
রাতে সা’দের ঘুম আসছিলো না বিধায় রুম থেকে বেরিয়ে ক্যারিডোরে হাঁটাহাঁটি করছিলো আর একটা ফিল্ম নিয়ে ফোন ঘাটছিলো তখনই চেঁচামেচি শুনতে পায় সে। রেলিংয়ের ধারে আসতেই কবির এবং জোহরার সব কথা সে শুনতে পেলো। বেশ রাত হওয়ায় এখন প্রায় সকলেই ঘুমে কাত। সা’দ সব শুনে তার মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন ভনভন করতে লাগলো।
কবির কোন এক লাখের কথা বললো? আর কবির এও কেন বললো সে সেহেরের মাকে মেরে ফেলেছে?

—“নাহ এদের মধ্যে এখনো অনেক রহস্য লুকানো আছে।”

এইসব রহস্য ভাবতে ভাবতে সা’দের নির্ঘুম রাত কেটে গেলো, শেষরাতে গিয়ে সা’দ ঘুমিয়ে গেলো।

চলবে!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here