দখিনা প্রেম,পর্ব ২৩,২৪

0
1522

দখিনা প্রেম,পর্ব ২৩,২৪
লাবিবা_ওয়াহিদ
পর্ব ২৩

সকাল সকাল কারীবের ডাক পরেছে। হাই দিতে দিতে সে ডাক্তার নিয়ে হাজির হলো তার স্যারের বাসায়। ভোর এখন সাড়ে ছ’টা বাজে। বেচারা কারীব গতকাল তার স্যারের সাথে সব করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে তো পড়েছিলোই কিন্তু তার ঘুম হওয়ার আগেই তার স্যারের ডাক। ডাক্তার চোখ কচলে চশমাটা ঠিক করে সা’দের রুমে প্রবেশ করলো। সা’দ তখন পায়চারি করছিলো রুমের মধ্যে। ডাক্তারকে দেখে সে বেডের পাশে এসে দাঁড়ালো। ডাক্তার সেহেরের চেকআপ করে কপালে ক্ষতটা ডেসিং করার কথা বললো। সা’দ সেহেরের পাশে বসে সুন্দরভাবে ডেসিং করে দিলো এবং বললো,

—“রাতে তীব্র জ্বর এলো কেন?”

—“আঘাতটার থেকেই জ্বরটা এসেছে। এতে চিন্তার কোনো কারণ নেই। তাকে বেশি বেশি খাওয়াতে হবে, অনেকটাই উইক উনি। আর আপনার স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে যেই ওষুধগুলো দিয়েছে সেগুলো আমাকে একটু দেখান আমি পারলে কিছু মেডিসিন বদলে দিবো।”

সা’দ কারীবকে ইশারা করতেই কারীব সেহেরের মেডিসিনের বক্সটা ডাক্তারের হাতে দিলো। ডাক্তার সব চেক করে নতুন মেডিসিন দিলো। এর মাঝে সেহেরের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। সামনে অন্য পুরুষকে দেখে সে লাফ দিয়ে উঠে বসলো। সেহের এভাবে ওঠায় সা’দ সেহেরের বাহু ধরে বলে,

—“কী হলো এভাবে উঠলে কেন?”

সেহের ঘাড় ঘুরিয়ে সা’দকে দেখে পুরো ঘরটা তাকালো। সে এক বিলাসবহুল ঘরে অবস্থান করছে। ডাক্তার সেহেরকে উঠতে দেখে মুচকি হেসে বলে,

—“এখন কেমন লাগছে?”

—“জ্বী ভালো।”

—“নিজের যত্ন নিবে এবং খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করবে কেমন? মিস্টার সা’দ, আমি তাহলে আসি!”

সা’দ কোনো কথা বললো না, শুধু মাথা নাড়ালো। ডাক্তার চলে যেতেই সেহের পুরো ঘরটা হা করে দেখছে। এমন সুন্দর রুম সেহের কোনোদিনও দেখেনি। কতো আলিশান রুমটা, চোখ ধাঁধানো। সা’দকে অস্ফুট সুরে বলে উঠলো,

—“এটা কোথায়? আমি এখানে কী করে এলাম?”

—“তোমায় কিডন্যাপ করে এনেছি বউ, আর এইটা আমাদের ঘর। আর এই বাড়িটা তোমার শ্বশুরবাড়ি!” মুচকি হেসে বললো সা’দ। সা’দের কথা শুনে সেহের বিস্ময়ের দৃষ্টিতে সা’দের দিকে তাকালো।

—“এসব কী বলছেন। দেখুন একদম মশকরা করবেন না!”

—“আহা! মশকরা কেন করতে যাবো, সত্যিই এটা আমার বাড়ি। আমি তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি!”

—“কেউ জানে না?”

—“সবাই জানে। ইভেন আমাদের বিয়ের কথা এখন সকলেই জানে, তাইতো এই বাড়িতে তোমায় নিয়ে এসেছি।” মুচকি হেসেই বললো সা’দ। তবে সা’দ এটা বললো না, কবির বা সুফিয়া সেহেরের আসল বাবা-মা নয়। যতদিন না সেহের সুস্থ হচ্ছে ততদিনে এগুলা বলাও অসম্ভব।
সা’দ এই কয়েকদিনে খোঁজ জারি রাখবে। খোঁজ লাগাবে সেহেরের মাকে কোন হসপিটালে ভর্তি করা হয় এবং সেদিন সেখানে ক’জন রোগীর বাচ্চা হয়েছিলো।

—“কেউ কিছু বলেনি?”

—“বললে কী এখানে আনতে পারতাম? সকলের মত ছিলো দেখেই এনেছি।”

হঠাৎ সেহেরের মন খারাপ হয়ে গেলো। দাদীমা, রিমন, জেঠু, চাচী, আবিদ, মানজু সকলকে ছাড়া যে কী করে থাকবে বুঝতে পারছে না। বড্ড মনে পরছে তাদের। সা’দ এর মাঝে কিছু লোককে ফোন করে কিছু একটা বলে দিলো। কল কেটে সেহেরকে বললো,

—“ঘুম না আসলে ফ্রেশ হয়ে নাও, এরপর কিছু খাও!”

—“না কিছু খাবো না। বাথরুমটা কোনদিকে?”

—“রুমেই আছে। ওইতো!” ইশারা দিয়ে দেখালো। সেহের কথা না বলে চুপচাপ ওয়াশরুমে ঢুকলো। কিছুক্ষণ পর আবার বেরিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো,

—“আমার ড্রেস তো এটা ছিলো না। ড্রেস কে চেঞ্জ করেছে?”

—“সার্ভেন্ট। কী ভেবেছো আমি চেঞ্জ করবো?”

সেহের লজ্জায় আবারও ধপ করে দরজা লাগিয়ে দিলো। আর সা’দ সেহেরের লজ্জা দেখে হুঁ হাঁ করে হাসতে শুরু করলো। কারীব সা’দের ঘরে এসে সা’দকে হাসতে দেখে বেক্কল বনে গেলো।

—“স্যার হাসছেন কেন?”

—“কিছু না, এমনি। নাস্তা রেডি করেছো?”

—“হ্যাঁ আপনার মা মানে আন্টি রান্না শুরু করেছে আগেই।”

—“মা এতো সকালে উঠেছে কেন?”

—“সে তো বলতে পারছি না স্যার।”

—“আচ্ছা তুমি নিচে গিয়ে বসো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি!”

—“জ্বী স্যার।”

বলেই কারীব চলে গেলো। বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। সেহের এখন মোটামুটি সুস্থ৷ সা’দের কয়েকদিন কাজ ছিলো না বিধায় সে সবসময় সেহেরের পাশে পাশে ছিলো। সেহেরের জন্য একসেট শাড়ি এবং ড্রেসও এনেছে, সাথে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। সেহের তো ভেবেই পায় না, সা’দ এতো কেয়ার কীভাবে করতে পারে? রাতে সা’দ সেহেরের পাশেই ঘুমায় তবে দুরত্ব বজায় রেখে। এ দেখে সেহের যেন আরও মুগ্ধ হয়। দিনদিন বেশ ভালোই দুর্বল হয়েছে সে সা’দের প্রতি। অবশেষে সা’দ সিদ্ধান্ত নিলো তাদের বিয়েটা আবার নতুন করে হবে। হলুদ, বিয়ে ঘরোয়াভাবে হলেও রিসিপশন বেশ বড় করে হবে। সা’দের প্রস্তাবে সকলেই রাজি হয়। সেহেরও রাজি হলো। তবে এখানে কথা আছে। বিয়ের আগে থেকে সেহের এবং সা’দ আলাদা আলাদা ঘুমাবে। এতে সা’দ রাজি হয়েছে কারণ বিয়ে ছাড়া সে সেহেরের কাছে যেতে পারবে না। পারিবারিকভাবে বিয়ে করেই সে সেহেরকে আপন করে নিতে চায়। সেহের এবং রুবাই একসাথে ঘুমায়। দাদীমা, আবিদ, রিমন, মানজু, চাচী সকলের সাথে প্রতিদিন কথা হলেও জেঠু সেহেরের সাথে কথা বলেন না। এতে সেহের বেশ ব্যথিত।

অবশেষে হলুদের দিন এলো। সেহের হলুদ শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে সে। সেহের কখনো শাড়ি পরেনি, তার উপর আজ তার গায়ে হলুদ, ভাবতেই কেমন শিউরে শিউরে উঠছে। সা’দকে সেও যে চায়, ভিষণভাবে। সা’দ তাকে যতোটা ভালোবাসা দিয়েছে, কেউ কোনোদিন তাকে এতো ভালোবাসা দেয়নি, বুঝেওনি। সেহেরের বিয়ে মানা নিয়ে সময় প্রয়োজন ছিলো কিন্তু সা’দ সেটা মুখ থেকে না শুনেই যথেষ্ট সময় দিয়েছে সেহেরকে। সেহের এখন আগের মতো চুপচাপ নয়, খুবই প্রাণ্যোচ্ছ্বল সে। সে যেন নতুনভাবে, নতুনরূপে বাঁচতে শিখেছে। সেহের ভাবনায় মগ্ন ছিলো এই ফাঁকে সা’দ রুমে প্রবেশ করলো। আয়নায় সা’দকে আসতে দেখে সেহের আৎকে পিছে ফিরে তাকালো। সা’দ মুগ্ধ হয়ে সেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন হলুদ পরী দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। এতো সুন্দর কেন মেয়েটা? সেহের আমতা আমতা করে বলে,

—“কী হচ্ছে কী আপনি এখানে কেকেকেন!?”

—“বউকে হলুদ মাখাতে এসেছি।” বলেই সেহেরকে ইচ্ছামতো হলুদ লাগিয়ে দিলো। সেহের চোখ ছানাবড়া করে বলে,

—“হলুদের অনুষ্ঠান তো এখনো শুরুই হয়নি আর আপনি আমাকে হলুদ লাগিয়ে নাজেহাল অবস্থা করেছেন! আপনিও না!” বলেই সেহের টিস্যু দিয়ে হলুদ মুছতে শুরু করলো৷ মুছতে মুছতে আবার বললো,

—“কী হলো চুপ কেন? এখন সবাইকে কী বলবো এই হলুদের ব্যাপারে?”

সা’দ ঘোর লাগা দৃষ্টিতে সেহেরের দিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে গিয়ে সেহেরকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। সেহের ভয়ে রীতিমতো কাঁপা কাঁপি শুরু করে দিয়েছে। সা’দ তার হাতদুটো সেহেরের কোমড়ে রাখতেই সেহের সাথে সাথে চোখমুখ খিঁচে জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করলো। সা’দ সেহেরের কোমড়ে হলুদ লাগাতে লাগাতে ঘোর লাগা কন্ঠে বলে উঠে,

—“বলবা তোমার জামাই তোমাকে প্রথম হলুদ ছুঁইয়েছে। আর তুমি সামান্যতে এই অবস্থা করছো কেন বলো তো? সামনের ডোজ তো আরও বেশি হবে! একবার বিয়েটা হতে দাও, এরপর বুঝবা এই সা’দ বিন সাবরান কী জিনিস!”

বলেই সেহেরের সামনে থেকে সরে আসলো। সেহের সেখানে দাঁড়িয়ে লজ্জায় মাথা নত করে আছে। সা’দ হেসে আবার সেহেরের সামনে গিয়ে সেহেরের থুঁতনি উঁচু করে বললো,

—“একবার বলেছি না মাথা নত করবা না! সা’দ বিন সাবরানের বউয়ের মাথা নত থাকাটা বেমানান। তুমি আমার বউ, সবসময় মাথা সোজা রাখবা ওকে?”

বলেই সেহেরের মাথায় টুপ করে কিস করে বেরিয়ে গেলো। আর সেহের সেখানে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর রুবাই আসলো। সেহেরকে হলুদ মাখা দেখে হেসে বললো,

—“নিশ্চয়ই আমার ভাইয়ের কাজ তাই না?”

সেহের লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো। রুবাই আবারও হেসে সেহেরকে সাথে নিয়ে নিচে চলে গেলো। গ্রাম থেকে কেউই আসেনি, বলা যায় আসতে পারবে না। সেখানকার অবস্থা নাকি ভালো না। কবিরও নাকি কোথাও গাঁ ঢাকা দিয়ে বসে আছে, পুলিশ এখনো তাকে খুঁজছে। নিচে হলুদ নিয়ে কথা উঠলে রুবাই কিছু একটা বলে কাটিয়ে দেয়। সা’দ হলুদে ইনভাইট করেছেন একমাত্র ফারুক হোসাইনকে। ফারুক হোসাইনকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে সা’দ তাই সে একদিন কথা দিয়েছিলো তার বিয়ের সকল অনুষ্ঠানে সর্বপ্রথম তাকে ইনভাইট করবেন। সেই কথা অনুযায়ী সা’দ তা-ই করলো।

চলবে!!!

দখিনা_প্রেম
লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ২৪ ||

ফারুক হোসাইন সেহেরকে প্রথম দেখাতেই বেশ ভালো চিনতে পারলো ইভেন সেহেরও তাকে চিনেছে।দুজনের কী ভাব। তাদের ভাব দেখে সা’দ অল্প হলেও ভিষণ অবাক হয়েছিলো কারণ, সে এটাই ভেবে পায়নি তারা দুজন-দুজনকে কীভাবে চিনলো? পরে ফারুককে জিজ্ঞেস করলে সে নিজেই মুচকি হেসে বলে,

—“তোমাকে একটা মিষ্টি মেয়ের কথা বলেছিলাম মনে আছে? সেই মিষ্টি মেয়েটিই তোমার হবু বউ। একদম পারফেক্ট চয়েস করেছো তুমি সা’দ। আই প্রাউড অফ ইউ!”

সেদিন সা’দ নিজেও বেশ খুশি হয়েছিলো। তবে সা’দদের বাড়িতে এসে মিসেস ফারুক হোসাইন যবে থেকে সেহেরকে দেখেছে তবে থেকে সে সেহেরের পাশে বসে অপলক দৃষ্টিতে তাকে দেখেই চলেছে। মিসেস ফারুক মানসিকভাবে অসুস্থ প্রায় অনেক বছর ধরেই। এভাবে তার দৃষ্টিতে সেহের বারংবার ইতস্তত হয়ে পরেছে। মিসেস হোসাইনকে এরূপ বিষয়ে প্রশ্ন করলেও সে কোনো উত্তর দেয় না। একদম চুপ করে সেহেরের পাশে বসে থাকে। অনেকে এও বলাবলি করছে সেহের ফারুক হোসাইনের মেয়ে, তাদের চেহারার মিল আছে। এসব ফিসফিস ফারুক হোসাইন বা সেহেরের কানে না গেলেও সা’দ ঠিকই শুনতে পেলো। তাই সা’দ নিজেই পর্যবেক্ষণ করেছে দুজনের চেহারার দিকে তাকিয়ে। আসলেই অনেক মিল। কিন্তু ফারুক হোসাইন তো তাকে বলেছে তার একটাই মেয়ে। আর সেই মেয়েটি তো এখন লন্ডনে পড়াশোনা করতে গেছে। এক মিনিট, ফারুক হোসাইন বলেছিলো তার আরেকটা মেয়ে ছিলো যে কি-না জম্মের পরপরই মারা গেছে। বিষয়টা চরম খটকা লাগলো সা’দের কাছে। তাই সে কিছু একটা ভেবে হলুদের অনুষ্ঠানের পরপরই ফারুক হোসাইনের ঘরে চলে গেলেন। সেখানে চিরুনি না পেয়ে ওয়াশরুম থেকে তার ব্রাশ এবং সেহেরের চিরুনি নিয়ে কারীবের মাধ্যমে কোথাও পাঠিয়ে দিলো। পরেরদিন বিয়ে সুস্থভাবেই সম্পন্ন হলো। এরকম এক বিশেষদিনে সেহের তার পরিবারের সকলকেই বড্ড মিস করছে কিন্তু কেউ তার পাশে নেই। সেহেরকে মন খারাপ করতে দেখে মিসেস হোসাইন সেহেরকে আচমকা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো আর বলতে লাগলো,

—“চিন্তা করিস না মা, তোর মা তোর পাশেই আছে। বিয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে তোকে কেউই আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না!”

মিসেস ফারুকের কথার আগা-মাথা কিছুই সেহের বুঝতে পারলো না। তবে সেহের তার থেকে অনেক প্রশান্তি পাচ্ছে যেমনটা তার মা তাকে জড়িয়ে ধরলে পেতো। সেহের কিছু না ভেবে নিজেও মিসেস ফারুকের সাথে লেগে রইলো। সা’দ ফারুকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে বলে উঠে,

—“আচ্ছা আঙ্কেল একটা কথা ছিলো!”

—“কী কথা বলো!”

—“আপনার ছোট মেয়ে কীভাবে মারা গেছে?”

ফারুকের চেহারা পাল্টে গেলো। চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

—“হঠাৎ-ই সে মারা যায়। তবে সে জম্মের পরপর সুস্থই ছিলো। জানি না কীভাবে কী হলো। আমার স্ত্রী তার শোকে মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছে, তার একই কথা তার মেয়ে জীবিত। অথচ আমরা দেখেছি মৃত! নিজ হাতে দাফন করেছি আমার সেই ছোট নিষ্পাপ মেয়েকে।”

বলেই সে হালকা চোখ মুছলো। সা’দ তখন আবারও বললো,

—“আপনার মেয়ের জম্মতারিখ?”

—“১৯শে ফেব্রুয়ারী!”

—“এ. এস হলি হসপিটালে?”

ফারুক বোকা বনে গেলো সা’দের কথায়। সা’দই বা কী করে জানলো হসপিটালের নাম? ফারুক হোসাইন তো কখনো তা জানায়নি তাকে।

—“তুমি কী করে জানলে?”

সা’দ মুচকি হেসে বলে,
—“ডিএনএ রিপোর্ট আসুক তারপর বোঝা যাবে, তবে তার আগে আরও কিছু খোঁজ নেয়া লাগবে।”

বলেই সা’দ পকেট থেকে ফোন বের করে ফোনে কিছু করতে করতে সেখান থেকে অন্যদিকে চলে গেলো। ফারুক সা’দের কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছে না।
ওদিকে রুবাই সেহেরকে খুঁচিয়ে বলে,

—“কী সেহের সা’দ কই? বিয়ে করে হারিয়ে গেলো নাকি?”

বলেই হেসে উঠলো। এদিকে সেহের কিছুটা লজ্জা পেলেও কেন যেন সা’দের জন্য চিন্তা হলো। রুবাই সেহেরকে সা’দকে নিয়ে নানানভাবে খোচাঁচ্ছে আর সেহের লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। তখনই রুবাইয়ের ফোনে সা’দের কল আসলো।

—“হ্যাঁ ভাই বল!”

—“সেহেরকে দে।”

—“এই দেখো তোমার বর কলও করেছে, নেও কথা বলো আসছি।” বলেই মুচকি হেসে কিছুটা সরে গেল রুবাই। সেহের ফোনটা হাতে নিয়ে ‘হ্যালো’ বলতেই সা’দ বলে উঠলো,

—“কী বউ আমায় মিস করছো? সমস্যা নেই আমি তো এখন পার্মানেন্টলি তোমার হয়ে গেছি। এখন শুধু রাতটা আসার অপেক্ষা।”

—“এই, আপনার এইসব লাগামহীন কথাবার্তা ছাড়া আর কিছু কী মুখে আসে না?”

—“উহু! আসে না গো!”

—“রাখেন ফোন।”

বলেই সেহের কল কেটে দিলো আর সা’দ ফোনের দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করলো। সেহেরকে জ্বালাতে তার বড্ড ভালো লাগে। আজ সা’দ খুশি অনেক বেশি খুশি। আজ থেকে সে তার প্রিয়তমাকেও খুশিতে দেখবে। এখন শুধু ডিএনএ রিপোর্ট আসার অপেক্ষা। কারীব কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়েছে, সা’দ আপাতত তারই অপেক্ষায় আছে। প্রায় ৪০ মিনিট পর কারীব ফিরলো। সা’দ রিপোর্ট হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। অতঃপর রিপোর্ট খুলে দেখতে লাগে। রিপোর্ট দেখে সা’দের ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো। হ্যাঁ সে যা ভেবেছে তা-ই হয়েছে। সা’দ রিপোর্ট নিয়ে ড্রইংরুমে চলে যায়। সেখানে সকলে সন্ধ্যার নাস্তা করতে ব্যস্ত। সা’দ সকলের এটেনশন চাইতেই সকে সা’দের দিকে মনোযোগ হলো। এখানে সা’দের পরিবার এবং মি. এবং মিসেস ফারুকও উপস্থিত। সেহেরও তাদের মাঝে ছিলো। সেহেরের পাশে মিসেস ফারুকও আছে। সে তো সেহেরের পাশে থেকে সরতে নারাজ। তার এমন আচরণে সকলেই কমবেশী অবাক হলেও মিসেস ফারুকের জেদের কারণে কিছু বলতে পারেনি। সা’দ তখনই তার বাবা জুবায়েরকে বললো,

—“বাবা কবির চাচার মেয়ে তো সেহের না তাই না?” সা’দের এমন কথায় সেহেরের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরলো। কিসব যা-তা বলছে সা’দ? কবির কেন তার বাবা হবে না? সা’দ যেন সেহেরের মনের কথা বুঝতে পারলো। তাই সে সেহেরকে আশ্বাস দিয়ে বলে,

—“কী কী বলছি পুরোটা শুনো তারপর ভেবো!”

সা’দের মাঝেই জুবায়ের একনার সেহেরের দিকে তাকিয়ে নিচুস্বরে বলে,

—“হ্যাঁ তো?”

—“তো বোঝাচ্ছি। ফারুক আঙ্কেল আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো!” সা’দের কথায় ফারুক হোসাইন নড়েচড়ে বসে। অতঃপর ঠান্ডা স্বরে বলে উঠে,

—“হ্যাঁ সা’দ বলো, আমি শুনছি!”

—“আপনার মেয়ে ১৯শে ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করে মারা যায়নি। এইযে আপনার স্ত্রীর সাথে যিনি বসে আছেন তিনি হলেন আপনার ছোট মেয়ে সেহের। আর যাকে আপনি নিজের মেয়ে বলে দাফন করেছেন তিনি আমারই চাচার মেয়ে।”

সকলে অবাক হয়ে গেলো সা’দের কথায়। হিসাবটা তারা ঠিক বুঝতে পারছে না। সা’দ আবার বলা শুরু করলো,

—“এ. এস হলি হসপিটালে সেদিন একই দিনে, একই সময়ে সুফিয়া মা এবং আন্টির ডেলিভারি হয়, দুজনেরই মেয়ে হয়ম তাদের চেকাপের জন্য চাইল্ড ক্লিনিকে নেয়া হয়। সেখানে একই বেডে দুজন শুয়েছিলো, এক সেহের এবং অন্যজন কবির চাচার মেয়ে। কবির চাচার ঠিকই তার মেয়েকেই মেরেছে। কিন্তু একজন নার্স ভুলবশত সেহেরকে নিয়ে সুফিয়া মায়ের কোলে দিয়েছে আর মৃত বাচ্চাকে ফারুক আঙ্কেলের কোলে দেয়। কী আঙ্কেল ঠিক বললাম তো?”
ফারুক হোসাইন নির্বাক হয়ে মাথা নাড়ালো।

—“সেই নার্সের গড়মিলের কারণে দুজন বাচ্চা আলাদা আলাদা মায়ের কোলে গেছিলো। একজন মৃত হয়ে আরেকজন জীবন্ত হয়ে। এটা আমার কথা না, আমি সেই হসপিটালে সব খবর নিয়েছি ইভেন ফারুক হোসাইন এবং সেহেরের ডিএনএ টেস্টও করিয়েছি। আপনারা চাইলে রিপোর্ট দেখতে পারেন, আমার হাতেই আছে রিপোর্ট।” বলেই সা’দ তার হাতে থাকা রিপোর্টটা ফারুক হোসাইনের হাতে দিলো। তিনি চোখে চশমা লাগিয়ে ভালোভাবে রিপোর্টটা পড়লেন।
যতোই পড়ছেন চোখের পানিতে তার চশমা ততোটাই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। এদিকে সেহেরের চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি পরছে। যাকে এতদিন মা বলে এসেছে সে তার মা নয়, তার পাশে বসা মা-টাই তার আসল মা? সেহের এতক্ষণে বুঝলো মিসেস ফারুকের তখনকার কথাগুলোর মানে।
ফারুক হোসাইন রিপোর্টটা সোফায় রেখে সেহেরের পাশে বসে সেহেরকে বুকে জড়িয়ে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো। সেহেরও নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না, সেও ফারুককে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। ফারুক হোসাইন প্রায় ১৯ বছর নিজের মনের মাঝে তার ছোট্ট মেয়েটাকে মৃত বলে লালন করে গেছে আর আজ তার ছোট্ট মেয়েটা তার বুকে। এর চেয়ে বড়ো সুখ আর কী হতে পারে? আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালা চাইলে কি-ই না করতে পারেন। তার দ্বারা সব সম্ভব। তাইতো সেহের নিজেকে এতিম ভাবলেও আজ পুরো পরিবার ফিরে পেলো। তার দুঃখের দিন শেষ। সকলের এতক্ষণ এই চরম সত্যিটা মানতে কষ্ট হলেও বাবা-মেয়েকে একসাথে কাঁদতে দেখে তাদের চোখের কোণেও জল জমলো। সা’দ চোখে পানি নিয়েই মুচকি হেসে এদিক সেদিক তাকিয়ে চোখের পানি ঢাকার চেষ্টা করতে থাকলো। কারীব চোখের কোণ মুছে সা’দের পিছে দাঁড়িয়ে সা’দের কাঁধে হাত রেখে বললো,

—“স্যার আপনি পেরেছেন। সত্যি-ই আপনার বুদ্ধির তারিফ করতে বাধ্য হচ্ছি। আপনার যাচাই-বিবেচনার কারণেই আজ এমন সুখের সময় নিজ চোখে দেখতে পারছি। আপনার পা ধরে আমার সালাম করতে মন চাইছে।” কারীবের কথা সা’দ নিশব্দে হাসলো। অতঃপর সে পিছে ফিরে কারীবকে হালকা জড়য়ে ধরলো। হ্যাঁ আজ সা’দ সফল হয়েছে। তার চেয়ে বড়ো সুখী আর কে আছে?

—“বোকা ছেলে। এতো বড়ো হয়েছো তাও বুঝো না, তোমার স্থান আমার পায়ে নয় বুকে! এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার এন্ড লাভলী!”

ফারুক তার সেহেরকে বুকে নিয়ে মিসেস মালীনির দিকে তাকালো। সে এখনো একইভাবে সেহেরের দিকেই তাকিয়ে। এখানের কেউ তার মেয়েকে না চিনলেও এই মালীনি হোসাইন ঠিকই সেহেরকে চিনেছে। সন্তানের প্রতি মায়ের টান হয়তো এটাকেই বলে। শেষমেষ ফারুক হোসাইন স্বীকার করতে বাধ্য হলো,

—“মালীনি! আমার স্বীকার করতে বাধা নেই তুমি ঠিকই আমাদের মেয়েকে চিনেছো। কিন্তু দেখো আমি কেমন বাবা যে কি না আমার এই ছোট্ট মেয়েটাকে চিনতে পারলাম না। সত্যিই তুমি প্রসংশার যোগ্য।”

ফারুক হোসাইনের কথায় মালীনি হাসলো।
—“হয়েছে। এখন মেয়েকে আমার কাছে দিন তো!আমার বুকটা যে হাহাকার করছে। আমার মা তুই একদম কাঁদবি না, আমি আর তোর বাবা আছি তো।” সে খুবই স্বাভাবিক আচরণ করলো যা দেখে ফারুক হোসাইন বিস্মিত হলেন। ফারুক দেশ-বিদেশের কতো ডাক্তার দেখালেন তার স্ত্রীকে তবুও তার অবস্থার তেমন একটা উন্নতি হয়নি। সে যতোবারই ডাক্তার দেখাতে গেছে মালীনি মিনতির সুরে বারবার বলতো,

—“আমার মেয়েকে এনে দাও, দেখবা আমি একদম ঠিক হয়ে যাবো!”

হ্যাঁ, মালীনি বরাবরই ঠিক ছিলো এবং ফারুক হোসাইন ভুল। সত্যি সত্যিই মালীনি আবার স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সেহেরকে দুজনই আগলে রাখলেন, একসময় ফারুক হোসাইন আবেগী সুরে বলে উঠলেন,

—“মা! মারে, একবার বাবা বলে ডাকবি? তোর মুখে বাবা ডাক না শুনে যে দম বন্ধ হয়েচ আসছে।”

সেহের অস্ফুট সুরে “বাবা” এবং “মা” বলে উঠলো। এবার ফারুক হোসাইনের সাথে মালীনিও কান্নায় যোগ দেয়। তাদের একান্ত কাটানো সময়গুলো ঘন্টাখানেক চললোই। কেউ-ই তাদের পরিবারে বিরক্ত করেনি। সা’দ দূরে পিলারের সাথে হেলান দিয়ে তার মায়াবীনির হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দেখছে। দেখার তৃষ্ণা যেন মিটবার নয়।

চলবে!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here